সোমবার | ১৬ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:২০
Logo
এই মুহূর্তে ::
দুর্দৈবপীড়িত রবীন্দ্রনাথ : দিলীপ মজুমদার শান্তি সভ্যতার গুণ, যুদ্ধ তার অপরাধ … ভিক্টর হুগো : অশোক মজুমদার হরপ্পার ব্যুৎপত্তি নিয়ে নতুন আলোকপাত : অসিত দাস বল পয়েন্ট কলমের জার্নির জার্নাল : রিঙ্কি সামন্ত মহেঞ্জোদারো নামের নতুন ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস পরিসংখ্যানে দারিদ্রতা কমলেও পুষ্টি বা খাদ্য সংকট কি কমেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী অথ স্নান কথা : নন্দিনী অধিকারী তন্ত্র বিদ্যার বিশ্ববিদ্যালয় চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধুসভ্যতার ভাষায় ও স্থাননামে দ্রাবিড়চিহ্ন : অসিত দাস ধরনীর ধুলি হোক চন্দন : শৌনক দত্ত সিন্ধুসভ্যতার ভাষা মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবির নামে : অসিত দাস বিস্মৃতপ্রায় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় ভাষায় সিন্ধুসভ্যতার মেলুহার ভাষার প্রভাব : অসিত দাস বঙ্গতনয়াদের সাইক্লিস্ট হওয়ার ইতিহাস : রিঙ্কি সামন্ত নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘ঝড়ের পরে’ ভালো থাকার পাসওয়ার্ড (শেষ পর্ব) : বিদিশা বসু গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘সময়ের প্ল্যাকটফর্ম’ গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি : রঞ্জন সেন জামিষষ্ঠী বা জাময়ষষ্ঠী থেকেই জামাইষষ্ঠী : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই প্রভু জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

নাট্য সমালোচনা—বহুরূপীর বর্বর বাঁশী : কেয়া চক্রবর্তী

কেয়া চক্রবর্তী / ৪৫৯ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ৭ আগস্ট, ২০২২

নাটক—নীতীশ সেন। পরিচালনা—শম্ভু মিত্র

বহুরূপীর সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা নীতীশ সেনের লেখা একটি মৌলিক নাটক, বর্বর বাঁশী। বর্তমান সমাজের দুর্নীতি, অবক্ষয়, হিংস্রতা, হতাশা, অতীতের সঙ্গে এর কার্যকারণসম্বন্ধ খুঁজে বার করা এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা—এই হল নাটকের বিষয়বস্তু। দুটি ক্ষয়িষ্ণু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার নিয়ে ঘটনা। এই দুটি পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রায় সকলেই জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে হেরে গেল। কেউ রুগ্ণ হয়ে পড়ল, কেউ চোর, কেউ-বা প্রায় বেশ্যা বনে গেল। এক ভাই আখের গোছানোর জন্য নিজের মামাতো বোনকে নিয়ে মেয়ের দালালি শুরু করল। এ-সব কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়—অদৃষ্টের দোষে আকাশ থেকে পড়া নয়। এর একটি ইতিহাস আছে। দুই কর্তাদের মধ্যে একজন চুরির দায়ে জেল খেটে এসেছেন। আরেকজন পাকিস্তানে হিন্দুনির্যাতনের অজুহাতে এখানকার এক মুসলমানের জমি হাতিয়েছেন এবং অসুস্থ ছেলেকে অবতার সাজিয়ে রোজগারের ফিকির খুঁজছেন। ধূর্ততা, লোভ, স্বার্থপরতা, ভণ্ডামি মিলিয়ে একটা অন্ধকার ঘুণধরা জগৎ। এই জমাট অন্ধকারের মধ্যেও ভালোবাসার ও বিবেকবিসর্জন না দিয়ে ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখে পরিচয় ও অনসূয়া। নাট্যকার এই ঘুণধরা সমাজের নোংরামি যত খোলাখুলিভবে দেখিয়েছেন, নোংরামি সাফ করার জন্য অন্তত দু-একজন মানুষের তীব্র, গভীর আকাঙ্খাও ততটাই স্পষ্ট করে তোলার চেষ্ট করেছেন। শুধু বড়ো বড়ো ঘটনা নয়, ছোটোখাটো নানা টুকরো ব্যাপার ও সংলাপেও সমাজের ছবি ও সমালোচনা আছে। কখনো তা তীক্ষ্ণ, কখনো বা একটু লঘু। ছেলে টাকা চুরি করার পর পুলিসের ভয় নেই শুনেই বাবার নিশ্চিন্ত হওয়া, মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর বাবার ঔদাসীন্য ও বিরক্তি, অসুস্থ ছেলেকে অবতার সাজিয়ে রোজগারের ফন্দি ফেঁসে যাওয়ার বাপের হিংস্রতা ইত্যাদি দর্শককে প্রচণ্ড আঘাত করে। আবার অরিজিনাল ফলোয়ার নিয়ে ঠাট্টা, তারকেশ্বরে বাবার থানে গিয়ে মারামারি করার প্রস্তাব, ‘ভগবান তার পিশেকে ঠিক চিনেছে’ কিংবা ‘এক বাপ অন্য বাপের সাফাই গাইছে’, ইত্যাদি মজার সংলাপ, ‘আজকালকার ছেলেমেয়েরা সব গোল্লায় গেল’ বলতে বলতে ছেলের পকেট থেকে বাপের সিগারেট চুরি ইত্যাদি মুহূর্তে কৌতুক একটু হাঁফ ছাড়ার অবকাশ এনে দেয়। হাসির মুহূর্তগুলিতেও অবশ্য সমাজের, বিশেষ করে আগের পুরুষের লোকেদের ভণ্ডামি নিয়ে হালকা ব্যঙ্গ আছে। এ নাটকের প্রধান দুটি গুণ হল সততা ও এক ধরনের প্রবল প্রাণ শক্তির প্রকাশ। এ ছাড়া সংলাপের কৌতুক ও তীক্ষ ব্যঙ্গের ধারও বেশ আকর্ষক মনে হয়। কিন্তু মুশকিল এই যে নীতীশ সেন নাট্যকার হিসেবে বিশেষ অভিজ্ঞ ও নিপুণ নন।বিবাহবিচ্ছেদ, তার পরের মানসিক ও সামাজিক জটিলতা, অল্পবয়সী হালকা মনের মেয়ের বখে যাওয়া, চুরি, সন্তানের জীবনে বাবার পাপের জের, গুরুগিরির ভণ্ডামি ইত্যাদি যাবতীয় সামাজিক সমস্যা তিনি একটি মাত্র নাটকে পুরেছেন। নানা গুরুতর ব্যাপার একসঙ্গে জোটানোর ফলে কোনোটাই ঠিক যথাযোগ্যভাবে তলিয়ে দেখার সুযোগ হয় নি। এ ছাড়া নাটকের কোনো নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দু নেই, বাঁধুনি নেই। অনেক ঘটনা নাটকীয় ভাবে উপস্থাপিত না করে বর্ণনা করে যাওয়া হয়েছে। ফলে নাটকটি জায়গায় জায়গায় কেমন যেন খবরের কাগজের সারাংশের মতো হয়ে পড়েছে। তৃতীয় দৃশ্যে লাখটাকা চুরি, ব্ল্যাকমেলিং-এর ভয়, দু-দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা, মারামারি সব কিছু মিলে বড়ো বেশি ভিড় করে। প্রযোজনার গুণে অবশ্য নানা এলোপাথাড়ি ব্যাপার অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন হয়ে এসেছে।

এ নাটকে যাঁরা অভিনয় করেছেন তাদের মধ্যে কালীপ্রসাদ ঘোষ ও শিবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছাড়া প্রায় সবই নতুন মুখ। কালীপ্রসাদ ঘোষ অভিনীত পরিচয় চরিত্রটি তৃতীয় দৃশ্যের কয়েকটি মুহূর্ত ছাড়া (সেই মুহূর্তগুলির দুর্বলতা ও সংকট চরিত্রটাকে মানবিক করেছে) প্রায় সবসময়ই ঋজু ও সৎ।একটি সত্যিকারের সৎ চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য ও নাটকীয়ভাবে উপস্থাপিত করা বড় কঠিন কাজ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই লোককে হয় এক ধরনের ব্যক্তিত্বহীন, গোবেচারা গোছের লোক, নয় একটা বক্তৃতার ঝুড়ি বলে মনে হয়। শ্রীঘোষ এই দুটি ত্রুটি-ই এড়িয়ে গেছেন। তার অভিনয়ে পরিচয় চরিত্রের ঋজুতা ও সততা খুব স্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটে উঠেছে। অথচ সারাক্ষণই তাকে আপনার আমার মতো সাধারণ সুখ-দুঃখের মানুষ বলেই মনে হয়। বোনকে ‘কোথায় মেরেছে রে’ বলার সময় তার মমতা, ‘‘আমি কী করে থামাব, কী দিয়ে থামাব’ বলার সময়কার অক্ষম ক্রোধ, ‘একটা কিছু ঠিক করতে পারলাম না রে’ কিংবা ‘আমার মত একা আর কে’ বলার মুহূর্তের হতাশা ইত্যাদি নাটক শেষ হওয়ার পরও বহুক্ষণ ঘুরে ফিরে মনে আসে। অভিনয়ে তিনি মোটের ওপর আনডারস্কোরিং-এর রীতি অনুসরণ করেছেন। সহজ সুরে গভীর কথা বলার জন্য যে সংযম ও নিপুণতা দরকার তা তার আয়ত্তে আছে। ‘দুঃখ কি একটা অজুহাত’, ‘এদেশে সব চাকরিতেই গায়ে ময়লা লাগে, শুধু শালারা স্বীকার করে না’, ‘আত্মহত্যা যে করে, লজ্জা তার নয়, যারা তার জন্য দায়ী তাদের’ – ইত্যাদি সংলাপ যে কোনো কাঁচা অভিনেতার মুখে ছেঁদো বক্তৃতার মতো শোনাতে পারত। কিন্তু তাঁর মুখ থেকে কথাগুলি এত সহজে অথচ এত ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে যে দর্শকের মনে তার প্রতিক্রিয়া প্রায় আমোঘ হয়ে দাঁড়ায়। মৃত্যুঞ্জয়ের ভূমিকায় শিবশংকর মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ও আগাগোড়া নিখুঁত। সব কিছু একেবারে মাপা, কোথাও কোনো রকম বাড়াবাড়ি নেই। বিকেলবেলার ঘুম মাটি করে চণ্ডীপাঠ শুনতে হওয়ার বিরক্তি, মেয়ের সঙ্গে কথা না বলা, ছেলের ভয়ে কথা ঘোরানো, ছেলের কাছ থেকে সাবান ভিক্ষে, লুঙ্গি সেলাই, আর প্রায় সব সময়েই এক ধরনের আধা-করুণ, আধা-হাস্যকর অসহায়তা মিলিয়ে তার অভিনয়ে বেশ একটি গোটা মানুষের চরিত্র দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য ভূমিকায় অঞ্জলি সেন, বিশ্বজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক চট্টোপাধ্যায়, মহম্মদ আস্পিয়া, হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়, উৎপল ভট্টাচার্য ও বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় যথাযথ — যথাযথ মানে বহুরূপীর অভিনয়ের মান অনুসারে যথাযথ, অর্থাৎবেশ উঁচু মানের। শুধু দ্বিতীয়বার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুহূর্তে অঞ্জলি সেনের অভিনয় একটু দুর্বল। সিগারেট ধরানোর সময় অশোক চট্টোপাধ্যায়ের মনঃসংযোগ দেখলে মনে হয় তিনি যেন কোনো দুরূহ অঙ্ক কষতে যাচ্ছেন। প্রতিমার ভূমিকায় শিখা মুখোপাধ্যায়ের হাসি মাঝে মাঝেই বড় কৃত্রিম। রবির সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর বিশেষ ভঙ্গিতে হাঁটার মধ্য দিয়ে যে ধরনের ইঙ্গিত ফুটে ওঠার কথা তা ঠিক ফোটেনি। শেষদৃশ্যে ব্ল্যাকমেলিং-এর ভয়ে তাড়িত হয়ে পরিচয়ের কাছে সাহায্য চাওয়ার মুহূর্তে তার অভিনয়ে আরও বেশি আবেগ প্রকাশিত হলে ভালো লাগত। এ ছাড়া সুনীলের ভূমিকায় নিরঞ্জন সরকার ও জগন্ময়ের ভূমিকায় তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় একটু কাঁচা। তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের সংলাপ বলার ধরণটি পড়া মুখস্থ বলে যাওয়ার মতো যান্ত্রিক। হাসির দৃশ্যাংশগুলিতে তিনি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলায় তার চরিত্রের বদমায়েসির দিকটি চেপে যায় এবং অনেক সময়ই তাকে ঠিক একটি কমিক চরিত্র বলে মনে হয়। এ নাটকে পাত্রপাত্রীদের অনেকেরই উচ্চারণের ত্রুটি আছে বলে দেখানো হয়েছে। কিন্তু অভিনেতা-অভিনেত্রীরা প্রায় কেউই সেই ত্রুটিগুলিকে আগাগোড়া নিয়মিত ভাবে বজায় রাখতে পারেন নি। মাঝেমাঝেই শুদ্ধ উচ্চারণ করে ফেলেছেন।

নাটকটি ন্যাচারালিস্ট হলেও মঞ্চসজ্জা পুরোপুরি ন্যাচারালিস্টিক নয়। উচ্চ-নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরের যথাযথ ছবি নয়, নাটকের পাত্রপাত্রীদের মতো রঙটিকেও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা আছে মঞ্চসজ্জায়। মঞ্চে একটি বড় মাপের ঘর, দুটি জলচৌকি, চেয়ার টেবিল, জুতোর তাক,, জলের কুঁজো, দড়িতে আধ ময়লা কাপড় ঝুলছে। ডানদিকে অন্য একটি ঘরে যাওয়ার দরজায় রঙচটা শাড়ির পর্দা। ঘরের পিছনের দেওয়ালের গায়ে লাগানো দরজা দিয়ে ভিতর দিকে কলঘরের দরজা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ মঞ্চের তিন দেওয়ালের গণ্ডিটুকু একটু ভেঙেচুরে মঞ্চের গভীরতাকে বেশ গুছিয়ে কাজে লাগানো হয়েছে। মঞ্চের সামনের দিকে দুটি লম্বা লম্বা কাঠের খুঁটি রাখায় বস্তির মাঠকোটা বাড়ির মতো লাগছিল। কিন্তু এ রকম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবেশে অমন সুন্দর হালকা রঙের দরজা একেবারে বেমানান। ঘরের দেওয়াগুলিতে তুঁতে-নীল রঙের পটভূমিকায় লাল রঙের আঁকিবুকি। দেওয়ালের আকারও সাধারণ ঘরের দেওয়ালের মতো নয় -তীক্ষ্ণ, কোণাচে, খোঁচাখোঁচা। মধ্যের সবচেয়ে উঁচু কোণটির সামনে প্রায় সব সময়ই পরিবারের যাবতীয় বিপর্যয়ের মূল যিনি সেই কর্তা বসে থাকেন। দেওয়ালের রঙে ও আকারে তীক্ষ্ণ তীব্র বিষাক্ত হিংস্রতার দ্যোতনা এক্সপ্রেশনিস্টিক ছবির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ন্যাচারালিস্টিক নাটকে এই বিশেষ রকমের মঞ্চসজ্জা আপাতদৃষ্টিতে খাপছাড়া বলে মনে হতে পারে। কিন্তু নাটকের সামগ্রিক আবহাওয়া সৃষ্টিতে এই মঞ্চসজ্জা বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। নাটকের মূল সুরের সঙ্গে মঞ্চসজ্জার একটি আন্তর মিল আছে।দু-একটি দৃশ্যের উপস্থাপনা ও রূপসজ্জার কয়েকটি ব্যাপার একটু গোলমেলে লেগেছে! মশা গুন্ডাকে মারতে যাওয়ার মুহূর্তটিকে বিশিষ্ট করে তোলা এবং মানুষের মনের অন্ধকার প্রবৃত্তির আভাস দেওয়ার জন্যই সম্ভবত ওই সময় আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই ধীরে ধীরে আলো নেভানো, দৃশ্যটিকে বেশিক্ষণ টানা এবং অভিনয়ে ঢিলে পড়ার জন্য পুরো ব্যাপারটি একটু অতিনাটকীয় হয়ে পড়েছিল। পরিচয় ঢোকার আগে পর্যন্ত সুনীল ও অনুসূয়ার দৃশ্যাংশটিও দুর্বল। পাত্রপাত্রীদের রূপসজ্জা কয়েক জায়গায় একটু অস্বাভাবিক লেগেছে। অবতার ও অবতারের বাবার মুখে বড় বেশি রঙ মাখানো হয়েছিল। সারা দিন অফিসে খাটার পর গুণ্ডার তাড়া খেয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় বাড়ি ফেরার সময় অনুসূয়ার মুখে নিখুঁত মেকআপ — তাতে ক্লান্তি ও ঘামের ছাপ নেই। এমন কি আফিম খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার পরও তার মুখের মেকআপ নায়িকা-সুলভ ভাবে উজ্জ্বল। চোখের কোণে একটু কালির ছোপ পর্যন্ত নেই। অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে ফিরে আসার পর ও সাজতে যাওয়ার আগে প্রতিমার মুখের মেকআপ একটু অদ্ভুত লাগে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার, কিন্তু এক অচিন ছাড়া পুরুষরা কেউ কখনও খালি গায়ে থাকে না। কারখানা থেকে ফেরার পরও পরিচয় কালিঝুলিমাখা জামা ছাড়েনা, গলা পর্যন্ত বোতাম আঁটা অবস্থা আস্তে আস্তে ভারি ভদ্রভাবে রুমাল দিয়ে গলার ঘাম মুছতে থাকে।

মূল নাটকের দুর্বলতা ও প্রযোজনার ছোটোখাটো ত্রুটি সত্ত্বেও নাটকের কয়েকটি জায়গা বিশেষভাবে দর্শকের মনকে নাড়া দেয়। যেমন ধরা যাক্, রাহুল যখন রোজগেরে অবতার থেকে হঠাৎ একটা রুগণ বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, কী ভাইবোন সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিচয় হঠাৎ খুব একা বোধ করে। অবতার- সাজা রুগ্ন ছেলেটিকে শ্রীমিত্র বড় নিপুণভাবে ব্যবহার করেছেন। প্রথম দিকে মনে হয় শুধু ধর্মের ভন্ডামি প্রকাশ করাই যেন এই চরিত্রটির একমাত্র নাটকীয় উদ্দেশ্য। কিন্তু তৃতীয় দৃশ্যে তার অসহায় ছোটাছুটি ও আর্ত বোবা কান্নার মধ্যে পুরো যুগের অসহায় আর্তনাদ মূর্ত হয়ে ওঠে। পরিচয় মার খেয়ে ফেরার পরে চারিদিকের জমাট অন্ধকার ঘেরা ছোট একটুখানি আলোর বৃত্তের মধ্যে বসে পরিচয়কে জল খাওয়ানোর দৃশ্যটিও দর্শককে গভীরভাবে স্পর্শ করে।

অন্যান্য কয়েকটি দিক থেকেও এ প্রযোজনার গুরুত্ব আছে। এ নাটকে বহুরূপীর নামকরা শিল্পীরা কেউ অংশগ্রহণ করেন নি। একেবারে আনকোরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়ে যে এমন জোরালো অভিনয় করানো যায় এবং এমন শক্ত বাঁধুনির টিমওয়ার্ক তৈরি করা যায় তা না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। বহু দর্শকের মনে ইদানীং বহুরূপীর একটা নির্দিষ্ট ভাবরূপ তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। রাজা, রাজা অয়দিপাউস, বাকি ইতিহাস ইত্যাদি মিলিয়ে একটু বেশি সূক্ষ্ম, বেশি মার্জিত, একটু যেন আশপাশের সাধারণ জগতের ছোঁয়াবাঁচানো ব্যাপার। কিন্তু এ নাটকটি একেবারে হাল আমলের সমস্যা নিয়ে লেখা – এ বড়ো নিদারুণ ভাবে পরিচিত জগতের কথা, বড়ো ভয়ঙ্কর রকমের সমকালীন। শুধু বহুরূপীর এতদিনকার আদল ভেঙেচুরে তাকে একটা নতুন চেহারা দেওয়া নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলা থিয়েটারের ক্ষেত্রেও বহুবারের মতো এবারও শম্ভু মিত্র একটা নতুন দরজা খুলে দিলেন। অধিকাংশ নাটকের দলই আজকাল বিদেশি নাটকের রূপান্তর ও অনুবাদ মঞ্চস্থ করছেন। বিদেশি নাটক করলে কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয় না এবং সোফোক্লিস, শেক্সপিয়ার, ব্রেশট ইত্যাদি মহা নাট্যকারদের নাটক থিয়েটারের স্বার্থেই সব সময় সব দেশে অভিনীত হওয়া উচিত। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে শুধু বিদেশি নাটকের ওপর ভরসা করে কোনো দেশের নাট্য-আন্দোলন অনির্দিষ্ট কাল ধরে চলে যেতে পারে না। পরিচালকদের সাধারণ অভিযোগ – প্রযোজনায় উৎসাহ জাগে এমন ভালো মৌলিক নাটক এ দেশে নেই। মৌলিকের নামে যা চলে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদেশি নাটকের অক্ষম অনুকরণ। পরিচালকদের এ অভিযোগ আংশিকভাবে সত্য। কিন্তু এ অবস্থার অন্য আরেকটি দিক আছে। বছরের পর বছর তাদের নাটক অপ্রযোজিত পড়ে থাকবে জেনেও এদেশের নাট্যকাররা ক্রমাগত ভালো নাটক লিখে যেতে থাকবেন এবং পরিচালকদের সহযোগিতা ছাড়াই ভারতবর্ষ কিংবা বাংলাদেশের বিশিষ্টসত্তাটিকে ধরতে পারে এমন একটি নাট্যরীতি আবিষ্কার করে ফেলবেন এমন আশা করা অবাস্তব ও অসংগত। ভবিষ্যতের মুখ চেয়ে কোনো না কোনো পরিচালককে ঝুঁকি নিতেই হবে। সুখের বিষয়, শম্ভু মিত্র সে ঝুঁকি নিলেন। তার মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠা পরিচালক নীতীশ সেনের মতো অখ্যাত নাট্যকারের নাটক প্রযোজনা করে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখলেন এবং প্রমাণ করলেন যে প্রযোজনার গুণে একটি সাধারণ নাটককেও দর্শককে গভীরভাবে নাড়া দেওয়ার মতো নাট্য-অভিজ্ঞতার স্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

সপ্তাহ ২৭ জুন ১৯৬৯

ঋণ স্বীকার: মধুময় পাল সম্পাদিত আগুনের খেয়া এবং মহালয়া চ্যাটার্জী


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন