বোলপুর শহর আজ থেকে দেড়শো বছর আগেও ছিল ধূ-ধূ প্রান্তর, রুক্ষ মরুভূমির মত ছিল তার চেহারা। লাল মাটির এই প্রান্তরকে নতুন জীবনদান করেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রায়পুরের সিংহবাড়ির কাছ থেকে নামমাত্র অর্থে জমি কিনে সেই জমিতে ব্রাহ্ম উপাসনার জন্য শান্তিনিকেতন গৃহ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই বোলপুর শহরকে এক নতুন রূপ দিয়েছিলেন তিনি। আর তাকেই পূর্ণাঙ্গ অবয়ব প্রদান করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথমে ব্রহ্মচর্যাশ্রম এবং পরে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করলেন রবীন্দ্রনাথ। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে মেটামরফোসিস হতে হতে আজকের কলেবর ধারণ করল বোলপুর।
বিশ্বভারতীর আমোদগেঁড়ে গবেষকগণ কোনওদিন বোলপুর নামটির ব্যুৎপত্তি বা Etymology নির্ণয় করার চেষ্টা করেননি। সকলেই একবাক্যে বলেন, বোলপুরের উল্লেখ রয়েছে প্রাচীন পুরাণে। পুরাণমতে রাজা সুরথ অর্থাৎ যিনি সমাধি বৈশ্যর সাথে মর্ত্যে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন ঘটান, তাঁর রাজ্যের রাজধানী ছিল বোলপুরসংলগ্ন সুপুর এলাকায়। সেখানেই কোনও এক বছর কয়েক লক্ষ ছাগবলি দেওয়া হয় দুর্গাপুজোর অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে। সেই বলির রক্তে ভেসে গেল চতুর্দিক। একটি বিশেষ স্থানে বাঁধ দিয়ে সেই রক্তস্রোত আটকানো হল। এই বলি থেকেই সংলগ্ন অঞ্চলের নাম হয় বলিপুর তথা অধুনা বোলপুর, আর যে স্থানে ওই বাঁধ নির্মিত হয়েছিল, তাই হল আজকের বাঁধগোড়া।
কিন্তু একটু খোঁজখবর নিলে বিশ্বভারতীর এই গবেষকগণ জানতে পারতেন, তাঁদের শান্তিনিকেতনেই কবিগুরু ওপার বাংলার পতিসর থেকে এনে বসিয়েছিলেন কুঠিবাড়ির কেরানি সংস্কৃতবেত্তা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। দীর্ঘ ছত্রিশ বছরের প্রচেষ্টায় তিনি লিখেছিলেন বাংলাভাষার অমূল্য অভিধান ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’।
বঙ্গীয় শব্দকোষ অভিধানে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বোল’ শব্দটি ফারসি থেকে বাংলায় এসেছে। বা আরবি মোর থেকে মোল হয়ে বোল। এর অর্থ গন্ধরস। [‘‘ইহা আরবের একজাতীয় গাছের আঠা। — হিন্দীশব্দসাগর]। সংস্কৃত ব্যুৎপত্তির কথাও বলা হয়েছে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান ও সুবলচন্দ্র মিত্রর আদর্শ বাঙ্গালা অভিধানে।
প্রাচীনকালে সুগন্ধি প্রস্তুতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গন্ধরসের ব্যবহার ছিল। যিশুখ্রিস্টকে তিনজন জ্ঞানী ব্যক্তি যে তিনটি উপহার দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি ছিল গন্ধরস।দেবীমাহাত্ম্য বইয়ে আছে, ‘বলং গন্ধরসে রূপে ম্বামিনি স্থৌল্য রূপয়োঃ সৈন্যয়ো” রিতি মেদিনী।’ বোলপুরের ছিল অসংখ্য মন্দির। এখনও আছে। মন্দিরের দেবদেবীর পূজায় নিত্য লাগত গন্ধরস। ফলে গন্ধরসের একটি মোকাম হয়ে উঠেছিল বোলপুর। বাইরে থেকে আমদানিকৃত গন্ধরস ব্যবসায়ীরা মন্দিরে মন্দিরে জোগান দিতেন। গন্ধরস বা বোল-এর মোকামটি আস্তে আস্তে বোলপুর বলে পরিচিত হল।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মুঘল আমল বা তারও আগে থেকে লাক্ষা (লাহা) তথা গালা শিল্পের জন্য দূরদূরান্তে বোলপুরের নাম ছড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় নীল চাষের খ্যাতি। ভারতবর্ষে বিদেশি শাসকদের অনুপ্রবেশের কিছু পরেই তাদের নজর পড়ে এই এলাকার উপরেও। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স দুই দেশের শাসকই ব্যবসার প্রয়োজনে বোলপুরে আসেন। ১৭৮২ সালে বোলপুরে আসেন ইংরেজ ব্যবসায়ী জন চিপ। যার নামে আজও বোলপুরের উপকণ্ঠেই রয়েছে চিপকুঠি। ওই অঞ্চলেই তখন কাছাকাছি দু’টি কুঠিবাড়ি নির্মাণ করা হয়, যার একটি থেকে চিপ সাহেব অন্যটি থেকে ফরাসি ব্যবসায়ী মনলি সিনর ব্যবসা পরিচালনা করতেন। পরবর্তীকালে এই মনলির কুঠি বিশ্বভারতী অধিগ্রহণ করে নেয়।
ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনেরও বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শহরের সঙ্গে। বঙ্গভঙ্গের সময় বিলেতি জিনিস বয়কট ও স্বদেশি আন্দোলনের পক্ষে প্রচার চালিয়ে একের পর এক জেলার কংগ্রেস নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গান্ধীজি প্রথম বোলপুরে পা রাখেন। তাতেই জোয়ার লাগে সেই আন্দোলনে। এখানকার ছাত্র আন্দোলন থেকেই দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন তিনি। তাঁর আহ্বানে হেতমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজ ও বেণীমাধব স্কুলের ছাত্ররা রাস্তায় নামে। ঢেউ লাগে শান্তিনিকেতনের ছাত্রমহলেও।
এরপর ধীরে ধীরে গঞ্জ থেকে শহরের রূপ নিতে থাকে বোলপুর। বীরভূম জেলার প্রথম রেল স্টেশন নির্মিত হয় এখানেই, আর তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠতে থাকে জনবসতি, অফিস-কাছারি ও অন্যান্য পরিষেবা। আর এই উন্নয়নের পথে প্রবল গতির সঞ্চার করে বিশ্বভারতী। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা না হলে আজ যে পরিচিতি ও সুযোগ-সুবিধা বোলপুর পাচ্ছে, তা কি পেত? বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করেই দেশ-বিদেশের পড়ুয়াদের বোলপুরে আগমন এবং পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকদের আগমন এখানে। বোলপুরের জনপ্রিয়তার পিছনে বিশ্বভারতীর অবদান এ থেকেই বুঝতে পারা যায়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, বিশ্বভারতীকে নিজের মতো করে বিকশিত হওয়ার সম্যক সুযোগ বোলপুর শহরই দিয়েছে। তাই বোলপুর ও শান্তিনিকেতন যেন সমার্থক।
বোলপুরের নামের সঙ্গে নরবলি বা পশুবলির ব্যাপারটি কবে থেকে জড়িয়ে দেওয়া হল, এটি কার উর্বর মস্তিষ্কের ফসল, তা জানি না। তবে বোল মানে যেমন গন্ধরস হয়, বোল মানে আমের বউলও হয়। বোয়াল মাছের কথ্যরূপও বোল। কোনও কিছুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না করে বোলপুরের এটিমোলজিতে বলিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হল কেন, তা জানার অধিকার আমাদের আছে। আমার মনে হয় শান্তিনিকেতন থেকে একান্নপীঠের অন্যতম বোলপুরের নিকটবর্তী কঙ্কালীতলায় প্রমোদভ্রমণে যাওয়া পণ্ডিতরাই এই বলি-রহস্যের নেপথ্যে। তাঁদের কলকাঠিতেই বোলপুরের ব্যুৎপত্তিতে বলিদানের বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে। লাক্ষাশিল্প কিংবা গন্ধরসব্যবসার রমরমার কথা গৌণ হয়ে পড়েছে।