পৃথিবীর কোন জাতিগোষ্ঠীর ভাষাই একদিনে জন্ম হয়ে বর্তমান অবস্থায় আসেনি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বাঙালি ও তার ভাষা বাংলা ক্রমবিবর্তনের ধারায় এক হাজারের বেশি সময় ধরে নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। হাজার বছরেরও আগে আজকের বাংলা ভাষা শুনতে আজকের মতো ছিল না, বর্ণমালাও কিন্তু এ রকম ছিল না। শত শত বছর ধরে পরিবর্তিত হতে হতে আজকে বাংলা ভাষা বৈচিত্রময় ও সমৃদ্ধশালী হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভাল, প্রত্যেকটা জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সত্তার প্রধান বাহক হল তার মুখে বলার ভাষা। দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া মুখে বলা ভাষাই এক সময় লেখ্য রূপ নেয়,। বাঙালি জাতির মুখের ভাষা হল বাংলা ভাষা। আদিতে বাঙালির মুখের ভাষার লেখ্যরূপ ছিল সাধু ভাষায়, যা এক সময় চলিত বা চলতি লেখ্য রূপে আত্ম প্রকাশ করে। এর বাইরে প্রমিত ভাষার (Standard Language) চলিত রূপের পাশাপাশি প্রচলিত অঞ্চলবিশেষের জনগোষ্ঠী কর্তৃক ব্যবহৃত আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে, আজ তার মৌখিক রূপ থেকে বাংলা সাহিত্যে লেখ্য রূপের মর্যাদা লাভ করেছে।
বাংলাদেশের অঞ্চল বিশেষের আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্যতা সম্বন্ধে আলোচনা করার আগে সাধু ভাষা ও চলিত ভাষার উপর স্বল্পপরিসরে বলে নেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের প্রসারকালে সাধু ভাষার দুটি রূপ দেখা গিয়েছিল : বিদ্যাসাগরী ও বঙ্কিমী। প্রথমটিতে খ্যাত ছিলেন বাংলা গদ্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর ভাষা বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দবহুল, যাতে অসংস্কৃত শব্দ পরিহারের প্রয়াস দেখা যায়।
বিদ্যাসাগরের লেখা বেতালপঞ্চবিংশতি থেকে সাধু ভাষার লেখ্যরূপের উদাহরণ এমন : ‘এই পরম রমণীয় স্থানে কিয়ৎক্ষণ সঞ্চরণ করিয়া, রাজকুমার অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইলেন এবং সমীপবর্তী বকুলবৃক্ষের স্কন্ধে অশ্ববন্ধন ও সরোবরে অবগাহনপূর্বক, স্নান করিলেন; অনন্তর, অনতিদূরবর্তী দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দিরে প্রবেশপূর্বক দর্শন, পূজা, ও প্রণাম করিয়া কিয়ৎক্ষণ পরে বহির্গত হইলেন।’
অন্যদিকে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে সাধু ভাষার লেখ্যরূপ এমন : ‘অনেক দিন আনন্দোত্থিত সঙ্গীত শুনি নাই, অনেক দিন আনন্দ অনুভব করি নাই। যৌবনে যখন পৃথিবী সুন্দর ছিল, যখন প্রতি পুষ্পে পুষ্পে সুগন্ধ পাইতাম, প্রতি পত্রমর্মরে মধুর শব্দ শুনিতাম, প্রতি নক্ষত্রে চিত্রা-রোহিণীর শোভা দেখিতাম, প্রতি মনুষ্য-মুখে সরলতা দেখিতাম, তখন আনন্দ ছিল। পৃথিবী এখনো তাই আছে, কিন্তু এ হৃদয় আর তাই নাই।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্প উপন্যাসে সাধু ভাষার বহুল প্রয়োগ দেখা যায়। তিনি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বাংলা ভাষা বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠা পায়। নদীয়ার শান্তিপুরের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা আদর্শ চলিত ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। মূলত তাদের মুখের চলিত মুখের ভাষার আদলে লেখ্য রূপ হিসাবে গল্প উপন্যাসের ভাষার মর্যাদা লাভ করে এক সময়। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী’র স্বামী সুসাহিত্যিক প্রথম চৌধুরী চলিত ভাষায় গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, পত্র লিখতে অগ্রণীভূমিকা পালন করেন। আসলে নদীয়া অঞ্চলের চলিত ভাষাই কলকাতা ও কলকাতার আশপাশের অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা হিসাবে সমাদৃত হয়। ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় স্বতন্ত্র শ্রেণির প্রমিত ভাষা গড়ে উঠলেও ঢাকায় তা হয়নি; এমনকি ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ার পরেও নয়।
বাংলদেশের কথ্য ভাষা অঞ্চল ভেদে বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। ভাষাবিদরা বাংলদেশের কথ্য ভাষার বিভিন্ন হেতু একে বাংলাদেশের উপভাষাসমূহ নামে অভিহিত করেন। তারা বাংলাদেশের উপভাষাসমূহ প্রধানত চার শ্রেণিতে ভাগ করেন। যেমন ১. উত্তরবঙ্গীয় দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া ও পাবনায় প্রচলিত উপভাষা; ২. রাজবংশী রংপুরের উপভাষা; ৩. পূর্ববঙ্গীয় (ক) ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বরিশাল ও সিলেটের উপভাষা, (খ) ফরিদপুর, যশোর ও খুলনার উপভাষা এবং ৪. দক্ষিণাঞ্চলীয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও চাকমা উপভাষা।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের উপভাষাগুলিকে প্রধানত দু শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয় ১. রাঢ়ী ও ঝাড়খন্ডী (দক্ষিণ-পশ্চিম বর্ধমান ও প্রেসিডেন্সি বিভাগের অধিকাংশ) এবং ২. বরেন্দ্রী ও কামরূপী (গোয়ালপাড়া থেকে পূর্ণিয়া পর্যন্ত)। এছাড়াও এ অঞ্চলের আদিবাসী জনগাষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে।
প্রমিত বাংলা ভাষা উপভাষায় কেমন রূপ লাভ করে তা একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে। যেমন ‘ছেলে’ শব্দটিকে বিভিন্ন উপভাষায় যেভাবে উচ্চারণ করা হয় তা হলো এরূপ : পো (মেদিনীপুর), ব্যাটা (মালদহ), বেটা (মানভূম), ছা (সিংহভূম), ছাওয়াল (খুলনা, যশোর), ব্যাটা ছৈল (বগুড়া), পোলা (ঢাকা, ফরিদপুর), পুত (ময়মনসিংহ), পুয়া (সিলেট), পুতো (মণিপুর), পোয়া (চট্টগ্রাম, চাকমা) এবং হুত (নোয়াখালী)
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক মৌখিক ভাষার উদাহরণ তুলে ধরলে ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণের আঞ্চলিক বা উপভাষার পার্থক্য দৃশ্যমান হয়। বহুল ব্যবহারের জন্য উপভাষাভাষী ও প্রমিত ভাষাভাষীদের মধ্যে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। প্রকৃত পক্ষে, বাংলা ভাষার মৌখিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুইটি ভাষারীতি সমানভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সাধারণভাবে শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে লেখ্য ও কথ্যরূপে প্রমিত চলিত বাংলা, লিখিতরূপে ও পাঠ্যপুস্তকে সাধু ও চলিত রীতি এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাভাষীদের মধ্যে মৌখিক ভাষারূপে উপভাষা ব্যবহৃত হয়। প্রমিত বাংলা ব্যবহারকারীরা চলিত রীতি ব্যবহার করে থাকে। উপভাষা অঞ্চল থেকে আগত ভাষাভাষীরা বাংলা ভাষার দুটি রূপ ব্যবহার করে। তারা বাড়িতে আঞ্চলিক রূপ এবং সর্বসাধারণের সঙ্গে ও শিক্ষার প্রয়োজনে চলিত রীতিতে প্রমিত রূপ ব্যবহার করে। বর্তমানে পাঠ্যপুস্তকে সাধুরীতির লেখ্য রূপের পরিবর্তে প্রমিত চলতি রূপই ব্যবহৃত হচ্ছে।
সত্যিকথা বলতে বাংলা ভাষার বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক বা উপভাষা আজ প্রমিত চলিত ভাষা সর্ব্ ক্ষেত্রে চালু হওয়ায় নিজ নিজ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের আঞ্চলিক ভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে। এটা বড়ই দু:খের বিষয় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের লেখাপড়া শেখা মানুষজন নিজের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে লজ্জাবোধ করে থাকে, যাতে তারা বাঙাল হিসাবে বিবেচিত হয় এই ভয়ে। অথচ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রমিত ভাষার পাশাপাশি এক বা একাধিক আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা (Dialect) ব্যবহার রয়েছে।
আজ ইংরেজি আর্ন্তজাতিক ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে, পৃথিবীর বহু ভাষা থেকে শব্দাবলী ইংরেজি ভাষার অর্ন্তভুক্ত হয়েছে, তা আঞ্চলিকই হোক কিংবা প্রমিত ভাষাই হোক।
বাংলা ভাষার আঞ্চলিক বা উপভাষার জেলাওয়ারী উদাহরগুলো উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে : সাধুঃ কোন এক ব্যক্তির দুটি পুত্র ছিল। (১৯০৩ এর আগে), কলকাতাঃ একজনের দুই ছেলে ছিল। (১৯০৩ এর আগে), হাওড়াঃ কোন লোকের দুটি ছেলে ছিল। (১৯০৩ এর আগে), মেদেনীপুরঃ এক লোক্কার দুট্টা পো থাইল। (১৯০৩ এর আগে),
বগুড়াঃ একঝনের দুই ব্যাটা ছৈল আছিল। (১৯০৩ এর আগে), পাবনাঃ কোন মানুষের দুই ছাওয়াল ছিল। (১৯০৩ এর আগে), মাণিকগঞ্জঃ য়্যাক জনের দুইডী ছাওয়াল আছিলো। (১৯০৩ এর আগে), ময়মনসিংহঃ একজনের দুই পুৎ আছিল্। (১৯০৩ এর আগে), নোয়াখালিঃ একজন মাইন্সের দুগা হোলা আছিল্। (১৯০৩ এর আগে), কুমিল্লাঃ এক ব্যাডার দুইডা পুত আসিল, চট্টগ্রামঃ উগগা মাইনষুর দুয়া ফুয়া আসিল্, কিশোরগঞ্জঃ এক ব্যাডার দুগা ছ্যাড়া আসিন, সিলেটঃ এখ ব্যাটার দুইটা ফুয়া আছিল, লক্ষীপুরঃ ওগ্গা ব্যাডার দুগা হোলা আসিল্, বরিশালঃ এইগ্গা ব্যাডার দুগগা ফোলা আসিলো/ এক ব্যাডার দুইডা ছেমরা আল্লেহ, ব্রাক্ষণবাড়িয়াঃ একজন ব্যাডার দুইডা পুত/পোলা আছিল, সিরাজগঞ্জঃ একখান লোকের দুইখান ছাওয়াল আছিল, টাঙ্গাইলঃ এক লোকের দুইটা পোলা আছিলো, গাজীপুরঃ ঐ ব্যাডার দুইডা ছ্যাড়া আছিল, ঢাকাইয়াঃ এক হালার দুইডা পোলা ভি আছিল, খুলনাঃ এট্টা লোকের দু’ডো ছেলে ছিলো, সাতক্ষীরাঃ এক বিটার দুজন ছাবাল ছেল, ফেনীঃ এগ্গা ব্যাডার দুগা হোলা আসিল্, ভোলাঃ একজন মাইনসের দুইডা পোলা আছিল, দিনাজপুরঃ একটা মানসের দুটো সোল আসিল্, যশোরঃ এক বিটার ২ খান ছাওয়াল ছিল, ঠাকুওরগাওঃ এডা লোকের দুডা ছুয়া ছিল, বিক্রমপুরঃ এক ব্যাটার দুইডা পোলা আসিল, জামালপুরঃ আক মাইসের দুইডা পোলা আসিল, রাজশাহীঃ একটা লোকের দুটা ছেলে ছিল, ফরিদপুরঃ ওই লুকের দুডা ছাওল্ আছলো, নড়াইলঃ এক বিটার দুটো ছোয়াল ছিল, কিশোরগঞ্জ: একজনের দুই ফুত্ আছিল, নরসিংদীঃ একটা বেডার দুই ছেরা আছিল, ঢাকাঃ এক ব্যাডার দুইডা পোলা আছিলো, কুষ্টিয়াঃ একটা লোকের দুইডি ছেলি ছিল, চাঁদপুরঃ একটা ব্যাডার আছিল দুইডা ফুৎ, নওগাঃ তার দুইটা চেঙ্গরা ছেল, চাপাইনবাবগঞ্জঃ একজনের দুটা ছেলে ছেল, বগুড়াঃ একজুনের দুকনা ছোল আছলো, পাবনাঃ কোন মাইনষের দুই ছাওয়াল ছিলে, কক্সবাজারঃ উগগো মাইনষুর দু’য়ো পুয়া আইসসিল। আমরা উপরের উদাহরণ থেকে বাংলা ভাষার আঞ্চলিকতা ও বৈচিত্র্যতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারি না।
মনোজিৎকুমার দাস, মাগুরা, বাংলাদেশ।