পানিফল নামটা কানে শুনলেই শিঙওয়ালা, কালচে সবুজ এক অদ্ভুত দর্শন ফলের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। খোসাটা এতটাই মোটা, ছাড়াতে বেশ কষ্ট। কিন্তু টুক করে মুখে পুরে দিতে পারলেই আর দেখে কে! গ্রীষ্মের দুপুরে, বর্ষার প্যাচপ্যাচে প্রাণান্তর আবহাওয়ায় কিম্বা শীতে ঠান্ডা জল খাওয়ার ভয় থেকে বাঁচতে, কয়েক টুকরো রসালো পানিফল প্রাণ জুড়ে আনে ষোল আনা তৃপ্তি।
এক পানিফল, নাম তার বহু। বৈজ্ঞানিক নাম – Trapa natans, পরিবার – Lythraceae। যেমন ইংরেজিতে বলে ওয়াটার চেস্ট নাট (water chest nut), মহারাষ্ট্র গুজরাটে বলা হয় সিংগোড়া (singhara), হিন্দিতে সিংহারা, পাঞ্জাবি আর উর্দুতে পানিফল পরিচিত সিংঘারা নামে, কন্নড় ভাষায় একে বলা হয় জলফলম্, চীনে এর নাম চিথুএ (Chithue)
দক্ষিণ জার্মানিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে জানা গিয়েছে, সেখানে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ যখন দানাশস্য চাষ করতে ব্যর্থ হচ্ছিল তখন খাদ্য চাহিদা পূরণে নিত্যদিনের তালিকায় থাকতো পানিফল। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোলাইনা এবং ওয়াশিংটনে পানিফল উদ্ভিদকে অনেক সময় জলজ আগাছা হিসবে গণ্য করা হয়। বিগত প্রায় তিন হাজার বছর আগে চিন ও ভারতে পানিফলের অস্তিত্বের স্বপক্ষে মেলে বেশ কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণ। ইউরোপে উনবিংশ শতকে পানিফল ব্যাপক পরিমাণে পাওয়া গেলেও পরবর্তীকালে ভৌগোলিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ফলটি ইউরোপে ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে।
পানিফল মূলত ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলের ফল। ভারতে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, বিহার, পাঞ্জাব, রাজস্থানের উদয়পুর সংলগ্ন কিছু অংশে পানিফলের কম বেশি চাষ হয়ে থাকে। পানিফল হিউমাস সমৃদ্ধ উর্বর পলিমাটি যুক্ত বদ্ধ জলাশয়ে জন্মায়। শীতকালে পানিফল বীজক্ষেপণ পদ্ধতির (ফল ফেটে বীজ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে) মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ঘটাতে শুরু করে।
পানিফল যে কতখানি উপকারী না বললে হয়তো অনেকের কাছে অজানা থেকে যাবে। পানিফল শুধু খাদ্যগুণে নয়, ধর্মীয় জীবনেও এর ব্যবহার হয়েছে। সুদূর চিনে প্রাচীনকালে পানিফল দেবতাদের উৎসর্গ করা হতো। উওর ভারতে পানিফলকে শুকিয়ে নিয়ে পিষে তৈরি করা হয় সিঙঘাড়ে কা আট্টা। নানা পুজো পার্বণে, এই আটাতো লাগেই, উপরন্তু নবরাত্রি চলাকালীন উপোস করে যখন ফলাহার খাওয়া হয় সেই ফলাহার তৈরির জন্য এই আটা জরুরী। দেবী দুর্গার আরাধনায় এই ফল অপরিহার্য।
পানিফল কাঁচা এবং সেদ্ধ দুভাবেই খাওয়া যায়। পুরু খোসা ছাড়িয়ে ভেতরের শাঁসটি খেতে হয়। চীনের বেশ কিছু বিশেষ খাবার তৈরিতে পানিফল ব্যবহার করা হয়। পানিফলের রয়েছে ব্যাপক পুষ্টিগুণ যা শরীরের পুষ্টির ঘাটতি পূরণ, শরীর গঠন, রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। পানিফলের প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যযোগ্য অংশে রয়েছে — খাদ্যশক্তি- ৬৫ কিলোক্যালরি, জলীয় অংশ- ৮৪.৯ গ্রাম, খনিজ পদার্থ- ০.৯ গ্রাম, খাদ্যআঁশ- ১.৬ গ্রাম, আমিষ- ২.৫ গ্রাম, চর্বি- ০.৯ গ্রাম, শর্করা- ১১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম- ১০ মিলিগ্রাম, আয়রন- ০.৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-১- ০.১৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২- ০.০৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি- ১৫ মিলিগ্রাম।
এছাড়াও পানিফলের মধ্যে থাকে স্টার্চ ম্যাগনেসিয়াম জিংক ক্যালসিয়াম পটাশিয়াম আয়রন থিয়ামিন রাইবোফ্লোবিন ভিটামিন এ ও সি। ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশনে ওষুধের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন এক কাপ করে পানিফলের রস ঘরোয়া টোটকা হিসেবে বেশ উপকারী। এমনকি গা বমি বমি ভাব বদাজমের সমস্যা মেটাতে পানিফলে জুড়ি মেলা ভার,বিশেষ করে বাচ্চাদের। ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। পানিফল রক্তচাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।
পানিফলের শুধু খাদ্যগুণ নয়, রয়েছে ঔষধি গুণও! যেমন — পানিফলের শাঁস শুকিয়ে রুটি বানিয়ে খেলে অ্যালার্জি ও হাত-পা ফোলা রোগ কমে যায়, উদরাময় ও তলপেটের ব্যথায় পানিফল খুবই উপকারী, বিছা বা পোকা কামড় দিলে আহত স্থানে পানিফল পিষে লাগালে ব্যথা দ্রুত সেরে যায়।
রুটি তৈরির সময় আটাতে পানিফলের গুঁড়ো মিশিয়ে নিলে রুটির খাদ্যগুণ নিঃসন্দেহে অনেকটাই বেড়ে যায় তা বলা বাহুল্য। পানিফল প্রায় ফ্যাট ফ্রি। আধুনিক স্বাস্থ্য সচেতন জীবনযাত্রায় এর গুরুত্ব অস্বীকার করার নয়। পানিফলে থাকে ডি-টক্সিফাইং উপকরণ, সদ্য জন্ডিস থেকে যারা উঠেছেন তাদের জন্য বেশ উপকারি, তবে অবশ্যই পরামর্শ নেবেন চিকিৎসকের। ডায়াবেটিস রোগীরা পানিফল খান একেবারে নিরাপদে, নির্ভয়ে।
পূজার সময় মা দুর্গার ভোগে বা নবরাত্রিতে অপরিহার্য পানিফলের যোগান নিয়ে এ বছর দেখা গিয়েছে সমস্যা। বন্যায় ভেসেছে পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা। জলমগ্ন সেই সব এলাকার তালিকায় রয়েছে পানিফলের ‘হাব’ পাঁশকুড়ার গড়পুরুষোত্তমপুর।
দুর্গাপূজার সময় বাজারে পানিফলের যোগান দিয়ে এ অঞ্চলের লোকেরা মূল সারা বছরে আয় করে। কিন্তু এ বছর চরম আর্থিক সংকটের মুখে চাষিরা।
মূলত পুজোর সময় এ রাজ্যের পাশাপাশি ভিন্ন রাজ্যেও পানিফলের যোগান এখান থেকেই হয়। কিন্তু কংসাবতী নদীর বাঁধ ভাঙ্গা, নিম্নচাপে টানা বৃষ্টি, বিভিন্ন জলাধার থেকে বিপুল পরিমাণে জল ছাড়ার ফলে এখানকার মানুষরাই এখন ভিটেমাটি ছেড়ে ত্রান শিবিরে — রাস্তার উপর ত্রিপলের ছাউনিতে দিন কাটাচ্ছেন। পুজোর আগে কার্যত আঁধার নেমে এসেছে ‘পানিফল পাড়ায়’। অন্যদিকে পুজোয় টাকা দিয়েও পানিফল মিলবে তো আশঙ্কা উদ্যোক্তাদেরও!!
পাঁশকুড়া পুর এলাকার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের গড়পুরুষোত্তমপুরের প্রায় ২০০ সংখ্যালঘু পরিবারের মূল জীবিকাই হলো পানিফল চাষ। বিঘার পর বিঘা নিচু জমি জুড়ে চাষ হাওয়া পানিফলের গুণগতমান এতটাই ভালো যে পুজোর সময় জেলা ছাড়িয়ে ভিন্ন রাজ্য পাড়ি দেয় এখানকার পানিফল।
আষাঢ় মাসে জমিতে পানিফলের চারা লাগানো হয় পুরুষের সঙ্গে মহিলারাও এ কাজে যুক্ত থাকেন। সাধারণত পানিফলের ক্ষেতে দুই থেকে আড়াই ফুট জল ধরে রাখতে হয় আর সেই জলে দাঁড়িয়ে তুলতে হয় ফল।
দুর্গা পূজার সময় পানিফলের পাইকারি দাম থাকে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা, চাষ ও ফল তোলার খরচ বাদ দিয়ে পুজোর দিনগুলিতে প্রতিদিন কাঠা প্রতি ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় হয়। এবছর বিশ্বকর্মা পুজোর আগে পানিফল উৎপাদন শুরু হয়েগেছিল ও বিক্রিও শুরু হয়েছিল, ফলে আয়ও ছিল।
এখানে পৌষ মাস পর্যন্ত পানিফলের উৎপাদন হয় তবে একমাত্র দুর্গাপূজার সময় সবচেয়ে বেশি দাম থাকে এই ফলের। মহালয়ার পর থেকে ব্যপক হারে পানিফল তোলা শুরু হয়। পাঁশকুড়া স্টেশন বাজারে বিক্রির পাশাপাশি বিহার ওড়িশা ছত্রিশগড় ইত্যাদি রাজ্যেও পাড়ি দেয় পানিফল।
তবে ‘পানিফল পাড়া’র এবার ছবিটি সম্পূর্ণ আলাদা কংসাবতী নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত গোটা গড়পুরুষোত্তমপুর এলাকা। পানিফলের ক্ষেতগুলি এখনো ছয় থেকে সাত ফুট জলের তলায়। পরিস্থিতি এমনই যে পানিফলের গাছ পচে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।ফলে পানিফলের হাব গড়পুরুষোত্তমপুর থেকে এ বছর পানিফল কতটা মিলবে তা নিয়ে সংশয়ে পুজো উদ্যোক্তারাও।
বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অনেকখানি জুড়ে রয়েছে পানিফল।সময় শেষ হয়ে যাওয়ার আগে দুর্গাপূজায় লক্ষ্মী পুজোতে অপরিহার্য এই পানিফল। পানিফল থেকে তৈরি ময়দা (অ্যারারূট) আমাদের চিরাচরিত মুখরোচক খাবার তৈরি করতে অতি অবশ্যই লাগে। আধুনিক প্রজন্মের কাছে এই ফলের জনপ্রিয়তা থাকুক বা নাই থাকুক, স্বাদ বদলের রেসিপিতে একআধদিন পানিফলের তরকারি অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারে আপনার হেঁসেলে। আর হ্যাঁ অনিদ্রায় যারা ভুগছেন তারা একবার ট্রাই করে দেখুন না পানিফলের ক্যারিশমা।