ডিসেম্বর মাসকে আমার কেন জানি বিষন্নতার মাস বলেই মনে হয়। কেমন যেন একটা না থাকা, না থাকা ভাব চতুর্দিকে। উত্তরে হাওয়ায় একটা না পাওয়ার হাহাকার মিশে থাকে। পাতা ঝড়ে গিয়ে গাছের যেমন একহারা চেহারা হয়, তেমন আমিও নিজেকে কেমন সব হারানো একজন বলে আবিষ্কার করি এসময়ে। কোনও কিছুতে মন বসে না। সন্ধ্যার আজানের ধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করে শুধু। অনেক কান্না, যেন কান্নার গমকে বিগত দিনের সব হাহাকার খেই হারিয়ে ফেলে!
দিনের ভাগ এত কম সময়েই শেষ হয়ে যায় মনে হয় এই তো সবে ঘুম থেকে উঠলাম! এরমধ্যে নাওয়া, খাওয়া সারতেই বেলা ফুরিয়ে রাত এলো! আর দীর্ঘ নিকষ কালো রাত যেন না ফুরানোর সংকল্প নিয়ে আসে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রাত ফুরাতেই চায় না যেন। হাতপা, কোমড় ব্যথা হয়ে যায় মাঝেমধ্যে শুয়ে থাকতে থাকতে! কিন্তু ভোরবেলা মসজিদ থেকে করুণ অথচ পরিপূর্ণ আর্জি শুনেও বিছানা ছাড়তে অলসতা কাজ করে।
এই সময়ে শুয়ে-বসে কল্পনা করতে খুব একটা খারাপ লাগত না। বিশেষত ছোটবেলার ডিসেম্বরের সময়গুলোতে। যখন ডিসেম্বর মানে আমরা ‘ছুটি’ বুঝতাম। ডিসেম্বর মানে ‘পড়তে বসতে হবে না’ বুঝতাম। ডিসেম্বরকে যখন ‘মামার বাড়িতে পিঠা খেতে যাবার সময়’ বলে জানতাম। ডিসেম্বর মানে ‘নতুন ধানের মাড়াই করা খড়ের গাদায় লুকোচুরি খেলা’ বুঝতাম। ডিসেম্বর আমাদের কাছে বহু প্রতীক্ষিত একটা মাসের নাম। যার কারণে জানুয়ারীর ১ তারিখ থেকেই ডিসেম্বরের জন্য অপেক্ষা শুরু হতো।
এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে। প্রাথমিক আর মাধ্যমিকের সব বার্ষিক পরীক্ষা হতো ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। মোটামুটিভাবে ১৪/১৫ তে শেষ হতো। হাতে থাকত ১৫ দিনের মতো সময়। একদম অবসর যাকে বলে। যেদিন পরীক্ষা শেষ হতো সেদিন সবাই বাড়িতে আসার পথে নিজেদের বানানো “১৫ দিন ছুটি গরম গরম রুটি, যদি খেতে চাস মামার বাড়ি যাস” ছড়া বলতে বলতে হুল্লোড় করে বাড়িতে ফিরতাম। মায়ের সাথে ঘ্যানঘ্যান শুরু হতো কবে যাব মামার বাড়িতে। কারণ ওখানে গেলে আর পড়তে হবে না ক’টা দিন। কেউ বলবে না পড়তে বস। বাড়িতে থাকলেই জোর করে হলেও পরের ক্লাসের বই নিয়ে পড়তে বসতে হবে সকাল সন্ধ্যা।
ডিসেম্বরের পর আবার সেই পুরোনো গৎবাঁধা অধ্যায় শুরু হতো। জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে ক্লাস শুরু! নতুন বই, নতুন পড়া, নতুন ক্লাস। শুরুর কিছুদিন ভালোই লাগত। এই ভালো লাগা কী মূল্যবান ছিল তা প্রথম উপলব্ধি করেছি মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে। জানুয়ারি চলে যায় সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা হয় না, নতুন ক্লাসেও উঠতে পারি না, নতুন বইও পাই না, নতুন পড়াও আসে না। সেই পুরোনো বই যা নবম, দশম শ্রেণী মিলিয়ে ২ বছর পড়লাম সেটাই পড়তে হচ্ছে! ভীষণ বিরক্তিকর লাগা শুরু হলো তখন। মনও খারাপ হলো। এই যে নিয়ম বদলের সূচনা হলো সেটার আর পরিবর্তন ঘটল না। আর নিয়ম করে নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন ক্লাস, নতুন পাঠ্যবই, নতুন পড়া পেলাম না। নতুন ক্লাস, পড়া যদিও বা পেলাম কিন্তু নতুন বই আর পেলাম না কখনও! প্রযুক্তির কল্যানে বলি আর অকল্যানেই বলি এখন হাতে বয়ে নিয়ে যাওয়া বই খুব কমই আমরা ব্যবহার করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নোট কপি, শীটের ফাইল, পিডিএফ দিয়েই দিব্ব চলে গেলো ৫/৬টা বছর! পড়ার চাপও কমলো। ঠিক কমলো তা নয়, কমিয়ে নিলাম!
নিয়ম করে ক্লাসে আসা, ইউনিফর্মের বাহার, পড়া করে ক্লাসে উপস্থিত হওয়া, বইখাতার ভারে কাঁধের ব্যাগ মাঝেমধ্যে রাস্তার মাঝখানে ধুলোবালিতে ফেলে দেবার মনোভাব, হরেক রকম টিফিন নিয়ে আসার বায়না, ডিসেম্বরে ফাইনাল পরীক্ষায় বসা সবই এক এক করে জীবন থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করলো!
ডিসেম্বরের যে ছুটির জন্য মন কেমন করতো সেসব এখন বিস্মৃতির অতল গর্ভে তলিয়ে গেছে। হাতড়ে বেড়ালে সেখানে এখন অ্যাটেনডেন্সের কড়াকড়ি, প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট, টিউটোরিয়াল, গ্রুপ প্রজেক্ট, রিসার্চের টপিক, রিপোর্ট এসব ঘুরেফিরে এসে পড়ে!
এখনও চোখ বন্ধ করলে ডিসেম্বরের দিনগুলোতে নিজেকে খুঁজে পাই। যেখানে সন্ধ্যার পর পড়তে বসার তাড়া নেই। ভোরবেলা চুপিচুপি গিয়ে খেজুরের রস নামিয়ে এনে মুড়ি দিয়ে খাবার তৃপ্তি লেগে আছে! নতুন আমন ধানের খুদে বানানো ‘জাউভাত’ আর খেজুরের নলেনগুড় নিয়ে যখন দুপুর রোদে খেতে বসতাম তখন দুনিয়ার সব না পাওয়ার দুঃখ ঘুচে যেত!
মাঠ জুড়ে তখন সর্ষে ফুলের হলুদ চাদরে মোড়ানো থাকত। বত্থুয়া শাকের লোভে ওপাড়ার মেয়েরা যাবার সময় ডাক দিলেই মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে কতক দিন চলেও যেতাম। কাদামাটি মাখা হাতপা নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলেই শুরু হতো “বাপের নাম ভুলিয়ে দেওয়া কঞ্চির মার”! আর যদি মাগরিবের আজান গত হয় তাহলে তো কথাই নেই। তখন শুধু চোখ দিয়ে জল বেরুবে কিন্তু মুখ দিয়ে আওয়াজ হওয়া চলবে না!
চারেদিকের খালবিলের পানি শুকিয়ে যাবার ফলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত তখন। সকালবেলা করে আব্বু মাছ এনেই ডাক দিতেন, “টুনি-মা, এখনও উঠিসনি তোরা! কি সাংঘাতিক কথা! সব ছেলেমেয়েদের পড়া হয়ে গেলো! কখন উঠবি? শিগগির ওঠ। তাড়াতাড়ি এসে দেখে যা কি মাছ এনেছি! একদম তাজা মাছ! এখনও লাফাচ্ছে!” কনকনে ঠান্ডায় কি আর এসব কথা কানে ঢোকে? নাকি ঢোকার মতো কথা! লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েই থাকতাম।
পরীক্ষা শেষ হবার পরের কয়টা দিন ভালোই কাটতো। একদম নিশ্চিত! যেন পড়ালেখার পাট চুকিয়ে ফেলেছি। কিন্তু রেজাল্টের দিনক্ষণ এগিয়ে এলেই বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করত। যেহেতু বাড়িভর্তি সকলেই ছিলেন শিক্ষক! রেজাল্টে একটু উনিশ-বিশ হয়েছে তো ঘরের বাহিরে বের হওয়া বন্ধ। পুনরায় আগের চেয়েও ভালো ফলাফল না করা পর্যন্ত কানের কাছে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা একই কথা বিটিভির একটানা বিজ্ঞাপনের মতো চলতেই থাকত! জীবনটা অতিষ্ঠ মনে হতো। অথচ এখন বুঝি ওই অতিষ্ঠ করা জীবনের সুখ কতখানি গভীর ছিল! হায়রে আমার ডিসেম্বরের দিনগুলো!
আজ ডিসেম্বরের বহু প্রত্যাশিত এই অধ্যায় শেষ হতে চলেছে। শেষ হতে যাচ্ছে সুন্দর স্মৃতির! এই শেষ থেকেই আবার শুরু হবে হয়তো কোনও এক নতুন শুরুর! যে শুরু নতুন করে স্মৃতি তৈরী করবে। ভালো লাগা, খারাপ লাগা মিলে মিশিয়ে দাঁড় করাবে আরেক অধ্যায়ের। যে অধ্যায়ে ডিসেম্বর থাকবে নতুন রূপে, নতুন নামে, নতুন পরিচয়ে। যে ডিসেম্বর ফেলে আসা ডিসেম্বরকে দূর থেকে দেখবে, চোখের জলে ভাসাবে, হাসাবে, কাঁদাবে।
স্মৃতির ভেতর এত বিষাদ, এত আরাম…
এত স্নিগ্ধ বিষাদ মিশে থাকে ডিসেম্বর ক্যালেন্ডারের প্রতি অক্ষরে, কে জানত!
আরও কত বিষাদই তো জীবনের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকে। আমলে না নিলেই কিছু নয়। সুন্দর হোক সবগুলো দিন।