বামদল, বিশেষ করে সিপিআইএম, এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অনেকে মনে করেন যে মমতার সঙ্গে আর এস এসে-র একটা গোপন সম্পর্ক আছে, বিজেপির প্রতি তাঁর দুর্বলতা আছে। এই ভাবনা থেকে তাঁরা মনে করেন ‘দিদি মোদির আঁতাত আছে’, তৃণমূল আসলে ‘বিজেমূল’। এ রকম ভাবনার পক্ষে কিছু চটজলদি দৃষ্টান্তও আছে। যেমন, মমতা এনডিএ মন্ত্রীসভায় ছিলেন; অটলবিহারী বাজপেয়ীর স্নেহধন্যা ছিলেন মমতা, প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী মমতার কালীঘাটের বাসভবনে এসেছেন, আর এস এস প্রধান মোহন ভাগবতেরও দুর্বলতা আছে, ইডি-সিবিআই পাঠালেও দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল সরকারকে তাঁরা চরম বিপদে ফেলছেন না ইত্যাদি।
ঐতিহাসিকভাবে এইসব অভিযোগ বিচার করে দেখা খুব জরুরি। প্রথমে আমরা পশ্চিমবঙ্গে আর এস এসের বিকাশ ও বিস্তার পর্যালোচনা করে বিচার করব এই বিস্তারের জন্য মমতা ও তাঁর দল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোন সাহায্য করেছেন কিনা।
বঙ্গে আর এস এসের বিকাশ ও বিস্তার
আর এস এস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের জন্ম ১৯২৫ সালে। নাগপুরে। জন্মের পর থেকেই আর এস এস সমগ্র ভারতে তাঁদের শাখা ছড়িয়ে দেবার আয়োজন করেছিলেন। ১৯৩৯ সালের ২২ মার্চ (এই দিনটিকে আর এস এস হিন্দু নববর্ষ হিসেবে স্মরণ করে ) কলকাতার মানিকতলা অঞ্চলের তেলকল মাঠে আর এস এসের বঙ্গ শাখার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন মহারাষ্ট্রের দুই নেতা — মহাদেব সদাশীব গোলওয়ালকর ও ভিথল রাও পটকি। জয়দেব ঘোষ ও কালিদাস বসু এই সংগঠনকে গড়ে তোলার জন্য জান লড়িয়ে দিয়েছিলেন। ঘোষ ছিলেন মুখ্য শিক্ষক আর বসু ছিলেন স্বয়ংসেবক বা স্বেচ্ছাসেবী।
এখানকার সংগঠনের কাজকর্ম দেখার জন্য মাঝে মাঝে নাগপুর থেকে নেতাদের পাঠানো হত। পাঠানো হয়েছিল মধুকর দত্তরায় দেওরা বা বালাসাহেবকে। ১৯৪৫ সালে পাঠানো হয় দত্তপন্থ বাপুরাও থেঙ্গাদিকে। ১৯৪৯ সালে পাঠানো হয় একনাথ রানাডেকে। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী হিন্দু মহাসভায় যোগ দেন ১৯৩৯ সালে। বালাসাহেব তাঁকে আর এস এসের বঙ্গশাখায় যোগ দেবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এভাবে শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে আর এস এসের সংযোগ গড়ে ওঠে। ১৯৫১ সালে তিনি আর এস এসের রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনসংঘের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের লোকসভা নির্বাচনে জনসংঘ সাফল্য লাভ করে। ফলাফল ও ভোটের হার এই রকম : কংগ্রেস-২৪ (৪২.১%), সিপিআই-৫ (৯.৫%), ভারতীয় জনসংঘ-২ (৫.৯%), আর এস পি –২ (২.৪%), এইচ এম এস–১ (৪.৩%)। ১৯৫৩ সালে শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পরে ভারতীয় জনসংঘ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বামেরা ক্রমশ শক্তিবৃদ্ধি করে। বামেদের শক্তিবৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের সমর্থন লাভ। ১৯৭৭ সালে ক্ষমতা লাভ করে বামেরা। দীর্ঘ ৩৪ বৎসর সে ক্ষমতা অব্যাহত ছিল। আর এস এসের শাখা ও স্বয়ংসেবকদের উপর বামেরা এক সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে (“But several RSS organisers I met blamed a ‘societal pressure’ that the Left created on the friends and families of swayamsevakes and shakha attendees’-এস. ভট্টাচার্যের প্রতিবেদনে আমির ভাডের উক্তি)। তবে এই প্রতিকূলতার মধ্যেও আর এস এস তার সামাজিক ও ধর্মীয় কাজকর্ম অব্যাহত রেখেছিল। ১৯৬৪ সালে আসরে নামে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ; ১৯৭০ থেকে বিদ্যাভারতী, ১৯৮০ থেকে বনবাসী কল্যাণ আশ্রম ও আশির দশকের শেষ থেকে সেবা ভারতী শুরু করে কাজ।
প্রথম পর্যায়ে আর এস এসের লক্ষ্য ছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শাখা স্থাপন। মুর্শিদাবাদ, সিউড়ি, উত্তরপাড়া, বর্ধমান প্রভৃতি স্থানে শাখা স্থাপিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হয় সামাজিক প্রকল্পের কাজ এবং তারা বেছে নেয় পিছিয়ে পড়া পশ্চিমাঞ্চল, উত্তরবঙ্গ, সুন্দরবন অঞ্চলকে।
২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল আর এস এসের সামনে এনে দেয় নতুন সুযোগ। এই নির্বাচনে সিপিআইএম-৯, কংগ্রেস-৬, তৃণমূল-১৯। আর এস এসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বঙ্গে তাঁদের সংগঠনকে শক্তিশালী করতে নির্দেশ দেন। আর এস এসের প্রায় ২৪টি ভিন্ন সংগঠন রাজ্যে কাজ শুরু করে দেয়। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসে এবং সেই সুযোগে আর এস এস তাদের সামাজিক প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই রকম প্রকল্প ২০১১ সাল পর্যন্ত ছিল ২০০টি, ২০২০ সালে তা হয় ৪৫০-এর বেশি। নতুন নতুন শাখা স্থাপিত হয়। ২০১৭ সালে রামনবমীর বিশাল মিছিল বের হয়। সরসংঘচালক মোহন ভাগবত রাজ্য পরিক্রমা করেন। তিনি আরও ৭০০ নতুন শাখা (এখনও পর্যন্ত ১৯০০টি শাখা ছিল পশ্চিমবঙ্গে) গঠনের নির্দেশ দেন। মোহন ভাগবত যদিও বলেন যে রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের কোন যোগ নেই, তবু দেখা যায় প্রকারান্তরে আর এস এস বিজেপির পায়ের তলার মাটিকে পাকাপোক্ত করার কাজই করে চলেছে।
শত্রুর শত্রু বন্ধু
বামফ্রন্ট, বিশেষ করে সিপিআইএমের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জী লড়াইতে অবতীর্ণ হন গত শতকের আশির দশকের শেষ থেকে। কিন্তু তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন, এই লড়াইতে কংগ্রেসের তেমন উৎসাহ নেই। তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের সঙ্গেও তাঁর তীব্র মতভেদ হয়। ১৯৯৭ সালে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। রাজনৈতিক কারণেই তিনি অনুভব করেন যে তাঁর এই সদ্যোজাত দলকে প্রসারিত করতে হলে একটি শক্তিশালী দলের সাহায্য প্রয়োজন। তাই তিনি ১৯৯৯ সালে বিজেপি পরিচালিত এন ডিএতে যোগ দেন ও মন্ত্রীত্ব লাভ করেন। পশ্চিমবঙ্গে বামদের উৎখাত করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য এবং সে কাজে তিনি এন ডি একে ব্যবহার করেন। রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জর্জ ফার্নান্ডেজ পশ্চিমবঙ্গে পরিদর্শন করে জানান যে এখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পরবর্তীকালে বিজেপি সাংসদ বিজয় গোয়েল, শিবসেনা সাংসদ সঞ্জয় নিরুপম পশ্চিমবঙ্গ সফর করে জানান যে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বিধ্বস্ত, রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করা প্রয়োজন। নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী দ্বিধাগ্রস্ত হলে মমতা বিরক্ত হন, পরে এন ডি এ ত্যাগ করেন। ২০০৬-৭ সালে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলনে মমতার রাজনৈতিক লাভ হয় বিপুলভাবে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধেন এবং মনোমোহন সরকারের রেলমন্ত্রী হন বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে তিনি ইউ পি একেও ব্যহার করার চেষ্টা করেন।
বঙ্গে বিজেপির বাড়-বাড়ন্তের দায়িত্ব কার
বাংলায় বিজেপির বাড়-বাড়ন্তে মমতা ব্যানার্জীর দায়িত্ব আছে। বাম শাসনকে উৎখাত করার জন্য তিনি বিজেপির সাহায্য নিয়েছিলেন। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে বিজেপি। তবে বিজেপির বাড়-বাড়ন্তে বাম ও কংগ্রেসেরও দায়িত্ব আছে। বামেদের কথা বলবার আগে তপন শিকদারের কথা বলা দরকার। ১৯৯৮ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী হিসেবে ইনি দমদম লোকসভা কেন্দ্রে জয়লাভ করেন। শোনা যায় সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তীর মদত ছিল তপন শিকদারের জয়ের পেছনে। সংসদীয় গণতন্ত্রে তিনিই বাংলার বিজেপির প্রথম প্রতিনিধি।
আরও একটা প্রসঙ্গ বলা দরকার। এখানকার সিপিএম নেতারা কেরল নিয়ে গর্ব করেন। বলেন সেখানে আর এস এস ও বিজেপিকে বাড়তে দেয় নি বামেরা। কথাটা সত্য নয়। পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে ছোট রাজ্য হলেও কেরলে আর এস এসের শাখা বেশি। ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ক্রমাগত বৃদ্ধি হয়েছে আর এস এসের শাখা। এখন সেখানে ৫১৪২টি শাখা সক্রিয়। তবে এ কথা ঠিক যে কেরলে বিজেপি বিধানসভা বা লোকসভায় কোন সাফল্য পায় নি। তার কারণ সেখানে কংগ্রেস জোট ও বাম জোটের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গে যদি তৃণমূল এবং বামও কংগ্রেসের মধ্যে ভোট ভাগ হয়ে যেত, তাহলে বিজেপির বাড়-বাড়ন্ত হত না।
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আসন ও ভোট শতাংশের হিসেব : তৃণমূল-১৮৪ (৩৮.৯%), সিপিআইএম-৪০ (৩০.১%), কংগ্রেস-৪২ (৯.১%)। এই বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির একটিও আসন নেই। সিপিআইএমের আসন কমেছে, কিন্তু ভোট শতাংশ বিশেষ কমে নি। ২০০৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআইএমের ভোট শতাংশ ছিল ৩৭.১%। ২০১১তে মাত্র ৭% কমেছে।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আসন ও ভোট শতাংশের হিসেব : তৃণমূল-৩৪ (৩৯.০৫%), সিপিআইএম–২ (২৯.৭%), বিজেপি-২ (১৭.০২%), কংগ্রেস-৪ (৯.৫৮%)। দেখা যাচ্ছে তৃণমূল তার ভোট শতাংশ ১% বাড়িয়েছে, সিপিআই এমের ভোট শতাংশ ১% কমেছে আর খাতা খুলে বিজেপির ভোট শতাংশ ১৭.ও২%।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আসন ও ভোট শতাংশের হিসেব : তৃণমূল-২১১ (৪৪.৯১%), সিপিআইএম-২৬ (১৯.৭৫%), কংগ্রেস-৪৪ (১২.২৫%), বিজেপি-৩ ( ১০.১৬% )। দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের ভোট শতাংশ পূর্ববর্তী লোকসভার চেয়ে ৫% বেড়েছে, সিপিআইএমের ভোট শতাংশ ১০% কমেছে।
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আসন ও ভোট শতাংশের হিসেব : তৃণমূল-২২ (৪৩.২৮%), বামদল-০ (৭.৪৬%, এর মধ্যে সিপিআইএমের ৬.২৮%), বিজেপি–১৮ (৪০.২৫%), কংগ্রেস-২ (৫.৬১%)। দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের ভোট পূর্ববর্তী বিধানসভার চেয়ে ১% কমেছে, সিপিআইএমের ভোট শতাংশ প্রায় ১৩% কমেছে, কংগ্রেসেরও কমেছে ৭% ; কিন্তু বিজেপির ভোট শতাংশ লাফিয়ে বেড়েছে ৩০%। সম্ভবত বাম ও কংগ্রেসের ভোট পড়েছে বিজেপির ঝুলিতে। ‘আগে রাম পরে বাম’ এই রকম একটা কথা চালু হয়েছিল বামের সমর্থকদের মধ্যে। তাঁদের মূল শত্রু যে তৃণমূল, হাবেভাবে সেটা প্রকাশিত হচ্ছিল।
২০২১ ফের বিধানসভা নির্বাচনের আসন ও ভোট শতাংশের হিসেব : তৃণমূল-২১৩ (৪৭.৯৪%), বিজেপি–৭৭ (৩৮.১৩%), সিপিআইএম-০ (৪.৯৪%), কংগ্রেস-০ (২.৯৪%)। দেখা যাচ্ছে পূর্ববর্তী লোকসভা নির্বাচনের চেয়ে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে ৪%, বিজেপির ভোট মোটামুটি ঠিকই আছে, সিপিআইএমের ভোট কমেছে ২%।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আসন ও ভোট শতাংশের হিসেব : তৃণমূল-২৯ (৪৬.২%), বিজেপি-১২ (৩৯%), সিপিআইএম-০ (৪.৭%), কংগ্রেস-১ (৪.৭%)। দেখা যাচ্ছে তৃণমূল ও বিজেপি কম পেয়েছে ১%, সিপিআইএম ৪% এই আছে।
এই হিসেব থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় দুর্নীতি, কুশাসন ইত্যাদি নানা অভিযোগ সত্ত্বেও তৃণমূল তার ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতে পেরেছে। বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক হঠাৎ স্ফীত হয়ে ওঠার কারণ বিজেপির আদর্শের প্রতি অনুরাগ নয়, অন্যের ভোট বিজেপির থলিতে ঢুকে যাওয়া।
ধর্মের তাসখেলা
ভারতের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে ধর্মের তাস নিয়ে বিজেপির আবির্ভাব ও বাজিমাৎ। রামমন্দির আন্দোলন দিয়ে তার শুরু। এক মহাকাব্যের ধীরোদাত্ত নায়ককে রাজনীতির চরিত্রে রূপান্তরিত করে, হিন্দুত্বের ধ্বজা উড়িয়ে এগিয়ে চলল বিজেপি। ১৯৮৪ সাল থেকে লোকসভায় বিজেপির আসন সংখ্যা ও ভোট শতাংশের হিসেবটা এই রকম :
১৯৮৪-২ (৭.৭৪%)
১৯৮৯-৮৫ (১১.৩৬% )
১৯৯১-১২০ (২০.১১)
১৯৯৬-১৬১ (২০.২৯%)
১৯৯৮-১৮২ (২৫.৫৯%)
১৯৯৯-১৮২ (২৩.৭৫%)
২০০৪-১৩৮ (২২.১৬%)
২০০৯-১১৬ (১৮.৮০% )
২০১৪-২৮২ (৩১.৩৪% )
২০১৯-৩০৩ (৩৭.৪৬%)
২০২৪-২৪০ (৩৬.৫৬%)
দিনে দিনে ধর্মের তাস খেলার গতি বাড়িয়েছে বিজেপি। অটলবিহারীর আমলে যেটুকু রাখঢাক ছিল, মোদির আমলে তা আর রইল না। বিজেপির নেতা ও কর্মীরা যে ধর্মনিষ্ঠ বা সৎভাবে তাঁরা ধর্মাচরণ করেন, সে কথা আমি মনে করি না। তাঁরা আসলে ধর্মব্যবসায়ী। ধর্মের তাস খেলে তাঁরা করায়ত্ত করতে চান রাজনৈতিক ক্ষমতা। সম্ভবত এই জন্যই ইদার্নীং শঙ্করাচার্য বিজেপি নেতাদের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যনার্জীও কি ধর্মের তাস খেলছেন না?
নিশ্চয়ই খেলছেন। বাড়িতে তিনি সাড়ম্বরে কালীপুজো করেন এবং তার ব্যাপক প্রচারও হয়। তিনি প্রায়শ মাজারে যান,. মন্দিরে গিয়ে পুজো দেন। চণ্ডীপাঠ করে তিনি বাড়ি থেকে বের হন। হিন্দুধর্ম নিয়ে তিনি বিজেপির সঙ্গে প্রতিযোগিতার মঞ্চে অবর্তীর্ণ হতে চান। ইমাম ভাতা, পুরোহিত ভাতা চালু করেছেন তিনি। রামনবমীর মিছিল করেন তিনি। অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের দিন কলকাতার রাস্তায় সব ধর্মের মানুষদের নিয়ে পথে নামেন। বিজেপি অভিযোগ করেন যে মমতা সংখ্যালঘু তোষণ করেন। করতেই হবে, কারণ মুসলমান ভোট ৩০%। আবার ৭০% হিন্দু ভোটের কিছু না পেলে চলবে না। তাই তাঁকে প্রমাণ করতে হয় যে তিনি হিন্দুবিরোধী নন। তার শেষ উদাহরণ দিঘায় জগন্নাথদেবের মন্দির।
মমতার ধর্মের তাস খেলা নিয়ে বামেদের বক্রোক্তি শোনা যায়। কিন্তু কোনদিনই আত্মসমালোচনা করেন নি তাঁরা। এ কথা ঠিক যে বামেদের শাসনকালে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় নি। কিন্তু তার কৃতিত্ব তো এদেশের মনীষীদের উদারনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যে অনেকাংশে নিহিত। ‘ধর্ম যে আফিং’ — এই চিন্তা-চেতনা কি তাঁরা রাজ্যের জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন তাঁদের দীর্ঘ শাসনকালের মধ্যে? ‘ঘরে হিন্দু বা ব্রাহ্মণ, বাইরে মার্কসবাদী’ — এই রকম দ্বৈতশাসনে কি পরিচালিত নয় অধিকাংশ কমরেডদের জীবন? যুক্তিবাদী মানসিকতার ভিতও কি বামেরা তৈরি করতে পেরেছেন?
ধর্ম নিয়ে তাসখেলা আমিও ব্যক্তিগতভাবে ঘৃণা করি। কিন্তু বিজেপির আগ্রাসী হিন্দুত্বের প্রচারের মুখে হিন্দুভোট পাওয়ার জন্য মমতাকে বলতে হয়, ‘আমাকে হিন্দুধর্ম শেখাচ্ছেন?’ বলতেই হয়, কারণ বিজেপি তাঁকে সচেতনভাবে মুসলমানদের দিকে ঠেলে দিয়ে হিন্দুদের ভোটের সিংহভাগ পেতে চাইছেন।
মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরি
মমতার তৃণমূল সরকারের অনেক নেতিবাচক দিক আছে। দুর্নীতি আছে, বাহুবলের আস্ফালন আছে, স্বজন পোষণ আছে, অপশাসন আছে, বেশ কিছু নেতার দাদাগিরি আছে। ২০১১ সালে ক্ষমতা লাভের কিছু পর থেকেই চিটফাণ্ডের দুর্নীতির কথা উঠতে থাকে। বামেরা উল্লসিত হয়ে ওঠেন। পরবর্তী নির্বাচনে ৮ম বামফন্ট্র সরকারের স্বপ্ন দেখাও শুরু হয়ে যায়। ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সাফল্য লাভ করে বিজেপিও এমনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। বাম ও বিজেপি-উভয়ের স্বপ্নভঙ্গ হতে দেরি হয় নি। বামেদের ব্যর্থতার কারণ : রাজনৈতিকভাবে মমতার বিরুদ্ধে টেক্কা নিতে না পারা, তাঁরা যে আবার ক্ষমতা লাভ করবেন — এই বিশ্বাস জনমনে স্থাপিত করতে না পারা, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং ভাবের ঘরে চুরি ইত্যাদি। বিজেপির ব্যর্থতার কারণ : হিন্দুত্বের আহ্বান বাঙলার মাটিতে খাপ খায় না, মোদি শাহের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, সাংসদ ও বিধায়কদের নিষ্ক্রিয়তা, ভুল প্রার্থী নির্বাচন, আদিবাসীদের মন জয়ে ব্যর্থতা, মহিলা ভোটার ও মুসলমান ভোটারদের বিরূপতা, দুর্নীতি-ধর্ষণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে সঠিক রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনায় ব্যর্থতা।
কিন্তু এসবের বাইরে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। সেটা তৃণমূল দল নয়, মমতা ব্যানার্জী স্বয়ং।
বাস্তবে তৃণমূল তো কোন রাজনৈতিক দল নয়, একটা বিশৃঙ্খল জনতা মাত্র। সেই বিশৃঙ্খল জনতাকে ধরে আছেন একজন। একজনই মাত্র। তিনি মমতা ব্যনার্জী। তাঁর প্রাণশক্তি, তাঁর ক্যারিশমার সঙ্গে টক্কর দিতে পারছেন না অন্য দল। তাঁকে ‘আণ্ডারএসটিমেট’ করে আরও ভুল করে যাচ্ছেন বিরোধীরা।
২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের পর ‘দুর্বার কলম’ পত্রিকায় আমার দুটি খোলা চিঠি প্রকাশিত হয়। একটি চিঠি মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে লেখা, অন্যটি তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জীকে লেখা। চিঠিদুটি গ্রন্থিত হয় ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘ একা এক নারী : প্রতিপক্ষ কয়েকজন’ বইতে। দুটি চিঠিতে আমি দুজনের নেতিবাচক ও ইতিবাচক উভয় দিকগুলি পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছিলাম তটস্থদৃষ্টিতে।
মমতা ব্যানার্জীর ভাবমূর্তির উপাদান হিসেবে আমি কয়েকটি সূত্র উপস্থাপিত করেছিলাম। সেই আলোচনা আমি অবিকল তুলে দিচ্ছি। পাঠক বিবেচনা করবেন ১৪ বছর আগে আমার মূল্যায়ন যথাযথ ছিল কিনা !
“মমতার উত্থানের ইতিহাস চমকপ্রদ। কংগ্রেস ছেড়ে যখন এলেন তখন নিতান্ত সাধারণ। বড় মাপের কোন নেতার পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষ কংগ্রেসও। প্রতিপক্ষ বুদ্ধিজীবীরা। লাগাতার আন্দোলনে নামলেন। সে আন্দোলনের পথ শোভন ছিল না সব সময়। কখনও কখনও তুঙ্গে উঠেছে নাটকীয়তা। বামফ্রন্টের মৃত্যুঘন্টা বাজানো, গলায় দড়ি দেওয়া, এসবের মধ্যে নাটকীয় উপাদান প্রচুর। হেসেছেন প্রতিপক্ষ। আমার বিশ্বাস মমতা নিজেও এসবের কার্যকারিতায় সন্দিহান ছিলেন। তবু করেছেন। যেকোনভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসা। আর ছিল অবিমৃশ্যকারিতা। যেমন মহাকরণ অভিযান। যেমন বন্ধু নির্বাচনে দোলাচলতা। একবার বিজেপি, একবার কংগ্রেস। অবিমৃশ্যকারিতা সমালোচিত হতে লাগল। আর এই সমালোচনার মধ্য দিয়ে রাজনীতির জগতে একটা নাম হয়ে উঠতে লাগলেন মমতা।
“যা বললাম তা ভঙ্গি দিয়ে চোখ ভোলানোর চেষ্টা। একান্ত কৃত্রিম। কিন্তু নিছক কৃত্রিমতা দিয়ে ক্যারিশমা বা ভাবমূর্তি তৈরি করা যায় না। ব্যক্তিত্বের কিছু অপরিহার্য উপাদান প্রয়োজন। তথাকথিত বংশগৌরবহীন, প্রাতিষ্ঠানিক সিলমোহরহীন মমতার ব্যক্তিত্বের সেই উপাদানগুলির দিকে চোখ ফেরানো যাক।
“প্রথমত, মমতা সহজিয়া। অর্থাৎ নেতাসুলভ তথাকথিত গুণাবলি তাঁর নেই। চেহেরায়, চলনে-বলনে একেবারে ঘরোয়া মধ্যবিত্ত নারী। চাপা হাসি মাপা কথার মানুষ নন। নিজেকে আড়াল করে রাখার প্রচেষ্টা নেই। রাগ হলে সেই রাগটা সহজে প্রকাশ করেন। সভায় বক্তৃতা করতে করতে কর্মী-সমর্থকদের ধমকে ওঠেন, কোন নতুন অতিথি এলে বক্তৃতা থামিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করে আবার বক্তৃতা। রাস্তায় কনভয় থামিয়ে মোটর সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়া মানুষটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। নেতার এই সহজিয়া ঘরোয়া ভঙ্গি এক নতুন ঘরানা। সিপিএম নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙারের মধ্যে এর কিছুটা আভাস ছিল। কিন্তু মমতা এই ভঙ্গি সযত্নে লালন করেন। বিবাহাদি করেন নি। কিন্তু ব্যাচিলারসুলভ রুক্ষতা নেই।
“দ্বিতীয়ত, পোশাক-পরিচ্ছদ। সরু পাড়, হালকা রঙের শাড়ি। পায়ে হাওয়াই চপ্পল। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগে কাগজ-পত্র, ওষুধ। পোশাক-পরিচ্ছদে তিনি কি গান্ধীকে অনুকরণ করেন? হতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে গান্ধী আর কোট-প্যাণ্ট পরেন নি। হাঁটুর উপর ধুতি। আদুল গা। ভারতের সাধারণ মানুষের একজন। কিন্তু সাধারণ হয়েও অসাধারণ। গান্ধী মহারাজ। মমতাও অত্যন্ত সচেতনভাবে তাঁর বাসস্থান ও পোশাক অপরিবর্তিত রাখেন।
“তৃতীয়ত, চলিষ্ণুতা। সকালে লালগড়, বিকালে বারাসাত, সন্ধ্যায় দিল্লি। এই দলীয় কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা, এই আরামবাগের জনসভা, এই রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি। শুধু ধাও, শুধু ধাও, শুধু বেগে ধাও। অবিরাম পথ পরিক্রমায় নারীর কিছু বাধা আছে। মমতা সে সব গ্রাহ্য করেন নি। ধীর-স্থিরভাবে হাঁটতে পারেন না। এই চলমানতা প্রাণশক্তির প্রকাশক।
“চতুর্থত, স্মৃতিশক্তি। রাস্তার নাম, স্থাননাম, কর্মীর নাম, আধিকারিকদের নাম অবলীলাক্রমে বলে যান। ব্যক্তি পরিচয়ের বন্ধনে মানুষকে বেঁধে ফেলা।
“পঞ্চমত, বক্তৃতায় নতুন ঘরানা। সে বক্তৃতা বিদগ্ধজনের পছন্দ হবে না। সে তো বক্তৃতা নয়, আলাপ, শ্রোতার সঙ্গে কথোপকথন, ডাইনে-বাঁয়ে ঘোরা, কখনও শাড়ির আঁচল মুখে বুলিয়ে নেওয়া, সব মিলিয়ে বক্তৃতার বিষয়টাকে শরীরী করে তোলা।
“ষষ্ঠত, সাহস কিংবা দুঃসাহস। হঠাৎ বড় বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ। যেমন মহাকরণ থেকে নবান্নে যাওয়া, অর্থভাণ্ডারের কথা না ভেবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, সবুজ সাথী, স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্প চালু করা।”
আমার এক সাংবাদিক বন্ধু অনিকেত চট্টোপাধ্যায় বলেছেন যে মমতার স্তাবকতা করা সহজ, সমালোচনা করাও সহজ, কিন্তু মমতা হয়ে ওঠা সহজ নয়। আর সহজ নয় বলেই মমতার অবর্তমানে তাঁর দলের অবস্থা হবে ‘হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা’র মতো।