মেদিনীপুর জেলার পুরাকীর্তির দুই বিখ্যাত গবেষক শ্রীতারাপদ সাঁতরা ও শ্রী প্রণব রায় মহাশয় মোটামুটি একই সময়ে (১৯৮৬/৮৭ সালে) ঘাটালের কাছে নবগ্রামের বিখ্যাত রায় (কংসবণিক ) পরিবারের তৈরি সিংহবাহিনী মন্দিরের ক্ষেত্রসমীক্ষা করে লিখেছিলেন — “এ গ্রামের উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি হলো, রায়পাড়ায় রায় পরিবারের গোপাল ও সিংহবাহিনীর পুবমুখী পঞ্চরত্ন মন্দির। এ মন্দিরে নিবদ্ধ প্রতিষ্ঠাফলকটির পাঠ নিম্নরূপ : “শকাব্দা ১৬৩১ … অতএব ১৭০৯ খ্রীস্টাব্দ এটির প্রতিষ্ঠা কাল”। আঠারো শতকের একেবারে গোড়ার দিকে এটি তৈরি হয়েছিল।
এরপর কেটে গিয়েছে তিন শ’ বছর। একদিকে জমিদারী উচ্ছেদ, অন্যদিকে পরিচর্যার অভাবে, সর্বাঙ্গে জরার আঘাত নিয়ে মুমূর্ষু হয়ে হারিয়ে যাওয়ার দিন গুনছে লিপিসাক্ষ্যে সর্বপ্রাচীন নবগ্রামের (ঘাটাল) সিংহবাহিনী (১৭০৯ স্ত্রীঃ) মন্দিরটি। মন্দির আজ বিগ্রহহীন। ওনাদের সকলেই একমত যে পোড়ামাটির ফলকসজ্জর উৎকর্ষতায় নিরিখে এটি মেদিনীপুর জেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মন্দির হিসাবে গন্য হতে পারে। তারও দশ বছর আগে জেলার অগ্রণী গবেষক পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ মহাশয় প্রণব রায়ের সাথে যৌথভাবে “ঘাটালের কথা” বইয়ে এটির বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন।ওনাদের সম্মিলিত দৃষ্টিতে দেখা সৌন্দর্যের অনেকখানিই আজ ম্লান হয়ে এসেছে । যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সে সম্পর্কে বলা যায় “প্রবেশপথের উপরে লঙ্কাযুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্যের ফলকগুলি একান্তই মনোরম। মন্দিরের সামনে ত্রিখিলান প্রবেশপথের ওপরের তিন প্রস্থে, কার্নিশের নীচে ও দুপাশে পোড়ামাটির ফলকের ছড়াছড়ি। মূর্তিগুলি ছোট ছোট ছাঁচে তৈরি। ভিত্তিবেদিসংলগ্ন দেওয়ালের প্যানেলগুলিতে সামাজিক দৃশ্যপট যেমন, শিকার দৃশ্য, প্রহরীসহ শৃঙ্খলিত বন্দী প্রভৃতি রয়েছে।
বেশ কয়েকটি ফলক নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকটি প্রতিকৃতি দেউলে শঙ্খবাদনরতা নারীমূর্তি উল্লেখযোগ্য। ছোট্ট ছোট্ট কুলুঙ্গীতে রাধাকৃষ্ণ, পূতনাবধ, ধেনুকাসুরবধ, গায়িকা, সন্ন্যাসী, বাদক প্রভৃতির মূর্তিও আছে। একটি ফলকে মহিলার টিয়াপাখিকে খাওয়ানোর দৃশ্যটি অনবদ্য। মন্দিরটির দক্ষিণদিকেও একটি অলিন্দ আছে। এছাড়া স্তম্ভমূলেও উৎকীর্ণ হয়েছে শিকারযাত্রা ও সন্ন্যাসীদের মিছিল। এ মন্দিরের অলঙ্করণসজ্জার আর এক বিশেষত্ব হল, পোড়ামাটির ফলকের সঙ্গে সবুজাভ মাকরা পাথরে উৎকীর্ণ অনুপম ভাস্কর্যযুক্ত ফলকের ব্যবহার, যা এ মন্দিরের শিল্পী-স্থপতির কারিগরী মুন্সীয়ানার প্রমাণ দেয়”। এরমধ্যে আরও ষাট বছর কেটে গিয়েছে বিগ্রহহীন এই মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আরও জীর্ণ হয়েছে। রায় পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের সদস্য অসিত রায় জানালেন তাঁদের পূর্বপুরুষের কাঁসাপেতলের বড় ব্যবসা ছিল।
নবগ্রামের পাশ দিয়ে এক সময়ে প্রবাহিত হত রত্নাকর নদ। বর্তমানে যা প্রায় খালে পরিণত হয়েছে। সেই নদীতে বর্ষাকালে বড় নৌকা আসত। রত্নাকর নদ থেকে শিলাবতী হয়ে জল পথে দেশে বিদেশে বহু জায়গায় পৌঁছে যেত রায়েদের কাঁসাপিতলের পণ্য সামগ্রী। ধীরে ধীরে বিত্তশালী হয়ে ওঠে রায় পরিবার। সময়ের নিয়ম মেনে সুখের দিনে গোপাল ও সিংহবাহিনীর মন্দির এবং শিবের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। কোনো এক সময়ে পণ্য বোঝাই নৌকাডুবিতে দুর্দিন নেমে আসে পরিবারে।
পরবর্তী কালে অর্থনৈতিক দিক থেকে বিপর্যস্ত পরিবারের উত্তরাধিকারীরা মন্দির সংরক্ষণের জন্য কিছুই করে উঠতে পারেননি। ফলে এক সময় শিব মন্দিরটি ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় । কালের রক্তচক্ষুকে অবহেলা করে টেরেকোটা ফলকে মোড়া সিংহবাহিনীর মন্দিরটি আজও দাঁড়িয়ে আছে। অবিলম্বে এই প্রাচীন মন্দিরটির সংস্কার ও সংরক্ষণ একান্ত প্রয়োজন।
শিল্পীর নিপুণ হাতে তৈরী মন্দিরের ভাস্কর্য সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। এমন স্থাপত্য কলার অবলুপ্তি মেনে নেওয়া যায় না। স্থানীয় গুণীজনদের চেষ্টায় সরকারি বা বেসরকারি ভাবে এগুলি রক্ষা করা সম্ভব।
শ্রী কমল ব্যানার্জি মহাশয় দীর্ঘদিন ধরেই বাংলার হারানো মন্দিরগুলি নিয়ে নিরলস কাজ করে চলেছেন।
আপনাদের ধন্যবাদ এগুলি জনগোচরে আনবার জন্য