সিংহাচলম্ মন্দিরে গেছিলাম। শ্রীবরাহ নরসিংহস্বামীর লাড্ডু প্রসাদ রাখা ছিল ফ্রিজে। আঙ্কাম্মার হাতে দিতেই ওর মা চিন্দাম্মা হাত থেকে মিষ্টিটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
“প্রসাদম্? নো নো। নো প্রসাদম্। মেমু খ্রীস্টান।”
একটা ঝটকা লাগল আমার। চিন্তা করে দেখলাম দীর্ঘদিনের অস্পৃশ্যতার বঞ্চনাতেই কি তার এই প্রত্যাখ্যান। আমি আর জোর করিনি। যে যার ভাবনা নিয়ে থাকুক। আমি আর কি করব!
আঙ্কাম্মা আমার মেয়ে টুসির খেলার সাথী। বিকেলে যখন চিন্দাম্মা অথবা চিন্দাম্মার মা আমাদের বাড়িতে কাজ করতে আসে, আঙ্কাম্মাও ওদের সঙ্গে আসে। টুসিকে ও সাইকেল শেখাতে গিয়ে হাঁচড়েপাঁচড়ে কতবার পড়েছে দু-জনেই। হাত পা ছড়েছে। সারা বিকেল ধরে ওদের বকর বকর আর খেলা!
দোতলার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে আমাদের মুখোমুখি থাকেন মূর্তি সাহেব। ওঁনারাও তেলেগু। মিসেস মূর্তি আমাকে অনেকবার বলে,
— টুসিকে তুমি কাজের মেয়ের সঙ্গে খেলতে দাও কেন? ওরা খুব নিচু জাত।
— এখন খেলুক না। বড় হতে হতে বন্ধুবান্ধব কত বদলাবে!
যা মিসেস মূর্তিকে বলিনি অথচ কানে এসেছে, তা আমার ভালো লাগেনি। মিসেস মূর্তির মেয়ে টুসিকে শুনিয়েছে, তোর বাবার তো শুধু একটা মোটর সাইকেল আছে। আমার বাবার মোটর সাইকেল, কার দুটোই আছে। বাবা বলছিল আমরা এবার আরো বড় গাড়ি কিনব!
টুসির সঙ্গে আঙ্কাম্মা ক্লাবের ফ্রী যোগা ক্লাসে যায়। ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে দু-জনে মেঢকাসন, কৌআ চাল দেখায়। আমি হেসে মরি। আঙ্কাম্মা নাকি যোগা ক্লাসের কালিআম্মা। গুরুজির কথায় সে প্রায়ই জিভ বা’র করে খড়গহস্ত হয়ে দাঁড়ায়।
গঙ্গাভরম্ বীচের লাগোয়া আঙ্কাম্মাদের ঘর। এই বীচের খবর ভাইজাগের সাধারণ ট্যুরিস্টরা খুব একটা জানে না। ভাইজাগ স্টীল প্ল্যান্ট বা ‘উক্কুনগরম্’ যেখানে শেষ হয়েছে সেখানেই সারি সারি জেলেদের বস্তির পর গঙ্গাভরম বীচ। সমুদ্রের ঝোড়ো হাওয়া, মাছের আঁশটে গন্ধ, নারকেল গাছের শুকনো পাতা-জঞ্জালের মধ্যেই বড় হচ্ছে আঙ্কাম্মা। সে তার মা আর দিদিমার সঙ্গে থাকে। সকালে ইস্কুলে যায়। আঙ্কাম্মার বাবা তাদের ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। তেলেগুদের পুরনো প্রথা অনুযায়ী চিন্দাম্মার সঙ্গে তার মামার বিয়ে হয়েছিল। পরে হয়তো আর তাকে পছন্দ হয় নি, তাই নতুন ভালোবাসার খোঁজে সে অন্য মেয়ের হাত ধরেছে। এদের কথা খানিকটা আকারে ইঙ্গিতে আমাকে বুঝে নিতে হয়। তেলেগু ভাষায় সড়গড় হওয়া অত সহজ নয়!
মাসের পাঁচটা দিন চিন্দাম্মা আমার ঠাকুরঘর ঝাঁট দেয়না, মোছে না। প্রথম প্রথম জিজ্ঞেস করলে নাক কান মুলে, কপালে হাত ঠেকিয়ে বলত ‘স্বামী, নো নো, পিরিয়ড।’
আমি মনে মনে বলতাম, ন্যাকা! এদিকে খ্রীষ্টান হয়েছেন বলে ঠাকুরের প্রসাদ খাবেন না, আর ওদিকে পিরিয়ডের সময় ঠাকুর ঘরে ঢুকবেন না। যতসব কাজ ফাঁকি দেওয়ার ধান্দা! কিন্তু এসব কথা ওকে বোঝানো আমার পক্ষে দুষ্কর। তাই রণে ভঙ্গ দিতাম। ঐ পাঁচদিন কাটিয়ে সর্বাঙ্গে হলুদ মেখে, মাথায় ফুল গুঁজে চিন্দাম্মা আবার সব কাজ করত।
বড়দিনে দু’দিন ছুটি নেবার পর সস্তার কেক এনে আমাদের দিয়ে বলত “যীশু কা প্রসাদ।”
একদিন প্রচুর হাত পা নেড়ে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করল, ‘আঙ্কাম্মার হাফ শাড়ি ফাংশন। পার্টি। কাম।’ আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না। শেষমেষ মিসেস মূর্তির শরণাপন্ন হতেই হোলো। মিসেস মূর্তি যা বললেন, তাতে আমার চোখ কপালে ওঠার যোগাড়!
— আঙ্কাম্মার প্রথম রজোদর্শন হয়েছে, সেই উপলক্ষ্যে কিছু মেয়েলি আচার অনুষ্ঠান, পুজোপাঠ হবে। তারপর খাওয়া দাওয়া, গিফট দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু তোমার ওখানে যাওয়া মানায় না। বস্তির লোকেরা দারু খেয়ে হল্লা করবে। তোমার সম্মান ক্ষুন্ন হবে।
— ঠিক আছে দেখি। ঐ জন্যেই আঙ্কাম্মা এখন আসছে না?
— হ্যাঁ ও পাঁচদিন সূর্যের মুখ দেখবে না।
— কি অদ্ভুত নিয়ম!
— হ্যাঁ এ নিয়ম আমাদের মধ্যে এখনো আছে।
টুসির বাবাকে বলতেই ও বলল, “যাও। তোমাকে ওরা নেমন্তন্ন করেছে! তুমি গেলে ওরা খুব খুশি হবে। মোটেই অসম্মান করবে না”।
টুসিও খুব খুশি। আঙ্কাম্মার বাড়ি যাবে। মনমরা হয়েছিল দু’দিন। আমাকে প্রশ্নে প্রশ্নে অস্থির করে তুলছিল, “ও খেলতে আসছে না কেন মা”!
আমি দোনোমনায় টুসিকে নিয়ে আঙ্কাম্মাদের বাড়ি পৌঁছে হতবাক। আলো দিয়ে সাজিয়ে, বাজনা বাজিয়ে এ যেন বিয়েবাড়ি! কত লোক নিমন্ত্রিত! আঙ্কাম্মাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ভারতনাট্যম্ নর্তকী। এমন সুন্দর সেজেছে! আমরা মেদুবড়া, ইডলি, চাটনি মিষ্টি খেয়ে আঙ্কাম্মাকে উপহার দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সারা রাস্তা টুসির কথা শুনতে শুনতে আর প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হয়রান হয়ে গেছিলাম। নিজের মনের ভেতর জেগে ওঠা প্রশ্নের উত্তর অবশ্য পাইনি! এরা কোন ধর্মকে আসলে মানে! আমাদের দেশের মানুষ এ কোন বিচিত্র রীতিনীতিকে এখনো পালন করে চলেছে!
মনের ভেতর আলোড়িত এসব প্রশ্ন অবশ্য প্রাত্যাহিকতার চাপে একটা সময় ফিকে হয়ে গেল। বেশ কিছুদিন পরে যা ঘনীভূত হয়ে উঠছিল,সেটি আন্দামান সাগরে ওঠা একটি ঘূর্ণিঝড়। যার পোশাকি নাম হুদহুদ। আমাদের বাংলার হুপুপাখি বা মোহনচূড়া। সেটি নাকি ক্রমশঃ বিশাখাপত্তনমের দিকে ধেয়ে আসছে। এখানেই তার আছড়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা। প্রশাসন থেকে বারবার সতর্কতা আসছিল। টুসির বাবা বলল, শুকনো খাবার দাবার ঘরে স্টোর করো। জল ভরে রেখো। হাতের কাছে টর্চ, মোমবাতি, দেশলাই সব যেন থাকে। মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলল, “কি হবে কিচ্ছু বলা যাচ্ছে না! “তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। মুখে উদ্বেগ।
দোকানে মোমবাতি, পাঁউরুটির আকাল হল। চিন্দাম্মা মেয়ে আর মা’কে নিয়ে গঙ্গাভরমের বস্তি ছেড়ে কোনো স্কুল বাড়িতে থাকবে বলল। মিউনিসিপ্যালিটিই এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
তারপর এলো সেই ভয়ঙ্কর দিন। সকাল থেকে চারিদিক নিস্তব্ধ-নিশ্চুপ।
গাছের পাতা নড়ছে না। পাখি ডাকছে না। যেন আসন্ন যুদ্ধের আগে প্রস্তুতি নিচ্ছে গোটা শহর। বিকেলের দিকে বৃষ্টি শুরু হল। বাড়তে লাগল হাওয়ার গতি। কাঁচের জানলার মধ্যে দিয়ে দেখতে পাচ্ছি বড় বড় গাছপালা প্রবল বেগে দুলছে!
“দেবী ইয়েল্লামাকে ডাকো। তিনিই সব বিপদ থেকে রক্ষা করেন। “মিসেস মূর্তি ঘনঘন প্রণাম ঠুকতে ঠুকতে এসে আমাদের বলে গেলেন। মন্দিরে ইয়েল্লাম্মা দেবীর মূর্তি আমি দেখেছি। ঘন কালো গায়ের রঙ, সর্বাঙ্গে সোনার গয়না, চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। তবে কালিঠাকুরের মত রুদ্ররূপা নন উনি। হয়তো বিপত্তারিণীর মত হবেন!
মিসেস মূর্তি চলে যাবার পর ধীরে ধীরে একটা সময় বৃষ্টি আর হাওয়ার তীব্রতা সবটাই কমে গেল। মনে হল ঝড় যেন অন্যত্র চলে গেছে।
জানতে ইচ্ছে করছিল বাইরের অবস্থাটা কেমন! যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন সবার সঙ্গে। মোবাইলের টাওয়ার ঠিকমত দেখাচ্ছে না। তবে থমথমে হয়ে আছে চারিদিক। ঘন্টা তিনেক পর আবার ভয়ঙ্কর বৃষ্টি শুরু হল। এবার হাওয়া তীব্রতর। নারকেল গাছগুলো যেন প্রবল রোষে আছড়ে পড়ে চুরমার করে দেবে ঘরবাড়ি। জানলার সমস্ত কাঁচ ঝনঝন করে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে। ফাঁকা জানলা দিয়ে জল ঢুকে ভাসিয়ে দিচ্ছে অন্ধকার ঘর। হে ভগবান, পৃথিবী কি রসাতলে যাবে! আমরা তিনজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে খাটের ওপর বসে আছি। মেয়েটা ভিজে যাওয়া পাখির মত থরথর করে কাঁপছে। ফোঁপাচ্ছে। একটা কথাও বলছে না।
একটা সময়, মাঝরাতে ঝড় থামল কিন্তু আমাদের ঘরের ভেতর সে ততক্ষণে আঘাত হেনে গেছে। টুসি শক্ত হয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছে।প্রচন্ড মানসিক আঘাতে ও বিপর্যস্ত। কাঁচের টুকরো আর জলে লন্ডভন্ড ঘর! কি যে করি! কোথায় যাই এখন!
সকালের আলো ফুটতেই দেখি কোনো পথ নেই। গাছপালা ভেঙে পড়ে গিয়ে অমন সুন্দর আমাদের কলোনীর চেহারাটাই যেন তছনছ হয়ে গেছে। বাসাভাঙা পাখিগুলো আর্তনাদ করছে। রাস্তায় পড়ে থাকা বড় বড় গাছ পেরিয়ে টুসিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব কি করে!
এমন সময় দরজায় ঠকঠক। কে এল সাতসকালে বিপদ মাথায় করে ! মূর্তিভাবী নাকি! দরজা খুলতেই দেখি মেয়ে আঙ্কাম্মার হাত ধরে চিন্দাম্মা দাঁড়িয়ে। কালো চেহারায় সোনার গয়না পরা চিন্দাম্মা কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল!
— তুমি এখানে এলে কি করে চিন্দাম্মা! রাস্তাঘাট বলে তো কিছু নেই।এই বিপদে এমন গয়না পরেছ কেন?
— ঘর থেকে স্কুলে শেল্টার নেবার সময় সব গয়না পরে নিয়ে ছিলাম। কোথায় এদিক ওদিক হয়ে যাবে! কাল ঝড়ের সময় আঙ্কাম্মা টুসির কথা ভেবে খুব কাঁদছিল। আমিই ওকে যেমন করে পারি নিয়ে চলে এলাম! তোমরা সবাই ঠিক আছ তো! যেশাস আমাদের সবাইকে রক্ষা করেছেন।
চিন্দাম্মা একথা বলে নিজের মাথায় বুকে একটা ক্রশ আঁকল। আজ ওর কোনো কথা বুঝতে আমার এতটুকু অসুবিধে হল না।
আঙ্কাম্মা ততক্ষণে দৌড়ে টুসির কাছে চলে গেছে, “টুসি টুসি দেখ, ম্যায় আ গয়ি। তুই এরকম করে শুয়ে আছিস কেন রে! চোখ খোল টুসি। ওঠ না!”
যে মেয়ে আমার এতক্ষণ নেতিয়ে পড়েছিল, সে ঐ ডাকে ধীরে ধীরে চোখ তুলে আঙ্কাম্মার দিকে চেয়ে একটু হাসল। আমাদের ধরে প্রাণ এল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
কে জানে আজ আমাদের যেশাস বাঁচালেন না স্বয়ং মূর্তিমতী দেবী ইয়েল্লাম্মা!
চিন্দাম্মা ততক্ষণে কোমরে আঁচল জড়িয়ে আমাদের লন্ডভন্ড ঘর পরিষ্কার করতে লেগেছে….
বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা, খুব সুন্দর লিখেছ।