আয়েষা দুদিন ইস্কুল যায় চারদিন যেতে পারে না। মাঝেমধ্যেই তার জ্বর, গলাব্যথা, সর্দিকাশি। ইস্কুল না যেতে পারলে তার দুঃখ হয় বটে তবে জ্বর আসার সময়টাও তার খুব ভালো লাগে। জ্বরটা কেমন বন্ধুর মত এসে তার হাত ধরে। মাথার মধ্যে বুড়বুড়ি কাটে। স্বপ্ন দেখায়। রঙিন সব স্বপ্ন! স্বপ্নেরা চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে, ঠিক সেই সময়টাই মা শালু হয়তো বলে উঠল,
— আশু শুয়ে আছিস কেন এই অবেলায়।
— বুখার আসছে আম্মী।
— ফির সে বুখার! খাবি কুছু। একবাটি মুড়ি দিই। গরম গরম চায় পী লে। বুখার ভাগ যাবে।
— না আম্মী, এখন কিছু খেতে ভালো লাগছে না।
— মর গে যা তব!
মায়ের হাঁকাহাঁকিতে স্বপ্নগুলোও কোথায় পালায় যে তখন! বড় ভীতু, লাজুক ওরা! আয়েষার মত ওরাও হয়তো মাকে ভয় পায়।
আয়েষা আবার অনেকক্ষণ চোখ বুঁজে পড়ে থাকে। চোখদুটো জ্বালা জ্বালা করে। ছোট্ট টোপা টোপা গালগুলো আস্তে আস্তে লালচে গরম হয়ে ওঠে। পায়ের নিচে রাখা কাঁথাটা টেনে নিয়ে আবার ভাবতে শুরু করে পালিয়ে যাওয়া স্বপ্নটা কোথায় শেষ হয়েছিল!
ও মনে পড়েছে, মনে পড়েছে! তার বইয়ে ‘এ’র এক্কাগাড়িটা তখন ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছিল। আয়েষাকে নিল না। বদমাশ ড্রাইভারটা বলল, “তোর কাছে পয়সা নেই, তোকে কোথায় নিয়ে যাব?” আয়েষা তেঁতুলতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে খুব কাঁদল। খুব কাঁদল।
অমন বিচ্ছিরি স্বপ্ন আর কক্ষনো দেখতে চায় না আয়েষা। বাবা জিনপরীদের গল্প বলেছিল না একবার! তাদের স্বপ্ন দেখব এবার। সুন্দর গোলাপী ড্রেস পরা পরী এসে যাদুকাঠি ঘুরিয়ে দিয়ে গেল আয়েষার মাথার ওপর। ব্যস ছুঁ মন্তরে আয়েষাদের ভাঙাচোরা ঘর মস্ত বড় হাভেলী হয়ে গেল। তাদের লাশকাটা গলিতে আর কোনো বদবু নেই। চেল্লামেল্লি-মারপিট নেই। সবকিছু কেমন ঝকঝকে তকতকে! ঐ স্বপ্নটাও পুরোটা দেখা হয়ে ওঠেনি আয়েশার। জ্বরের অতলে তলিয়ে গিয়েছিল সেদিন। ঘুম ভেঙে উঠে বাবাকে দেখতে পেয়ে আব্দার করেছিল বাপসোহাগী মেয়ে, “বাপু, আমাকে একটা ঐ পরীদের মত গোলাপী ড্রেস কিনে দেবে?”
বাবা হরিরাম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, “হ্যাঁ বেটা,তোমার জ্বর পালিয়ে যাক। চুস্ত হয়ে যাও। নিশ্চয়ই কিনে দেব”।
আয়েষা সেই স্বপ্নের ছবিগুলোই দেওয়ালে আঁকে। তাদের নোনা ধরা ছোট্ট দেওয়ালে পরী ওড়ে। প্রজাপতি নেচে বেড়ায়। ফুল হাসে। চাঁদতারা আঁকা মসজিদের রূপোলী ফোটো আর বজরঙ্গবলীর ক্যালেন্ডারের সঙ্গে তারা দিব্যি রয়ে যায়।
জ্বর কমলে আয়েষা আবার পিঠে ব্যাগ নিয়ে ইস্কুল যায়। সরস্বতী শিশু বিদ্যা মন্দিরে ঢুকতেই দেখা যায় বীণাবাদিনীর ছবি টাঙানো রয়েছে
দেওয়ালের ঐ উঁচুতে। ছবিটা ঠিক স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় না ছোট্ট আয়েষার কাছে। তবুও ছবির সামনে হাতজোড় করে লাইনে দাঁড়িয়ে আয়েষারা গায়, “জয়তু জয় জয় দেবী সরস্বতী”। প্রথম প্রথম আয়েষা শুধু ঠোঁট নাড়ত, এখন শুনতে শুনতে সবটা শিখে গেছে।
ইলা দিদিমণি বলেছে, “মা সরস্বতী হচ্ছে বিদ্যার দেবী। তাই তো আমরা ইস্কুল শুরু হবার আগে সরস্বতীর প্রার্থনা করি। তিনি আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি দেন। তোমরাও বাড়িতে লেখাপড়া করার আগে মনে মনে মা’কে প্রণাম করবে। বইতে কক্ষনো পা ঠেকাবে না”।
দিদিমণির কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আয়েষা। বই খুলে পড়তে বসার আগে মাথায় ঠেকায়। বড় যত্নে বইপত্র গুছিয়ে রাখে।
মেয়ের লেখাপড়ায় মনোযোগ দেখে হরিরাম শালুকে বলে, “দেখছিস শালু, আমরা আনপড় হলে কি হবে। বিটিয়া আমাদের পঢ়াই করবে। বড় হবে। তখন আমরা আর এইসব মুর্দা ঘরের এই গন্দা কাম করব না।”
শালু মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, “আসমান কা তারা গিনতে থাকো তুমি। আশু স্রেফ সাত সাল কি! আভী সে খোয়াব মৎ দেখো। বাইরে শেয়াল কুকুরের দল ওঁত পেতে বসে থাকে। বিটিয়া বড় হচ্ছে। ঐ সব হারামজাদাদের থেকে তোমার মেয়েকে আগে বাঁচিও।”
বাপু আর কিছু বলে না। চুপচাপ শুয়ে পড়ে। আয়েষা বুঝতে পারে, যেদিন বাপু বেশি মদ খায়, সেদিন আর বেশি কথা বলতে পারে না।
এক চিলতে ঘরে ছোট্ট জানলা দিয়ে হাওয়ার সঙ্গে মর্গের দুর্গন্ধ ঢুকে পড়ে। আম্মী রেগে গিয়ে জানলাটা জোরে বন্ধ করে দেয়। আয়েষা আম্মী আর বাপুর মাঝখানে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়।
আজকাল ভোরবেলা আয়েশার স্বপ্নে প্রায়ই আলোর সিঁড়ি বেয়ে তিনি আসেন। ইস্কুলের বড় ঘরে তাঁকে রাখা হয়েছিল যে! কাগজের শিকলি আর আল্পনার মাঝখানে কি সুন্দর করে তিনি বসে ছিলেন! গলায় গাঁদা ফুলের মালা। এক ঢাল ঢেউ খেলানো চুল! পায়ের তলায় আবার একটা হাঁস। আয়েষা সেদিন পেটপুরে খিচুড়ি প্রসাদ খেয়েছিল।
স্বপ্নে তিনি এলেই আয়েষাদের বদবুওলা মহল্লায়, একফালি উঠোনে ধূপধুনোর গন্ধ। চারিদিকে পূর্ণিমার মত ফটফটে জ্যোৎস্না। কি সুন্দর মিষ্টি সুরে অজানা এক বাজনা বাজে। ধবধবে সাদা শাড়ি পরা দেবীটি মুচকি মুচকি হাসেন। আয়েষা তাড়াতাড়ি তাঁর নরম সুন্দর পায়ে প্রণাম করে ইস্কুলে শেখা প্রার্থনা গায়, জয়তু জয় জয় দেবী সরস্বতী। এক একদিন দুষ্টু লম্বাগলা রাজহাঁসটা ঠাকুরের চারপাশে ঘুরতে থাকে। আয়েষাকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। আয়েষা বেচারী দূর থেকে কপালে আঙুল ঠেকিয়ে নমস্কার করে। তারপর বর্ণপরিচয় খুলে বসে।
ইস্কুলের বড় ঘরে সরস্বতী দর্শন করে আসার পরেও এক আধবার জ্বর হয়েছে আয়েষার। জ্বরের স্বপ্নে সরস্বতী অবিকল ইলা দিদিমণি হয়ে যায়। টানটান শাড়ি পরা, বিনুনিবাঁধা সরস্বতী তখন ব্ল্যাকবোর্ডে এ বি সি ডি লেখে। এবারের জ্বরটা অনেকদিন ভোগালো আয়েষাকে। জ্বরের ঘোরে আয়েষা প্রতিদিন মা সরস্বতীকে দেখেছে। আলোয় আলোময় হয়ে তিনি সাত বছরের বালিকার হৃদয় হরণ করে নিয়েছেন।
জ্বর ভালো হতেই আয়েষা ব্যাগ কাঁধে ইস্কুল যাবার জন্যে রেডি। মা শালু চেঁচাল —
— চানটান করে বস্তা কাঁধে তুই এখন কোথায় যাবি?
— কোথায় আবার যাব? ইস্কুল।
— ইস্কুল যে তোর বন্ধ হয়ে গেছে রে ছোকরি!
আয়েষার ছোট্ট মাথায় তখন বজ্রাঘাত। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে হাতপা ছুঁড়ে কেঁদেই যায়। কেঁদেই যায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মা’কে প্রশ্ন করে,
— কেন আম্মী? কেন?
শালুর সে উত্তর জানা নেই। সেও রেগেমেগে বলল, —
— নৌটঙ্কি করিস না আশু। উঠ। আমি কি করে জানব, তোর ইস্কুল কেন বন্ধ হল?
হাঁউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আয়েষা আবার বলে, —
— তুমি কেন কিছু জানো না! আমি এখন কি করে লেখাপড়া করব? সরস্বতী ঠাকুর কোথায় আসবে?
আয়েষার ছোট্ট শরীরটা কান্নার দমকে যেন ভেঙেচুরে যায়! কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের আবার জ্বর। জ্বরের ঘোরের প্রলাপে এবার খোদ সরস্বতীর কাছেই তার যত অভিযোগ আর অভিমান, “কোথায় চলে গেলে সরস্বতী মাঈয়া! তুমি ছাড়া কে পড়াবে আমাদের! ফিরে এসো আমাদের ইস্কুলে। ছেড়ে চলে যেও না। আমি খুব মন দিয়ে এবার পড়াশোনা করব, দেখো”।
জলপটি, পাখার বাতাস, গরম চায়েতেও সে জ্বর কমেনা। ভুল বকা বাড়তেই থাকে। অগত্যা পদ্মপুকুরতলার ডাগদরবাবু ভরসা। সবকথা জেনে শুনে তিনি বললেন, “এ জ্বর সর্দিকাশি, গলাব্যথার নয়। ইস্কুল বন্ধ হয়ে মেয়ে তোমার মনে বড় আঘাত পেয়েছে। আমি ওষুধ দিচ্ছি। তবে তুমি যেমন করে হোক, মেয়ের মন ভালো রাখার চেষ্টা করো। চিন্তা কোরো না। ও ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”
আদরের মেয়ে আশুকে ভালো করতে বাবা হরিরাম চিন্তায় আকাশ পাতাল এক করে ফেলছে। তার কামকাজে মন নেই। দারুতেও আর মৌতাত আসেনা!
বছর ঘুরে বসন্ত পঞ্চমী তিথি আবার ফিরে এল। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছোটো বড় সাইজের হংসবাহিনীরা অপেক্ষায়। বাজারে ফলমূল আক্রা। ফুলের দোকানে গাঁদাফুলের ঢের।
হরিরাম কি ভেবে বাজার থেকে একটি ছোট্ট একছাঁচের সুন্দর সরস্বতী মূর্তি কিনল। সঙ্গে কিছু ফলমূল, গাঁদাফুলের মালা। দুটো পয়সা বেশি খরচ করে মেয়ের জন্য ছোট্ট একটা বাসন্তীরঙা শাড়িও।
ঘরে পৌঁছে মেয়েকে সে সব দেখাতেই জ্বরেভোগা দুর্বল মেয়ে লাফিয়ে উঠল,
— বাপু, বাপু, আমাদের ঘরে মা সরস্বতীর পুজো হবে? আমরা পুজো করব?
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বাপ বলে,
— হ্যাঁ বেটু। তোমার টানে মা এখানে এসেছে। তুমি তাড়াতাড়ি উঠে ভগবানকে দিয়া দেখাও। তোমার জন্যে নতুন পীলা কাপড়া এনেছি। একবারটি পরো।
এই প্রথম লাশকাটা গলিতে বীণাপাণির অধিষ্ঠান। হরিরাম আর শালু তাদের এক চিলতে বারান্দা যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সরস্বতীর মূর্তিকে বসালো। ফলমূল কেটে থালায় সাজানো হল। ততক্ষণে বস্তির কচিকাঁচারা ভীড় করেছে হরিরামের দোরে। আয়েষা বাসন্তীরঙা শাড়িতে সেজে প্রদীপ জ্বেলে আরতি করছে। গাইছে, “জয়তু জয় জয় দেবী সরস্বতী”। ছেলেপুলের দল গলা মিলিয়েছে।
হরিরাম দেখল প্রদীপের আলোয় মেয়ের মুখ জ্বলজ্বলে। সরস্বতীর মুখের হাসিটাও কি একটু চওড়া লাগছে!
খুশিতে ডগমগ হয়ে আয়েষা বাপকে বলল, “বাপু দেখেছ, সরস্বতী মাঈয়া ঠিক যেন আমাদের ইলা দিদিমণির মত সুন্দর!”