মহাকুম্ভের প্রথম দুর্ঘটনা আগুন, বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড ঘটে ১৯ জানুয়ারি। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত মঙ্গলবার পদপিষ্ট হয়ে কমপক্ষে ৩০ জনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনা সেখানেই থামে না, বৃহস্পতিবারও কুম্ভ প্রাঙ্গনের সেক্টর ২২-এ আগুন লেগে ১৫টি তাঁবু পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। কুম্ভমেলা আর দুর্ঘটনা যেন অবিচ্ছেদ্য কারণ, ১৯৫৪ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম কুম্ভেই ঘটেছিল মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। নদীর জলে ডুবে এবং পদপিষ্ট হয়ে সেবার প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ৮০০ মানুষ! ১৯৮৬ তেও হরিদ্বার কুম্ভে ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর ২০০৩ সালেও নাসিকের গোদাবরী নদীর তীরে বসা কুম্ভ মেলায় ভিড় আর ঠেলাঠেলিতে অন্তত ৩৯ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালে এলাহাবাদের কুম্ভমেলায় (মেলা চত্বরে নয়) রেলব্রিজ ভেঙে পড়ে মৃত্যু ঘটেছিল ৪২ জনের। এক যুগ পর ফের কুম্ভে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটল।
উল্লেখ্য, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এবং তাঁর সরকারের মন্ত্রী ও আধিকারিকেরা মেলা শুরুর কয়েক মাস আগে থেকেই বারবারই বলেছিলেন, প্রয়াগরাজে প্রবল ভিড়ে পদপিষ্ট হওয়ার সম্ভবনা থাকলেও ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস ক্রাউড ম্যানেজমেন্ট’ আয়োজন করেছেন যাতে কোটি কোটি পুণ্যার্থী নিশ্ছিদ্র সুরক্ষার আওতায় থেকবেন। কিন্তু মঙ্গলবার গভীর রাতে মৌনী অমাবস্যার শাহি স্নানের শুরুতেই প্রবল ভিড় সামলাতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন। যদিও ভিড় নিয়ন্ত্র কিভাবে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটলো? জানা যাচ্ছে, মঙ্গলবার গভীর রাত থেকেই প্রয়াগরাজ ডিভিশনাল কমিশনারের দফতরের এক কর্তা মাইক নিয়ে ভক্তদের দ্রুত পুণ্যস্নানের আবেদন জানাচ্ছিলেন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সেদিন মাঝ রাতে আট কোটিরও বেশি মানুষ কুম্ভমেলায় হাজির হয়েছিলেন। মাইকে প্রশাসনের আবেদন শুনেই বিরাট সংখ্যক মানুষ হইহই করে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গমের দিকে এগিয়ে যেতেই ঘটে বিপত্তি। মঙ্গলবার রাতে কেবল একসঙ্গে বহু মানুষ নয়, অনেকে মাথায় ভারী মালপত্র নিয়েও স্নান করতে এগিয়েছিলেন। নদীর তীরে রাখা ছিল লোহার বহু ডাস্টবিন, রাতের অন্ধকারে সেগুলি ভাল দেখা না যাওয়াতে ধাক্কা খেয়ে বহু মানুষ মাথায় থাকা মালপত্র সহ মাটিতে পড়ে যান।
মাটিতে পড়ে যাওয়া মানুষের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আরও অনেকে পড়ে যান। তাঁদের মাড়িয়েই এগোতে থাকেন অন্যেরা। এছাড়াও ভিড়ের চাপে একের পর এক ব্যারিকেড ভেঙে পড়ে। এই অব্যবস্থাকে কোনো ভাবেই আর নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি পুলিশ। জানা গিয়েছে, সাধারণ দর্শর্থীদের জন্য গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গমে যাওয়ার মূল রাস্তাটি ছিল বন্ধ ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের ধস্তাধস্তি আর চাপে বহু মানুষ দমবন্ধ হয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকেন, ধাক্কাধাক্কি করে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন, পড়ে যাওয়া মানুষের গায়ের উপর দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন, অনেকেই ব্যারিকেড টপকানোর চেষ্টাও করেন। সব মিলিয়ে প্রবল ধাক্কাধাক্কি আর ধস্তাধস্তি চলতে থাকে, পিছন থেকে আরও ভিড়ের চাপ আসে। স্বভাবতই সেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। যদি ধরে নেওয়া যায় যে প্রশাসনের তরফে ভিড় এড়াতে করার মাইকে তাড়াতাড়ি স্নান সারার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তাহলে স্নানে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ রাখা হল কেন? উদ্দেশ্য যাই থাক তার ফল হয় উল্টো। অতীতে কুম্ভমেলায় পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা বহু বার ঘটলেও ভিড় নিয়ন্ত্রণে রাখার আগাম ব্যবস্থায় বা দুর্ঘটনা ঘটলে সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য যোগী সরকারের জে কোনো সঠিক পরিকল্পনা’ ছিল না তা স্পষ্ট।
কুম্ভ মেলা নতুন নয়, যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। দেশের যে কোনো মেলার থেকে কুম্ভমেলা অনেক অনেক বড়। তবে এর আগে কুম্ভ নিয়ে যত চর্চা হয়েছে এবারের সঙ্গে তার তুলনা হয় না। এবার চর্চাতে যেমন তেমনি মাতামাতিও চরমে পৌঁছেছে। দেশজুড়ে কয়েক মাস ধরে কোটি কোটি টাকা খরচ করে মহাকুম্ভের প্রচার চালিয়েছে যোগী সরকার। সরকার সহ সমগ্র গেরুয়া বাহিনী সামাজিক মাধ্যমে প্রচার চালিয়েছে- এবার নাকি ২০ থেকে ৩০ কোটি মানুষ মেলায় আসবে। কিন্তু আয়োজক বা প্রচারকেরা একবারও যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে ভেবে দেখেননি প্রয়াগের মেলা প্রাঙ্গনে ২০/৩০ কোটি মানুষের জায়গা দেওয়া এবং সুস্থ ভাবে ফেরত পাঠানো কিভাবে সম্ভব? যে প্রাঙ্গন দুই থেকে চার কোটি মানুষের ভিড়ে বিপর্যস্ত বা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে সেখানে ২০ কোটি মানুষের সমাবেশে তো এমনিতেই উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়বে। আসলে ভিড় বাড়ানোর প্রচার ছিল রাজনৈতিক স্বার্থে। প্রথমত কেন্দ্র ও রাজ্যে বিজেপি সরকারের আমলে এই প্রথম উত্তর প্রদেশে মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাই মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ আগেই জানিয়েছিলেন ৪০ কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ মহাকুম্ভে আসবেন। জে কারণে যোগী এবং মোদী কুম্ভের ধর্মীয় মাহাত্ম্য প্রচার করেছেন কয়েক মাস ধরে। যার মধ্যে ছিল ধর্মকে রাজনীতির আঙিনায় প্রতিষ্ঠিত করার সুকৌশলী প্রচেষ্টা। যার প্রধান অনুষঙ্গ ভোট রাজনীতির জমি উর্বর করা অথবা ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে গোটা দেশ থেকে মানুষ এনে হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম করে দেওয়া।
অথচ উত্তর প্রদেশ রাজ্য প্রশাসন বা মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, নিহত ও আহতের সংখ্যা জানাতে তারা অনিচ্ছুক। কারণ, ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা যাতে কোনোভাবেই তাঁর বিরুদ্ধে না যায়। মুখ্যমন্ত্রী যোগী নির্বাক থাকুন বা যাই বলুন না কেন দুর্ঘটনার পর যে প্রশ্নগুলি উঠেছে তার সদুত্তর মেলেনি। উত্তর প্রদেশ রাজ্য প্রশাসনের তরফে মহাকুম্ভ মেলায় দর্শনার্থীদের জন্য বেশ কয়েকটি অস্থায়ী সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল৷ কিন্তু অমৃতস্নানের আগের তিন দিন থেকে ওই সেতুগুলি বন্ধ রাখা হয়েছিল। কেন? মহাকুম্ভ মেলার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নজরে রাখার জন্য এআই ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছিল৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই সমস্ত ক্যামেরা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়৷ কেন? অত বড় মেলায় যাতায়াতের জন্য একটিমাত্র রাস্তা কেন? মহাকুমা শাসক জানিয়েছেন, অনুমতি ছাড়াই বহু তাঁবু তৈরি হয়েছিল, স্থানীয় প্রশাসনের নজর এড়িয়ে বেআইনি তাঁবু তৈরি হল কিভাবে? রাস্তার দুধারে যথেষ্ট জায়গা না ছেড়ে হাজার হাজার দোকান গড়ে উঠলো কাদের অনুমতিতে? দু’দুটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কিভাবে ঘটলো, কেন দমকল যথাসময়ে ঘটনাস্থালে পৌঁছাতে পারলো না? এরকম আরও বহু প্রশ্ন প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভের মেলার বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কে দেবে উত্তর!