মঙ্গলবার | ২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৫:১৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
রোনাল্ড রসের কাছে জব্দ ম্যালেরিয়া : রিঙ্কি সামন্ত রাজ্যে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে, কমবে অন্য রাজ্যের উপর নির্ভরতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় উনিশের উত্তরাধিকার : শ্যামলী কর কেট উইন্সলেটের অভিনয় দক্ষতা ও চ্যালেঞ্জিং ভূমিকার ৩টি চলচ্চিত্র : কল্পনা পান্ডে হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলা — আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংকট : সুব্রত কুমার দাস সিন্ধুসভ্যতার ভাষা যে ছিল প্রোটোদ্রাবিড়ীয়, তার প্রমাণ মেলুহা তথা শস্যভাণ্ডার : অসিত দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (শেষ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস জাতিভিত্তিক জনগণনার বিজেপি রাজনীতি : তপন মল্লিক চৌধুরী গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তালশাঁসের চাহিদা : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (ষষ্ঠ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস ভারতের সংবিধান রচনার নেপথ্য কারিগর ও শিল্পীরা : দিলীপ মজুমদার চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (পঞ্চম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস আলোর পথযাত্রী : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (চতুর্থ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস কন্নড় মেল্ল থেকেই সিন্ধুসভ্যতার ভূখণ্ডের প্রাচীন নাম মেলুহা : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (তৃতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস লোকভুবন থেকে রাজনীতিভুবন : পুরুষোত্তম সিংহ চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (দ্বিতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত রবীন্দ্রনাথের ইরান যাত্রা : অভিজিৎ ব্যানার্জি ঠাকুরকে ঠাকুর না বানিয়ে আসুন একটু চেনার চেষ্টা করি : দিলীপ মজুমদার যুদ্ধ দারিদ্র কিংবা বেকারত্বের বিরুদ্ধে নয় তাই অশ্লীল উন্মত্ত উল্লাস : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ, পঁচিশে বৈশাখ ও জয়ঢাক : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী ও শান্তিনিকেতন : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বাঙালী রবীন্দ্রনাথ : সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক দূর পর্যন্ত ভেবেছিলেন আমাদের ঠাকুর : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথের প্রথম ইংরেজি জীবনী : সুব্রত কুমার দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (প্রথম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস শুক্লাম্বর দিঘী, বিশ্বাস করে দিঘীর কাছে কিছু চাইলে পাওয়া যায় : মুন দাশ
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

নদিয়ার মিষ্টি — সেকাল ও একাল : দীপাঞ্জন দে

দীপাঞ্জন দে / ১৬৬০ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪

বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বিশেষ সংখ্যার লেখা।

২০১৬ সালের একটি মিষ্টি অভিজ্ঞতার গল্প বলে শুরু করি। মিষ্টান্ন প্রেমী হিসেবে তো বটেই, মিষ্টান্ন বিষয়ে চর্চা করার সুবাদে কৃষ্ণনগরের মিষ্টির দোকানগুলিতে আমার আনাগোনা লেগেই থাকে। কখনও ক্রেতা হিসেবে, কখনও বা ক্ষেত্রসমীক্ষক হিসেবে। নদিয়া জেলার মিষ্টান্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার কাজ তখন জোর কদমে চলছে। ২০১৬-র জানুয়ারির কথা, নদিয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরের প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন বিপণি ‘অধর মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান’-এ গিয়েছি। সূর্য তখন মধ্যগগনে, দোকানের সামনে একটি চারচাকা গাড়ি এসে দাঁড়ালো। দুইজন ভদ্রলোক মিষ্টি কেনার জন্য গাড়ি থেকে নামলেন। পরে কথোপকথনে জানতে পেরেছিলাম যে, তাঁরা উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙা থেকে এসেছেন। অধর মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানে তাঁরা এসেছিলেন মূলত কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সরপুরিয়া এবং সরভাজা মিষ্টি দুটি সংগ্রহ করতে। সেই মোতাবেক তাঁরা কেজি খানেক করে উভয় প্রকারের মিষ্টি ক্রয় করেন। কিন্তু বহিরাগত পর্যটক বলে কথা, এত সহজে কি মনের আশ মেটে। দোকানের শোকেসের দিকে একবার নজর বোলাতেই হলো। আর তখনই ঘটে কাণ্ডটি। শোকেসে রাখা মিষ্টির দিকে তাকিয়ে তাদের মধ্যে একজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে বসলেন— আলুভাতে মাখার মতো দেখতে এটা কি? প্রশ্নটি শুনে দোকানদার তো একেবারে হতবাক, আমিও স্তম্ভিত! আসলে এইভাবেও যে সেই মিষ্টান্নটির বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে, সেটি ইতিপূর্বে কখনও ভেবে দেখি নি। তবে হ্যাঁ, একথা ঠিক যে, মিষ্টিটি তৈরির সময় আলুভাতে মাখার মতোই সেটিকে চটকাতে হয় এবং তারপরে সেগুলিকে গোল্লা গোল্লা করে পাকিয়ে মিষ্টির রূপ দিতে হয়। খেতে হয় খুবই সুস্বাদু। দামের দিক থেকেও সমৃদ্ধ। কৃষ্ণনগর তথা নদিয়া জেলায় এই মিষ্টিটি বহুল প্রচলিত। যাইহোক, কিছু পাঠক নিশ্চয় আন্দাজ করতে পেরেছেন যে, এখানে যে মিষ্টিটির কথা বলা হচ্ছে, সেটি হলো ‘নিখুঁতি’। ২০১৬ সালের সেই অভিজ্ঞতার পর আমিও ঘনিষ্ঠ মহলে কখনও-সখনও নিখুঁতিকে ‘আলুভাতে মাখা মিষ্টি’ বলে সম্বোধন করে থাকি।

ছানার আবিষ্কার হোক বা রসগোল্লার প্রাদুর্ভাব বাংলার নদিয়া জেলার কথা না বললেই নয়। ‘নওদিয়াহ’ (ফার্সি শব্দ, অর্থ ‘নতুন দেশ’) থেকে  ‘নদিয়া’য় ক্রমবিবর্তনে মিষ্টান্ন শিল্প তার ঐতিহ্যের সাথে রসে বসে একাকার হয়ে গেছে। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ দেখা যায় স্বয়ং রাঘবদাস নদিয়া থেকে পুরীতে  মহাপ্রভু চৈতন্যের জন্য মিষ্টি নিয়ে যেতেন। নদিয়ার মিষ্টান্ন শিল্পের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। বাংলার অনেক মিষ্টিরই আঁতুড়ঘর নদিয়া। মুড়াগাছার ছানার জিলিপি, শান্তিপুরের নিখুঁতি, নবদ্বীপের রাজভোগ, অমৃতি, লাল দই, কৃষ্ণনগরের সরভাজা, সরপুরিয়া, সরতক্তি, ভালুকার গজা, বেতাইয়ের কাঁচাগোল্লা, চমচম, রানাঘাটের পান্তুয়া, মাজদিয়া-কৃষ্ণগঞ্জের মাখা সন্দেশ এই জেলার মিষ্টান্ন শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

কৃষ্ণনগর তথা নদিয়া জেলা এমনিতেই গো-বলয়। পুরনো মানুষেরা কৃষ্ণনগরকে এখনো গোয়ারী বলেই চেনেন আর ‘গোয়াড়ি’(কৃষ্ণনগর) তো আসলে গো-বাড়ি। রসগোল্লা তথা একাধিক মিষ্টান্নের প্রধান উপাদান ছানা নাকি নদিয়ার কৃষ্ণনগরেই আকস্মিকভাবে আবিষ্কার হয়। তখন নদিয়ারাজ  ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭২৮-১৭৮২ খ্রি.)। ‘অন্নদামঙ্গল’ থেকে জানা যায় তাঁর রাজ্য চুরাশি পরগনায় বিভক্ত ছিল। কলকাতাসহ চব্বিশ পরগনাও নদিয়ারাজের অধীনস্থ ছিল। রাজার গোয়ালে প্রচুর গরু ছিল। এহেন রাজ্যে কোনও উৎসব উপলক্ষে কড়াই কড়াই দুধ জ্বাল দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু রসুইকারের ভুলে এক কড়াই দুধ হঠাৎ কেটে যায়। তখন ঐ দুধকে কিভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে সবাই ভাবতে থাকে। অতঃপর সেই ‘কাটা’ দুধ থেকেই আবিষ্কার হয় ছানা। অন্যমতে আবার পর্তুগীজদের থেকে বাঙালিরা ছানার ব্যবহার শিখেছিল। যাইহোক পরবর্তীততে এই ছানা মিষ্টান্ন তৈরির প্রধান উপাদান হিসেবে ক্ষীরকে পিছনে ফেলে দেয়।

নদিয়ার ফুলিয়ার বাসিন্দা হারাধন ময়রার হাতেই নাকি জন্ম হয় ছানার তৈরি শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন রসগোল্লার। হ্যাঁ, কলকাতার বাগবাজার নয়, রসগোল্লার জন্মভূমি নদিয়া। নদিয়ার ইতিহাস তো এটাই বলে। সেকালের খ্যাতনামা লেখক পঞ্চানন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন : “রসগোল্লার প্রত্নতত্ত্ব বলিয়া রাখি। উহার বয়স ৫৯/৬০ বৎসরের অধিক নহে। (এটি ১৩৩২ বঙ্গাব্দের হিসাব)। কৃত্তিবাসের জন্মস্থান ফুলিয়া গ্রামে রসগোল্লার জন্মভূমি।” হারাধন ময়রা রানাঘাটের পালচৌধুরিদের জমিদার বাড়িতে হালুইকরের কাজ করতেন। একদিন তিনি পালচৌধুরীদের ক্রন্দনরত শিশুকন্যাকে সান্ত্বনা দিতে উনানের উপর বসানো গরম চিনির রসে কয়েক ডেলা ছানা ফেলে দেন। অতঃপর তিনি দেখেন সেটি এক উন্নত মিষ্টান্নে পরিণত হয়েছে, পালচৌধুরী জমিদারবাবু যার নাম দেন রসগোল্লা। রসালাপী সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলি তাঁর গল্পে রসগোল্লার ইতালি জয়ের কাহিনী দর্শিয়েছেন।

কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া ও সরভাজা মিষ্টি দুটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ। কিন্তু এই দুই মিষ্টির আবিষ্কারক বা এর আবিষ্কারের সময়কাল সঠিকভাবে বলা দুষ্কর। অনেকের মতে এই মিষ্টির বয়স ১৫০ বছরের অধিক নয়। কিন্তু এপ্রসঙ্গে বলতে হয় চৈতন্যচরিতামৃত-এ সরপুরিয়া মিষ্টান্নটির উল্লেখ রয়েছে—

সরপুরী অমৃত পদ্ম চিনি।

খণ্ডখিরিসার বৃক্ষ        ঘরে করি নানা ভক্ষ্য

রাধা যাহা কৃষ্ণ লাগি আনি।।

সুতরাং চৈতন্যচরিতামৃত-এর বিবরণ মানলে সরপুরিয়া মিষ্টান্নটির বয়স আরো বেড়ে যায়। কৃষ্ণনগরের স্বনামধন্য এই মিষ্টান্ন নির্মাণের গৌরবপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ছিলেন ভারতকত্তা, অধর কত্তা, বক্রেশ্বর কত্তা, নসীরাম কত্তা প্রমুখ। কৃষ্ণনগরের আদি প্রথায় এদের নামের সঙ্গে পদবী যোগ না করে কত্তা বলে সম্বোধন করা হত।

ছানা ও ক্ষীরের বাটা মাখা সন্দেশের (হলুদ রঙের) উপর সরযুক্ত নরম মিষ্টির নাম সরপুরিয়া, এক ধরনের সন্দেশ বলা যেতে পারে। সরপুরিয়া ও সরভাজা একই মিষ্টি। সরপুরিয়াকে ঘি দিয়ে ভাজা হলে, তা সরভাজা হয়ে ওঠে। এই মিষ্টি তৈরির প্রধান উপাদান হলো ছানা, ক্ষীর, চিনি, দুধের সর, কাঠ বাদাম, ছোট এলাচ, পেস্তা ও ঘি। প্রথমে ছানা, ক্ষীর ও চিনি কড়াইতে পাক দেওয়া হয়। তারপর কাঠ বাদাম ঘি দিয়ে ভেজে গুঁড়ো করে তাতে মেশানো হয়। ছোট এলাচ ও পেস্তার গুঁড়োও মেশানো হয়। পাক হয়ে গেলে সেই মিশ্রণ গোল চাকতির মতো করে বসানো হয়। দুধের সর তিনটি স্তরে বসানো হয়। এই দুধের সর জোগান দেন গোয়ালারা। নদিয়া জেলা শিল্প কেন্দ্রের আধিকারিকরা জানান, খুব তাড়াতাড়িই কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া ও সরভাজা মিষ্টি জি আই তকমা পাবে।

মিষ্টান্ন শিল্পের জন্য দরকার ছিল দুধের। আর কৃষ্ণনগরে যার মোটেই অভাব ছিল না। কৃষ্ণনগরের আদি ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে সেখানে মূলত গো-পালক বা গোয়ালা জাতি বাস করত। কৃষ্ণনগরের পূর্ব নাম ছিল রেউই। সেখানে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থের বসতি প্রায় ছিল না। বিস্তর গোপের বাস ছিল। রাজা রাঘব মাটিয়ারি ছেড়ে রেউই (কৃষ্ণনগর) গ্রামে তার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। ‘ক্ষিতিশবংশাবলিচরিতম্’-এ রয়েছে— “রেউই ইতি প্রসিদ্ধগ্রামে গোপানাং বহুনামাধিষ্ঠানামতঃ প্রসঙ্গতঃ কৃষ্ণনামস্মরর্ণাদ্যর্থং চ তদ্গ্রামস্য কৃষ্ণনগরেতিসংজ্ঞাং চকার।” অর্থাৎ রেউইয়ে অনেক গোপের বসতি ছিল যারা মহাসমারোহে কৃষ্ণের পূজা করত, এ কারণে রুদ্ররায় রেউই-এর নাম কৃষ্ণনগর রাখেন।

শান্তিপুরের মিষ্টান্নের কথা না বললে নদিয়ার মিষ্টান্ন বিষয়ক আলোচনা পূর্ণতা পায় না। শান্তিপুরের মিষ্টান্ন নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। মিষ্টান্ন তৈরির প্রধান উপাদানগুলি যেমন— চিনি, দুধ, ঘি, খেজুর গুঁড় সহজলভ্য হওয়ায়, এখানে মিষ্টান্ন শিল্পের প্রসার ঘটেছিল বলে মনে হয়। এছাড়া শান্তিপুরকে মন্দির নগর ও তীর্থস্থান বললেও অত্যুক্তি হয় না। বিভিন্ন পূজার্চনা, রাসপূর্ণিমা, দোলকে কেন্দ্র করে শান্তিপুরে যে জনসমাগম হত, তার দ্বারাও মিষ্টান্ন শিল্প প্রসার পায়।

একদা শান্তিপুরের শর্করা শিল্প যথেষ্ট প্রসিদ্ধ ছিল। শান্তিপুরে খেজুরগুড় থেকে বিশেষ একধরণের চিনি তৈরি হত, যা ‘দোলো চিনি’ বা ‘দোবড়া চিনি’ নামে পরিচিত ছিল। কাশী অঞ্চলের মিষ্টান্ন এই দোলো চিনিতেই তৈরি হত। তাই অনেকে একে কাশীর চিনিও বলত। ভীম নাগের সন্দেশে ও বাগবাজারের রসগোল্লাতেও এই চিনির ব্যবহার হত বলে জানা যায়। এই চিনি দিয়ে তৈরি মিষ্টান্ন খুব সুস্বাদু ছিল। দেশীয় পদ্ধতিতে গুঁড়ের উপর শেওলা চাপা দিয়ে এই চিনি তৈরি হত। স্বাদে ও সুগন্ধে দোলো চিনি ছিল অতুলনীয়। বিদেশে এর যথেষ্ট চাহিদা ছিল। ইউরোপীয়রা চায়ের সাথে এই চিনি ব্যবহার করত। In 1792 there were Shipped for England from Santipur Factories, 1400 m.d’s.  The Calcutta Review 1846, p.p. page 416-418 [1400 m.d’s — 14000 মণ] দোলো চিনির কারখানা ছিল প্রধানত শান্তিপুরের পশ্চিমে সুতরাগড় অঞ্চলে। ১৮৪৫/৪৬ সালে লর্ড বিশপ সুতরাগড়ের বৃহৎ চিনির কারখানার কথা উল্লেখ করে বলেছেন ওই অঞ্চলে ৪০/৫০টি দোলো চিনির কারখানা ছিল। এক-একটি কারখানা থেকে ৫০০ মণ চিনি পাওয়া যেত। ৭০০ জন কর্মী একাজে নিযুক্ত থাকত। জে.এইচ. ই. গ্যারেটের বর্ণনায় উনিশ শতকের শুরুতে শান্তিপুরে এরকম একটি চিনির কারখানার কথা রয়েছে।

মোদক সম্প্রদায়ের মানুষেরাই মূলত এই চিনি প্রস্তুত করত। এখনকার রামপদ সরণী, ষড়ভুজ বাজার, মাতৃসদনের পাশে, হরিপুর স্ট্রীট, বিশ্বাস পাড়া স্ট্রীট প্রভৃতি জায়গায় দোলো চিনির কারখানা ছিল। কারখানার মালিকদের মধ্যে ছিলেন বিষ্ণুচরণ ইন্দ্র, দীননাথ ইন্দ্র, দুর্লভচন্দ্র দাস, মহাদেব নন্দী, গোবর্ধন দে, রামহরি দাস, মহেশ নন্দী।  কাছেই হরিপুরের খালে এক ইঞ্চি থেকে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ আকারের একধরণের জলজ শেওলা হত। একে এমনিতে ‘ফিতে শেওলা’ বলা হত। এইটি চাপা দিয়ে খেজুরগুড় থেকে এই ‘দোলো’ চিনি পাওয়া যেত। কয়েকদিন শেওলা চাপা দিয়ে রাখলে গুঁড়ের পিচ্ছিল অংশ জলের সাথে বার হয়ে যেত এবং গুঁড়ের লাল রং কেটে সাদা রং-এ পরিণত হত। তারপর সেটা রোদে শুকিয়ে দোলো চিনি তৈরি হত।

সমগ্র শীতকাল জুড়ে শান্তিপুরে দোলো চিনি তৈরির এই প্রক্রিয়া চলত। শীতকালে এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে খেজুরগুড় পাওয়া যেত।  তাছাড়া মাজদিয়া, যশোর জেলা, কৃষ্ণগঞ্জ, হাঁসখালি থেকে কলসি ভরে খেজুরগুড় আসত। যশোর জেলার কোটচাঁদপুর থেকে মশকে (চামড়ার থলি) করে উৎকৃষ্ট গুঁড় আসত। এক একটি মশকে ৬০ কেজি গুঁড় থাকত। ইংরেজরাও শান্তিপুরের চিনির ব্যবসাতে অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। একটি হিসাবে দেখা যায় ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি ২০,৫১৬ টাকা ৭ আনা ৬ পাই বিনিয়োগ করে। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে ওই টাকা ১,২১,০০০ হয়ে কোম্পানির হাতে ফিরে আসে। ৫৪% লাভে ওই চিনি বিলাতে বিক্রি হয়েছিল।১৯ কিন্তু উনিশ শতকের শেষদিক থেকে মরিশাস ও জাভা থেকে ভারতে বিদেশী চিনি আমদানি হতে থাকে। অল্পদামে সেই চিনি বিক্রি হতে থাকে। ফলে বিদেশী চিনির সাথে প্রতিযোগিতায় দেশীয় দোলো চিনি তার বাজার হারাতে থাকে। পরিশোধিত চিনির প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হয়। ধীরেধীরে দোলো চিনির কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। এ অঞ্চলের নিধিরাম রক্ষিত এ শিল্পের শেষলগ্ন পর্যন্ত ব্যবসা চালিয়ে গেছেন।

শান্তিপুরের আশেপাশের অঞ্চল থেকে উৎকৃষ্ট মানের ছানা পাওয়া যেত। ছানা আসত বেলেডাঙ্গা, হিজুলী, গয়েশপুর, রঘুনাথপুর, বাগআঁচড়া, বয়রা, শান্তিপুর ঘুরপেকে পাড়া, লক্ষ্মীতলা পাড়া প্রভৃতি অঞ্চল থেকে। উৎকৃষ্ট শ্রেণীর ছানা উৎপাদনকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হারাণ ঘোষ (বেলেডাঙ্গা), দুর্গাপদ ঘোষ (গয়েশপুর), বলাই ঘোষ (বাগআঁচড়া), কার্তিক ঘোষ (ঘুরপেকে পাড়া), রতন ঘোষ (লক্ষ্মীতলা পাড়া) প্রমুখ।

শান্তিপুরের একটি স্বনামধন্য মিষ্টি হলো নিখুঁতি। শান্তিপুরের নিখুঁতি নদিয়া জেলার অন্যান্য অঞ্চলের নিখুঁতির থেকে আকারে ও  স্বাদে আলাদা। দেখতে অনেকটা ভাঙা ছানার জিলাপীর অংশ বলে মনে হয়। নাম থেকেই বোঝা যায় এটি হলো খুঁত বিহীন মিষ্টি। শান্তিপুরের নিখুঁতি ছানা দিয়ে তৈরি এবং লম্বাটে। আর নদিয়া জেলার অন্যান্য জায়গার নিখুঁতি ছানা ও ক্ষীর উভয়ের মিশ্রণে তৈরি এবং গোল করে বাঁধা। জলবিহীন ছানার সাথে অল্প ময়দা, চিনি ও চালের গুঁড়ো মিশিয়ে মাখা হয়। তারপর সেই ছানা প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা করে ভেজে চিনির রসে চুবানো হয়। প্রতিটি নিখুঁতির ভেতর বড় এলাচের দানা দেওয়া থাকে। বিক্রির সময় অল্প গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রসজ্ঞ কবির ভাষায়—

খাসামোয়া, কাঁচাগোল্লা, নিখুঁতি এ মিষ্টান্ন সকল।

বাখানিব কত যার নাম মাত্র জিবে আসে জল।।

শান্তিপুরের প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন খাসামোয়া এখন কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। খাসামোয়া তৈরিতে লাগতো পরিষ্কার কনকচূড় খই, গাওয়া ঘি, দোলো চিনি ও জাইফল। গাওয়া ঘি ও দোলো চিনির অভাবে খাসামোয়া এখন আর হয় না। সুতরাগড়ের ঘোষেরা গরুর দুধ থেকে গাওয়া ঘি তৈরি করতেন। ব্রিটিশ আমলে সেই ঘি খেয়ে নাকি এক সাহেব মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং সেই ঘি-এর উপর গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে এই ঘি এত সুস্বাদু কারণ এখানকার গোখাদ্য ঘাস। ঘাসেই আছে এক বিশেষ উপাদান। সেই উপাদানই এই উৎকর্ষের কারণ। সুতরাং দোলো চিনির মতো গাওয়া ঘি তৈরিতেও শান্তিপুরের খ্যাতি ছিল বলা যায়। খাসামোয়া তৈরি করতে প্রথমে চিনির পাকে খই জারিয়ে নেওয়া হত। তারপর গাওয়া ঘি ও জায়ফল গুঁড়ো তাতে ভালো করে মিশিয়ে মোয়া বাঁধা হত। এই খাসামোয়া ছিল শান্তিপুরের ঐতিহ্য মিষ্টান্ন। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১৩৭৯ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় একটি তুলনা প্রসঙ্গে লেখা হয়—

শান্তিপুরের খাসা খই,

বর্ধমানের বসা দই,

বঁধু আমি তোমা বই,

আর কারো নই নই।

নবদ্বীপ বাংলার একটি প্রাচীন জনপদ। ভাগীরথী ও জলঙ্গী নদীর মিলনস্থল হলো নবদ্বীপ। একটি মতে দুই নদীর মিলনস্থলে নতুনভাবে জেগে ওঠা চরা বা দ্বীপ থেকে এই জনপদের নাম ‘নবদ্বীপ’ হয়েছে। আবার অন্যমতে ‘নব’ মানে নতুন নয়; এ হলো সংখ্যা নয়। নতুনভাবে জেগে ওঠা ওই চরে এক মহান তন্ত্রসাধক আশ্রয় নিয়েছিলেন। লোকচক্ষুর আড়ালে তিনি ওখানে বসে গুপ্ত সাধন-ভজন করতেন। সাঁজের বেলায় নবগ্রহের উদ্দেশ্যে জ্বেলে দিতেন নয়টি প্রদীপ। এর থেকেই ঐ দ্বীপের নাম হয় নব-দীপ, এবং সেখান থেকেই নবদ্বীপ। গোয়াড়ি-কৃষ্ণনগর থেকে প্রায় সাত ক্রোশ দূরে নবদ্বীপ। এখানকার ময়রারা বৃহৎ রাজভোগ তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এখন যা খুব একটা দেখা যায় না। নবদ্বীপের আর একটি বিখ্যাত মিষ্টান্ন হলো অমৃতি। কলাই ডাল গুঁড়ো করে মেখে জিলিপির মতো করে ভাজা হত। তারপর রসে চুবিয়ে বিক্রি করা হত।

নবদ্বীপের লাল দই খেতে বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা নবদ্বীপে এসে হাজির হন। ছুরি ছাড়া কাটা যায় না বলে ‘চাক্কু দই’ নামেও এটি পরিচিত। নবদ্বীপের লাল দই করতে কাঠের উনানে ছ’ থেকে সাত ঘন্টা ঢিমে আঁচে দুধ জ্বাল দিতে হয়। দুধে যতক্ষণ না লাল রঙ ধরবে ততক্ষণ ‘ফুট’ চলতেই থাকবে। দুধ তৈরি হলে মাটির হাঁড়িতে দুধ ঢেলে নিভন্ত উনানের চারপাশ ঘিরে বসিয়ে দেওয়া হয়। হাঁড়ির গায়ে চট জড়িয়ে সারারাত রেখে দেওয়া হয়। সকাল হতে হতে দই জমে পাথর হয়ে যায়। নবদ্বীপের লাল দইয়ের জন্মকাল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ বলে ধরা হয়। এই লাল দই তৈরি করেছিলেন নবদ্বীপ ফাঁসিতলা নিবাসী ময়রা কালী ঘোষ। কালী ঘোষ ও হরি ঘোষ ছিলেন দুই ভাই। তারা মূলত দই এবং ঘোল তৈরি করতেন। মরা আঁচে মোষের দুধে অল্প অল্প জল দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে ফুটিয়ে দুধকে ঘন করা হত। অনেকক্ষণ জ্বাল দেওয়ায় সেই দুধ লাল হয়ে যেত। তাই দিয়ে ঘোল তৈরি করতেন দুই ভাই। তাদের তৈরি ঘোল লাল ঘোল বলে এলাকায় পরিচিত ছিল। লাল ঘোল থেকেই সম্ভবত লাল দইয়ের ভাবনা। নবদ্বীপের লাল দইয়ের আবিষ্কারক হিসেবে অনেকে আবার কালীপদ মোদকের নাম করেন। যিনি কালী ময়রা নামে খ্যাত ছিলেন।

বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ের প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ল্যাংচার আঁতুড়ঘরও নদিয়া। অষ্টাদশ শতাব্দীর চালচিত্রে লেখা নারায়ণ সান্যালের গবেষণাধর্মী ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘রূপমঞ্জরী’তে সেই কিসসাটি বর্ণিত হয়েছে। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের একটি কন্যার বিবাহ হয়েছিল বর্ধমান রাজার এক পুত্রের সঙ্গে। বিবাহের কয়েকবছর পর মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়। তার মুখে কিছুই রোচে না। তার শাশুড়ী— বর্ধমান মহিষী— নানা সুখাদ্য নিয়ে আসেন; কিন্তু পুত্রবধূ শুধু মাথা নাড়ে। একদিন তিনি জনান্তিকে বৌমাকে চেপে ধরেন, বল মা, তোমার কী খেতে ইচ্ছে করছে? বালিকাবধূ নতনেত্রে বলেছিল ‘ল্যাংচা’! শুনে রানীমা আকাশ থেকে পড়েন? আসলে বাপের বাড়িতে থাকতে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে ঐ বালিকাবধূ একটা মিষ্টান্ন খেয়েছিল, যার নাম সে ভুলে গেছে। যে তৈরি করত তার একটা পা খোঁড়া! সেই ল্যাংচা-মেঠাইওয়ালার সেই বিশেষ মিষ্টান্নটি আস্বাদনের সাধ হয়েছে আসন্নপ্রসবার। কথাটা সে মুখ ফস্কে বলে ফেলেছে। জানাজানি হলে বেচারি নিদারুণ লজ্জা পাবে। অতঃপর রাজমহিষী গোপনে সংবাদটা বর্ধমানরাজকে জানান। তারপর রাজাবাহাদুরের জরুরী এবং গোপনপত্র নিয়ে এক বিশ্বস্ত অশ্বারোহী দ্রুত নদিয়া থেকে সেই খঞ্জ ময়রাকে বন্দী করে আনেন। কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমতিক্রমে বর্ধমানরাজ সেই খঞ্জ ময়রাকে শহর বর্ধমানের পুবে চারক্রোশ দূরে বড়শূল গ্রামে একটি ভূসম্পত্তি দান করেন। এইভাবে ল্যাংচা-বিশারদ বর্ধমানে প্রতিষ্ঠা পেল। বড়শূল থেকে আধক্রোশ দূরত্বে বাদশাহী সড়কের উপর শক্তিগড় গ্রামে তার দোকান দেওয়া হলো। সেই খঞ্জ ময়রা সব পেল, কিন্তু খোয়ালো তার আবিষ্কৃত মিষ্টান্নের আদিম নামটা। সেটা হয়ে গেল ল্যাংচা!  ঔপন্যাসিকের মতে সময়কালটি ছিল ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দ। অর্থাৎ এটিকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের(১৭২৮-১৭৮২ খ্রি.) একটি ঘটনা বলে ধরা যায়।

ছানার গজা এমন একটা মিষ্টি যেটা এখনকার দিনে বিশেষ হয় না। কারণ এই মিষ্টি তৈরিতে দীর্ঘ সময় লাগে। প্রথমে ছানা নিয়ে সেটাকে মেজে চটকে নিতে হয়। তারপর ছানার সাথে ময়দা ও এলাচ মিশিয়ে আবার ভালো করে মেজে নিতে হয়। ছানার গজা পুরনো রসে করতে হয়। গাদের ভেতরে যে রস থাকে সেটা বার করে পুরনো রসে দেওয়া হয়। এতে ছানার গজা তাড়াতাড়ি লাল হয়। ‘গাদ’ বলতে চিনির রস থেকে যে লেয়ারটা ওঠে সেটা।  রসটা তৈরি হলে ছানা পিস পিস করে গরম রসে ফেলা হয়। দীর্ঘক্ষণ রসে সিদ্ধ হবার পর ছানার পিসগুলো ফুলে লাল হয়ে যায়। এবার জল খাইয়ে রসকে পাতলা করতে হয়। তারপর ঠাণ্ডা হলে রস থেকে ছানার গজা  তুলে পাত্রে সাজানো হয়।

শুধু ছানা বা ক্ষীরের তৈরি মিষ্টান্নই নয়, বেসনের মিষ্টিরও চল নদিয়াতে ছিল। বেসনের তৈরি একটা প্রাচীন মিষ্টান্ন হলো পক্কান্ন। এখনকার ময়রারা পক্কান্ন বা পক্কান খুব একটা তৈরি করেন না। পূজোর সময় নদিয়া জেলার দুএকটি দোকানে কেবল পক্কান্ন পাওয়া যায়। নদিয়ার মধ্যে কৃষ্ণনগর ও শান্তিপুরের পক্কান্নের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। প্রথমে বেসন শক্ত করে মাখতে হয়। তারপর ডলনা দিয়ে বেসনের ঝুরি বার করে রিফাইন তেলে সেগুলো ভাজা হয়। এরপর কড়াইয়ে আখের গুঁড়ের পাক দিতে হয়। গুঁড়ের পাক সম্পূর্ণ হলে কড়াই নামিয়ে ‘বীজ মেরে’ ঠাণ্ডা করে নিতে হয়। গুঁড় যাতে শুকিয়ে না যায় তার জন্য ‘বীজ মারা’ হয়। তারপর ঝুরি গুলো গুঁড়ের মধ্যে ঢেলে, একটু কুপিয়ে নিয়ে, যখন জমে আসে তখন গোল করে বেঁধে নেওয়া হয়। এভাবে তৈরি হয় সুস্বাদু পক্কান্ন।

নদিয়া জেলার বহুল প্রচলিত একটি মিষ্টি হলো মণ্ডা। কম মূল্যের মিষ্টান্ন হিসেবে এর বিশেষ জনপ্রিয়তা। সন্দেশের মতো পাক করে মণ্ডা তৈরি হয়। ময়রাদের ভাষায়, একটু চিনি বেশি আরকি। মণ্ডা তৈরিতে রসের উপরকার যে ‘ভোগ’ পড়ে তা দেওয়া হয়, ভাঙা মিষ্টি চটকে দেওয়া হয়, তার সাথে ছানা, একটু ক্ষীর, একটু খেজুরগুড় দিয়ে, একসাথে কড়াইয়ে পাক দিতে হয়। তারপর কড়াই নামিয়ে ‘বীজ মেরে’ সেটা ঠাণ্ডা করে নেওয়া হয়। এবার অল্প অল্প করে নিয়ে গামছা পাতা পাটার উপর ফেলা হয়। এভাবে তৈরি হয় মণ্ডা।

নদিয়ার মিষ্টান্ন প্রসঙ্গে নবদ্বীপের ফেনি বাতাসার কথা না বললেই নয়। পায়েস রান্নাকে সুস্বাদু করার জন্য এটি খুব প্রয়োজনীয় মিষ্টান্ন। নদিয়ার মুড়াগাছার ছানার জিলিপি তেমনি আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। নদিয়ার আরেকটি মিষ্টান্ন হলো নলেন গুঁড়। নলেন গুঁড় অর্থাৎ নতুন খেজুরগুড়। বাঙালির শীত পানসা হত যদি খেজুরগুড় না থাকতো। আর পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলা খেজুরগুড়ের অন্যতম জোগানদার। উলার সন্দেশ ছিল নামকরা। নদিয়া জেলার রানাঘাট অঞ্চলের একটি প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ছিল পানতুয়া। ‘উনিশ শতকের রানাঘাট’ গ্রন্থে পানতুয়াকে এই শতাব্দীর বিখ্যাত মিষ্টান্ন দ্রব্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রকম নদিয়া জেলার বহু জনপদই তার মিষ্টান্নের জন্য প্রসিদ্ধ।

বাংলা তথা ভারতের আর্থ-সাংস্কৃতিক মানচিত্রে নদিয়ার মিষ্টান্ন শিল্পের এক বিশেষ জায়গা রয়েছে। এর পশ্চাতে এই জেলার ময়রাদের পারদর্শিতা, সুনিপুণতাকে বিশেষ কৃতিত্ব দিতেই হয়। কৃষ্ণনগরের ময়রাদের কথা আগেই বলা হয়েছে। এছাড়াও নদিয়া জেলার বেশ কিছু ময়রা সুনাম অর্জন করেছিলেন। উলার নীলকমল, রাখাল, হিরু এবং মোহিনী ময়রানী এবং শান্তিপুরের বামুন ময়রা অত্যন্ত সুনাম করেছিলেন। এই জেলার মিষ্টান্নের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এগুলি মোটা রসের মিষ্টি। নদিয়ার মিষ্টান্ন শিল্প একাধিক পরিবর্তনের সাক্ষী। নদিয়াবাসী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মিষ্টির আকার, রূপ, স্বাদ পাল্টাতে দেখেছে। কৃষ্ণনগরের সরভাজা-সরপুরিয়ার প্রসঙ্গেও একথা বলা চলে। এখনকার সরভাজা-সরপুরিয়ার সাথে নাকি পূর্বেকার সরভাজা-সরপুরিয়ার বিরাট ফারাক রয়েছে। এই জেলার অনেক মিষ্টান্ন আবার কালের নিরিখে হারিয়ে গিয়েছে। কৃষ্ণনগরের সরতক্তি, শান্তিপুরের দোলো চিনি, খাসামোয়া এর মধ্যে অন্যতম। তবুও একাধিক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেলেও, এই জেলার মিষ্টান্ন এখনও দেশ বিদেশের মানুষদের আকৃষ্ট করে।

লেখক: আঞ্চলিক ইতিহাস লেখক, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন