যত দিন যাচ্ছে পাল্টাচ্ছে সবকিছু। চোখের সামনে যা দেখি, সবই যেন কোথায় গরমিল লক্ষ্য করি। ভয় হয়। কেন জানি না। ইদানিং প্রবীণ কিংবা বয়স্ক লোকদের আর একসঙ্গে বসে আড্ডা দিতে দেখি না। আবার চোখেও পড়ে না একেবারে বৃদ্ধদেরও। যাঁরা হাঁটু মুড়ে কিম্বা মাথা হাঁটুর উপর রেখে বসে আছেন। আর ঠিক পাশেই রাখা আছে শেষ জীবনের সহায় সম্বল লাঠিটা। এঁদের মা বলতেন ‘তিন মাথা’ পুরুষ। বুঝতে না পারায় বিষয়টি মা আরও খুলে বলেছিলেন। তা হল দুই হাঁটুর মাথা আর শরীরের মূল মাথা, মোট তিন মাথা।
আগে সমাজে তিন মাথাদের বুদ্ধি নিয়ে মানুষ চলত। সমীহ করত সকলে। এঁদের দেখা পেলেই শুধোতাম ‘দাদু কেমন আছো?’ ঝুলে পড়া গাল, চামড়ার ভিতরে ঢুকেছে চোখ দুটো। ফোকলা হাসি। হাত-পায়ের আঙুলগুলো কাঁপছে। তবুও জড়ানো গলায় দাদু বলতেন, ‘এই বেশ আছি। পরপারের অপেক্ষা করছি।’ ছেলেবেলায় সেই সমস্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাছে কত গল্প শুনেছি। তাঁদের আর দেখা পাই না। রাস্তা-ঘাটে চোখ খুঁজে বেরিয়েছে ওই সমস্ত মানুষদের। দেখা নেই। কাউকে শুধোলে বলে, যে দু-একজন আছেন, তাঁরা আর বাড়ির বাইরে বের হন না। প্রবীণদের কথা শুনব বলে প্রতিদিন মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠতো। একবার ঠাকুরদার মুখে শুনেছিলাম, ‘তিন মাথা যার বুদ্ধি নেবে তার, মাঝপুকুরের জল খাবে আর ভিটেতে বাজার বসাবে।’
তিনটি কথার অর্থ তখনও বুঝিনি। তিন মাথা বলতে বুঝেছিলাম ব্রহ্মার কথা বলছে। মাঝপুকুরে জল অর্থাৎ দিঘি বা পুকুরের মাঝখানে গিয়ে জল এনে খাওয়া এটাই বোধগম্য হয়েছিল। শেষ কথাটা অর্থাৎ ‘ভিটেয় বাজার বসাবে’ — এই কথাটি শুনে মনে হয়েছিল ভিটেতে জিনিসপত্রের কেনা বেচার হাট বসাতে। এই কথাগুলি শুনে ঠাকুরদাকে ভাল লাগেনি। মনে হয়েছিল শেষ বয়সে ভিমরতি ধরেছে। মাথাটা একেবারে গেছে। যখন বড় হলাম, বুঝলাম ওই তিনটে কথার অর্থ। ‘তিনমাথা যার বুদ্ধি নেবে তার’ কথাটা একজন প্রবীণ অভিজ্ঞ মানুষের কথা বলতে চেয়েছেন। বয়সকালে অনেক বৃদ্ধকেই দেখা যায় দু-হাঁটু উপর দিকে মুড়ে বসে থাকতে। দুই হাঁটু আর মাথা এক হয়ে যেত। এই প্রবীণ মানুষের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারলে জীবনে বড় হবার পথ দেখা যাবে।
তাই এই সমস্ত বৃদ্ধদের যে কোনও কাজের পরামর্শ নিতে পারলে লাভ। আবার ‘মাঝপুকুরের জল খাবে’ অর্থাৎ কেউ জল খেতে দিলে সবসময় উপরের জলটা ফেলতে হবে। ধুলো-বালি-ময়লা উড়ে এসে পড়তেই পারে। শরীর সুস্থ বা পেট সুস্থ রাখতে বিশুদ্ধ জল পান করা উচিত। এটাই মনে করাতে চেয়েছেন। এছাড়া শেষকথাটি হল — ভিটেতে বাজার বসাবে। কখনওই ভিটেতে কেউ বাজার-হাট বসায় না। বৃদ্ধ বলতে চেয়েছেন গ্রামে-গঞ্জে ভিটেতে ঘর-বাড়ি থাকে। তার পরেও জায়গা পড়ে-থাকে। ওই জায়গা ফেলে না রেখে বিভিন্ন ধরনের সবজির গাছ বসাতে হবে। তাহলে বাজারে যেতে হবে না। সংসারের প্রয়োজনীয় সবজি এখান থেকেই মিলবে।
এই গূঢ় অর্থ আজ বুঝেছি। যখন বুঝেছি তখন আর সেই ঠাকুরদা নেই কিম্বা কোনও বয়স্ককেও আর দেখতে পাই না। কেউ বৃদ্ধাশ্রমে, কেউ বা বাড়ির অন্তরালে ঘরের এক কোণে পরপারের আশায় দিন গুনছেন। যেখানে শান্তির বদলে দুঃখ বড় হয়ে বিরাজ করছে। বাড়ির মানুষের কাছে এরা এখন বোঝা। প্রবীণের উপদেশ, ভাব-ভাবনা, আদর্শ থেকে বঞ্চিত আজকের প্রজন্ম। তাই মনে হয় বড়দের আদর্শকে ভুলে যাচ্ছে। ‘তিন মাথা’দের বুদ্ধি বা উপদেশ পাবার জন্য গলি থেকে পাড়া, পাড়া থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে শহর ছুটে বেড়াচ্ছি। হায়! এদের দেখা মেলে না। একমাত্র সঙ্গী মেয়েটাও প্রশ্ন করে, কোথায় গেল ‘তিন মাথারা?’ উত্তর দিতে পারি না। চাপা দুঃখ, বেদনা নিয়ে পথ চলছি। জানি না এপথ কোথায় শেষ হবে!