বিয়ের পর অন্তরার দিনগুলো যেন প্রজাপতির ডানায় ভর করে উড়ে যাচ্ছে। এত রঙচঙে রঙিন তবুও ধরে রাখা যায় না। এম.এ পাশ করার পর অন্তরাকে যখন ওর বাবা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কি রে, এবার সরকারী চাকরির পরীক্ষার জন্য তৈরী হবি নাকি পিএইচডি করবি?” মুহূর্তকাল না ভেবেই ও জবাব দিয়েছিল, “অনেক হয়েছে বাবা, আর কিচ্ছু নয়। এখন শুধু খাব আর ঘুমোবো।” মেয়ের কথা শুনে ওর মা বলেছিলেন, “বেশ, তবে গানের রেওয়াজ বন্ধ করা চলবে না।” তারপর ওর বাবার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “এবার মেয়ের জন্য পাত্র দেখ। তবে হ্যাঁ, এমন পাত্র চাই যার পরিবারের সাথে ও এমনভাবেই থাকতে পারবে।” অন্তরার বাবা সেই কথা রেখেছেন। বিয়ের পর ওকে এক গ্লাস জলও গড়িয়ে খেতে হয় না। শ্বশুর-শাশুড়ীর নয়নের মণি অন্তরা।
নিত্যনতুন সাজগোজ, বেড়ানো, পার্টি, শপিং এত আনন্দের মাঝে অন্তরার আজকাল কেন যেন মনে হয় জীবনে কোথাও একটা বড়ো ফাঁক থেকে গেছে। জীবনের সুর যেন তালে মিলছে না। শ্বশুর মলয়বাবুকে দেখলে একথাটা যেন বড় বেশি করে মনে হয়।
মানস অফিস বেরোনোর আগে ব্রেকফাস্ট করার সময় শিখাদেবী নিজে ছেলের তদারকি করেন। অন্তরা পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। মানস একদিন অন্তরাকে বলেছিল, “একসাথেই বসে পড়ো।” ছেলের কথা শিখাদেবী সঙ্গে সঙ্গেই নাকচ করে দিয়ে বলেন, “ও তো আর অফিস যাবে না! তোর সাথে তাড়াহুড়ো করে খাওয়ার কোনো দরকার নেই। আমাদের সাথে ধীরেসুস্থে খাবে।”
মনে মনে বলেন, এ যে রান্নাঘরের রাজনীতি। অন্তরা দেখে রোজই একঘেয়ে সাহেবী ঘরানার ব্রেকফাস্টে এরা অভ্যস্ত। একটু মুখ বদলানোর জন্য একদিন বলে, “জলখাবারের মেনুতে মাঝেমধ্যে লুচি বা কচুরী আলুরদম হতে পারে না?” মানস যেন আঁতকে ওঠে, “উফফ্ ওই তেল, ঘিয়ের ক্যালোরি ঠাসা খাবার! একদম না।” শিখাদেবী ছেলের কথা কানেও নেন না। অন্তরাকে বলেন, “তোমার সংসার, তোমার ইচ্ছে খাটবে না তা কি হয়! তবে রান্নার মাসী তো এসব করতে পারবে না। ওকে যেমনটা বলা আছে তার বাইরে ও কিছুই করতে চায় না। তাই এসব করতে হলে তোমাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। দেখ যদি একা সবকিছু সামলাতে পার।” আর কথা বাড়ান না শিখাদেবী। ভালো করেই জানেন বৌমা আর এগোতে সাহস পাবে না। তিনি বিচক্ষণ মানুষ। তাই সংসারটি বৌমার হাতে তুলে দিয়ে শুধুমাত্র চাবিকাঠিটি নিজের কাছে রেখে দেন।
রোজকার মতো সেদিনও জলখাবারের পাট চুকলে শিখাদেবী স্নান সেরে ঠাকুরঘরে ঢুকেছেন। মলয়বাবু খবরের কাগজ নিয়ে সোজা নিজের ঘরে। অন্তরা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রান্নার মাসীর সাথে খানিক বকবক করার পর নিজের ঘরে আসার সময় কি ভেবে শ্বশুরের ঘরে উঁকি দেয়। দরজার সামনে আসতেই কানে আসে মিউজিক প্লেয়ারে খুব আস্তে আস্তে বাজছে, “আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনই লীলা তব”। ও দাঁড়িয়ে পড়ে। গান শেষ হয়। ওর চোখে জল। এখন ও বুঝতে পারে মায়ের ধরে বেঁধে শেখানো রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেওয়াজের মধ্যেই ওর জীবনের ছন্দ বাঁধা ছিল। অনুভব করে আজ এত বৈভবের মাঝেও ও কেন তালহীন। ধীর পায়ে ঘরে ঢোকে অন্তরা। বলে, “বাবা, ভলিয়ুমটা একটু জোরে দিলেই তো আমরা সবাই শুনতে পারি।” মলয়বাবু খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর বলেন, “তোমার শাশুড়ী আর স্বামীর রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ নয়।” শুনে অন্তরার কেমনযেন একটা রোখ চেপে যায়। বলে, “আপনি তো পছন্দ করেন। আমিও করি। মানস ইংরাজী গানের ভক্ত। অফিস থেকে ফিরে ঘরে রোজ ওর পছন্দসই গান চালায়। আমার ভালো না লাগলেও শুনতে বাধ্য হই। মা গুরুদেবের স্মরণে প্রতিমাসে একদিন করে হরিনাম সংকীর্তনের আসর বসান। এটাও তো ওনার ভালোলাগার জন্যই। তাহলে সকালবেলায় সবাই যখন নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে তখন না হয় আমার আপনার ভালোলাগার রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজুক।” মলয়বাবু অবাক হয়ে অন্তরার চাপা তেজের আলো দেখতে থাকেন। বড় ভালো লাগে। ওকে কাছে ডাকেন। মাথায় হাত রেখে বলেন, “তুই চেষ্টা করে দ্যাখ্।”
পরদিন সকালে শিখাদেবী ছেলের ব্রেকফাস্টের তদারকি করছেন এমন সময় কানে আসে রবীন্দ্রনাথের গান, “বিপুল তরঙ্গ রে…” মা-ছেলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। আওয়াজটা আসছে মলয়বাবুর ঘর থেকে। অন্তরা ভলিয়ুমটা এমনভাবে দিয়েছে যাতে উচ্চকিত না হয় অথচ বাড়ির সবার কানে পৌঁছয়।
শিখাদেবী গজগজ করতে শুরু করেন, “সকালবেলায় কোথায় ঠাকুরের নামগান করবে তা নয়, ওই প্যানপ্যানানি গান চালিয়ে বাড়িশুদ্ধু লোককে ঝালাপালা করে দিল!”
অন্তরা এসে শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে আব্দারের সুরে বলে, “মা, তোমার মুখে তো রাতদিন ঠাকুরের নামগান শুনি, মাসে একবার অষ্টপ্রহর ধরে হরিনাম শুনি, রোজ মানসের পছন্দের ইংরেজী গান শুনি। এখন থেকে আমার আর বাবার পছন্দের রবিঠাকুরের গানও তোমাদের শুনতে হবে। বেশীক্ষণ নয়, রোজ সকালের এই সময়টুকু।” বৌমার আব্দার শিখাদেবী ফেলতে পারেন না। সকালের ব্যস্ত সময়টুকু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দখলে চলে যায়।
সময় গড়ায়। অন্তরার কোলে এসেছে ফুটফুটে খুকু। খুকুর মুখে বুলি ফুটতে না ফুটতেই শিখাদেবী শুরু করেন, “অন্তরা, মনে রেখো, খুকু তোমার মতো বাংলা ইস্কুলে যাবে না। ও পড়বে ইংরেজী ইস্কুলে। এবার থেকে ওই প্যানপ্যানানির বদলে বরং ছোটদের ইংরেজী গান চালালে খুকুরই ভালো হবে।” মানসও মাঝেমাঝেই বলে, “মায়ের কথাটা ফেলনা নয়। শুনে চললে মেয়েরই ভালো হবে।” অন্তরা মুখে কিছু বলে না। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। খুকুও একটু বড় হতেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি নিজের বিরক্তি প্রকাশ করতে থাকে। অন্তরা ওসবে পাত্তা দেয় না। মেয়েকে বলে, “তুই তো পড়াশোনা করে একদিন মস্ত চাকরি করবি। হয়তো বাইরে কোথাও চলে যাবি। আমার বাঁচার জন্য এই অভ্যাসটুকু আমাকে ছাড়তে বলিস না।
বিশ্বমানের আইটি ফার্মের চেন্নাইয়ের শাখা অফিসে কর্মরত আধ্যা। মাসতিনেক হল এখানে জয়েন করেছে। চিরকাল ডাকাবুকো ধরণের হলেও এই প্রথম নিজের বাড়ির বাইরে এসে নিজেকে একটু গুটিয়েই রাখে ও। সহকর্মীদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট একমাত্র বাঙালী আধ্যাকে কিছুটা মজা করেই সবাই কলকাতার রসগুল্লা বলে ডাকে। ও রেগে গেলেও মুখে প্রকাশ করে না। মনে মনে ভাবে, দক্ষিণী সম্বর, বড়া, দোসার চেয়ে রসগোল্লার স্বাদ যে কত মধুর তা ইণ্ডিরিপিণ্ডিরি ভাষার লোকজন বুঝবে কি করে! আসলে দক্ষিণ ভারতের বেশিরভাগ আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে আধ্যার একইরকম মনে হয়। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না। তাই এসব ভাষাকে ও একান্তে ইণ্ডিরিপিণ্ডিরি ভাষা বলে।
এখানে আসার পর ও এই অফিসে সাড়ম্বরে বড়দিন পালন হতে দেখেছে। শুনেছে বছরের বিভিন্ন দিনে গুটিকয়েক উৎসব একইসাথে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা এই ফার্মের প্রতিটি শাখায় পালিত হয়।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারী। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আধ্যার অফিসের সেমিনার হলে সব কর্মী উপস্থিত। ইংরাজী মাধ্যমে পড়াশোনা করা আধ্যার মাতৃভাষা নিয়ে কোনওকালেই মাথাব্যথা ছিল না, আজও নেই। বাংলাভাষাটা না বলতে পারলেই ও বাঁচে। নেহাৎই দায়ে পড়ে এমন অনুষ্ঠানে ওর আসা। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। সহকর্মীরা যে যার নিজস্ব মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখছে। গান, কবিতা, আবৃত্তি ইত্যাদি পরিবেশন করছে। হিন্দী আর ইংরাজী ভাষার অনুষ্ঠানগুলো ছাড়া সবকিছুই ওর একঘেয়ে মনে হতে থাকে। এদিকওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারে বেশিরভাগেরই অবস্থা ওরই মতোন। যে যার মতো গল্প করছে, কেউ বা ফোনে ব্যস্ত।
অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। সঞ্চালক সবাইকে শুভেচ্ছা, ধন্যবাদ জানাতে ব্যস্ত। দর্শকরাও সীট ছাড়ছে। হঠাৎই আধ্যার বুকের ভেতরটা কেমনযেন তোলপাড় করে ওঠে। ও ছুটে গিয়ে স্টেজের ওপর উঠে সঞ্চালকের হাত থেকে মাইকটা কেড়ে নেয়। ওর এমন আচরণে সবাই হতভম্ব। ও তখন যেন অন্য মানুষ। নিজের খেয়ালে খোলা গলায় গেয়ে ওঠে, “মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে”। ওর গান শুনে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে। গানের ছন্দে তাল মিলিয়ে সহকর্মীরা তালি দিতে থাকে। গান শেষ হলে হাততালিতে হল ফেটে পড়ে। সমস্বরে আওয়াজ ওঠে, “আধ্যা, আধ্যা।”
আজ ওর মনে হয় মাতৃভাষা মায়ের মতোই, বড়ই আপন। নিজের পছন্দ, অপছন্দ, বিরক্তি সবটুকু মায়ের ওপর উগরে দিলেও মা যেমন সবসময় ভালোবাসায় আগলে রাখে ঠিক তেমনই বোধহয় এই বাংলাভাষা। তা না হলে কোনোদিন না শেখা, মন দিয়ে না শোনা গানটা এমন অনায়াসে সে গাইল কি করে!
ফোনের ওপার থেকে খুকুর কাঁপা কাঁপা গলা, “জান মা, রবীন্দ্রসঙ্গীত বড্ডো ভালো। আমি এখন শুধুমাত্র কলকাতার রসগুল্লা নই, আমি আধ্যা।”
অন্তরা মেয়ের এইসব কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না পারলেও অনুভব করে নিজের সত্তার শিকড় মেয়ের মনেও ছড়িয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে মেয়েকে বলে, “যা কিছু আপন তা চেতনা জুড়ে থাকে। তার লয়, ক্ষয় নেই। চেষ্টা করেও তাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই রে।”
ফোনটা নামিয়ে রাখে অন্তরা। বিকেলের মরা আলোটা হঠাৎই যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। দূরে কোথাও কোকিল ডাকছে। চারদিক আজ বড়ই ছন্দোময়।।
খুব সুন্দর গল্প🍁☘️
অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।