সিন্ধুসভ্যতা বর্তমানে হরপ্পা-সভ্যতা নামে পরিচিতিলাভ করেছে।
হরপ্পা বর্তমানে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে অবস্থিত একটি বৃহৎ জনপদ। আধুনিক শহরটি প্রাচীন শহরের একটি অংশ এবং এর পাশেই অবস্থিত। হরপ্পার ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি কেবল সিন্ধুসভ্যতার আদিযুগেরই প্রমাণ দেয়নি, পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সংস্কৃতিরও প্রমাণ দেয়। রাভি নদীর পুরাতন পথটি হরপ্পার উত্তরে চলে গেছে, সেখান থেকে আরও ছয় মাইল উত্তরে সরে গেছে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধিকর্তা আলেকজান্ডার কানিংহাম এখানে উনিশ শতকে দু’বার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালিয়েছিলেন।
অনেকের ধারণা আছে, হরপ্পার প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে, যেখানে চ্যমন কর্তৃক বৃশ্চিকবংশের পরাজয় ঘটে। নামটি হরি-যুপুয়া নামে সেখানে লিপিবদ্ধ। পূর্ববর্তী বাসিন্দারা সম্ভবত অনার্য ছিলেন, তাঁরা পরাজিত হয়েছিলেন। তাঁদের মতে এ কথা বলা যেতেই পারে যে এই স্থানটি সেই বিখ্যাত স্থানগুলির মধ্যে একটি যেখানে তথাকথিত আর্যরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে পরাজিত করে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে, তত্ত্বের সমর্থনে আরও প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত, এটি বেশিরভাগই অনুমান বলে চালানো উচিত। কেননা আর্যরা ভারতে এসেছিল সিন্ধুসভ্যতার পতনের এক হাজার বছর পরে।
“হরপ্পা” নামের ব্যুৎপত্তিও বিশ বাঁও জলে। সিন্ধিভাষায় হরপ্পা মানে মাটির নীচে তলিয়ে যাওয়া নগর। এটি সিন্ধুসভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হলেও নামটির ব্যুৎপত্তি নিশ্চিতভাবে নির্ধারিত হয়নি। এর উৎস নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব আছে।
১.স্থানীয় ভাষার উৎস : কিছু গবেষক মনে করেন, “হরপ্পা” নামটি ওই অঞ্চলের স্থানীয় ভাষা বা উপভাষা থেকে উদ্ভূত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন স্থানের নামের শেষে “-আপ্পা” উপসর্গটি মাঝেমধ্যে দেখা যায়।
২.সংস্কৃত সংযোগ : আরেকটি তত্ত্ব অনুযায়ী, এই নামটি সংস্কৃত শব্দ “হর”-এর সাথে সম্পর্কিত, যা হিন্দু দেবতা শিবের একটি রূপ। এটি সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় তাৎপর্যের ইঙ্গিত দেয়।
উনিশ শতকে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের বহু আগেই এই শহরটির অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। কিছু প্রাচীন পাঠ্যে এর উল্লেখ থাকতে পারে, যদিও প্রত্যক্ষ প্রমাণ বিরল।
কয়েকটি ব্যুৎপত্তিগত তত্ত্ব অনুসারে, এই নামটি স্থানীয় ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য বা উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, তবে এর নির্দিষ্ট প্রমাণ সীমিত।
সার্বিকভাবে বলা যায়, “হরপ্পা” নামটির নির্দিষ্ট উৎস অনিশ্চিত হলেও, এটি সম্ভবত স্থানীয় ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। এই স্থানটি এখন সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার উন্নত নগর-পরিকল্পনা ও সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে।তা খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৫০০ সালের দিকে পূর্ণবিকশিত হয়েছিল।
সিন্ধুলিপি যে প্রোটোদ্রাবিড়ীয়, তা নিয়ে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। ইরাবথম মহাদেবন, আস্কো পারপোলা, রোমিলা থাপার, ডি ডি কোসাম্বী তাঁদের বিভিন্ন লেখায় এই তত্ত্বের বিশ্লেষণ করেছেন ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে।
আমার মতে তাঁদের ধারণা সঠিক। হরপ্পার ব্যুৎপত্তি নিয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে এমন কতকগুলি শব্দ পেয়েছি কন্নড় ভাষায়, যা রীতিমতো ভাবিয়ে তোলার মতো।
কন্নড় ভাষায় হুরুপু মানে উৎসাহ, উদ্দীপনা। হরপ্পা তথা সিন্ধুসভ্যতার আমলে মানুষের প্রধান ভূমিকা ছিল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে কৃষিকাজ ও পশুপালন করা। একই উদ্দীপনার সঙ্গে তারা গড়ে তুলেছিল শস্যভাণ্ডার, শুরু করেছিল বহির্জগতের সঙ্গে বাণিজ্য।
কন্নড় হরিবি মানে বড়ো মৃৎপাত্র বা অলিঞ্জর, বড়ো হাঁড়ি। সিন্ধুসভ্যতার প্রাণভোমরা ছিল মৃৎপাত্র। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে উঠে এসেছে হাজার হাজার বিভিন্ন মাপের মৃৎপাত্র।
আবার কন্নড়ে হুরি মানে ডাল বা শস্য ভাজা। দানাশস্যের প্রভূত উৎপাদন হত হরপ্পায়। মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য ছিল গম, যব, ধান ইত্যাদি।
এর মধ্যে প্রোটোদ্রাবিড়ীয় হুরুপু শব্দটি থেকে হরপ্পা আসতেই পারে। হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে একটি শব্দের এটুকু পরিবর্তন তো অবধারিত। এই শব্দটি মনে হয় কোনও বিশেষজ্ঞের গোচরে আসেনি। ইরাবথম মহাদেবনের মত দক্ষিণী গবেষকও এই শব্দটির কথা কোথাও বলেননি।
আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি আনন্দপুর, আনন্দনগর, খুশিগঞ্জ, আমোদপুর, খোসবাসপুর ইত্যাদি জায়গা। মনের আনন্দ, খুশি-খুশিভাব এই সমস্ত নামের মধ্যে লুকিয়ে আছে।
কন্নড়ভাষায় হুরুপু মানে উৎসাহ-উদ্দীপনা। এটি ছিল প্রাচীন সিন্ধুউপত্যকার প্রোটোদ্রাবিড়ীয় অধিবাসীদের মনের বিশেষ একটি ভাব। সেই থেকেই যে কালক্রমে হরপ্পা নামটির সৃষ্টি হয়নি তা কে বলতে পারে!