পঁচিশে বৈশাখ নিয়ে কিছু লিখতে গেলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি আক্ষেপের কথা মনে পড়ে। তিনি নাকি কবিতায় বৈশাখের সঙ্গে জয়ঢাক ছাড়া কিছু মেলাতে পারেননি।
আর একটি কবিতা পড়েছিলাম বহুদিন আগে। কবির নাম মনে পড়ছে না। কবিতাটির নাম ‘চব্বিশে ও ছাব্বিশে বৈশাখ’। এখানে লিখলাম যতটা মনে পড়ে —
চব্বিশে ও ছাব্বিশে বৈশাখ
পঁচিশে বৈশাখের আগের দিনটি ছিল চব্বিশে বৈশাখ।
এক মহাপুরুষের জন্মের শেষ প্রস্তুতি চলছিল,
ডাক্তার, বদ্যি, হাকিম, ধাইমা সকলেই ছিল উৎকণ্ঠিত।
এর মধ্যেই ঘন ঘন বার্তা পাঠানো হচ্ছিল
এদিক ওদিকে আত্মীয় কুটুম্বজনের বাড়িতে
এক নক্ষত্রের জন্মের আগাম খবর জানিয়ে।
দলগত সংহতির কোনও ত্রুটি বা ব্যত্যয়
ঘটাতে পারত সমূহ সর্বনাশ।
**
মহাপুরুষের জননীকে কিন্তু থাকতে হচ্ছিল
ধীর স্থির ও অচঞ্চল,
কারণ তিনিই তো হবেন রত্নগর্ভা
মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাদেই!
মহাপুরুষ ভূমিষ্ঠ হলেন পঁচিশে বৈশাখে—
তারপরের দিনটি যে ছিল ছাব্বিশে বৈশাখ
তা বলাই বাহুল্য।
**
এদিনটা ছিল আরও মারাত্মক
পৃথিবীর আলোর সঙ্গে মুখোমুখি মোলাকাতের
দ্বিতীয় চব্বিশ ঘণ্টার গুরুত্ব ছিল আরও অনেক বেশি
পৃথিবীর যাবতীয় ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া ও ছত্রাকের
আক্রমণ প্রতিহত করার প্রক্রিয়াটা সেদিনই যে
সেই নবজাতককে রপ্ত করতে হয়েছিল।
এরপরের ঘটনা তো কীটাণুর বিরুদ্ধে
এক মানবসন্তানের যুদ্ধজয়ের ইতিহাস।
এহেন ক্রান্তদর্শী ও কালজয়ী রবীন্দ্রনাথেরও কিন্তু দৃষ্টির কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। লাল-দুর্বলতা বলা যায় এটিকে। লাল রঙ তিনি ভালো দেখতে পেতেন না। তখন লাল সেলামের চল হয়নি বঙ্গে। হলে তিনি আরও আতান্তরে পড়তেন।
কাব্যসাহিত্যে তিনি ‘লাল’ শব্দটি বেশি জায়গায় লেখেননি। ‘রাঙা’ ব্যবহার করেছেন। ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে’— যেমন লিখেছেন, তেমনি ছেলে-ভোলানো ‘রবিমামা দেয় হামা, গায়ে রাঙা জামা ওই’— এটাও লিখেছেন।
লাল একেবারে লেখেননি তা নয়, তবে তুলনায় কম। সাহিত্যে ও আত্মজৈবনিক লেখাতে ক্বচিৎ কদাচিৎ লাল রঙের উল্লেখ পাওয়া যায়।
জীবনস্মৃতিতে ‘হিমালয়যাত্রা’ পর্বে লিখেছেন, ‘পিতা গায়ে একটি লাল শাল পরিয়া হাতে একটি মোমবাতির সেজ লইয়া নিঃশব্দসঞ্চরণে চলিয়াছেন’।
‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’-এ লিখিয়াছেন, “একজন মুসলমানিনী সাজিয়াছেন, লাল ফুলো ইজের, তার উপর একটা রেশমের পেশোয়াজ, মাথায় টুপির মতো—”।
আর একটি পত্রে লিখিয়াছেন, “ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে লাল লাল ফুলো ফুলো মুখ নিয়া বাড়ির দরজার বাইরে ও রাস্তায় খেলা করিতেছে।”
তাহলে কবিগুরু প্রশান্তকুমার মহলানবিশের পত্নী নির্মলকুমারী মহলানবিশকে তিনি লাল রঙ দেখতে না পাওয়ার কথা বলতে গেলেন কেন? তা না বললে নির্মলকুমারীই বা বাইশে শ্রাবণ বইয়ে লিখলেন কেন, —
“বাগানে ঘাসের মধ্যেও খুব ছোট নীল রঙের জংলী ফুল ফুটে থাকলে ঠিক ওঁর চোখে পড়তো, বলতেন, ‘দ্যাখো দ্যাখো, কী চমৎকার ফুলটা’। হাসতেন আর বলতেন, ‘কী আশ্চর্য। এতো স্পষ্ট জিনিসটা দেখতে পাচ্ছ না? আমি তোমার লাল ফুল ভালো দেখতে পাইনে বলে আমাকে ঠাট্টা করো।…”
তবে কবিতা, গল্প, উপন্যাসে লাল-এর চেয়ে ‘রাঙা’ যে বেশি ব্যবহার করেছেন, সেটা অনস্বীকার্য।
কবিগুরু যে আংশিক বর্ণান্ধ ছিলেন, তা কবি নিজেই স্বীকার করেছেন।
তাহলে রবীন্দ্রনাথের ‘লাল’ রঙ আসলে কী? তিনি যদি সত্যিই লাল রঙ দেখতে পেতেন, তবে তিনি বিভিন্ন সময়ে লাল রঙ দেখতে না পাওয়ার কথা বলতে গেলেন কেন?
আমরা বর্ণান্ধ মানুষের রঙের স্পেক্ট্রামের কথা জানি। রেড-গ্রিন কালার ব্লাইন্ড ব্যক্তিরা লালকে শুধু সবুজই দেখেন না, বাদামি ও ধূসরও দেখেন। রবীন্দ্রনাথের লেখায় উল্লিখিত লাল আসলে বাদামি বা ধূসর। তাঁর আঁকা ছবিতেও সেটা লক্ষ্য করা যায়। মনে হয় রবীন্দ্রনাথের রেড-সেনসিটিভ কোন সেলে (Cone Cell) শুধু নয়, গ্রিন-সেনসিটিভ কোন সেলেও গোলমাল ছিল। অর্থাৎ তিনি শুধু প্রোটানোপই (Protanope) ছিলেন না, ডিউটেরানোপ-ও (Deuteranope) ছিলেন।
তাই তিনি লাল রঙকে বেগুনি, বাদামি বা ধূসর দেখতেন। এই রঙকেই তিনি ‘লাল’ লিখেছেন বিভিন্ন লেখায়।
জানি না, চক্ষুবিশেষজ্ঞরা কবির রঙের এই বিচিত্র পারসেপশন নিয়ে কী বলবেন! জ্যোতির্ময় বসু আর পিকফোর্ডের পরে কেউ এটা নিয়ে কাজ করেছেন কি?