তোমার কবিতা বিকেলবেলার সুর
তোমার কবিতা সকালের রোদ্দুর
তোমার কবিতা দুপুরের মিঠে হাওয়া
ছেলেবেলাকেই বারবার ফিরে পাওয়া।
***
তোমার কবিতা ছড়িয়ে দিয়েছে গান
বাংলার গ্রামে বাংলার নদীপথে
ছন্দদোলায় দুলেছে কিশোরবেলা
স্বপ্ন দেখেছি বৃষ্টিমুখর রাতে।
***
তোমার কবিতা শীতের শিশির যেন
মনের কিনারে প্রজাপতি ডানা মেলে
তোমার কবিতা আকাশের ক্যানভাসে
কত না রঙের কত না আবির খেলে।
***
তোমার কবিতা প্রকৃতির কথা লেখে
তোমার কবিতা জীবনের ধারাপাত
বাংলা ভাষার টাপুরটুপুর জলে
বাড়িয়ে দিয়েছে বন্ধুর দুটি হাত।
যাঁর কবিতা নিয়ে লিখতে বসে আমি লিখে ফেললাম মধ্যে এই পংক্তিগুলি,তাঁকে আমি চিনি খুব ছোটোবেলা থেকে। সূত্রটা একদিকে, রেডিও অন্যদিকে ছোটোদের পত্রিকা ‘তিতলি’। আকাশবাণীতে তাঁর লেখা পঠিত হত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, প্রচারিত হতো তাঁর লেখা নাটক, তাঁর লেখা গান। বাবা বলতেন তিনি ওই মানুষটাকে চেনেন। তাছাড়া বিভিন্ন ছোটদের পত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত পড়তাম। একটু অবাক হতাম, একজন মানুষ এত লিখতে পারেন কী করে। পরে তিনি আমারও বন্ধু হলেন। বয়সে সন্তানতুল্য আমি, কিন্তু সদা প্রাণোচ্ছল এই মানুষটিকে দাদা বলেই ভেবে গিয়েছি। জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই তিনি ভেবে গেছেন ছোটদের জন্য — এই জন্য তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে একটি ছোটোদের পত্রিকা সম্পাদনা করা মোটেও সহজ কথা নয়। শিশুদের ভালোবাসেন, শিশুমনকে আদর করতে জানেন। শিশুসাহিত্যে মগ্ন থেকে গবেষণাধর্মী কাজ করে চলেছেন।
বর্ধমান জেলা জামালপুর থানার ইসলামপুর গ্রামে তাঁর জন্ম ১৯৪৯-এ। বাবা পশুপতি ঘোষ, মা চণ্ডীবালা দেবী।নদিয়া জেলার ধুবুলিয়ায় তাঁর বসবাস। তাঁর বাড়ির নাম আমাদের সবাইকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে — ‘মেঘছায়া’ আর সেই মেঘের ছায়াতে বসেই শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ রচনা করে চলেছেন ছড়া, কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গান। অসংখ্য তাঁর বই। আকাশবাণীর একজন নিয়মিত নাট্যকার এবং গীতিকার তিনি। বেতার-নাটক লিখেছেন অনেকগুলি, তাঁর জন্য পেয়েছেন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড।সম্প্রচারিত নাটকের সংখ্যাও কম নয়। অজয় দাস, কল্যাণ সেন বরাট প্রমুখ খ্যাতিমান সুরকার গানের সুর করেছেন তাঁর গানের কথায়। সেই গান গেয়েছেন বনশ্রী সেনগুপ্ত, শ্রীরাধা বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ। লিখেছেন অসংখ্য পত্রপত্রিকায়। তাঁর কবিতা আবৃত্তি করেছেন প্রখ্যাত বাচিকশিল্পীরা। গল্প লিখেছেন, পুরস্কার পেয়েছেন। কবিতা, প্রবন্ধের জন্যও সম্মাননা পেয়েছেন। ওপার বাংলা থেকেও এসেছে সম্মান।
ছোটোদর জন্য লেখা তাঁর কবিতা আলোচনা প্রসঙ্গে হাতে তুলে নিলাম ‘আমার বাংলা’ গ্রন্থটি। কবির ভিতর লুকিয়ে আছে বাংলার শত গ্রাম। তিনি ঘুরেছেন দামোদর তীরবর্তী জনপদ থেকে ভাগীরথী, জলঙ্গি, চূর্ণী, মাথাভাঙা, ইছামতী প্রভৃতি জনপদে। যেখানে গেছেন বাংলার গ্রাম যেন পায়ের নূপুর হয়ে বেজেছে আর সেই নূপুর যতই বেজেছে ততই তিনি খুঁজে পেয়েছেন লেখার উপকরণ। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বাংলার মাঠ-ঘাট, পথ, নদী, অরণ্য, পাহাড়, গাছ, ফুল-ফল, পশুপাখি, পতঙ্গ, কৃষক-শ্রমিক, মজুর-মাঝি-জেলে-ফেরিওয়ালা এবং আরো কত গ্রামীণ বিষয়। লেখায় ধরা পড়েছে গ্রামীণ মানুষের চাহিদা, প্রাপ্তি, সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগ, পরাজয়, সাফল্য-সংগ্রাম সবকিছু। তিনি যেখানে গেছেন আপন করে নিয়েছেন সেখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ। প্রাককথনে তিনি লিখেছেন, “আমার ভিতর সামু নামের যে ছোটো ছেলেটা আছে, লেখার টেবিলে বসে আমি তাকে খুঁজে বেড়াই। তার চোখ দিয়ে দেখি অপরূপা বাংলাকে। দেখে নীল-মাখানো আকাশ, গৈরিক বসন-পরা মাটি — পুবের দিগন্ত, পশ্চিমের জলাভূমি, উত্তরের কলুপুকুরের শ্মশান, দক্ষিণের মজা বিল। দেখি রাতের গা-ছমছম উঠোন — উঠোনে পাতা খেজুরপাতার পাটি — কালি-পড়া লন্ঠনের আলো — ঝিকমিক তারা-ঘেরা চাঁদ। সেই চাঁদের থেকে চরকাকাটা বুড়ি আমায় ডাকে।”
এই গ্রন্থে ৮৮টি কবিতা আছে। কবিতাগুলি ছোটদের পাশাপাশি বড়োদেরও আকর্ষণ করবে এটা স্বাভাবিক। গ্রন্থের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে নস্টালজিয়া। ছেলেবেলার ডাক, ভুবন ডাঙার কথা, সেই অমলের গ্রাম, মা-মাটির গল্প, পারুল গ্রামে নতুন বছর, ঝুম পাহাড়ের দেশ, ধুবুলিয়ার জ্যৈষ্ঠ-দুপুর, ইছামতী, ময়ূরাক্ষী, ভাইফোঁটার গল্প, রেলস্টেশনের ছেলে, ছেলেবেলার রবিন ঠাকুর, কিশোরবেলা, বৃষ্টি ভেজার ইচ্ছে, ফুলের গল্প, অজানা পাখির খোঁজে, সোনার কাঠি রুপোর কাঠি, আঁধারঝারি গ্রাম, আলোর দেশের নদী, ও আমার অনেক কিছু, ইচ্ছে, ফেরিওয়ালা, জোছনার জাল — কবিতাগুলি আমাদের নিয়ে যায় মায়াময় জগতে, বাংলার শীতলপাটি-বিছানো উঠোনে, বিস্ময়পুরে —হাতে তুলে দেয় ভোরের কুসুম, ছেলেবেলার ডাক শুনতে পাই, বাংলাদেশ হয়ে ওঠে নীরব বন্ধু —
বাংলা আমার সকালবেলার রোদের মতো সুদূরগামী,
হাওয়ায় দোলা কৃষ্ণচূড়ার ফুলের মতো লালবাদামি
ঢেউ-দোলানো নদীর মতো ছুটন্ত এক ডাকহরকরা,
বাংলা আমার দিঘির থেকে ভরিয়ে নেওয়া পিতল-ঘড়া।
‘আমার বাংলা’র পাতায় পাতায় খুঁজে পাই বৃষ্টি দিদিকে, খুঁজে পাই ডাকঘরের অমলকে। মা-মাটির গল্প শুনতে শুনতে হারানো গ্রামের খোঁজে ছুটে যাই — বুকের ক্যানভাসে এঁকে নিই ময়ূরাক্ষীর ছবি —
ও ময়ূরাক্ষী, এ বুকের ক্যানভাসে
তোর এ ছবিটা অবিকল নেব এঁকে?
সম্মতি যদি দিস তুই ইশারাতে
তোকে নেব এই বুকের গভীরে ডেকে।
মনের মধ্যে গ্রাম উঁকি দেয়। নবান্ন উৎসবে পৌঁছে যায় বিকেলপুর গ্রামে।ভুবনডাঙার পাশে গাছের ছায়ায় সুরের মায়ায় শান্তি হেসে-খেলে বেড়ায়, রাঙামাটি হয়ে যাচ্ছে, জঙ্গল-ভরা খোয়াই-এ কোনো এক বৈশাখে কবির সঙ্গে আমিও গিয়ে দাঁড়াই। কোপাই বইছে ধীরে, শান্ত উৎসব হচ্ছে সাঁওতাল বাড়ি ঘিরে, ছাতিম-গন্ধে মাতোয়ারা হয় সোনাঝুরি বট পাকুড়, সেখানে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কৃষ্ণচূড়ার ডালে কোকিল গাইছে তার সুরে গান পাতার অন্তরালে, ফুলের গন্ধে চমক লেগে মন মেতে ওঠে —
কৃষ্ণচূড়ার ডালে
কোকিল গাইছে তার সুরে গান পাতার অন্তরালে
‘ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে’
চলো যায় গিয়ে শরীর বিছাই ঘাসের আসন পেতে।
‘সূর্য ওঠার দেশ’ প্রকাশিত হয় ২০১২-তে। এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক প্রয়াত সুধীর চক্রবর্তী। তিনি লেখন, “নির্ভয়ে ঢুকে পড়া যেতে পারে ‘সূর্য ওঠার দেশে’ কবিতার প্রথম সিঁড়ির ধাপে পা রেখে একেবারে বহু চেনা কিন্তু চিরঅচেনা কবিতার দেশে যেখানে নাকি ভর্তি হওয়া যায় সূর্যের ইসকুলে এবং যেখানে মানুষের মুখ আঁকার করণ-কৌশল শেখা যায় রামধনুর সাতরঙের বর্ণমালায়। এক আঁচড়ে দক্ষ কবি বুঝিয়ে দেন ‘সূর্য ওঠার দেশে’ পৌঁছানোর অলৌকিক ছাড়পত্র তাঁর কাছেই মজুত, তিনি নিজেও একজন ব্যোমযাত্রী এবং এতটাই সাহস আর প্রত্যয় যে আমাদের মতো ঘরকুনো সব ভীতুদের ধরে বেঁধে নিয়ে যেতে পারেন সেই অলীক অভিযানে।… শ্যামাপ্রসাদের কবিমন আর পরিশীলিত কবিভাষা বয়ে যাবে সূর্য ওঠার দেশকে ছুঁয়ে মাটি পৃথিবীর গহন টানে এমন আশীর্বাদ থাকল এই অগ্রপথিকের।”
নাম-কবিতায় পেলাম —
“তুমি বলেছিলে নিয়ে যাবে সেই সূর্য ওঠার দেশে
যেখানে আলোরা খেলা করে সব পাখিদের ভালোবেসে।
যেখানে পাখির ডানা —
স্বপ্ন আনতে রোজ ছুঁয়ে আসে আকাশের সামিয়ানা।”
সবুজ শস্যক্ষেতে আমিও বসে থাকি চিঠি হাতে করে, কারণ তুমি বলেছিলে সূর্য ওঠর দেশে নিয়ে যাবে। আমিও তো চেয়েছি সূর্য উঠার দেশ থেকে আগুন ঝরিয়ে নেব, ফেরার সময় দু-চোখে আমার ফাগুন ভরিয়ে নেব, নিঝুম উঠোনে সন্ধে নামলে প্রদীপ ধরিয়ে নেব, হিমে-কাঁপা সব পথশিশুদের চাদর জড়িয়ে দেব। তাঁর কবিতার হাত ধরে আমরা আকাশের মাঝখান দেখতে পাই। আকাশ-ধাঁধার মজা উপলব্ধি করতে পারি। বুঝতে পারি, —
“আসলে আমার আকাশ-ধাঁধার মজাখানা হলো এই
যে যেখানে আছে আকাশের মাঝ রয়ে গেছে সেখানেই।”
কলকাতার শিশু পৌঁছে যেতে চায় গ্রামের পথে। সে দেখতে চাই গ্রামের আকাশ, নদীর কূল, ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়তে চায় মাঠে, গায়ে-লাগা ধুলো শিশির জলে ধুয়ে নিতে চায় সে, বসতে চায় বকুল গাছের তলায় বাঁশের মাচায়, দেখতে চায় শালি কীভাবে ডানা নাচায়, দেখতে চায় গ্রামের মা-মাসিরা কেমন করে ঘোমটা তুলে জল নেয় টিউকলে, দাওয়ায় আসন পেতে বসে কলাপাতায় ভাত খেতে চায়। একটি শিশুর মনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেন কবি।
তাঁর কাব্য জুড়ে গাছেদের কথা আছে, কাব্যে দেখা হয়ে যায় নদীর সঙ্গে, ফুল ফোটে চিত্রকরের মনে, দেশের জন্য শিরায় শিরায় আবেগের হাওয়া বয়, বুকের মধ্যে বইতে থাকে দেশপ্রেমের নদী। তাঁর কবিতায় লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো তৈরি করে নাটকীয় দৃশ্য। ছবির পরে ছবি সাজিয়ে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র। ‘একটা বোকা ছেলে’, ‘রুদ্রপ্রসাদ ধর’, ‘অনামিকার চিঠি’ পড়তে পড়তে গল্পের ভিতরে ডুব দিই আমরা পাশাপাশি ‘তাহাদের কথা’ উঠে আসে তাঁর লেখায় — যারা প্রতিদিন সুখ ভাগ করে নেয়, দুঃখকে যারা রচনা করতে জানে, যারা প্রতিদিন স্নেহ, মায়া ব্যয় করে। বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল কবি। বাংলা ভাষাকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা। বাংলা ভাষা তাঁর কাছে ভোরবেলাকার স্বপ্নের মতো,সে নবান্নে সাজিয়ে তোলে বরণডালা —
“তোমার রঙেই রূপসী বাংলা, ঠাকুমার ঝুলি, নালক
আবোল তাবোল, আনন্দমঠ, হলদে পাখির পালক
তোমার রঙেই টুসু-ভাদুগান বাউল জারি ও সারি তোমারই জন্যে জীবন হয়েছে আরো বেশি দরকারি।”
বিভিন্ন ঋতু সেজে ওঠে তাঁর বর্ণমালায়। বিকেলে শর্ত আঁকে মেঘ দিয়ে ছবি, আবার হেমন্তে —
“মাঠে ধানগাছ ছেড়েছে সবুজ শাড়ি
সোনার মুকুটে মাথা হয়ে গেছে ভারি
মাটিতে বিছানা পাতবেই তাড়াতাড়ি।”
আর বসন্তে —
“অন্ধকারকে হলুদ মাখিয়ে
উজল করবে রাত
অশোক শিমুল পলাশ ছড়াবে
রবীন্দ্র-মৌতাত।”
এই পৃথিবীর অসুখ ভীষণ এখন। ভয়ে ভয়ে আছি সবাই। ছোটরাও দীর্ঘদিন ঘরবন্দি। অদৃশ্য এক ভাইরাস গিলে খাচ্ছে সময় আর এই মুহূর্তে তাঁর কবিতা যেন বলছে —
“তাইতো এনেছি রঙিন ওষুধ শিমুলের ডাল থেকে সেরে যাবে রোগ, হোলির এ রং এক্ষুণি নাও মেখে।”
ছড়াকে আবৃত্তিযোগ্য করার জন্য কবি আজকের শিশু-কিশোরের মনস্তত্ত্বটি বোঝার চেষ্টা করেছেন। জোর দিয়েছেন সংলাপধর্মীতা, কল্পনাপ্রবণতা ও মজা সৃষ্টির উপর। নাগরিক শিশু-কিশোরের সাথে গ্রামের সম্পর্ক খুবই কম — তাই, বেশিরভাগ ছড়ায় গ্রাম্যজীবনের চালচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। নজর রেখেছেন ছন্দ ও অন্তমিল বজায় রাখতে গিয়ে বাক্যবন্ধ ও শব্দবন্ধের সাবলীলতা যাতে নষ্ট না হয়। ছন্দ ও অন্তমিল যাতে পঠন প্রক্রিয়ার কোনো ক্ষতি না করে, তার উপরও নজর দিয়েছেন। শ্যামাপ্রসাদের ‘ছোটদের আবৃত্তিযোগ্য কবিতা’ (স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থ) পড়তে গিয়ে কথাগুলি মনে হবে। ভূমিকায় পবিত্র সরকার ছন্দেই লিখেছেন —
“ছোটোদের কথা, স্বপ্ন, সত্য,
ভালো-মন্দের সহজ তত্ত্ব,
আশা ও নিরাশা, দুঃখ ও সুখ —
যাতে স্পন্দিত ছোটোদের বুক।”
এই গ্রন্থে আছে পাখিদের আনাগোনা, পক্ষীরাজের কথা, বহুরূপী চাঁদ জলঙ্গী নদীর কথা, তেপান্তরের মাঠ, সুন্দরবনের গল্প, আজকের রূপকথা, পৌষপাবনের কাল, হলুদ- বনের পাখি, বাউল, জ্যৈষ্ঠের ঝড়, রবিবারের দুপুর, কু ঝিকঝিক ট্রেন, জাতীয় সড়ক।প্রিয় জলঙ্গী নদীকে নিয়ে কবি লেখেন —
“একটা নদী ভীষণভাবে গ্রামকে ভালোবাসে
গ্রাম দেখলেই থমকে দাঁড়ায়
বেড়ায় ঘুরে পাড়ায় পাড়ায়
ইন্দিবুড়ির উঠোন দেখে খিলখিলিয়ে হাসে, কিংবা নাসির মিঞার দোরে মুখ ঘুরিয়ে কাশে।
কালো রঙের এই নদীটির
নাম কি জানো কেউ?
নদীর নামটি জলাঙ্গী, তার
একটুও নেই ঢেউ।”
“গ্রাম ছড়ানো এক রাঙা-পথ অস্ত-রবির আলো/ বন্ধু আমায় বললে এসে — কেমন আছ, ভালো?/ আমি বললাম — ভালো থাকার মন্ত্র এলাম শিখে/ এই দেখো না রবি ঠাকুর নাম দিয়েছেন লিখে।”
‘রাঙা পথের গল্প’-এর প্রথম স্তবক এটি, বইয়ের নাম রবিনঠাকুর। আমার খুব ভালোলাগা গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবি লিখেছেন রবিনঠাকুর।২৮ টি কবিতার সংকলন। এই সংকলনে ছোটোদের জন্য অনেকগুলি কবিতা আছে। “রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব আসমানের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। আমাদের বঙ্গভূমির প্রাণের ঠাকুর। আমাদের ধমনী দিয়ে প্রবাহিত এক রক্তিম নদী। উপনিষদের সুগভীর প্রতিধ্বনি। গ্রামীণ বাউলের একতারা। আবছায়া প্রশান্ত পল্লির কীর্তন। জোড়াসাঁকো ছুঁয়ে-থাকা পতিতধারিণী গঙ্গার পবিত্র প্রবাহ। বইয়ের পাতায় ছন্দে-কথায় রবীন্দ্রনাথ ধরা পড়লেন ছোটোদের মনে —
“যখন নীলের গা চুঁইয়ে উপচে পড়ে রোদ,
যখন বাতাস শীতকে বলে: সকল দেনা শোধ, যখন ধূসর মাটি শুকিয়ে নরম খাঁটি
যখন নদীর বালির গায়ে মাখা রাত;
তাকিয়ে দেখো তোমায় ছুঁয়ে একটা কবির হাত…
জোড়াসাঁকো, শিলাইদহ, ভুবনডাঙার হাওয়া, পাড়ায় পাড়ায় যখন করে কেবল আসা-যাওয়া, যখন রাঙামাটি গানের সুরে খাঁটি
যখন ভোরে হাতছানি দেয় ছাতিম বকুল পাকুড় সেই কবিটা বলবে:জানো আমি রবিনঠাকুর।”
পাগল নদী বয়ে চলে আপন বেগে, মধুমাঝির নৌকাখানা তীরের গায়ে লাগে। মাঝিকে বলি মাঝি নৌকা ভিড়াও এপারটিতে। সবার মনকে ভরিয়ে দেবো রবীন্দ্র সংগীতে। মায়ের জন্য চাঁপা ফুলের গন্ধ চেয়ে নিতে ইচ্ছে করে রবি ঠাকুরের কাছে। গীতবিতান, সঞ্চয়িতা, ডাকঘর সূর্যের মতোই। রবীন্দ্রনাথ শিশুমনের পৃথিবীতে এনে দেন দুঃখ-ধোয়ানো আলো। পাখি, নদী, রবীন্দ্রনাথ এক হয়ে যান কবির ভাষায় —
“একটা পাখি উড়তে উড়তে পিছন ফিরে তাকাল ডানায় একটু বোশেখমাসের তপ্ত হাওয়া মাখাল পরেই আবার উড়ল
একটুখানি ডাইনে গিয়ে আবার বাঁয়ে ঘুরল বলল: নদী বলতে পারিস কোথায় ভুবনডাঙা? নদী বলল: ক্যামনে বলি, কন্ঠ যে আজ ভাঙা।
পাখি বলল: ভাঙা গলা সারাতে চাস না কি? তাহলে চল, ছাতিমবনের গানের হাওয়া মাখি। গাইতে গাইতে গলাটা তোর যখন হবে আলো আমার সাথে তুই গাইবি — ‘আলো আমার আলো।’
কবির ছায়া তোর জলেতে করবে যখন স্নান
তুই গাইবি — ‘সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ।’
***
এই না বলে, চলল পাখি শান্তিনিকেতনে
নদী চলল তার পিছনে অতি সঙ্গোপনে।
পথের সাথে পথ জুড়ে যায় দেখে বট আর পাকুড়
নদীর দুচোখ জুড়ে তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
সবার বুকেই তিনি আছেন। পৃথিবীর গ্রামে, শহরে তাঁর নামে বিকিকিনি চলে। তাঁর কথা বলে সাগর,পাহাড়,মেঘ বৃষ্টি,পাখি।চৈত্র ফুরালে কবিতা ও গানে মেতে ওঠে বৈশাখী। ছোটোদের মনকে বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আজও মনে হয় ছোটোদের জন্য রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছেন তা বড়োদের মনকেও ভাবিয়ে তোলে। তাঁর সৃষ্টিসম্ভারকে ছন্দের বন্ধনে বেঁধে ফেলে তৃপ্ত হই আমরা। তাঁর ভাষাকেই আশ্রয় করে লিখে ফেলতে পারি হাজার হাজার পঙক্তি —
“এবার আমায় জাগাও তুমি প্রিয়
ছোট্ট ঘরে আর কতকাল
ইচ্ছেটুকু রাখবো আড়াল
সামনে এসে একটু বাতাস দিও
এবার আমায় জাগাও তুমি প্রিয়।”
কবি সুবোধ সরকার তাঁর ‘একশো গানের কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন “বইটিতে বিভিন্ন ধরনের গান সংকলিত হয়েছে। কিন্তু যে মনের কবি মনের পরিচয় আমরা এই বই থেকে পাই, সেই মন খুব নরম এবং গভীর। বইটিতে তিমিরবিনাশী দেবীকে নিয়ে যেমন গান আছে, তেমনি ভ্রমরের ভ্রমণের আনন্দ নিয়েও গান আছে। পুরনো দিনের গানের মেজাজকে নতুন প্যাকেজে সাজিয়ে তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন নতুন গানের ডালি।” গানের সুরে শিশুমনের খুব কাছাকাছি পৌঁছানো যায়। ছোটদের ছড়ার গান আজ আর তেমন লেখা হয় কই! ছোটোদের ছোটবেলাটাই যে হারিয়ে যাচ্ছে। পুরোনো রেকর্ড আজও তো আমাদের মনে করাই ‘বড়ো হওয়া খুব ভুল’। শ্যামাপ্রসাদ ঘোষের গানের কথায় ছোটবেলার স্বপ্নগুলো ছড়িয়ে আছে — আছে দেশবন্দনা, পরিবেশকে ভালোবাসার বার্তা। ছড়ার গানে কান পাতলে শুনতে পাই —
“চাঁদের বুড়ি চরকা কাটে
ঝিলিক লাগা জ্যোৎস্না রাতের
আসমানে
রাতপরী তাই খোকার চোখে
ঘুম আনে।
ঘুম আনে।।”
গানের ভিতর কান পাতলে রূপকথার গল্প শোনা যায়, হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে রাজপুত্তুর ছোটে —
“তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে গহন বনের শেষে রাজারকুমার পৌঁছে গেল অচিনপুরের দেশে এমন সময় দেখল হঠাৎ বিরাট নদী
জল করে থৈথৈ
নদী বলে: আমি এখন তোমার বন্ধু হই।”
আকাশবাণীতে প্রচারিত দেশ বন্দনার গান ছোটোদের দেশকে ভালবাসতে শেখায় — ভারতবর্ষকে ঘিরে ছোট্ট শিশুর স্বপ্নের জগৎ রচিত হয় —
“উড়ন্ত পাখিদের ডানার ছন্দ দেখে
ভাসমান মেঘেদের রঙিন স্বপ্ন রেখে
যখন পথিক পথ চলে
তখনই তো দিকে দিকে নতুন শপথ লিখে স্বাধীনতা হেসে কথা বলে।”
পরিবেশের গান ভালোবাসতে শেখায় পরিবেশকে, সকলে একসঙ্গে গেয়ে উঠি —
“অরণ্যে ডালে ডালে পাখি গাক গান
অতল নদীর জল
করুক না টলমল
সবুজের লাবণ্যে ভরে যাক প্রাণ।”
ছোট্ট একটি পুস্তিকা ‘ছন্দে গাঁথা মদনমোহন’ খুব প্রয়োজনীয় একটি সৃষ্টি। নদিয়া জেলার কৃতী সন্তান, সাহিত্যিক মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবন ও সাহিত্যকে ছন্দে বেঁধেছেন কবি শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ। ছোটদের কাছে অতি সহজেই ছন্দ দোলায় পৌঁছে যাবেন মদনমোহন। যিনি একসময় ‘শিশু শিক্ষা’র মতো গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, স্পর্শ করেছিলেন শৈশবের মনের আঙিনা, ‘কাননে কুসুমকলি’ ফুটিয়ে তুলেছিলেন,সেই মদনমোহনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়েছে। বিল্বগ্রামের কথা উঠে এসেছে কবিতার পাতায়। মদনমোহনের জন্মকথা, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, রচনাবলীর কথাও কাব্যভাষায় নির্মাণ করেছেন শ্যামাপ্রসাদ-এ এক যথার্থ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
“স্কুল তো হলো কী শেখাবেন বই নাই তো কোনো বিদ্যাসাগর বললেন, ‘ভাই থামবো না কক্ষনো। শিশুশিক্ষার প্রথমপাঠ লিখে ফেলবে তুমি, দেখবে তোমায় মনে রাখবে তোমার জন্মভূমি।’ প্রাজ্ঞপুরুষ, দক্ষপুরুষ স-ভার নিলেন তুলে শিশুর পড়া শুরু হলো সমস্ত ইস্কুলে।
‘শিশুশিক্ষা’ দেখে বেথুন হলেন চমকিত বিদ্যাসাগর হলেন খুশি হলেন খুবই প্রীত।
কারণ ভাষা খুবই সরল, সহজ বাকরীতি অসাধারণ পদবিন্যাস মনে জাগায় প্রীতি।”
মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে নিয়ে সম্পূর্ণ পদ্যে এরকম একটি পুস্তিকা সত্যিই অভিনব।
শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ দীর্ঘদিন ধরে যেমন ছোটোদের জন্য গল্প, কবিতা, নাটক, গান, ছড়া লিখেছেন তেমনি তিনি দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করছেন ‘তিতলি’ পত্রিকা। প্রখ্যাত বহু শিশুসাহিত্যিক তাঁর সম্পাদিত এই পত্রিকায় বিভিন্ন সময় লিখেছেন,আজও লিখে চলেছেন। হয়েছে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ সংখ্যা।
শ্যামাপ্রসাদ ঘোষের সম্পাদনায় ১৯৯২ সাল থেকে ‘তিতলি’ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ধুবুলিয়া থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকা প্রকাশ করেছে লিমেরিক সংখ্যা, ছড়া সংখ্যা, বিভূতিভূষণ সংখ্যা, শৈলেন ঘোষ সংখ্যা, পবিত্র সরকার সংখ্যা। অসংখ্য ছড়া থাকে এই পত্রিকায়, থাকে সাক্ষাৎকার, শিশু সাহিত্যকেন্দ্রিক নানা প্রবন্ধ, ছোটদের নাটক।অন্নদাশঙ্কর রায়, সন্দীপ রায়, পবিত্র সরকার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, কার্তিক ঘোষ, অপূর্ব দত্ত, স্বপ্নময় চক্রবর্তী প্রমুখ বিশিষ্টশিশুসাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ পেয়েছে এই পত্রিকায়।
পাশাপাশি যে কথাটা বিশেষভাবে উল্লেখ্য, শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ দীর্ঘদিন ধরে শিশুসাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সম্প্রতি তাঁর লেখা শিশু সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা শিশুসাহিত্যের পরম্পরা, ধারা, ধারাবাহিকতা, বৈশিষ্ট্য, প্রকার-প্রকরণ, পত্রপত্রিকা এবং সেকালের বরেণ্য লেখক-লেখিকাদের বিশ্লেষণমূলক আলোচনা তাঁর ‘পঁচিশটি প্রবন্ধ বিষয় : শিশুসাহিত্য’ শীর্ষক গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। গ্রন্থটির প্রথম পর্বে ‘বাংলা শিশুসাহিত্য’ অংশে আছে রূপকথা, পুরাণ, অনুবাদ, শিশু সাহিত্য বিষয়ক পত্রপত্রিকার কথা, আছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের শিশুসাহিত্যের কথা, বিংশে শতাব্দীর পত্র-পত্রিকা, নদিয়ার শিশুসাহিত্যের শেষ একশো বছরের আলোচনা, আদি-সাহিত্য ছড়া ও তার গতিপ্রকৃতি,শিশুসাহিত্যের ছড়া ছড়ার শিশুসাহিত্য নিয়ে বিশ্লেষণ, রূপকথার সেকাল-একালের মধ্যে আছে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, লীলা মজুমদার, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবনীতা দেবসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শৈলেন ঘোষ, রতনতনু ঘাটী ও দীপান্বিতা রায়ের কথা। শিশুসাহিত্যের প্রকার ও প্রকরণও আলোচিত হয়েছে এই গ্রন্থে। পাশাপাশি দ্বিতীয় পর্বে ‘শিশু সাহিত্য ও শিশু সাহিত্যিক’ অংশে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ও ছোটদের অনুবাদ সাহিত্য, শিশু সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান, শিশুসাহিত্য দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আমার দেশ, শিশুসাহিত্য যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিখুশি প্রভৃতি বিষয়। শিশু সাহিত্যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, সুনির্মল বসু, লীলা মজুমদার, বিমল মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অবদান তুলে ধরেছেন সাবলীলভাবে। শৈলেন ঘোষ, শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র সরকার, সুনীতি মুখোপাধ্যায়, কার্তিক ঘোষ, ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, ওপার বাংলার তপন বাগচী প্রমুখের শিশুসাহিত্য নিয়ে আলোচিত হয়েছে এই প্রবন্ধ গ্রন্থে।
শ্যামাপ্রসাদ ঘোষের একেবারেই প্রথম দিকের বই ‘স্বপ্নের রামধনু’।এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন সবার প্রিয় শিশুসাহিত্যিক অপূর্ব দত্ত। ভূমিকায় অপূর্ব দত্ত লিখছেন — “শিশু মনের আনাচে কানাচে ঘুরে ছোটদের চোখ দিয়েই তিনি পরখ করে যান তাদের মনোজগৎ, যে জগতের কোনও পরিসীমা নেই, যে জগতৎ তাদের পরিচিত পথ-ঘাট,নদ-নদী,বাঁশঝাড়, চড়াই-বুলবুলি, রাংচিতার বেড়া আর নিকোনো উঠোন ছাড়িয়ে মিশে গেছে দূরান্তের চাঁদ-তারা-সূর্য ভরা আকাশের গায়ে। কখনো চূর্ণী নদীর পিঠে রেল ব্রিজের উপর দিয়ে যেতে যেতে ওমর ঝমর শব্দের মধ্যে জেগে ওঠে তাঁর শৈশব। কখনও বা আলুখেতের শিশিরভেজা আলপথের উপর দিয়ে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে তিনি ফিরে যান তাঁর কতকাল আগে ফেলে-আসা কিশোরবেলায়।” ফেলে-আসা গ্রামের কথা পড়লে মন কেমন করে। কবির মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করে —
“ফেলে আসা গ্রাম ফেলে আসা গ্রাম
তোর কথা মনে পড়ে,
কেমন আছিস, কীভাবে আছিস—-
জানতে ইচ্ছে করে।…
ফেলে আসা গ্রাম, ফেলে আসা গ্রাম
মন যে কেমন করে,
ফেলে আসা গ্রাম যদি ফিরে যাই
স্থান দিবি অন্তরে?”
ছড়ায় গ্রামজীবনের স্নিগ্ধ ছবি আসলে শ্যামাপ্রসাদের গ্রামকে ভালবাসার কথাই মনে করিয়ে দেয়। গ্রামের পরিবর্তনের ছবি দেখে আমাদের বুকেও ব্যথা লাগে ঠিকই কিন্তু গ্রামের পথ ক্রমশ পাল্টে যায়, ইলেকট্রিকের আলো এসে ঝলমল করে রাতের বেলা, হাসানডাঙা বিলের ওপারে হয়েছে নতুন ব্রিজ, বাড়িতে বাড়িতে এসে যায় টিভি, অনেকের বাড়িতেই ফ্রিজ,দাদু-ঠাকুমা সন্ধ্যায় সাক্ষরতা স্কুলে যায়, সাইকেল চেপে ছেলেরা যায় স্কুলে, বাজারে দোকান বসে নতুন নতুন, কালো চকচকে নতুন রাস্তা গ্রাম তাকে ছুঁয়ে যায় গ্রামটিকে, তৈরি হয় হেল্থ সেন্টার। তাই প্রিয় প্রীতিদিদিকে চিঠি লিখে জানাতে ইচ্ছে করে —
“প্রিয় প্রীতিদিদি তোমাকে এবার প্রথম লিখছি চিঠি,
আগামী ছুটিতে আমাদের গ্রামে ঘুরে যেও লক্ষ্মীটি
সেবার যখন এসেছিলে তুমি,হয়েছিল অসুবিধা এখন সে ভয় নেই একটুও তা বলতে নেই দ্বিধা।…
বদলে যাওয়া গ্রামের কথা লিখতে লিখতে শেষে আমিও যেন বলে ফেলি —
‘এবার যখন আসবে তখন এসব দেখতে পাবে, ইচ্ছে করলে ছবি-টবি তুলে কলকাতা নিয়ে যাবে।
পুরোটা না হয়,হাফ কলকাতা হয়ে গেছে এই গ্রাম
গেঁয়ো বলে আর করবে না কেউ আমাদের বদনাম।”
‘স্বপ্নের রামধনু’ গ্রন্থটি সত্যিই স্বপ্নের রামধনু হয়ে আমাদের মনে রং ছড়িয়ে দেয়। রামধনুর সাত রং তাদের শরীরে জড়িয়ে নিয়েছে পথ-মাঠ-নদী- বন।আমরাও মেখে নিয়েছি সেই রামধনুর রং। স্বপ্নে দেখা নদীর গল্প বলেন কবি। নদীর ধারে ধারে কত গ্রাম, নদীর গায়ে লেপ্টে-থাকা বেড়ার বাড়ির ফাঁকে হালকা আলো হাত বাড়িয়ে আমাকেও ডেকে নেয়।
বাগানের দিকের জানলা তুলি প্রতিদিন খুলে রাখে। দুপুর গড়ালেই সেখানে গন্ধের ফেরিওয়ালা এসে দাঁড়াই তুলির মন উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে —
ফেরিওয়ালা বলে: কী গন্ধ নেবে? বলো দেখি তাড়াতাড়ি
বেশি দাঁড়াবার জো নেইকো আজ যেতে হবে পাঁচবাড়ি।
কালকে নিয়েছো মাঠের গন্ধ, তার আগে নিয়েছো ফুলের,
তার আগে নিয়োছো গাছের, দূর আকাশের রাজকন্যার চুলের।
আজকে আমার ঝুলিতে অনেক নতুন গন্ধে ভরা,
নদীর, মাছের, জলের, ফলের — গন্ধ রয়েছে কড়া।”
সেই গন্ধের ফেরিওয়ালার কাছে তুলি তার নিজের গায়ের গন্ধ তুলে দেয়, আর বলে, “সেই গন্ধটা নিয়ে গিয়ে তুমি অন্য বাড়ির দোরে/ ‘ছোট্ট মেয়ের বন্ধ নেবে গো’ — ব’লে হাঁক দেবে জোরে।”
আর ছড়ায় গল্পওয়ালা গল্প শোনায় সুবর্ণরেখার, রূপসী যমুনাবতীর, রাজকুমারের গল্প বলে গল্পওয়ালা,গাঁয়ের মাঠের গল্প শুনি,শুনি বর্ষার সবুজ মাঠের গল্প হেমন্তে গ্রামের মাঠের রং বদলায়। আবার এই মাটি হয়ে ওঠে বিজলিগড়ের রাজকুমারের গল্পের শিরোনাম — ‘ডাকাতমারির মাঠ’। গল্প-ওয়ালার গল্প শুনতে শুনতে আমরাও শিহরিত হই —
“শোনা যায় নাকি বহুদিন আগে একদিন সেই মাঠে/ বিজলিগড়ের রাজারকুমার গিয়েছিল মাঝরাতে/ তারপর সে কী ভীষণ যুদ্ধ!দশ ডাকাতের সাথে/ ষোল বছরের কুমার সে দশ ডাকাতের মাথা কাটে/ সেই যুদ্ধের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রামে গ্রামে/ ধন্য ধন্য রব উঠেছিল রাজকুমারের নামে/রাজা বলেছিল: জ্বালাবে না আর দশখানা বজ্জাত/ তাই এ মাঠের নাম রাখলাম ডাকাতমারির মাঠ/ এইটুকু বলে থেমে গেল সেই বৃদ্ধ গল্প-ওলা/ তাড়াতাড়ি করে গুছিয়ে ফেলল তার অদ্ভুত ঝোলা/ ছেলেরা বলল, মেয়েরা বলল: আবার আসবে কবে?/ গল্প-ওয়ালা বলল : আসব, যেদিন ইচ্ছে হবে/ সেদিন বলব নদীর গল্প সুবর্ণরেখা নদীর/বলব গল্প — মাঝির কন্যা রূপসী যমুনাবতীর।”
আমরাও সেই গল্প-ওয়ালার গল্প শোনার অপেক্ষায় রইলাম।
ছোটোদের জন্য লেখা তাঁর উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় বই ‘ছোটোদের জন্য কবিতা’র কথা দিয়ে শেষ করব আমার এই লেখা। ছোটোদের জন্য কবিতায় শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ প্রথম থেকেই অন্যরকম। ২০০৩-এ প্রকাশিত এই গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন শিশুসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকারকে। শ্যামাপ্রসাদ ঘোষের প্রাককথন থেকেই বুঝতে পারি এই গ্রন্থ নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি ব্যয় করেছেন দীর্ঘ সময়। এই গ্রন্থের আগে তিনি লিখেছিলেন ছোটোদের গল্প সংকলন ‘কাশফুলের বালিশ’, ‘ছোটোদের আবৃত্তিযোগ্য কবিতা’। তিনি বুঝেছিলেন আজকের ছোটোদের জন্য ছড়া কবিতা লিখতে হলে, তাদের এখনকার মানসিক অবস্থানটা ভালো করে জানা দরকার। বোঝা দরকার তারা কী চায় — কিসে তাদের অতৃপ্তি, কিসে তাদের আনন্দ। “পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বদলাতে হবে ছড়া-কবিতা রচনার ভাব ও ভঙ্গি। সোজা কথায় ছড়া নির্মাণে আধুনিকতা চাই। সমসাময়িক বিষয় নির্বাচনে, শব্দচয়নে ও বলার ভঙ্গিতে আরো স্মার্ট হতে হবে, ছন্দ ও অন্তমিলে আনতে হবে বৈচিত্র্য, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একইভাবে বলে গেলে ছড়া-কবিতা একঘেয়ে বা ক্লান্তিকর হয়ে উঠতে পারে। এটা দূর করতে চাই নির্মাণ-বৈচিত্র্য। কল্পনাপ্রবণতা, সংলাপধর্মীতা, কৌতুকমুখিনতা প্রতিও দৃষ্টি দিতে হবে।” বইটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে কবি অনেকাংশে সফল হয়েছেন। কবির সঙ্গে আমিও স্বপ্ন কুড়োতে গিয়েছি, গ্রামের চিঠি পড়তে পড়তে আমিও কখন আত্মীয় হয়ে যায় ওদের, চাঁদ বুড়িটার জন্য আমারও মন খারাপ করে, ইটের শহর কলকাতাকে চিনতে পারি, শুনতে পাই এক শহরের কথকতা, দেখতে পাই বদলে যাওয়া ছেলেবেলাকে, শরতের আলোয় দুগ্গা নামের একটা মেয়েকে দেখতে পাই —
“শিউলি ঝরার শব্দ শুনে একটা খুকি জাগে; ঘুমিয়ে থাকা ভাই-এর আগে গায়ে তার সে জাগা লাগে।
সেই না লাগা দরজা খুলে
বেরিয়ে দেখি দুচোখ তুলে
দুগ্গা নামের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আগে।”
আমারও যে সকালটাকে চুরি করতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে করে —
“এই রোদ তোর
হলুদ রঙটা
দেনা আমায়
ভাই
না যদি দিস
করবো চুরি
সারা সকাল
টাই।
সকাল সকাল
নরম সকাল
তুই কি আমার
হবি?
আঁকার খাতায়
আঁকবো তোকে
রাখবো করে
ছবি।”
বিষয়-বৈচিত্র্যে ভরপুর শ্যামাপ্রসাদ ঘোষের ছোটোদের জন্য লেখা কবিতাগুলি আগামীতে ছোটোদের কাছে পৌঁছে যাক বেশি বেশি করে। ছোটোরা খুঁজে পাক স্বপ্ন — ভালবাসুক প্রকৃতিকে, প্রকৃতির সঙ্গে লগ্ন-থাকা মানুষকে — ছেলেবেলাকে প্রাণভরে উপভোগ করুক — নদী, ফুল, পাখি, আকাশ, প্রজাপতি, ঘাসফড়িঙের সঙ্গে গল্প করুক শৈশব।
‘কথাকৃতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত