আজ বাইশে শ্রাবণ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮২ তম প্রয়াণ দিবস। কবিগুরুর সৃষ্টি আমাদের মনে করিয়ে দেয় মৃত্যুর মধ্য দিয়েই বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা ঘোষিত হয়। তাই কবির প্রয়াণ দিবসে দৈনন্দিন জীবনধারার সবুজ পতাকাকে জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসব পালিত হয়।কবি নিজের জীবনকালেই বহুবার পালন করেছেন এই বৃক্ষোৎসব।
বৃক্ষরোপণ যে একটি উৎসব হতে পারে, তা কবি প্রত্যক্ষ করেছিলেন বিদেশে গিয়ে। ১৯১৬ সালে জাপানের ভ্রমণের সময় ওকাকুরার সমাধিতে তাঁর ছেলের উপস্থিতিতে একটি ছোট্ট ফার গাছ রোপন করেন। এরপর ইটালি ভ্রমণের সময় একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বাগানকরা, সংগীত চর্চার উৎসাহ দেখে রবীন্দ্রনাথের নিজের আশ্রমের কথাই মনে পড়েছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথের আগমনকে চিরস্মরণীয় রাখতে একটি জলপাই গাছের চারা রোপন করেন।
ওই বছরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাঙ্গেরির ব্যালাটন ফ্লুরেডে সাহিত্যিক ‘সান্দুর কিসফালুদি’র একটি মর্মর মূর্তির সামনে ‘লাইম ট্রি’ এর চারাগাছ রোপন করেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন–ব্যালাটন ফ্লুরেডের বেলাভূমি আকাশ ও জলের এমন অপূর্ব ঐক্যতান আমার অন্তরআত্মাকে উন্মিলিত উদ্ভাসিত করে।এই অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে চার লাইনের একটি কবিতা ও তার ইংরেজি অনুবাদ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন। আজও সেখানে পাথরের বেদিতে খোদাই করা রয়েছে তাঁর কবিতা।
“When I am no longer on this earth, my tree, Leth the ever-renewed leaves of thy spring. Murmur to the wayfahrer The poet did love while he lived.”
বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘হে তরু, এ ধরাতলে/ রহিব না যবে /তখন বসন্তে নব পল্লবে পল্লবে/তোমার মর্মরধ্বনি/ পথিকেরে কবে,/ভালো বেসেছিল কবি বেঁচে ছিল যবে।’
শান্তিনিকেতনে এই উৎসবের সূত্রপাত হয়েছিল ১৩৩২ বঙ্গাব্দে তাঁর ৬৪ বছরের জন্মদিনের অঙ্গ হিসেবে। কবির আবাসস্থল উত্তরায়নের উত্তরদিকে পথের ধারে ‘পঞ্চবটী’–অশ্বত্থ, বেল, বট, আমলকি ও অশোক বৃক্ষরোপনের মধ্য দিয়ে। এই উপলক্ষে কবি রচিত ‘মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে’ গানটি গাওয়া হয়। সন্ধ্যায় অভিনীত হয় ‘নটীর পূজা’ নৃত্যনাট্যটি।
শান্তিনিকেতনে বর্ষামঙ্গলের সঙ্গে বৃক্ষরোপের উৎসবের ভাবনা কবির মনে উদয় হয়। বৃক্ষ বন্দনার সূত্রপাত হয় তেইশে মার্চ ১৯২৭, এরপর বিশেষ বিশেষ বৃক্ষের বর্ণনায় তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
১৯২৮ সালের ১৪ জুলাই শান্তিনিকেতনের গৌড়প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌরহিত্যের প্রথম বৃক্ষরোপণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই উপলক্ষে কবি ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ও ব্যোম এই পঞ্চভূতের প্রশস্তি করে ছয়টি কবিতা রচনা করেছিলেন। এবং শেষ ও ষষ্ঠটি হল একটি মাঙ্গলিক কবিতা যেটি তিনি লিখেছিলেন এটি শিশু বৃক্ষের উদ্দেশ্যে ‘প্রাণের পাথেয় তবে পূর্ণ হোক এ শিশু চিরায়’। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু ও বিশিষ্ট শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ কর পঞ্চভূত ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সবাইকে সুসজ্জিত করেছিলেন। গৌড় প্রাঙ্গণে বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের পরে সিংহসদনে সভা হয় এবং সেখানে রবীন্দ্রনাথ সদ্যরচিত ‘বলাই’ গল্পটি পড়ে শোনালেন। এই গল্পের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের বাল্যকাল থেকেই বৃক্ষ জীবনের সঙ্গে যে নিবিড় আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল সে ভাবটি প্রকাশ পেয়েছে। এই গল্পের নায়ক বলাই তার নিঃসঙ্গ জীবনে গাছপালার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতো।
১৯৩৬ সালের বাৎসরিক বর্ষামঙ্গল ও বৃক্ষরোপণ উৎসবের আয়োজন হয়েছিল শান্তিনিকেতনের আশ্রম ছাড়িয়ে ভূবনডাঙ্গা গ্রামে। সেবারে ভূবনডাঙ্গা গ্রামের বিশাল জলাশয়ের প্রতিষ্ঠা ছিল বর্ষামঙ্গল উৎসবের একটি বিশেষ অঙ্গ।এই জলাশয়ের ধারে কবি একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের চারা রোপন করেন। সেবারের বর্ষামঙ্গলে কবি রচিত তিনটি নতুন গান গাওয়া হয় ‘চলে ছল ছল নদী ধারা নিবিড় ছায়ায়,’ ‘আঁধার অম্বরে প্রচন্ড ডম্বরু’ এবং ‘ওই মাধবীলতা দোলে।’
পরের বছর ১৯৩৭ সালের ১৪ই আগস্ট ‘আন্দামান দিবস’-এ শান্তিনিকেতনের নিকটবর্তী সাঁওতাল গ্রামে কবির পৌরহিত্যে বৃক্ষরোপণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় সে বছর পন্ডিত নিত্যানন্দ বিনোদ গোস্বামীর একমাত্র পুত্র বীরেশ্বরের মৃত্যুতে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছিল।
এরপরের বছর বৃক্ষরোপণ উৎসবে কবির বিশেষ আমন্ত্রণে সর্বপল্লী ডাক্তার রাধাকৃষ্ণণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, সন্ধ্যায় ‘পরিশোধ’ নৃত্যনাট্যটি দেখেন।
১৯৪০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সকালে বৃক্ষরোপণ ও সন্ধ্যায় বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠিত হয়।’এসো এসো ওগো শ্যামছায়া ঘন দিন’ — এই গানটি ছিল কবির লেখা শেষ বর্ষা সংগীত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণের পরের বছর ১৯৪২ সালে শান্তিনিকেতনে প্রথম তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপিত হয়। সে বছরই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কবির মৃত্যুদিনেই শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসবের আয়োজন হবে। শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকা-সহ ভবনের কর্মচারীবৃন্দরা সকলেই অংশ নেন এই বৃক্ষরোপনের অনুষ্ঠানে। সে বছর সকালে মন্দিরে উপাসনা পরিচালনা করেছিলেন ক্ষিতি মোহন সেন।এরপর কবিকন্যা মীরাদেবী ছাতিমতলার কাছে বৃক্ষরোপণ করেছিলেন।
প্রতিবছর শান্তিনিকেতনে ভোরের বৈতালিক থেকে শুরু করে বিকালের শোভাযাত্রা সহযোগে বৃক্ষরোপণ করার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয় নানান মনোগ্রাহী অনুষ্ঠান ও কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে। যে চারাগাছটি রোপন করা হবে সেটিকে সুসজ্জিত কাঠের তৈরি চতুর্দোলায় চার জন পালকি বাহকের কাঁধে চাপিয়ে পঞ্চকন্যা ও ছত্রবাহক সহযোগে একটি নির্দিষ্ট স্থানে আনা হয়। পঞ্চকন্যার জন্য ফুলের তৈরি টিকলি, কানের দুল, মাথার মুকুট, হাতে চুড় ,বালার মতো নয়নাভিরাম অলংকার তৈরি করে কলা ভবনের ছাত্র ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকারাই। এই পঞ্চকন্যারা পৃথিবীতে জল, অগ্নি, বায়ু, মৃত্তিকা ও প্রাণ এই পঞ্চভূতের প্রতিনিধি। এদের হাতে থাকা জলের পাত্র জলকে , হাতপাখা বায়ুকে, ধূপদানি ধূপ আগুনকে, মাটির তাল মৃত্তিকাকে এবং শঙ্খ শুভ ধ্বনিকে প্রতীকায়িত করে। পাঠভবনের ক্ষুদে পাঁচজনকে সাজানো হয় পঞ্চপুত্র হিসেবে। এদের পরনের পাঞ্জাবির রং, মাথায় থাকা মুকুটের নকশা এবং কপালে আঁকা টিপের পার্থক্য দিয়েই আলাদা ভাবে চিনতে পারা যায় পঞ্চভূতের প্রত্যেককে। বৃক্ষরোপণের স্থানটিকে আলপনা দিয়ে সাজানো হয়। গাছ রোপন করেন স্বয়ং বিশ্বভারতীর উপাচার্য।
বৃক্ষকে বন্দনা করার যে অনন্যভাবনা তা আমাদের বৈচিত্র্যের রূপকার ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিখিয়েছিলেন। কবি বৃক্ষকে ‘গৃহহারা আনন্দের দল’, ‘মরু বিজয়ের কেতন’ ও ‘মাটির বাঁশি’ বলে সম্বোধন করেছেন। এই সম্বোধনের মধ্যে লুকিয়ে আছে বিজয়ের দীপ্তি, মৃত্তিকার অভিব্যক্তি।
১৯৫০ সালের জুলাই মাসে ভারত সরকার বনমহোৎসব আরম্ভ করেন। প্রাচীন পার্বণ এভাবেই হয়ে ওঠে আধুনিক। সেই সময় বাংলা সরকার বনমহোৎসব নামে যে পুস্তিকাটি প্রচার করেন, তাতে প্রচার অধিকর্তা স্বীকার করেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথই দিব্যদৃষ্টিতে অনুভব করেছিলেন এই সভ্যতা বিধ্বংসী গধ্নুতা এবং বনচ্ছেদ নিবারণ করতে না পারলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব নয়।
বাইশে শ্রাবণ কবির মহাপ্রয়াণ নয়, তাকে স্মরণের এক অভিনব পার্বণ যা বৃক্ষবন্দনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। কারণ বৃক্ষ রোপন শেখায় পুনর্জীবনের মন্ত্র। এই দিনটি কেবলমাত্র তর্পনের দিন নয় — বৃক্ষরোপণের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণের এক অভিনব পার্বণ, জীবন বৃক্ষের অনন্ত সম্ভবনার দ্বার উদঘাটন।।
তথ্যঋণ: রবীন্দ্রজীবনকথা–প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, স্বপন কুমার ঘোষ ও অন্যান্য।
খুব ভালো লাগল
ধন্যবাদ 🌹
” দাও ফিরে সে অরণ্য লও হে নগরী” রবীন্দ্রনাথ বারবার তার রচনার মধ্য দিয়ে
সবাইকে জানাবার বোঝাবার আমৃত্যু প্রয়াস করে গেছেন।গাছ বাঁচিয়ে রাখে গাছ
সাজিয়ে রাখে প্রকৃতির ঘর দুয়ার।রবীন্দ্রনাথই ভারতবর্ষে প্রথম বৃক্ষ সচেতন বৃক্ষ রোপন করার প্রথা অথবা অভ্যাস আরম্ভ করেন।শান্তিনিকেতন শিখিয়েছে গাছের
ভাষা গাছের ছায়ায় অনুভব করার প্রয়োজনীয়তা।এই সুন্দর চমৎকার প্রতিবেদন
রবীন্দ্র চিন্তা রবীন্দ্র ভাবনার সাথে পরিচয় করিয়ে পাঠককে পরিবেশ সচেতন করে
প্রতিদিনের রবীন্দ্রনাথকে আরও কাছের মানুষ করে তুলতে সাহায্য করবে।
বাইশে শ্রাবন আসলে পঁচিশে বৈশাখের প্রতিকৃতি।রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আছেন থাকবেন চেতনে চিন্তনে বিবেকে,আমি গাইবো- “আছো বিটপি শতায় জলদের গায় শশী তারকায় তপনে”
কত সুন্দর করে বললেন। অসংখ্য ধন্যবাদ।
কবির প্রয়াণ দিবস শোক সভা করে নয় বরং নতুন প্রাণের আবাহনের মধ্যে দিয়ে তাকে চির অমর করে রাখতে হবে। আর এই নতুন প্রাণের আবাহন মানেই বৃক্ষরোপণ।
বেশ সুন্দর লিখেছেন। ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
খুব খুশি হলাম আপনার মতামত পেয়ে।
অনেক ধন্যবাদ।