আজকাল ট্রাফিকের ভিড়ে দুচাকার ছিপছিপে বাইসাইকেল কলকাতার রাজপথে ব্রাত্য। মোটর বাইকের দাপটে গলিঘুঁজিতেও এর দৌরাত্ম কমে গেছে। গ্রামে গঞ্জে যদিও সাইকেলের জনপ্রিয়তা এখনো বেশ। অথচ বিশ্বউষ্ণায়নে পরিবেশ বান্ধব ভূমিকায় সাইকেল কতটা প্রয়োজনীয় তা আমরা সকলেই জানি। অমর্ত্য সেন ক্লাস নিতে যেতেন সাইকেল চেপে। কোন এক সময় সাইকেল নিয়ে বিশ্ববাসীর মতো বাঙালির রোমান্টিকতাও কিন্তু কিছু কম ছিল না। ইতিহাস ঘাটলেই তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। মেয়েদের বাইসাইকেল চড়ার ইতিহাসটাও কিন্তু কম ইন্টারেস্টিং নয়। স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, মেদিনীপুরে থাকার সময় মহাশ্বেতা দেবীও সাইকেল চড়ার আনন্দ উপভোগ করেছিলেন।
সম্ভবত ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা এক নতুন গাড়ি — বাইসাইকেলের সন্ধান দেয়। এই নতুন গাড়ি তখন তামাম বিশ্বে বেশ উন্মাদনা ফেলে দিয়েছিল। তবে এই সংবাদের পর তার আর কোন উচ্চবাচ্য দেখা যায়নি। ১৮৮৬ সালে বাইসাইকেল চেপে কলকাতায় আসেন টমাস স্টিভেন্স। সেদিন তাকে দেখতে ময়দানে ভিড় করেছিলো ছেলে ছোকরার দল। কলকাতাবাসি প্রেমে পড়ে যায় এই দুই চাকার।
১৮৯৭ সালে কলকাতাতে তৈরি হয় সাইক্লিস্ট এসোসিয়েশন। “শিক্ষিত নরনারী সখের স্টিমার, গাড়ী, ঘোড়া ত্যাগ করিয়া এখন বাইসিকলের আদর করিতেছেন” — পুণ্য ১৮৯৮।
বাঙালি উদ্যোগপতি হেমেন্দ্র মোহন বসুর উদ্যোগে ১৯০৩ সালে তৈরি হয় ‘এইচ বোস আন্ড কোং সাইকেলস্’ ।তার কাছ থেকে সাইকেল শিখে গড়ের মাঠে সাইকেল চালাতেন জগদীশচন্দ্র বসু, তার স্ত্রী লেডি অবলা বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার, নির্মলা দেবী প্রমুখ। জগদীশচন্দ্র বসু বাইসাইকেলকে বলতেন তাদের পুষ্পক রথ।
দেখতে দেখতে আভিজ্যতের সীমানা ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের নাগালে পৌঁছে যায় এই বাইসাইকেল। ক্রমে ক্রমে ময়দানে প্রতিদিন সকাল এবং সন্ধ্যাবেলায় দলে দলে নারী-পুরুষ বাইসাইকেল চালিয়ে বেড়াতো। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সাইকেল চড়ে চৌরঙ্গী অঞ্চলে হাওয়া খেতে যেতেন। কলকাতা এবং বোম্বের মতো শহরগুলিতে প্রচুর সংখ্যক যুবক, যুবতী বিশেষ করে পার্সি এবং উচ্চবর্ণের বাঙালিরা সাইক্লিংকে কেবল একটি খেলা হিসেবেই নয়, বরং পরিবহনের একটি মাধ্যম হিসেবেও উৎসাহের সাথে গ্রহণ করতে শুরু করে।
যদিও সে সময় মহিলারা পুরুষের তুলনায় অনেকটাই কম বাইসাইকেল ব্যবহার করতেন। রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব শুধু আমাদের দেশে নয়, পশ্চিমের দেশগুলোতেও মহিলাদের বাইসাইকেল চালানোর ওপর প্রশ্ন তুলেছিল। মেয়েদের সাইকেল চালানো নিয়ে চিন্তিত ছিলেন চিকিৎসকরাও।
সাইকেল চালানোর সময় অপ্রাকৃতিকভাবে চলাফেরা করার জন্য, সাইক্লিং করা মহিলাদের যৌন অশ্লীলতায় লিপ্ত বলে মনে করা হত। ডক্টর জেমস প্রেন্ডারগাস্ট বলেছিলেন মেয়েরা সাইকেল চালালে ‘হস্তমৈথুনপ্রবণ’ হয়ে পড়বে মহিলারা। এর জন্য তারা দায়ী করেন সাইকেলের বসার সিট’টিকে। সাইক্লিং করলে নারীদের মধ্যে যৌন অনুভূতি জাগ্রত হবে।
মিশরীয় নারীবাদী নাওয়াল এল সাদাভির লেখা “Women in the Arab World” বইটিতে বলা হয়েছে যে আরব সংস্কৃতি নারীর কুমারীত্বের উপর অযৌক্তিক গুরুত্ব দিত। উদাহরণস্বরূপ, সাইক্লিং বা ঘোড়সওয়ারের মতো খেলাধুলার ফলে মেয়েদের যোনিচক্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সাইক্লিং করলে মেয়েরা যৌনতা হীনতায় ভুগবে। সেই সময় মেয়েরা সাইকেল চড়লে তাদের মুখের অভিব্যক্তিকে সন্দেহের চোখে দেখতো।
সেই সময় পুরুষ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মেরি বিসল্যান্ড, মেরি সার্জেন্ট হপকিন্স এবং এমা মফেট টাইং-এর মতো মহিলারা চিকিৎসা সংক্রান্ত সাধারণ বিষয়গুলির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তাঁরা প্রচার করেছিলেন যে, সাইক্লিং দীর্ঘ-নিষ্ক্রিয় পেশীগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং আরোহীদের মানসিকভাবে আরও ভালো বোধ করতে সাহায্য করে এবং নিজস্ব ক্ষমতার প্রতি আরও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে অনেক কিছুই। বঙ্গে সাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে মহিলাদের সুরক্ষার একটা বড় প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে তারা যা পোশাক পড়ে সাইকেল চালাত, সেই পোশাক গতিশীল চাকায় আটকে গেলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ছিল প্রবল।
১৯০২ সালের ২৭শে ডিসেম্বর ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিল ‘দ্য কলোনিয়াল জুভেনাইল সাইকেল’। সেখানে তারা ঘোষণা করে, পুরুষ আরোহীর পাশাপাশি মহিলাদের জন্য তারা বাইসাইকেল তৈরি করেছেন।
সাইকেলগুলি আয়তনে ছিল পুরুষের বাই সাইকেলের আয়তনের তুলনায় ছোট। বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে মেয়েদের সাইকেলে পিছনে চাকার উপর অংশ সুক্ষ রেশমি দ্বারা আবৃত করা হতো।
উচ্চবিত্তের পাশাপাশি সাধারণ মধ্যবিত্ত মেয়েদের চেতনায় বাইসাইকেলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম। ছাত্রীসংঘের পক্ষ থেকে ১৯৩০ এর শুরুর দিকে আয়োজন করা হল মেয়েদের একটি বাইসাইকেল প্রতিযোগিতা কলকাতা থেকে বর্ধমান পর্যন্ত। প্রায় ১০০ কিমিরও বেশি খোলা রাস্তার সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন অনেক বাঙালি মহিলা। আর সাইকেল চালিয়ে প্রতিযোগিতার মধ্যে যিনি প্রথম হলেন, সেই বঙ্গতনায় নাম হলো আভা দে।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আভা দে কোনো পুরুষের থেকে কম ছিলেন না। তিনি তাঁর সাহস ও শারীরিক শক্তির জোরে জীবনকে তুচ্ছ করে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সাঁতার কাটা থেকে শুরু করে দৌড়ানো, গাছে ওঠা, সাইকেল চালানো সবেতেই ছিলেন পারদর্শী। আভা দে ‘ছাত্রীসংঘ’তে যোগদান করেছিলেন তাঁর বন্ধু কল্যাণী দাসের সঙ্গে। স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তিনি অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন, দু-চার পয়সার তেলেভাজা খেয়ে সারাদিন কাটিয়েছেন। ইংরেজ পুলিশের ঘোড়ার লাগাম টেনে প্রতিরোধ জানিয়ে ছিলেন এই বীরাঙ্গনা। ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’র সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকা আভাকে বেআইনি শোভাযাত্রা ও সভায় যোগদান করার অপরাধে প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি করেছিল ব্রিটিশ সরকার।
স্বাধীনতা সংগ্রামে গোপন খবর আদান-প্রদানের জন্য সেই সময় অত্যন্ত জরুরী ছিল বাইসাইকেল। শুধু নিজেদের জন্য নয়, নারীরা নিজেদের জমানো পয়সা থেকেও বিপ্লবী পুরুষদের জন্য সাইকেল কিনে দিতেন। এমনই একজন সাহসী বঙ্গতনয়া ছিলেন চারুবালা কাঞ্জিলাল। ১৯৩০ সালে সংঘটিত লবণ আইন অমান্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাঙালি মেয়েরা। চারুবালা নিজের সমস্ত মূল্যবান গয়না লুকিয়ে বিক্রি করে বিপ্লবীদের জন্য দশখানা সাইকেল কিনে দিলেন।
মেয়েদের বাইসাইকেল চড়ার ইতিহাস শুধু কলকাতায় নয়, ছড়িয়ে পড়ল বরিশালে। বিপ্লবী শান্তিসুধা ঘোষ ১৯৩১ সালে বরিশালের মেয়েদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘শক্তিবাহিনী’ সংঘ। যেখানে মেয়েদের সাইকেল চড়া শেখানো হতো।
মেয়েদের বাইসাইকেল চড়া দেশবাসীর মনের স্বাধীনতা লাভের উদ্দীপনাকে আরো বাড়িয়ে দিলো। এই যাত্রাপথে অন্যতম সৈনিক ছিলেন তপতী মিত্র। কলকাতার বেলতলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তপতি মায়ের কাছে সাইকেল কেনার আবদার করে আর সেই সাইকেল শেখানোর জন্য তাকে ভর্তি করে দিলে তার মা সেন্ট জেমস্ স্কোয়ারের শিশুমঙ্গল প্রতিষ্ঠানে। দীর্ঘদিন ধরে অনলস প্রচেষ্টায় চন্দননগর স্পোর্টসে সাইকেল চালিয়ে তিনি প্রথম হলেন।
ঠিক এই সময়ে ১৯৪৪ সালে কালীঘাটে অনুষ্ঠিত হতে চলেছিল সাইকেলের প্রতিযোগিতা। তপতী ফিরিঙ্গি মেয়েদের সঙ্গে লড়াই করবেন। যে সমস্ত লোকেরা এতদিন ধরে তার নামে কুৎসা রটিয়ে ছিল, আজ তারাই তপতীর জন্য পথে নামলো। পূর্ববর্তী চ্যাম্পিয়ন মিস বেলগ্রেডকে হারিয়ে কালীঘাটে ঐতিহাসিক জয় আনলেন এই বঙ্গতনয়া।
এরপর তপতী আইএসসি পাস করে ডাক্তারি পড়তে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন। ডাক্তার হলেন নিয়ম মত। সবাইকে অবাক করে কানে স্টেথিস্কোপ লাগিয়ে শিশু এবং প্রসূতির বুক পরীক্ষা করেছেন, আবার সাইকেল চালিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটতেন মুমূর্ষু রোগীর সেবা করার জন্য। নিত্যদিনের লড়াইয়ে বাইসাইকেল হয়ে উঠল যেন নারীদের প্রধান সঙ্গী।।
তথ্যঋণ : উইকিমিডিয়া, অঙ্কন ঘোড়ই-এর রচনা এবং অন্যান্য।