বৃহস্পতিবার | ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৬:৪৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
কেন বারবার মণিপুরে আগুন জ্বলে আর রক্ত ঝড়ে : তপন মল্লিক চৌধুরী শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (শেষ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (প্রথম পর্ব) : অভিজিৎ রায় শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (ষষ্ঠ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (শেষ পর্ব) : বিজয়া দেব শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (পঞ্চম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ? : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (চতুর্থ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (শেষ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার শতবর্ষে সঙ্গীতের ‘জাদুকর’ সলিল চৌধুরী : সন্দীপন বিশ্বাস সাজানো বাগান, প্রায় পঞ্চাশ : অমর মিত্র শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (তৃতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (একাদশ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার খাদ্যদ্রব্যের লাগামছাড়া দামে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের : তপন মল্লিক চৌধুরী মিয়ানমারের সীমান্ত ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্যোগ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (দ্বিতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (দশম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার বুদ্ধদেব গুহ-র ছোটগল্প ‘পহেলি পেয়ার’ ‘দক্ষিণী’ সংবর্ধনা জানাল সাইকেলদাদা ক্যানসারজয়ীকে : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (প্রথম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (নবম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘তোমার নাম’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (অষ্টম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘হাওয়া-বদল’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (সপ্তম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার প্রবোধিনী একাদশী ও হলদিয়ায় ইসকন মন্দির : রিঙ্কি সামন্ত সেনিয়া-মাইহার ঘরানার শুদ্ধতম প্রতিনিধি অন্নপূর্ণা খাঁ : আবদুশ শাকুর নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘শুভ লাভ’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (ষষ্ঠ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (পঞ্চম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কৃষ্ণনগরের মিষ্টি : দীপাঞ্জন দে

দীপাঞ্জন দে / ৮২৬৮ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৩

পয়লা বৈশাখ। হালখাতা সেরে বাড়ি আসার পর দেখা যাবে হরেক রকম মিষ্টান্নের স্তুপ বাড়িতে জমা হয়েছে— কিছু পছন্দের, আবার কিছু অপছন্দের। যা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। আবার মিষ্টির প্যাকেট খুলে পছন্দের মিষ্টি পাওয়ার যে অনাবিল আনন্দ, সেটিও বলে বোঝানো যাবে না। বিশেষ করে বাড়ির ছোটরা পয়লা বৈশাখে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে, কখন বড়রা হালখাতা করে বাড়ি ফিরবে। এমনকি পয়লা বৈশাখে প্রাপ্ত মিষ্টির প্যাকেট দেখে মধুমেহধারী মানুষটিরও মুখে হাসি ফোটে, যদিও সেই মিষ্টি তার আস্বাদনের নয় বলে আগেই নির্ধারিত। তবুও সেই আনন্দ সে উপভোগ করে। পয়লা বৈশাখ ঘিরে বাঙালির এমন অভিজ্ঞতা ঘরে ঘরে। পয়লা বৈশাখের আনন্দে আমিও কয়েকটি মিষ্টির সুলুকসন্ধানের চেষ্টা করব।

পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরের মুকুটে যে পালকগুলি শোভমান, তার মধ্যে মিষ্টান্ন শিল্প অন্যতম। একদা কৃষ্ণনগরের মিষ্টান্ন শিল্পের জগৎজোড়া প্রসিদ্ধি ছিল — সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এখন যে সেই সমৃদ্ধি খোয়া গিয়েছে, সেটা বলা বোধহয় পুরোপুরি সঠিক হবে না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মিষ্টান্ন শিল্পের আভিজাত্য ও মান যে ক্রমান্বয়ে কমেছে, সেটা বলতে দ্বিধা নেই। পক্ষান্তরে আরেকটি বিষয়ও ঘটেছে— বাংলার একাধিক জনপদে স্বতন্ত্র মিষ্টান্ন শিল্পের জনপ্রিয়তা কৃষ্ণনগরের মিষ্টির আভিজাত্যকে কিছুটা প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমরা যদি হিসেবের খাতা নিয়ে বসি, তবে দেখব সমগ্র বাংলা জুড়ে মিষ্টির ছয়লাপ। কত কত মিষ্টি — তবে এমন অনেক মিষ্টি রয়েছে যেগুলি একেবারেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেই মিষ্টিগুলির নাম হয়তো অন্য জেলার মানুষেরা জানেন না। কিন্তু তার এলাকায় সে সুপারহিট। আর তার সাম্রাজ্য বিস্তার এমনভাবেই ঘটেছে যে, সেখানে অন্য মিষ্টির প্রবেশ অসম্ভব বলেই প্রতিভাত হয়। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝান যাক — ধরুন কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া ও সরভাজা এই মিষ্টি দুটি মহানগর কলকাতায় পাওয়া গেলেও যেতে পারে, কিন্তু এই দুটি মিষ্টি কি বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে পাওয়া সম্ভব? অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সরপুরিয়া ও সরভাজা সেখানে পাওয়া যাবে না। কারণ উত্তরটা এখনো পর্যন্ত ‘না’। সেখানে যে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে ‘মেচা’ — ‘ক্ষীরের মেচা’। আবার কৃষ্ণনগরের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কৃষ্ণনগরে মিষ্টান্ন শিল্পের যে সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে, সেখানে সিংহাসনে বিরাজমান — সরপুরিয়া ও সরভাজা।

বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে যে সকল মিষ্টির আবির্ভাব ঘটেছে, সেই সকল মিষ্টির শুধু নাম উল্লেখ করতে গেলেও, তালিকাটি এত বড় হবে যে, এই নিবন্ধের কলেবরে তাকে সীমায়িত করা যাবে না। আর কৃষ্ণনগরের মিষ্টির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনায় সেটি খুব বেশি প্রাসঙ্গিকও হবে না। হলফ করে বলা যায়, বাংলার মিষ্টির প্রকারভেদ এতই বেশি যে, বাংলার সবকটি মিষ্টি চেখে দেখেছেন এমন ভোজন রসিক পাওয়াও দুষ্কর হবে! তবে আমরা কৃষ্ণনগরের মিষ্টান্ন শিল্পের গভীরে প্রবেশ করার আগে তার আশেপাশের জনপদের অর্থাৎ নদিয়া জেলার মিষ্টিগুলির কথা একটু জেনে নিতেই পারি।

নদিয়া জেলা বাংলার অনেক মিষ্টিরই আঁতুড়ঘর। এই জেলার মিষ্টান্ন শিল্পের কথা বলতে গেলে, যে সব মিষ্টির কথা বলতেই হয় — ধুবুলিয়ার ক্ষীর সাগর, মুড়াগাছার ছানার জিলিপি, শান্তিপুরের নিখুঁতি, নবদ্বীপের রাজভোগ, অমৃতি, লাল দই, কৃষ্ণনগরের সরভাজা, সরপুরিয়া, সরতক্তি, ভালুকার গজা, বেতাইয়ের কাঁচাগোল্লা, চমচম, রানাঘাটের পান্তুয়া, মাজদিয়া-কৃষ্ণগঞ্জের মাখা সন্দেশ, রসগোল্লা, ইদানিং কালে চাপড়ার কালাকান্দ, কেক সন্দেশ প্রভৃতি। এই সব মিষ্টি জেলার মিষ্টান্ন শিল্পের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। পাশাপাশি রয়েছে কিছু চটকদার মিষ্টি, যেমন — চেন্নাই এক্সপ্রেস, ব্ল্যাক ডায়মন্ড, টুইন ওয়ান প্রভৃতি। আবার বিশেষ বিশেষ উৎসবকে কেন্দ্র করেও নিত্যনতুন মিষ্টির আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন কৃষ্ণনগরেই ভাইফোঁটাকে কেন্দ্র করে ভাইফোঁটা সন্দেশ, বর্নভিটা সন্দেশ, পপকর্ন সন্দেশ, তরমুজ সন্দেশ, গোলাপ সন্দেশ, পেয়ারা সন্দেশ, তুবড়ি সন্দেশ দেখতে পাওয়া যায়।

কৃষ্ণনগরের মিষ্টির যে জগৎজোড়া খ্যাতি, তা অর্জনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে সরপুরিয়া ও সরভাজা। কৃষ্ণনগরের এই দুই মিষ্টি ইতিহাস প্রসিদ্ধ। কিন্তু এই দুই মিষ্টির আবিষ্কারক বা এর আবিষ্কারের সময়কাল সঠিকভাবে বলা দুষ্কর। অনেকের মতে, এই মিষ্টির বয়স ১৫০ বছরের অধিক নয়। আবার এপ্রসঙ্গে আরেকটি তথ্যও দিয়ে রাখতে হয় — প্রায় ৫০০ বছর আগে রচিত কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-য় সরপুরিয়া মিষ্টান্নটির উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে রয়েছে—

“সরপুরী অমৃত পদ্ম চিনি।

খন্ডখিরিসার বৃক্ষ ঘরে করি নানা ভক্ষ্য

রাধা যাহা কৃষ্ণ লাগি আনি।।”

সুতরাং চৈতন্যচরিতামৃত-এর বিবরণ মানলে সরপুরিয়া মিষ্টান্নটির বয়স অনেক বেড়ে যায়। বিবর্তনের কৃষ্ণনগর দেখলে বলা যায় কৃষ্ণনগরের স্বনামধন্য এই মিষ্টান্ন নির্মাণের গৌরবপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ছিলেন ভারত কত্তা, অধর কত্তা, বক্রেশ্বর কত্তা, নসীরাম কত্তা প্রমুখ। কৃষ্ণনগরের আদি প্রথায় এই ময়রাদের নামের সঙ্গে পদবী যোগ না করে ‘কত্তা’ বলে সম্বোধন করা হত।

অনেক মিষ্টি অপ্রচলিত হয়ে গিয়ে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। কৃষ্ণনগরের মিষ্টান্ন শিল্পের ইতিহাসে এমনটি ঘটতে দেখা গেছে। কৃষ্ণনগরের একটি উল্লেখযোগ্য মিষ্টি যেমন কালের নিরিখে হারিয়ে গিয়েছে। সেই মিষ্টির নাম ‘সরতক্তি’। একদা সরপুরিয়া ও সরভাজার সাথে একই সঙ্গে সরতক্তির নাম উচ্চারিত হত। এখন সে বিলুপ্ত। এখনকার মিষ্টান্ন কারিগরেরা অনেকে এই মিষ্টির নামই শোনেননি। আর বর্তমানে সরতক্তি তৈরি করাও নাকি দুঃসাধ্য — এমনটি বলেছিলেন গোয়ারী বাজারের প্রবীণ ময়রা প্রয়াত নৃপেন মোদক।

কৃষ্ণনগরের মিষ্টান্ন শিল্পের আভিজাত্য নিয়ে বর্তমানে খুব বেশি চর্চা হয় না — এ কথা ঠিক। প্রকৃত মিষ্টান্ন প্রেমীর সংখ্যাও হয়তো দিনে দিনে কমেছে। আর ‘মিষ্টান্ন শিল্প’ সম্পর্কে বলতে হয়—সে তো আর শিল্প নেই, ‘মিষ্টান্ন ব্যবসা’য় পরিণত হয়েছে। সে কারণেই তো আজ বেশিরভাগ জায়গায় মিষ্টান্ন শিল্পী নয়, মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। পূর্ববর্তী প্রজন্মের মিষ্টান্ন শিল্পীদের উত্তরপুরুষেরা ধীরে ধীরে মিষ্টান্ন ব্যাবসায়ী পদে উন্নীত হয়েছেন। মহানগর কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে কয়েক দশক আগেই সেই উত্তরণ ঘটেছে, আর কৃষ্ণনগরের মতো মফঃস্বল শহরের ক্ষেত্রে এটি একবিংশ শতকের উপহার। কৃষ্ণনগরের মিষ্টান্ন শিল্পের বিবর্তনে বিষয়টি খুবই প্রকট। মিষ্টিতে ভেজালের বিষয়টিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়। ২০১৯ সাল — কৃষ্ণনগরে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে, ঘূর্ণি এলাকার একটি মিষ্টির দোকানে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বাজেয়াপ্ত করতে গিয়ে কৃষ্ণনগর পৌরসভা ও কৃষ্ণনগর পরিবেশ বন্ধুর যৌথ নজরদারি টিম ভেজাল মিষ্টির সন্ধান পায়। কৃষ্ণনগরের মিষ্টান্ন শিল্পের হতশ্রী অবস্থার প্রকাশ ঘটে সর্বসমক্ষে। জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকে ফলাও করে সেই খবর ছেপেছিল এই শিরোনামে — ‘প্লাস্টিকের নজরদারিতে উদ্ধার হল পচা মিষ্টি’। এরপর কৃষ্ণনগরের মিষ্টির সুনাম আর সর্বসমক্ষে করার স্পর্ধা থাকেনা কারো। যদিও পৌর প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ঘূর্ণির সেই মিষ্টির দোকান সাময়িকভাবে সিল করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হল কৃষ্ণনগরের প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন শিল্পের এই পরিণতি কেন? সেই উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে — মিষ্টান্ন আদতে যে একটি শিল্প, বেশিরভাগ ময়রাই সেটি ভুলতে বসেছে। তাদের কাছে এটি হল একটি লাভজনক ব্যবসা। আর সে কারণেই তো যে শহরে একদা ভূমিষ্ঠ হয়েছিল মিষ্টান্ন পরিবারের দুই অভিজাত সন্তান — সরপুরিয়া ও সরভাজা, আজ সেখানেই পাওয়া গেল পচা মিষ্টি।

কিন্তু এই ভেজালের যুগে এবং ‘সুগার ফ্রি’ মিষ্টির ক্রেতাদের ভিড়ে যারা এখনো সত্যিকারের মিষ্টান্নপ্রেমী, তারা কোহিনূরের খোঁজ ঠিকই রাখেন। কৃষ্ণনগরের মিষ্টান্ন শিল্পের একটি ধারা কিন্তু নেপথ্যে এগিয়েই চলেছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে তাদের কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মিষ্টান্ন শিল্পের মান মর্যাদা রক্ষা এবং তার মান বর্ধনে তারা সদা সক্রিয়। এই ধরণের প্রয়াস অবশ্যই প্রশংসনীয়। ঐতিহ্যের মিষ্টিগুলি যেমন রয়েছে, নতুন নতুন মিষ্টিরও জন্ম হতে দেখা গিয়েছে। যেমন একমাস আগেই কৃষ্ণনগরে একটি মিষ্টির জন্ম হয়েছে — নাম ‘কেশরী কালাকান্দ’। এটি ওজনে বিক্রি হচ্ছে— ৬০০ টাকা কেজি দরে। আভিজাত্যে ভরপুর মিষ্টি। দাম শুনে আন্দাজ করাই যায় যে, এই কেশরী কালাকান্দ কৃষ্ণনগরের মিষ্টান্ন শিল্পের কুলপতি সরপুরিয়া ও সরভাজাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর স্পর্ধা দেখিয়েছে। ২০২৩ সালের রংদোলের ঠিক আগের দিন কৃষ্ণনগরের বুকে সে প্রথম ভূমিষ্ট হয়। মিষ্টান্ন প্রেমীদের প্রতিক্রিয়া এই মিষ্টির ভবিষ্যৎ রচনা করবে।

কৃষ্ণনগরে নতুন মিষ্টি ভূমিষ্ট হওয়ার এমন উদাহরণ আরো রয়েছে। মাত্র দুই বছর আগেই যেমন কৃষ্ণনগরে আরেকটি মিষ্টির জন্ম হয়েছিল, যার কথা না বললেই নয়। সেই মিষ্টির নাম দেওয়া হয় ‘কেশর পুলি’। ‘ক্ষীর পুলি’ নামে একটি মিষ্টি কৃষ্ণনগরে এমনিতেই খুব জনপ্রিয়। কৃষ্ণনগরের প্রতিটি মিষ্টান্ন বিপণিতেই ক্ষীরপুলি পাওয়া যায়। কেশর পুলি হল সেই ক্ষীর পুলিরই সংস্কারিত রূপ। প্রসঙ্গত বলে রাখি, যারা কৃষ্ণনগরের মিষ্টান্ন শিল্পের গুণমান বিচারে মিষ্টির আস্বাদন করতে চান, তারা কৃষ্ণনগরের অধর মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষীর পুলি (উপরে পেস্তা দেওয়া) খেয়ে দেখতে পারেন। বর্তমানে যার দাম প্রতি পিস ১২ টাকা। ফিরে আসি নবাগত মিষ্টি — ‘কেশর পুলি’-র প্রসঙ্গে। কেশর পুলির স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ — সবই অতুলনীয়। যারা এই মিষ্টির স্বাদ আস্বাদন করেছেন, তারাই কথাটির প্রকৃত মাহাত্ম্য বুঝবেন। সবুজ রঙের পাতলা কাগজের বাটিতে বসানো হলুদ ক্রিম রঙের মিষ্টি, কেশর দুধে মিশে যে রঙটি হয় আরকি! এরই নাম কেশর পুলি — যার একটির দাম ১৫ টাকা। তবে কৃষ্ণনগরের একটি নির্দিষ্ট দোকানেই এই মিষ্টিটি পাওয়া যায়, তারাই এই মিষ্টির ধারক ও বাহক। দুই বছর অতিক্রান্ত, কেশর পুলি মিষ্টিটি কৃষ্ণনগরে রমরমিয়ে চলছে। প্রত্যহ নির্দিষ্ট পরিমাণে এই মিষ্টি করা হয়ে থাকে। তাড়াতাড়ি শেষও হয়ে যাওয়া। ক্রেতারা কেশর পুলি কিনতে এসে, না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন — এমনটা আমি চাক্ষুষ করেছি বহুবার।

সাম্প্রতিককালের একটি ঘটনা বলে এই মিষ্টান্ন সফর এখনকার মতো শেষ করব। কৃষ্ণনগরের একটি বিশেষ মিষ্টি নিয়ে আমার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা কথা বলি — একদিন শহরের একটি প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন বিপণির সামনে একটি চারচাকা গাড়ি এসে দাঁড়াল। দু’জন ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নামলেন কৃষ্ণনগরের মিষ্টি কেনার জন্য। কথোপকথনে জানতে পেরেছিলাম তাঁরা উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙা থেকে এসেছেন। তাঁরা মূলত কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সরপুরিয়া এবং সরভাজা মিষ্টি দুটি সংগ্রহ করতে এসেছিলেন। কেজি খানেক করে উভয় প্রকারের মিষ্টি কিনলেন। তারপর দোকানের শোকেসের দিকে একবার নজর বুলিয়ে তাদের মধ্যে একজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন — আলুভাতে মাখার মতো দেখতে এটা কি? প্রশ্নটি শুনে দোকানদার তো একেবারে হতবাক, আমিও স্তম্ভিত! আসলে এইভাবেও যে সেই মিষ্টিটির বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে, সেটি ইতিপূর্বে কখনও ভেবে দেখি নি। তবে হ্যাঁ, একথা ঠিক যে, মিষ্টিটি তৈরির সময় আলুভাতে মাখার মতোই সেটিকে চটকাতে হয় এবং তারপরে সেই মাখা থেকে গোল্লা পাকিয়ে মিষ্টির আকার দেওয়া হয়। খেতে হয় খুবই সুস্বাদু। দামের দিক থেকেও সমৃদ্ধ। কৃষ্ণনগর তথা নদিয়া জেলায় এই মিষ্টিটি বহুল প্রচলিত। যাইহোক, কিছু পাঠক নিশ্চয় আন্দাজ করতে পেরেছেন যে, এখানে যে মিষ্টিটির কথা বলা হচ্ছে, সেটি হল ‘নিখুঁতি’। সেই অভিজ্ঞতার পর আমিও কখনো সখনো নিখুঁতিকে ‘আলুভাতে মাখা মিষ্টি’ বলে সম্বোধন করে থাকি।

লেখক: আঞ্চলিক ইতিহাস লেখক, নদিয়া।


আপনার মতামত লিখুন :

24 responses to “কৃষ্ণনগরের মিষ্টি : দীপাঞ্জন দে”

  1. Sumana Ghosh says:

    😋😋🤤🤤 মিষ্টান্ন 😋😋🤤🤤

  2. Dipankar Das says:

    খুব সুন্দর মিষ্টি লেখা, দীপাঞ্জন। খুব ভালো লাগলো কয়েকটি নতুন মিষ্টির নাম শুনে। খেয়ে স্বাদ নিতে হবে।

    • দীপাঞ্জন দে says:

      হ্যাঁ, স্যার। যেগুলো খাওয়া হয়নি এখনো, খেয়ে দেখতে পারেন স্যার। মিষ্টান্নপ্রেমীদের জন্য এবং সঠিক ইতিহাসের স্বার্থে আমি মিষ্টিগুলির পক্ষপাতনিরপেক্ষ মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি।

  3. Smarajit Kumar Biswas says:

    Informative and historical documents. Very good.

  4. Jawhar Mukherjee says:

    Hotei parey krisnagarer bikhyato misti sarpuria ba sar bhaja. Tabey bektigato bhabey amar kintu tamon bhalo lagey ni. Prothom j din kheyechilam, krisnagarer sei dokaney jiggasha korechilam sarpuria te ki ki lagey, suney ami jantey cheyechilam moyda ba chal guro jatiyo kichu na thakle erakom ata ata laglo kano? Uttar pai ni. Hoyto akhon dam ta kreta der sadhyer modhye rakhtey giye quality compromise kortey hochhe. Or otherwise overhyped. Actually I didn’t find anything great with sarbhaja and sarpuria. E gulo akantai amar bektigato matamot.

    • দীপাঞ্জন দে says:

      মন্তব্যটি করার জন্য ধন্যবাদ। ভিন্ন অভিজ্ঞতা খুব স্বাভাবিক। মিষ্টির গুণমান বিষয়ক আলোচনা বিস্তারিত করা যাবে আপনার সঙ্গে। সরপুরিয়া, সরভাজা প্রসঙ্গে আপনার মূল্যায়ন আরো বেশি জানতে চাই।

  5. Nabajyoti Biswas says:

    Khub informative and well composed..

  6. পবন ভৌমিক says:

    একের পর এক অতি অসাধারণ অসামান্য সুস্বাদু টেষ্টি যেই মুখোরোচক মনোপ্রিয় মিষ্টান্ন ভান্ডারের নাম শুনছি সেই একের পর এক রসোমাখিত লোভ মিষ্টি লালসার স্বাধে ভরা জিভ টি যেন আর থাকতে পারছে না, কবে যে তার দেখা পাব, কৃষ্ণনগরের বুকে যাবো আর সেই টেষ্টি মিষ্টান্ন টির ভোজন প্রিয় হবো…………. ।
    অধরের স্বরপুরিয়া,স্বরভাজা মুখে লেগে থাকা এক প্রায়ত দিবস , কেবল চার বন্ধুর ভাগে চার পিস, মনে হয় আরো কিছুটা যেন মিসমিস…….।।
    লেখাটি মন, প্রাণ,ক্ষীরের মত জুড়িয়ে গেল । 🥰😍👌💕☺️😋😋।

  7. MRINMOY GOPE says:

    কেশরী কালাকান্দ ও কেশর পুলি কৃষ্ণনগরের কোন দোকানে পাওয়া যায়, একটু জানালে খেয়ে দেখা যেতো।

  8. Misipiya Nasrin says:

    আমি সাধারনত মিষ্টি খেতে খুব একটা পছন্দ করিনা,তবে এতো varities মিষ্টির প্রকারভেদও হয় আমার কাছে অজানা ছিল,আগে জানতাম কতিপয় কয়েকটা মিষ্টির নাম,।
    তবে আজকে আপনার লেখনির দ্বারা অনেক মিষ্টির সম্পর্কে জানতে পারলাম।
    আর এখন মনে হচ্ছে খেয়েও দেখি কেমন ! যে কতটা সুস্বাদু মিষ্টি হয় এই মিষ্টান্ন।
    কৃষ্ণনগরের মিষ্টি খেয়েছি আমি অনেকবার তবে যায় বলেন ,খেতে সত্যিই অন্যরকম।
    তবে in future আরো ভালো করে tast করতে হবে।But the desire to taste this is only after reading your writing.

  9. Misipiya Nasrin says:

    আমি সাধারনত মিষ্টি খেতে খুব একটা পছন্দ করিনা,তবে এতো varities মিষ্টির প্রকারভেদও হয় আমার কাছে অজানা ছিল,আগে জানতাম কতিপয় কয়েকটা মিষ্টির নাম,।
    তবে আজকে আপনার লেখনির দ্বারা অনেক মিষ্টির সম্পর্কে জানতে পারলাম।
    আর এখন মনে হচ্ছে খেয়েও দেখি কেমন ! যে কতটা সুস্বাদু মিষ্টি হয় এই মিষ্টান্ন।
    কৃষ্ণনগরের মিষ্টি খেয়েছি আমি অনেকবার তবে যায় বলেন খেতে সত্যিই অন্যরকম।
    তবে in future আরো ভালো করে tast করতে হবে।But the desire to taste this is only after reading your writing.

  10. shree says:

    ছোটবেলায় মামাবাড়ি (বহরমপুর)গেলেই মামা ছানাবড়া আনতো আর আমরা এখান থেকে নিয়ে যেতাম সরপুরিয়া। কত্ত স্মৃতি জড়িয়ে আছে মিষ্টিগুলোর সাথে। অনেক ধন্যবাদ। এরকম আরও লিখতে থাকুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন