বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে যেসকল প্রতিভাধর সাহিত্যিকদের অবদান স্মরণীয় আছে তাদের মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত অন্যতম। পুরাতন ঐতিহ্য ভেঙে বঙ্গ সাহিত্যে ব্ল্যাঙ্ক ভার্স বা অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন। এর আগে তিনি সংস্কৃত নাটক রত্নাবলীর ইংরেজিতে অনুবাদ করে গুণীজনদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। বন্ধু গৌড়দাস বসাকের সঙ্গে বাংলা ভাষার ভালো নাটক রচনা সম্ভব কিনা তা নিয়ে তর্কাতর্কি হয় রত্নাবলী নাটকের মহড়া সময়ে। তারই পরিণাম স্বরূপ জন্ম নেয় শর্মিষ্ঠা নাটক। মধুসূদন দত্তের প্রথম নাটক।
মহাভারতের আদি পর্বের শর্মিষ্ঠা-যযাতি-দেবযানীর আখ্যান এই নাটকের মূল উৎস। তিনটি চরিত্রের প্রণয় দ্বন্দ্বই এই নাটকের মূল কথা। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত নাটকটি ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে অভিনীত হয়। বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চের সূত্র ধরেই মধুসূদন দত্তের সঙ্গে আলাপ হয় সাহিত্য অনুরাগী রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের। অমিত্রাক্ষর ছন্দে কাব্য রচনা প্রসঙ্গে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে মধুসূদনের তুমুল বিতর্ক হয় এবং মধুসূদন বলেন তিনি বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের কাব্য রচনা করে দেখাবেন।
এরপর গ্রিক পুরানের আদর্শে রচিত করেন পদ্মাবতী নাটক। বিদর্ভ রাজ ইন্দ্রনীল রতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ নির্বাচন করায় শচী ও মূরোজা তার শত্রু হয়। এই শত্রুতা ও তার নিবাসন নিয়েই নাট্য কাহিনী। এই নাটকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ আংশিক ব্যবহার করে মধুসূদন বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে আলোড়ন তোলেন। মিত্রাক্ষর ছন্দের শৃংখল থেকে মুক্তি দিলেন বাংলা কাব্য কে — রচিত হলো ইতিহাস। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এবং পন্ডিত রাজেন্দ্রলাল মিত্র মধুসূদনের কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ হলেন। বাংলা কাব্যজগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো।
এরপর মধু কবি তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ। ভাষায়, ভাবে, ছন্দে, শিল্পরীতিতে এই গ্রন্থখানির নবীনতা অবিসংবাদিত।
এটি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল যতীন্দ্রমোহনের অর্থানুকুল্যে।
অতঃপর মধুকবি তার অভিজ্ঞতা এবং জীবন দৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রামায়ণ অবলম্বনে অমিত্রাক্ষর ছন্দে মেঘনাথবধ কাব্য রচনা করলেন। এ কাব্য বাঙালি জীবনের রীতিমতো সাড়া ফেলে দিলো। মেঘনাদবধ কাব্য রামায়ণ-আহৃত কাহিনীর পুণরাবৃত্তি নয় — এটি নবজাগ্রত বাঙালীর দৃষ্টি নিয়তি-লাঞ্ছিত নবমানবতাবোধের সকরুণ মহাকাব্যের রূপে অপূর্ব গীতি-কাব্য। এখানে রাম নয় রাবণকে দেখা দেয় নায়ক রূপে — হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে বাঙালি চিত্ত সেদিন মোহিত হয়ে গিয়েছিল। বইটির প্রুফ দেখতে দেখতে তিনি বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে বলেছিলেন, ‘মাই ডিয়ার রাজ দিস উইল সিওরলি মেক মি ইমমর্টাল। ‘এমনই ছিল মধুসূদনের প্রতীতি।
দুটি খণ্ডে বিভক্ত কাব্যটি ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে রচিত হয়। প্রথম খন্ড (১-৫ সর্গ) ১৮৬১ সালের জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখে প্রকাশিত হয়, আর দ্বিতীয় খন্ড (৬-৯ সর্গ) ঐ বছরেই রচনা করেন। মুদ্রণের ব্যয়ভার বহন করেছিলেন দিগম্বর মিত্র। কৃতজ্ঞ মধুসূদন এই অভিনব কাব্যকুসুম তাঁকেই উৎসর্গ করেন।
বাঙালি গুণীর সমাদর করতে জানেন।মেঘনাদবধ কাব্যের বৈশিষ্ট্য এবং তার অভিনবত্ব ধরা পড়েছিল ২১ বছরের এক তরুণের চোখে — নাম কালীপ্রসন্ন সিংহ। জোড়াসাঁকরের বিখ্যাত সিংহ পরিবারের সন্তান ও বাংলার নবজাগরণে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ তারই রচনা। বিদ্যাসাগর মহাশয় নির্দেশে এবং হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের সহযোগিতায় ইতিমধ্যেই তিনি মূল মহাভারতের বঙ্গানুবাদের ব্যবস্থা করেছিলেন।
কালীপ্রসন্নর মনে হল মাইকেলের সাহিত্যিক ক্রিয়াকর্মের জন্য তাকে সংবর্ধনা জানানো উচিত।
কালীপ্রসন্নর সঙ্গে মধুসূদনের ইতিপূর্বেই আলাপ হয়েছিল যখন তিনি পুলিশ কোর্টে কাজ করতেন। পরে আরো ঘনিষ্ঠতা জন্মায়। কালীপ্রসন্ন বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা প্রকাশ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে করেই ক্ষান্ত হয়নি সাহিত্য যাত্রার জন্য বিদ্যোৎসাহিনী সভাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কলকাতা অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এই সভার সদস্য ছিলেন ।এই সভার পক্ষ থেকেই মাইকেল মধুসূদন কে সংবর্ধনা জানাতে মনস্থ করলেন কালীপ্রসন্ন। অমৃতাক্ষর ছন্দের জন্যই এই সংবর্ধনা। মধুসূদনের আগে এই বাংলায় কোন সাহিত্যসেবিকে কোন সংবর্ধনা জানানো হয়নি। মধুসূদন সেই হিসেবে বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী। মাইকেলের শত্রুর যেমন অভাব ছিল না তেমন কমতি ছিল না গুনানুরাগীরও। সংবর্ধনা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, দিগম্বর মিত্র, রমাপ্রসাদ রায়, কিশোরী চাঁদ মিত্র গৌড়দাস বসাক, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যান্য বিশিষ্ট মানুষজন। অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি।
মধুসূদন তখন ৬ লোয়ার চিৎপুর রোডে থাকতেন সেদিন সন্ধ্যায় বন্ধু গৌর দাস বসাক ও তার সাহিত্যকর্মের সহায়ক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত রামকুমার বিদ্যারত্ন কে সঙ্গে নিয়ে যান সভার উদ্দেশ্যে। প্রসাদপোম অট্টালিকার দ্বারা দেশে অপেক্ষা করছিলেন সবান্ধবে কালীপ্রসন্ন। সকল সুধীমণ্ডলের হর্ষধ্বনিতে কবিকে স্বাগত জানানো হলো। এমন সম্বর্ধনার কথা ভাবতেও পারেননি কবি! নির্দিষ্ট আসনে কবি আসন গ্রহণ করলে সভার কাজ আরম্ভ হল উদ্বোধনী সংগীত দিয়ে। এরপর কালীপ্রসন্ন সিংহ বিদ্যুৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে কবির হাতে তুলে দিলেন মানপত্র।
অভিনন্দন পত্র পাঠের পর কালীপ্রসন্ন নিজের হাতে কবির গলায় মালা পরিয়ে দিলেন এবং বিখ্যাত হ্যামিলটন কোম্পানির তৈরি একটি রুপোর মূল্যবান পানপাত্র (silver claret jug) তার হাতে তুলে দিলেন। কোট প্যান্টালুন পড়া কবি যিনি বিদেশী ভাষার মোহে একদিন মাতৃভাষা ভুলে যেতে চেয়েছিলেন, এমন সম্বর্ধনায় অভিভূত হয়ে পড়েন এবং সভায় ভাষণ দেন বাংলায়।
এরপর ঢাকা তেও মধুসূদন সংবর্ধিত হয়েছিলেন। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুরুলিয়া যান। পুরুলিয়ার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অনুরাগীরা কবিকে সেখানকার মিশন হাউসে সংবর্ধনা জানালে কবি বিশেষভাবে আপ্লুত হন এবং পুরুলিয়া মন্ডলের প্রতি নামে একটি সনেট লেখেন।
ব্যারিস্টারি পড়তে ইউরোপে যান কবি। ফ্রান্সে সপরিবারে থাকার সময় বিভিন্ন কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কপর্দকশূন্য মধুসূদন কালীপ্রসন্নর দেওয়া সেই অমূল্য উপহার রুপোর পানপাত্রটি বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। জীবনে ধন মান কম পাননি কিন্তু বহেমিয়ান, বিশৃঙ্খল জীবনযাত্রার জন্য সেসব কিছুই তাকে শেষ পর্যন্ত হারাতে হয়েছিল। এটাই ছিল তার জীবনের ট্রাজেডি।
তথ্যসূত্র : মধুস্মৃতি — নগেন্দ্রনাথ সোম, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত — যোগীন্দ্রনাথ বসু, প্রিয়ব্রত মুখোপাধ্যায়ের লেখা এবং উইকিপিডিয়া।
অসাধারণ লেখনী,,,পড়ে খুব ভালো লাগলো
থ্যাঙ্ক ইউ ❤️
অসাধারণ লেখা। অভিনন্দন।
অনেক ধন্যবাদ ❤️