সাসারাম মানে বাবু জগজীবন রাম। পেছন ফিরে তাকালে ইতিহাস বইয়ের জ্ঞান, শের শাহ সুরির সমাধিস্থল। এছাড়া সাসারামের অন্য কোনো পরিচয় জানা ছিল না।
প্রথম দর্শনে শহরটার প্রতি মোটেই প্রেম জাগে না। যত্র তত্র পানের পিক, অপরিচ্ছন্নতা, গুটকাডলা হাতের তালু, চটকদার শাড়ি, গোয়াল — খাটালের দুর্গন্ধ মেজাজ বিগড়ে দেবার জন্যে আদর্শ। কিন্তু এক মনের ঘরে যেমন অনেকজনার বসতি, তেমনি এক জায়গার মধ্যেই থাকে অন্য অনেক চোরাগোপ্তা স্থান। তাকে শুধু চিনে নেবার অপেক্ষা।
শহর ছাড়তেই ধানের ক্ষেতে সবুজায়ন। ধানের বুকে সবে দুধ জমতে শুরু করেছে। তাই বোধহয় ধানগাছেরা “স্তনভারে ঈষৎ নম্র”। দূরে সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণাদের মুক্তির আনন্দ। পথের ধারে ধারে প্রথম বাদলের নয়, শেষ বরষার কদম ফুল ফুটে আছে। যে দিকে চোখ যায়, আদিগন্ত সবুজের হাতছানি।
রোহতাস জেলার কৈমুর পাহাড়ের কোলে বসে আছেন দেবী তুতলা ভবানী। তুতলার সঙ্গে তোতলানোর কোনো সম্পর্ক নেই, স্থান-মাহাত্মে দেবীর এমন নামকরণ। দেবীর আরেকটি সুন্দর নাম সোনাক্ষী। দেবীদের অধিষ্ঠান বেশির ভাগ পাহাড়-পর্বতে। ইনিও বিরাজ করেন জঙ্গল-পর্বতের মাঝে। বর্ষায় দুটি পাহাড়ের মাঝখান থেকে নেমে আসা একটি ঝর্ণা পা ধুইয়ে দেয় দেবী সোনাক্ষীর। ছেলেপুলে কোলে কাঁখে নিয়ে অনেকটা চড়াই ভেঙে ভক্তের দল যাচ্ছে পুণ্যলোভে, ঝর্ণার আকর্ষণে। সদ্য জ্বর থেকে উঠে আমার আর গৌরীদির ভাদুরে রোদে পাহাড়ী পথে আর চড়ার ক্ষমতা ছিল না। আমরা গাছের ছায়ায় বসে বসে জঙ্গল নদী পাহাড় আর মানুষ দেখলাম।
কৈমুর পাহাড়ের বুক থেকে নেমে আসা ঝর্ণা উপত্যকায় নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে নিয়ে বালি পাথর। সে নদী তিরতির করে চলে বিলীন হয়েছে সোন নদীর বুকে। সেই নদীর কাছে বসে থাকতে থাকতে মনে হল পাহাড় থেকে সগৌরবে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে এমনটি শান্ত হয়ে গেল কি করে? তারপরে সোনের বুকে তার অস্তিত্ব হারালো! একেই কি বলে বৃহতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ?
কৈমুর পাহাড়ের ধার ঘেঁষে চলতে চলতে পথ আমাদের পৌঁছে দিল রোহতাস গড়ে। দুর্গের ভাঙাচোরা বিশাল ফটকে কত গৌরবগাথা, পরাজয়ের বেদনা। কিংবদন্তি বলে, রহস্যে ঘেরা এই কেল্লা নাকি আদতে পৌরাণিক রাজা হরিশ্চন্দ্র পুত্র রোহিতাশ্বের। রোহিতাশ্ব লোকমুখে রোহতাস। ইতিহাস জানায়, এই দুর্গকে মহিমান্বিত করেছিলেন শের শাহ সুরি। দুর্গের ভিতর মসজিদ আছে। মন্দির ভি আছে। একা একা কখনো রাখালিনী বিজলী কিলাতে গেলে তার ডর লাগে। দুর্গের বাইরে সারি সারি ঘোড়াশাল, পিলখানা। বৃষ্টি পড়লে তার গায়-বাছরাদের সেখানে নিশ্চিন্ত আশ্রয়। কেল্লার সামনের মাঠে বর্ষায় সবুজ ঘাস লকলকিয়ে উঠেছে। এই চারণভূমি ছেড়ে নড়তেই চায় না রাখালিনী রাখালদের চারপেয়েরা।
দুর্গের হাতিশালে হাতি আর শোভা না দিলেও দুর্গের প্রধান দেউড়িতে দুটি সুন্দর অলঙ্কৃত হাতি। শের শাহের পর আকবরের সময় রাজা মানসিংহ এই কেল্লার দখল নিয়েছিলেন। তখন হয়তো আবার গমগমিয়ে উঠেছিল রোহতাসগড়। কেল্লার ভেতর মন্দিরের ঘন্টা বাজত। রাজস্থানী ঝরোখায় বাঈশাহদের হাসির লহর উঠত। শাহী দরবারে রাজপুত বীরদের মোজরীর আওয়াজ উঠত খসখস মচমচ। সেইসব স্মৃতি বুকে নিয়ে, বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এখন ধ্বংসের দিন গুনছে রোহতাসগঢ়। সরকার, পর্যটক সবাই কেমন যেন উদাসীন এই ঐতিহ্যের প্রতি।
শুধু প্রকৃতি এখানে অকৃপণ। বর্ষার জলে সে আনন্দে সেজে উঠেছে দিকে দিকে। দুর্গাবতী জলপ্রপাত পাহাড়ের বুকে তৈরি করেছে গভীর গুহা। তাঁর নাম তেল্হার কুন্ড। কর্মনাশা নদী নাচতে নাচতে এসে কঠিন পাথর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নিচে। নাম নিয়েছে কর্কটগঢ় জলপ্রপাত। করমচাট জলাধার ঘিরে রয়েছে শিবলিঙ্গের মত একখন্ড পাহাড়কে। সবটাই বড় মনোরম। চোখ জুড়োনো। মালিন্য, নীচতা, অশুচির ঊর্দ্ধে ওঠা শান্তির এক একটি আবাসস্থল।
সাসারামে শেষ শয্যায় শুয়ে আছেন শেরশাহ সুরি তাঁর আত্মীয় পরিজনদের নিয়ে। শেরশাহ তাঁর আব্বাজান এবং প্রিয় বেয়াই মশাইকেও ভোলেন নি। তাঁদের সমাধিও রয়ে গেছে সাসারামের বুকে।
ইতিহাস বিখ্যাত এই আফগানী বাদশা মুঘল সাম্রাজ্যকে টক্কর দিয়েছিলেন। তাঁর চিরশত্রু হুমায়ূনও তাঁকে সম্মান দিয়ে ওস্তাদ-ই-বাদশাহাঁ বলতে কার্পণ্য করেননি। তিনি ছিলেন সুলতান-ই-আদিল বা ন্যায়পরায়ণ শাসক। শাসনব্যবস্থার সংস্কারে আকবরের পূর্বসূরী।
তাঁর সমাধিস্থলের চারিদিকে জলের পরিখা। স্থানীয় মানুষ এটিকে বলেন পানি রোজা। নিজের জীবদ্দশায় এই সমাধির কাজ শের শাহ শুরু করে দিয়েছিলেন। সূর্যাস্তে জলের ওপর ছায়া পড়ে সেই অপূর্ব ইন্দোইসলামিক স্থাপত্যের।
কেমন যেন মন বিষণ্ণ হয়ে যায় ।
তিন হাজার বছরেরও পুরনো সভ্যতা আর সংস্কৃতির পীঠস্থান বিহার। এখানেই প্রথম গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেছিল লিচ্ছবিরা। বিহার আমাদের দিয়েছে বোধিবৃক্ষের ধ্যান, নালন্দা-ওদন্তপুরী-বিক্রমশীলার জ্ঞান। সেই কোন কলেজ জীবনে নালন্দা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। সেকথা আবার মনে পড়ে গেল এতদিন পর আবার বিহারে এসে। আমরা যে বড্ড ভালোটুকু আঁকড়ে বাঁচতে চাই!
Khub bhalolaglo. known off beat place tar somporke jene
Thank you Parama ♥️