একাত্তরের গল্প গ্রন্থে সেলিনা হোসেনের অসাধারণ হাতে রচিত হয়েছে একাত্তরে নারীর দূরবস্থার কথা। গল্পের আমিনা ও মদিনা আর কেউ নয়, আমাদের বোন, আমাদের কন্যা। যুদ্ধদিনে যাঁরা বেঁচে ছিলেন তাঁদেরর জীবন ছিল মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। এদের মধ্যে সন্ত্রস্ত, নিরুপায়, পরনির্ভরশীল নারীর দূরবস্থায় আকাশ বিদীর্ণ হয়, লজ্জায় নত হয় চরাচর; আর আমাদের বিবেক জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়। অন্যদিকে সখিনার মতো সাহসী নারীরাও আছে, যারা যুদ্ধকে আপন শক্তিতে মোকাবেলা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প গ্রন্থে মোট ২২টি গল্প স্থান পেয়েছে। এই গল্পগুলো হলো — আলো দেখা, যুদ্ধের ছবি, কেঁদো না, শেষ পর্যন্ত শফিউল্লাহ, সখিনার চন্দ্রকলা, গাছের ছায়ায় গণকবর, সিজ ফায়ার, সমাবেশ, রেজিনার গুপ্তধন, মা-মেয়ের যুদ্ধ, স্বর্ণচাঁপা, ভিটেমাটি, শকুনের ছায়া, মুখোশ, দুঃখ, আমিনা ও মদিনার গল্প, দুরকম যুদ্ধ, বদলে যাওয়া, পা ও গ্রেনেড, পরজন্ম, যুদ্ধ জয়, ডিসেম্বর।
সেলিনা হোসেনের একাত্তরের গল্প গ্রন্থে মূলত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের বেদনাদীর্ন সময়ের যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ পরর্বতী সময়ের দুরবস্থার চিত্র উঠে এসেছে।
আমরা এই বইয়ের প্রথম গল্প আলো দেখা, নিয়ে আগে আলোচনা করবো। এই গল্পের চানবরু একজন বীরাঙ্গনা। সে তার মর্মবেদনা নিজের জবানীতে ব্যক্ত করেছে,যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সে একজন বীরাঙ্গনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে পাকবাহিনীর দ্বারা ধর্ষিত হয়।রাজাকারেরা তাকে ধরে নিয়ে পাকমিলিটারিদর ক্যাম্পে দিয়ে আসে।
বিজয় লাভের পর সে তার গ্রামের মানুষের চোখে বীরাঙ্গনার মর্যাদা পায় না। সে আত্ম কথনের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের কালপর্বে লাঞ্ছিত হবার বেদনাদয়ক কাহিনী তুলে ধরেছেন।
‘একদিন বটগাছের নিচে বসে থাকবার সময় একটা ছোট বাচ্চা ছেলে বলে, ওই দেখ ওই মাগী পাকিস্তানি মিলিটারীর সঙ্গে শুয়েছিল।’ চানবরু ছোট ছেলে মুখ শুনতে পায়। এ থেকে সে বুঝতে পারে তাকে একশ্রেণির মানুষ কিভাবে মূল্যায়ন করে। তার খুব কষ্ট হয়।
বছর খানেক পরে সে শুনতে পায় শ্লোগান — রাজাকারদের ফাঁসি চাই। চানবরুর মনটা আনচান করে ওঠে। লোকজন রাজাকারদের ফাঁসি চাই বলে এগিয়ে আছে। আসে মোমবাতি হাতে। চানবরুর মনে উথালপাথাল শুরু হয়।
রাজাকারদের ফাঁসি কামনা করে আসছেন সে ধর্ষিতা হবার পর থেকে। সে যেন আকাশে আলো দেখতে পাচ্ছে।
ভাল লাগার অনুভূতি জেগে ওঠা তার মনে।
‘মা ও মেয়ের যুদ্ধ’ এমন একটি গল্প যেখান মা-মেয়ের জীবনের বেদনাদীর্ন দুরবস্থার বাস্তবধর্মী কাহিনী সেলিনা হোসেন গভীর মমতায় তুলে ধরেছেন।
আমার কাছে এই গল্প গ্রন্থের সবচেয়ে ভাল লাগার গল্প স্বর্ণচাঁপা। তিনি তার লেখা গল্পে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারেন তার প্রমাণ পাই মুক্তিয়ুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা ‘স্বর্ণচাঁপা’ গল্পটিতে। কিশোর বেলার ভালবাসা অব্যক্ত অভিব্যক্তিতে সেলিনা হোসেন সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন এ গল্পে তা বলে শেষ করা যায় না। এটি ভিন্ন স্বাদের গল্প। মামুন ও সুপর্ণার অব্যক্ত ভালবাসার অভিব্যক্ত হয়েছে ছোটগল্পের ঘরাণায়। সুপর্ণাদের বাড়িতে একটা স্বর্ণচাপা ফুলের গাছ আছে। বোশেখ মাসে স্বর্ণচাঁপা ফোটে। সোনার মত রঙ, তীব্র গন্ধ। সুপর্ণা জানে মামুন স্বর্ণচাঁপা ফুল খুব ভালবাসে।তাদের ঘরের ছাদে উঠে ফুল পেরে নিয়ে যায়।
তা দেখতে পেলে সুপর্ণা মামুনের সঙ্গে ঝগড়া করে। সুপর্ণা যেবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা সেবার মামুন কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে। একদিন সুপর্ণা মামুন বাড়ি যায়। সেদিন মামুন বাড়ি ছিল না। সে মামুনের পড়ার টেবিলে রসায়ন খাতার হিজিবিজি লেখার মধ্যে মামুনের হাতে লেখা আবিষ্কার করে একটা লাইন — “স্বর্ণচাঁপা মতো মেয়ে সুপর্ণা।”
মামুনের এই লেখাটা পড়ে সুপর্ণার মনে হয় বৈশাখ মাস এলেই মধ্যে যেন বৃষ্টি ঝরায়। সে যে তাকে ভালোবাসে তা বুঝতে কষ্ট হয় না সুপর্ণার।
তার পরদিন একের পর এক দিন গড়িয়ে যায়।
সুপর্ণা অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে আর মামুন এম.এসসি ফাইনাল ইয়ারে। তাদের কেউই ভালবাসার কথা একে অপরকে বলতে পারে না। সুর্পণার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। মামুন মনে মনে তাকে ভালবাসলেও তা প্রকাশ করে না। বরং তার বিয়ের সব কাজ করে দেয় খুশি মনে। পরবর্তী বোশেখ না আসতেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মামুন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। সুপর্ণা তখন শ্বশুর বাড়িতে তার স্বামী শিহাবে সঙ্গে ঘরসংসার করছে।
বোশেখ মাসের শেষ দিকে সুপর্ণা মামুনের একটা চিঠি পায়, চিঠি তো একটা চিরকুট, তাতে লেখা — সারা বাংলাদেশে স্বর্ণচাঁপা ফোটাবার দায়িত্ব নেব বলে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি সুপর্ণা।
মামুনের লেখা এই একটা বাক্যই সুপর্ণার মনে দাগ কেটে যায়। মনে দাগ কাটলেও তার কিছুই করার ছিল না।
পাকমিলিটারিরা সুর্পণার স্বামী শিহাবকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে মামুন বাড়ি ফিরে আসে, ওদিকে সুর্পণার স্বামী শিহাবের কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। জানা যায় তাকে পাক-আর্মিরা হত্যা করে।
সুর্পণা বাবার বাড়িতে ফিরে আসার পর মামুনের সঙ্গে তার দেখা হয়। মামুনের একরাশ এলোমেলো চুল, কাঁধে একটা রাইফেল। একদিন মামুন সুর্পণাদের রাড়ি এলে কথাবার্তা ছলে মামুন তাকে ভাল লাগার কথা বললে সুর্পণা মামুনকে উষ্মাপ্রকাশ বলে, তুমি তোমার ভালবাসর কথা আগে মুখফুটে বলতে পারনি।
তার অনেক গল্পেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দামাল বাঙালি যুবক-যুবতীদের আত্মত্যাগের কথা গল্পে আকারে এমন ভাবে তুলে ধরেছেন যা ইতিহাসের কথা হলেও পাঠকের মনে হবে বাস্তবধর্মী জীবন্ত গল্পকথা।
সে ভাবে, তার জীবন তো আঁধারে ঢেকে গিয়েছি, আজ সে আলো দেখতে পেয়ে তার মনটা খুশিতে ভরে গেল।
সেলিনা হোসেন তার এই বইয়ের কিছু গল্প সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া নির্যাতিত নারী পুরুষের কথা বিধৃত হয়েছে।
এই গল্পগ্রন্থের সব গুলোতেই ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের বেদনার কথাই সেলিনা হোসেন বাস্তবতার আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন। তার একটা গল্প সখিনার চন্দ্রকলা, এই গল্পের প্রধান চরিত্র সকিনা। সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। সুলেমান একজন রাজাকার। সুলেমান গ্রামের মেয়েদের ধরে ধরে পাকমিলিটারী ক্যাম্পে পৌছে দেয়। সকিনার দা, সে দা দিয়ে এক একটা মিলিটারি ও রাজাকারকে নিকেশ করে দেবার শপথ নেই। সকিনা দাই এর কাজ করে।
আকবর আলী বৌ পোয়াতি, তার ব্যথা উঠিছে। সে সকিনা নিয়ে যায় তার বাচ্চা খালাস করার জন্য। সে তার বৌ আমিনা বিবিকে দেখেই বুঝতে পারে তার মিয়া হবে।
গ্রামের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যায়।
রাজাকাররা মিলিটারিদের নিয়ে অনেকেই মরে ফেলে। তারা অনেক মেয়েকে ধর্ষণ করে। সকিনাও ধর্ষিত হয়। সে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার পর এক সময় দেশ স্বাধীন হয় অস্ত্র জমা বলায় সকিনাকে অস্ত্র জমা দিতে বলায় সে বলে — সোলেমান রাজাকার এখনো মরে নাই তাই সে অস্ত্র জমা দিবে না।
পটভূমি মুক্তিযুদ্ধ হলেও সেলিনা হোসেন গল্পের আবহে যুদ্ধের নানা ঘটনাকে কল্পনায় বিস্তার ঘটিয়ে চরিত্রের মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণে সমকালীন পাটাতনেও নিয়ে এসেছেন। এখানে ইতিহাসের ঘটনা এক জায়গায় থমকে থাকেনি। গল্পে যুদ্ধাহত মাসুদ হয়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ভূলুণ্ঠিত চেতনার প্রতিমূর্তি। স্বাধীনতার পরে পরিবর্তিত সুযোগ নিয়ে রাজাকার জগলুর পুনরুত্থান, শক্তি ও দাপট প্রতিষ্ঠিত করে ওপর কাঠামোর বর্তমানের অন্যান্যসেলিনা হোসেন গল্পের আবহে যুদ্ধের নানা ঘটনাকে কল্পনায় বিস্তার ঘটিয়ে চরিত্রের মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ ঘটিয়েছেন।
মনোজিৎকুমার দাস, প্রাবন্ধিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা।