ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাশ ও আইন হওয়ার পরই হিংসার জেরে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন গ্রাম থেকে কয়েকশো মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। স্থানীয়রা বলছেন সংখ্যাটি হাজারেরও বেশি। পাশাপাশি এও বলা হচ্ছে, ঘরছাড়ারা কেবল নিজের জেলার অন্যত্র নয়, অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে মালদায় পালিয়ে গিয়েছিলেন, কেউ পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডে গিয়েও আশ্রয় নিয়েছিলেন। গত ৪৮ ঘণ্টায় মুর্শিদাবাদে নতুন করে কোনও হিংসার ঘটনা না ঘটলেও ঘরছাড়া অনেকেরই অভিযোগ, সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদের নামে লুঠপাট চলেছে। অনেকেরই বাড়ি থেকে টাকা, গয়না লুট করা হয়েছে। অভিযোগ, গবাদি পশুও বাদ যায়নি। সামসেরগঞ্জে হরগোপিন্দ দাস এবং তাঁর ছেলে চন্দন দাসকে ছুরির আঘাতে খুন করা হয়েছে। দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বীরভূম থেকে, অপরজন বাংলাদেশ সীমান্তের কাছ থেকে গ্রেফতার হয়েছে বলে খবর।
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাই জানিয়েছেন, হিংসার জেরে মুর্শিদাবাদ থেকে কয়েকশো মানুষ ভাগীরথী নদী পেরিয়ে মালদায় আশ্রয় নেন। মানুষ পালাতে শুরু করে মুর্শিদাবাদের সুতি, ধুলিয়ান, জঙ্গিপুর এবং শামশেরগঞ্জের মতো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ক্ষোভ ব্যাপক হিংসায় পরিণত হওয়ার পর। সংবাদ মাধ্যমে আমরা মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকার পোড়া দোকান, হোটেল এবং বাড়িঘরের ছবি দেখেছি। ধুলিয়ানের মন্দিরপাড়ার সাংবাদিকের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। অত্যাচার থেকে বাদ যাননি মহিলা ও শিশুরাও। এই অশান্তি এবং অত্যাচার চালালো কারা? স্পষ্ট জানা গিয়েছে, বাইরের কিছু লোক স্থানীয় কয়েকজনের সাহায্যে হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীদের হাতে পায় ধরেও নিস্তার পায়নি নিরিহ মানুষ, হামলাকারীদের কাছে অস্ত্র থাকায় ভয়ে ঘরদোর ফেলে পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
এই হিংসার কারণ কি? গত ৮ এপ্রিল, ২০২৫ ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন কার্যকর হওয়ার পর ওই আইনের বিরুদ্ধে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ শুরু হয়, পরবর্তীতে যা দ্রুত হিংসায় রূপ নেয়। শামশেরগঞ্জের জাফরাবাদে ছুরিকাঘাতে দুটি মৃতদেহ উদ্ধারের পর শতাধিক জনকে গ্রেফতার এবং জেলার বহু এলাকায় নিষেধাজ্ঞা ও ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়। হিংসার জেরে তুঙ্গে ওঠে রাজনৈতিক উত্তেজনা। সাংসদ খলিলুর রহমান (তৃণমূল কংগ্রেস) বলেন, এই হিংসা ঘটিয়েছে বাইরের লোক, কিন্তু তারা কারা সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারেন নি। অন্যদিকে বিজেপি নেতারা ঘটনার জন্য তৃণমূলকে পুরোপুরি দায়ী করেছে। এই অবস্থায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই আইন বাংলায় কার্যকর হবে না বলে ঘোষণা করেন। রাজ্য সরকারের ব্যবস্থাকে অপর্যাপ্ত বলে কলকাতা হাইকোর্ট মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেয়।
পুলিশ দুদিন আগেই দাবি করে, ওয়াকফ প্রতিবাদের জেরে মুর্শিদাবাদে যে হিংসা তা এখন নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পুলিশের এই দাবির পরেই দক্ষিণ ২৪ পরগণার ভাঙ্গরে ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ ঘিরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। সেখানেও পুলিশের গাড়ি জ্বালানো হয়, পুলিশ লাঠি চালায়। কিন্তু সবথেকে বড় প্রশ্ন, মুর্শিদাবাদ কিংবা ভাঙর ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদের ঘটনা কীভাবে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে পরিণত হল? কাদের ভয়ে গ্রামের মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য জেলা কিংবা রাজ্যে পালাতে বাধ্য হল। পুলিশ প্রশাসন, রাজনৈতিক দলের লোকজন বলছেন, বাইরের লোক, এখানেও প্রশ্ন অন্য জেলা বা রাজ্য থেকে কত লোক ঢুকে পড়লো যে তাদের কেউ বাধা দিতে পারলো না, কাদের ইন্ধনে তারা শয়ে শয়ে লোককে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করলো? স্বাধীনতা পরবর্তী এই রাজ্যে যেকটি সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশই শহর বা শহারাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা খুবই বিরল। কারণ গ্রামে ধর্মের ভেদ, পারস্পরিক বিরোধিতা এমনকি সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব থাকলেও নিজেদের জীবন জীবিকার কারণেই গ্রামাঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ সহজে ঘটেনা। কিন্তু কয়েকদিন আগে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গায় যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে তা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে গ্রামাঞ্চলে মানুষের পারস্পরিক ঐক্যবদ্ধতায় একটা ফাটল ধরেছে।
কিন্তু কীভাবে রাজ্যের এই জেলায় গ্রামাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং জীবন ও জীবীকার কারণে বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা সম্প্রীতি ও একতায় এতবড় চিড় ধরলো সেটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। কারা কিভাবে মানুষের মধ্যে বিভেদের বিষ ঢেলেছে সেটা পুলিশ-গোয়েন্দা তদন্ত করে খুঁজে বের করবে হয়তো, রাজনৈতিক চর্চা যারা করেন তারাও অনুসন্ধান করবেন নিশ্চয় কিন্তু এই রাজ্যে ওয়াকফ বিরোধীতা থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বা দাঙ্গার ঘটনা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। ওয়াকফের বিরোধীতা তো কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে কিন্তু সেখান থেকে সাম্প্রদায়িক হিংসায় রূপ নেওয়াটা কেবল নিন্দনীয় নয়, অত্যন্ত ভয়ের। একদিকে যেভাবে রাজনৈতিক তর্ক খুব দ্রুত হিন্দু-মুসলমান নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করে চলছে, পাশাপাশি ধর্মীয় মেরুকরণের একটা চেষ্টা তো প্রবল ভাবেই শুরু হয়ে গিয়েছে তাতে বুঝতে অসুবিধা হয়না ধর্মীয় বিদ্বেষের প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েই আছে। সেখানে একটু কেবল ছিটেফোঁটা আগুন এসে পড়লেই জ্বলে উঠবে।