‘জটায়ু’র চরিত্রে অনেকেই অভিনয় করলেও সন্তোষ দত্তকে ভোলা যায় না। অভিনয় জগতে তাঁর মতো বৈগ্রহিক অভিনেতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি ‘জটায়ু ওরফে লাল মোহন গাঙ্গুলী বাস্তবে সন্তোষ দত্ত। অনেকেই বলেন সন্তোষ দত্তর কথা ভেবেই সত্যজিৎ রায় যেন তৈরি করেছিলেন ‘জটায়ুকে। বাংলার রাজনীতি বা সমাজজীবনে এখনো অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছেন ‘জটায়ু। তাই আজও বই আর সিনেমা বাইরে তাকে নিয়ে অসংখ্য বিজ্ঞাপন, মিম ছেয়ে থাকে সোশ্যাল মিডিয়া ঘিরে। এত বছর পরেও রাজ্যে ভুয়া ভ্যাকসিন নিয়ে হইচইয়ের পর সন্তোষ দত্ত ওরফে ‘জটায়ু কে দেখা গেলো নতুন বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বইয়ের নাম ‘ভ্যাকসিনে গ্যামাক্সিন।’
অতিমারীর সময়ে কোভিড বিধি শেখাতেও তিনি ছিলেন সবার আগে — ‘হাতটা স্যানিটাইজ করেছেন তো?’ আবার কাশির সরু গলি জুড়ে গরু দেখে জটায়ু বলেছেন, “একটু সোনা চেয়ে নেবেন নাকি ফেলুবাবু”? কিংবা হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়ার মিমে লাফিং ল্যান্ডমাইন জটায়ুর সেই অমোঘ সংলাপ, ‘তাঙ্গ মাত করো।’
গত শনিবার ২ ডিসেম্বর ছিল তার জন্মদিন। বেঁচে থাকলে তিনি হতেন ৯৮ বছরের। এই চিরসবুজ চিরকালীন অভিনেতার স্মরণে আজকের প্রতিবেদন।
১৯২৫ সালের ঢাকায় জন্ম। ছোট থেকেই অভিনয়-নাটকের প্রতি অসম্ভব নেশা। যদিও থিয়েটারের নেশা বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত।সাত বছর বয়েসে বর্ধমানে বাবারই ক্লাবে নাটক করেন ‘সাজাহান’। নাটকের ঘোর কাটাতেই সংসারমুখী করতে বাবা ছেলেকে বিয়ে দেন খুব অল্প বয়সে। পাত্র বিদ্যাসাগর কলেজের থার্ড ইয়ারের উনিশ বছরের ছাত্র আর পাত্রী এগারো বছরের বালিকবধূ প্রতিমা দেবী।
যদিও বা তাতে বিশেষ লাভ কিছু হয়নি। সিনেমার চেয়ে নাটককে হয়তো একটু বেশি ভালবাসতেন সন্তোষ দত্ত। এক সময় সবিতাব্রত দত্ত, নির্মলকুমারদের নিয়ে ‘আনন্দম’ নাট্যসংস্থাও তৈরি করেন। পরে যার পরিচিতি হয় রূপকার নামে। এই রূপকার গ্রুপের চলচ্চিত্তচঞ্চরী নাটকে সন্তোষ দত্তকে ভবদুলালের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছিলেন সত্যজিৎ।জহুরীর চোখ চিনে নিয়েছিল জহরকে। পরশপাথর থেকে শুরু।এরপর থেকে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আটটি ছবিতে নানান চরিত্রে অভিনয় করেন সন্তোষ দত্ত।
“সোনার কেল্লা” সিনেমার শুটিংয়ের কাজটা ছিল বেশ কঠিন। বিকালে একটা দৃশ্য মনে আছে , যেখানে মরুভূমির মাঝখানে ফেলুদার গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেছিল। সেখান থেকে উঠের পিঠে চড়ে ওরা পৌঁছেছিল রামদেওরা নামে একটি স্টেশনে। অনেক পথ উটে চড়ে ফেলুদা, তোপসে আর লালমোহন বাবু যখন এসে ওই নির্জন স্টেশনে নামলেন, তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে। পশ্চিমদিকে মরুভূমির বালির ওপর আশ্চর্য লালচে আলো ছড়িয়ে পড়েছে।
এতটা পথ উটের পিঠে চড়ে লালমোহন বাবুর পিঠ কিছুটা আড়ষ্ট আর অসার হয়ে গেছিল। তাই তিনি স্টেশনের খালি প্লাটফর্মে হাত পা রেখেছিলাম ব্যায়াম করে নিবেন। এদিকে ধীরে ধীরে সন্ধ্যে হয়ে আসছে… এই সময় ক্যামেরামান কিংবা অভিনেতা যদি কিছু ভুল করে থাকেন তাহলে সমস্ত ভুল শুধরে নিয়ে আবার শুটিং করতে গেলে অন্ধকার হয়ে যাবে।
যদিও শুটিংয়ের অনেক আগেই রিহার্সাল দেওয়া হচ্ছিল। লাঠি স্টেশনে এসে সূর্যাস্তের পর সেই শর্টটা নেওয়া হবে। রিহার্সালের সময় লালমোহনবাবুর মুখ চোখ ভালোই দেখা দিয়েছিল কারন তখন বেশ ভালো রকম রোদ ছিলো। কিন্তু যখন দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি হল তখন সূর্য ডোবার চকচকে লাল আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে লালমোহনবাবুর সারা শরীরটা যেন হয়ে গেল ঘন কালো চলমান ছায়ামূর্তি।
তারপরে অবশ্যই একটা সুবিধা হয়েছে। জটায়ুর ঠোঁট বা চোখ দেখা যায়নি বলে তার ব্যায়ামের ভঙ্গির দিকে দর্শকরা অনেক বেশি মন দিতে পেরেছে। সত্যজিৎ রায় জানতেন, লালমোহন বাবুর যদি মুখ চোখ যদি স্পষ্ট দেখা যেত তাহলে দর্শকের দৃষ্টির অনেকটাই কেড়ে নিতো তার অদ্ভুত মজাদার হাবভাব। তাঁর ডায়ালগ থ্রোয়িং, হাঁটাচলা, তাকানোই ছিল একটা গোটা শিল্প। এমনই বিশিষ্ট বিরল প্রতিভা সম্পন্ন ছিলেন সন্তোষ দত্ত।
সিনেমায় অভিনয় করার মতো তাঁর চাকরি করার কাহিনিও বেশ চিত্তাকর্ষক। সেই আমলে ইম্পেরিয়াল ব্যাংকে (যেটি এখন স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া) ইন্টারভিউ দিতে যান হাফপ্যান্ট পড়ে, চাকরিও পান। লিস্টের প্রথমেই ছিল তার নাম। জয়েন করতে গিয়ে জানতে পারলেন, তিনি যদি চাকরিটা না নেন তবে সদ্যপিতৃহারা একটি ছেলের চাকরি হবে। তখনই ডিসিশন নেন এই চাকরি তিনি করবেন না। অবশ্য পরের মাসেই তার জয়েন করার চিঠি আসে। এমনই মায়াময় ছিলেন মানুষটি। সর্বদা বিপাকে পরা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেন।
ব্যাঙ্কে ১৪ বছর চাকরি করার পর হঠাৎ করে ট্রান্সফারের অর্ডার আসে উড়িষ্যায়। সঙ্গে সঙ্গে চাকরি ছেড়ে দিলেন। সময়টা ছিল খুব চ্যালেঞ্জিং। হাড়ভাঙা পরিশ্রম আইনি পেশায়, সঙ্গে চলছিলো শুটিং। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সব সময় পাশে ছিলেন স্ত্রী প্রতিমা দেবী।
নামকরা আইনজীবি ছিলেন সন্তোষ দত্ত। ক্রিমিনাল ল’ইয়ার হিসেবে তুখোড় ইংরেজিতে একের পর এক প্রশ্নবানে ধরাশায়ি করে দিতেন প্রতিপক্ষকে। অথচ অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী এই মানুষটি কিন্ত জটায়ুর চরিত্রে সঠিক ইংরেজি বলতে গিয়ে দশবার হোঁচট খেয়েও শেষমেশ অবধারিত ভাবেই ভুল বলতেন। এটা সন্তোষ দত্তই পারতেন।
কৌতুক অভিনেতা হিসেবে যতটা স্বীকৃতি, সম্মান ও অর্থ পাওয়ার কথা ছিল তা কোনদিনই তিনি পাননি। সত্যজিৎ রায় ঠিকই বলতেন, তুলসি চক্রবর্তী, উৎপল দত্ত, রবি ঘোষ, সন্তোষ দত্ত-র মতো অভিনেতারা বিদেশে জন্মালে একাধিক অস্কার পেতে পারতেন। এক অদ্ভুত অভিমান কষ্ট যন্ত্রণা নিয়ে ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে লাং ক্যান্সারে টানা ছ-মাস চিকিৎসা চলার পর ৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮ না ফেরার দেশে হাঁটা দিলেন সন্তোষ দত্ত।
সন্তোষ বাবু থাকতেন ৪৯-এ আমহার্স্ট স্ট্রিটের পৈত্রিক বাড়ি ‘সুরধনী কুটীর’-এ । সন্তোষ বাবুর পৈত্রিক বাড়ি এটি। দেড়শ বছরের পুরনো এই বাড়ীতেই আমৃত্যু কাটিয়েছেন। ক্রিমিনাল লইয়ার হিসেবে তার চেম্বারটিও ছিল এই বাড়িতে। মৃত্যুর দিন এখানে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়, রবি ঘোষ, তপন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখেরা। এ বাড়ির দোতালায় শায়িত ছিল সন্তোষবাবুর মরদেহ। পুরনো বাড়িটির সরু সিঁড়ি বেয়ে ওঠাও কষ্টকর ছিল।
সন্তোষ বাবুর মৃত্যুর কিছুকাল পর তাঁর প্রিয়জনেরা বাড়িটি বিক্রি করে দেন। নতুন মালিক সাবেক দোতলা বাড়ির উপর আরো একটি তলা তুলেছেন। বাড়ির সামনে থেকে সন্তোষ বাবুর নেমপ্লেট সরিয়ে নয়া মালিকের নাম বসানো হয়েছে। এমনকি বাড়ি বিক্রির কিছুদিন পর ওজনদরে বেচে দেয়া হয়েছিল সমস্ত জিনিসপত্র, যার মধ্যে ছিল সোনার কেল্লায় অভিনয় সুবাদে সন্তোষ বাবুর বিশেষ স্বীকৃতি শংসাপত্রটিও।
২০২৫ সালে সন্তোষ বাবুর জন্মশতবার্ষিকী। স্থানীয় ২৭ নম্বর ওয়ার্ড সিটিজেনস ফোরাম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমহার্স্ট রো-র বাড়ীর কাছেই স্মৃতিফলক বসানোর। পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে চলে গেছেন সন্তোষ দত্ত তবু ‘জটায়ু’কে হারিয়ে দিতে চাননা কেউই।
“জটায়ু”লালমোহনবাবু” আর সন্তোষ দত্ত* সবাই এক কিন্তু অসাধারণ উৎকৃষ্ট
অভিনয়ের গুণে তিনি প্রত্যককে আলাদা করেছেন প্রত্যেকের থেকে কিন্তু একই
রয়ে গেছেন নিজ গুণে আর অদ্বিতীয় সত্যজিত*বাবুর সংস্পর্শে।মহানুভব অসম্ভব
জনপ্রিয় এই মানুষটির জনপ্রিয়তা কোনো বিশেষ বিখ্যাত নায়ক নায়িকার চেয়ে
কোনো অংশে কম ছিলোনা।আজও কানে বাজছে লালমোহনবাবুর একটা বিশেষ
সংলাপ,- “কাঁটাগুলো কি বেছে খায়?”।বাংলা বাঙ্গালী মাছ বেছে খেতে জানে আর জানে বেছে রাখতে ভালোবাসায় শ্রদ্ধার বিশেষজনকে “শ্রী সন্তোষ দত্ত” সেই
বিশেষ গুণীজনের একজন যাকে আমরা ভীষণ ভালোবাসায় সুরক্ষিত রেখেছি
মনের মণিকোঠায়।
শ্রী তুলসী চক্রবর্তী* সেই রকমই একজন ভালোবাসা শ্রদ্ধার আসনে সংরক্ষিত প্রিয় জনের একজন।তিনি উপেক্ষিত নন,তিনি স্মৃতিঘরে ধুলি মলিন যার ছবিতে
সময়ের ধুলিছাপ।আপনি সেই ধুলাবালি সরিয়ে স্মৃতিঘর আলোকিত করলেন।
ভালোলাগা ভালোবাসা অফুরান।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এত সুন্দর একটি মতামতের জন্য।