বৃহস্পতিবার | ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:২২
Logo
এই মুহূর্তে ::
হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় কেন বারবার মণিপুরে আগুন জ্বলে আর রক্ত ঝড়ে : তপন মল্লিক চৌধুরী শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (শেষ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (প্রথম পর্ব) : অভিজিৎ রায় শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (ষষ্ঠ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (শেষ পর্ব) : বিজয়া দেব শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (পঞ্চম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ? : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (চতুর্থ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (শেষ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার শতবর্ষে সঙ্গীতের ‘জাদুকর’ সলিল চৌধুরী : সন্দীপন বিশ্বাস সাজানো বাগান, প্রায় পঞ্চাশ : অমর মিত্র শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (তৃতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (একাদশ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার খাদ্যদ্রব্যের লাগামছাড়া দামে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের : তপন মল্লিক চৌধুরী মিয়ানমারের সীমান্ত ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্যোগ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (দ্বিতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (দশম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার বুদ্ধদেব গুহ-র ছোটগল্প ‘পহেলি পেয়ার’ ‘দক্ষিণী’ সংবর্ধনা জানাল সাইকেলদাদা ক্যানসারজয়ীকে : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (প্রথম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (নবম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘তোমার নাম’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (অষ্টম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘হাওয়া-বদল’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (সপ্তম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার প্রবোধিনী একাদশী ও হলদিয়ায় ইসকন মন্দির : রিঙ্কি সামন্ত সেনিয়া-মাইহার ঘরানার শুদ্ধতম প্রতিনিধি অন্নপূর্ণা খাঁ : আবদুশ শাকুর নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘শুভ লাভ’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (ষষ্ঠ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

নন্দী-মা লিখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় / ১০১৬ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ১৪ মার্চ, ২০২২

ধর্মতলার অনশন মঞ্চে থাকাকালীনই আমরা খবর পাচ্ছিলাম, বলপূর্বক বিভিন্ন জায়গায় জমি অধিগ্রহণের জন্য সরকারি নির্দেশনামা জারি করা হচ্ছে। যেখানে যেখানে ওই কাজ হচ্ছিল, সেখানেই আমাদের আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হচ্ছিলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাধারণ মানুষ।

যেমন পরমাণু কেন্দ্র তৈরি হবে সরকারি খবর রটে গিয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের হরিপুরে। তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গেই যোগ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারও। একদিকে পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য কয়েক হাজার একর জমি দখলের চেষ্টা। অন্যদিকে আবার ওই জেলারই নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাবের জন্য জমি অধিগ্রহণ। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। জমি হারানোর আতঙ্কে, পরমাণু কেন্দ্রের ভয়ে এবং সিঙ্গুরের কৃষক ও সাধারণ মানুষের উপর সরকারি বাহিনীর অত্যাচার দেখে মানুষ আরও শঙ্কিত হচ্ছিলেন।

সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে সিঙ্গুর-আন্দোলন চলাকালীনই শুরু হয়েছিল হরিপুরের প্রতিবাদ মিছিল। এমনিতেই তমলুক বা সাবেক তাম্রলিপ্ত চিরকালই আন্দোলনের পীঠস্থান। তাই জমি আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা নিতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা জোটবদ্ধ হতে শুরু করেছিল। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর আবেদনে সাড়া দিয়ে ২৬ দিনের অনশন আন্দোলন প্রত্যাহার করার পরেই আমি অসুস্থ শরীর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। ফলে ২৯ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত বহির্জগতের সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগই ছিল না।

৩ জানুয়ারি রাতে প্রথম জানতে পারলাম, নন্দীগ্রামে জমিরক্ষার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বড়ো গণ্ডগোল হয়েছে। জমি দখলের বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার পর ওখানকার সমস্ত মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন বিডিও অফিসে। পুলিশের সঙ্গে তখন তাঁদের বচসা হয়। তা থেকেই শুরু হয় লাঠিচার্জ। জনগণের সঙ্গে সংঘাত শুরু হয় প্রশাসনের একাংশের। জমি দখলের বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার সময় থেকেই সংঘাত শুরু হয়েছিল। ক্রমশ পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। গ্রামবাসীরা এককাট্টা।

৭ জানুয়ারি সোনাচূড়ায় খুন হলো বিশ্বজিৎ-ভরত-সেলিম। ক্রোধে-আক্রোশে জ্বলে উঠল নন্দীগ্রাম। সিপিএম হার্মাদদের হামলার প্রতিবাদে বেরিয়ে এলেন নন্দীগ্রামের দলমতনির্বিশেষে মা-ভাই-বোনেরা। নন্দীগ্রামের আন্দোলন পরিণত হলো আত্মমর্যাদার আন্দোলনে। শুরু হলো জীবন সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়। সেখ সুফিয়ান, আবু তাহের, সোয়েম কাজি, কুদ্দুস, নিশিকান্ত মণ্ডলরা একজোট হলেন। তাঁদের সাহায্য করতে সর্বশক্তি দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস। শিশির অধিকারী, শুভেন্দু অধিকারী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সীরা ওই আন্দোলনকে নিজেদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন ভেবেই নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন।

সিঙ্গুরের কৃষিজমি আন্দোলনের সময় থেকেই অনেক বামপন্থী বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছিল। সিঙ্গুরের অনশন আন্দোলনে যাওয়ার আগে আমরা ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’ গড়ে আন্দোলন শুরু করেছিলাম। তখন সেই বামপন্থী বন্ধুরাও তাঁদের বুদ্ধি-পরামর্শ-সহযোগিতা ও ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মাধ্যমে আমাদের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন।

সিঙ্গুরের আন্দোলন যখন ধর্মতলায় কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলন গড়ে তুলছিল, তখন বাংলা-সহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ওই আন্দোলনের যথার্থতা নিয়ে একটা জনমত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তার প্রতিফলন ঘটেছিল মানুষের মধ্যে। যাঁরা জমি আগ্রাসনের আশঙ্কায় শঙ্কিত ছিলেন, তাঁরা নিজেদের অধিকার রক্ষায় জোটবদ্ধ হচ্ছিলেন। নন্দীগ্রাম থেকে হরিপুর, ভাঙড় থেকে ক্যানিং, ক্যানিং থেকে রায়চক, বারাসাত থেকে বর্ধমান, বর্ধমান থেকে বীরভূম, উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ি থেকে চা-বাগান—সর্বত্রই মানুষ গর্জে উঠেছিলেন।

সিঙ্গুর যে পথ দেখিয়েছিল, নন্দীগ্রাম তা গ্রহণ করে জমির লড়াইকে বাঁচার লড়াইয়ে পর্যবসিত করেছিল। হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই বিশ্বজিৎ-ভরত-সেলিমের খুনের ঘটনা শুনে পার্থদা, দোলা সেন, পূর্ণেন্দু বসুকে সেখানে পাঠাই। তাঁরা ফিরে এসে যা বলেছিলেন, ভয়ংকর। সিপিএমের নেতারা তখন নন্দীগ্রামের মানুষকে জব্দ করতে পর পর এলাকায় হার্মাদবাহিনী সংগঠিত করে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ করার পরিকল্পনা করছে। তাদের সঙ্গে পুলিশ আছে বলেও জানতে পেরেছি।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই আমি নন্দীগ্রাম যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ৪ ফেব্রুয়ারি গেলাম নন্দীগ্রামে। আন্দোলনে নিহত সাত জনের পরিবারের হাতে আমার সহকর্মীদের তরফে এক লক্ষ টাকা করে সাহায্য তুলে দেওয়া হলো। শোনা যাচ্ছিল, জমি অধিগ্রহণের সরকারি বিজ্ঞপ্তি নাকি প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। তাঁরা সেটা প্রথমে বিশ্বাসও করেছিলেন। কিন্তু দেখছিলেন, তেখালি ব্রিজ পেরিয়ে খেজুরির দিক থেকে প্রায় প্রতিদিনই সিপিএমের সশস্ত্র হার্মাদরা আসছিল হুমকি দিতে। অন্যদিকে, প্রশাসন আন্দোলনকারীদের জড়িয়ে দিচ্ছিল মিথ্যা মামলায়। যাতে তাঁরা আন্দোলন থেকে সরে আসেন।

ক্রমশ তৈরি হচ্ছিল প্রশাসনের উপর অনাস্থা। যে রাস্তা দিয়ে সশস্ত্র সিপিএম ক্যাডারদের আনাগোনা চলছিল, সেই রাস্তা কেটে দেন গ্রামের মানুষ। প্রশাসন ঘোর বিপাকে পড়ল। বাঁচার পথ খুঁজছিলেন মানুষ। অত্যাচার, অনাচার, সন্ত্রাসকে জয় করে এগিয়ে যাচ্ছিল জোটবদ্ধ নন্দীগ্রাম। কিন্তু দীর্ঘ তিরিশ বছর যে মানুষ তাদের বশংবদ ছিল, তাঁদের এই ঘুরে দাঁড়ানো ভালো চোখে দেখল না সিপিএম। বিনয় কোঙার হুমকি দিলেন, ‘চারিদিক থেকে গিয়ে পাল্টা মার দেওয়া হবে। ওরা অস্ত্র নিয়ে এলে আমরা কি চুপ করে থাকব? দরকার হলে ওদের দখলে থাকা চারটে গ্রাম পঞ্চায়েত ঘিরে ফেলে জীবন জেরবার করে দেব। লক্ষ্মণ শেঠকে ফাঁসি দিলে কি শুভেন্দু অধিকারীরা বাঁচবে?’

২০০৭ সালের ৬ জানুয়ারির মধ্যে কেশপুর-লাইনেই নন্দীগ্রাম দখলের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল সিপিএম। খেজুরি, হলদিয়া এবং রেয়াপাড়া দিয়ে সশস্ত্র ক্যাডারদের ঢোকানোর পরিকল্পনাও চূড়ান্ত। গড়চক্রবেড়িয়া, কালীচরণপুর, সাউদখালি, সোনাচূড়া-সহ চারটি গ্রাম পঞ্চায়েত দখলে অভিযানের যুদ্ধ শুরু করতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সিপিএমের অনুমতির অপেক্ষায় ছিল তারা। পুরো অভিযান পরিচালনার জন্য বিভিন্ন এলাকায় ছোটো-বড়ো মিলিয়ে ২৫টি ক্যাম্প গড়া হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল, প্রথম জমিরক্ষা আন্দোলনের নেতাদের তাড়াতে ময়দানে নামবে খেজুরির কুখ্যাত হার্মাদবাহিনী। শিবিরগুলির মধ্যে যোগাযোগের জন্য একাধিক মোবাইল ফোনও প্রতিটি শিবিরে পাঠানো হয়েছিল। সিপিএমের আশ্রিত এলাকার দাগী অপরাধীদের খেজুরির তিনটি শিবিরে আনা হয়েছিল। ৬ জানুয়ারি সকাল থেকেই শিবিরগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সবকটি শিবির মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার ক্যাডার এবং দুষ্কৃতী নন্দীগ্রাম দখলমুক্ত করার প্রস্তুতি নেয়। আনা হয় অন্তত ৫০০ মোটরবাইক।

৭ জানুয়ারি সূর্যোদয়ের আগেই রক্তাক্ত হলো নন্দীগ্রামের মাটি। মারা গেলেন তিন জন। ৩ থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ এবং সিপিএমের তরফে মোট ১০টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। অভিযুক্ত প্রায় এক হাজার জন।

রাতে হামলার আশঙ্কায় জেগে থাকতেন নন্দীগ্রামের মানুষ। শাঁখ-কাঁসর ঘণ্টা নিয়ে, মসজিদে মসজিদে মাইকের সামনে। বহিরাগতদের আক্রমণের সংকেত দিতে। আন্দোলনকারী ও আন্দোলন-বিরোধী দু-ভাগে বিভক্ত তালপাটি খালকে মাঝে রেখে। উত্তরে নন্দীগ্রাম আন্দোলনকারীদের স্বভূমি। দক্ষিণে আন্দোলন-বিরোধী সিপিএমের দুর্ভেদ্য দুর্গ। একজন গড় রক্ষা করতে চায়। অন্য দল চায় প্রতিরোধ ভেঙে, গুঁড়িয়ে দিয়ে গড় দখল করতে।

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে ত্রাস আর আতঙ্ক গ্রাস করল নন্দীগ্রামকে। সিপিএমের সমর্থকরা ফেরিঘাট বন্ধ করে দেওয়ায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর প্রভাব পড়ল। শিল্পনগরী হলদিয়ায় জনমজুর খাটতে যাওয়া শ্রমিকদের রোজগারের পথ বন্ধ হলো। বন্ধ হয়ে গেল শাক-সবজি-মাছের ছোটো ব্যবসায়ীদের উপার্জনের রাস্তা।

৪ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের দিকনির্দেশ করতে নন্দীগ্রামের কলেজ-মাঠে বিশাল জনসভা করলাম। সেখানে বললাম, ‘সিঙ্গুর থেকেই সরকারের জোর করে জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। সেই আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছে গোটা বাংলায়। শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। শিল্প বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জোর করে কৃষিজমি গ্রহণ আটকাব। বুদ্ধবাবু বাংলার মা-মাটি-মানুষকে বোঝেন না। তাই এ ভাবে কৃষিজমি নিচ্ছেন।’

ক্রমে রাজ্য-রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল। বামফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে মতভেদ প্রকাশ্যে চলে এল। ফ্রন্টের বৈঠকে শরিকরা প্রশ্ন তোলায় মুখ্যমন্ত্রী বললেন, তিনি নাকি কিছুই জানতেন না। তাঁদের লোকেরা কেন সমীক্ষা না করে মৌজার তালিকা তৈরি করেছে, জানতেন না। নন্দীগ্রাম যে এত ঘন বসতিপূর্ণ, জানতেন না। তাঁদের অন্যায় হয়ে গিয়েছে। ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি নন্দীগ্রাম গিয়ে সব বুঝিয়ে বলবেন।

মুখ্যমন্ত্রী গেলেন। কিন্তু খেজুরির হেড়িয়াতে। নন্দীগ্রামের ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সদস্যরা সেখানে যোগ না দিয়ে নিজেরা মিটিং-মিছিল করলেন। সিপিএমের তরফে ৭ জানুয়ারি ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো মুখ্যমন্ত্রীর সভায়। কিন্তু তাঁরা কেউই গেলেন না। উল্টে বললেন, ‘খুনি মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে টাকা নেব না।’ সিপিএমের স্থানীয় নেতারা বললেন, সম্ভবত ওঁরা ‘রাজনৈতিক কারণে’ সাহায্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী সেই সভায় বললেন, মানুষ না চাইলে নন্দীগ্রামে জোর করে জমি নেওয়া হবে না। কিন্তু মানুষের মনের সংশয় যায়নি। তাঁরা ভাবলেন, আন্দোলন থেমে গেলেই আবার জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। ফলে আন্দোলন আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

সমাবেশে ছিলেন পার্থদা, পূর্ণেন্দুদা, শুভেন্দু, সমীর পুততুণ্ড, কবীর সুমন, সুনন্দ সান্যাল এবং সিঙ্গুরে নিহত তাপসী মালিকের বাবা মনোরঞ্জন মালিক। অনশন প্রত্যাহারের পর নন্দীগ্রামের প্রথম জনসভাতেই আমি সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলাম।

মার্চের শুরুতে নন্দীগ্রামের দখল নেওয়ার জন্য সিপিএম এবং পুলিশি তৎপরতা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হলো। ৪ মার্চ কোলাঘাটে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অতিথিশালায় বৈঠক হলো ‘অপারেশন নন্দীগ্রাম’ নিয়ে। সেখানে হাজির পুলিশের পদস্থ কর্তাদের সঙ্গেই সিপিএমের নেতারা। তারপরেই নন্দীগ্রামের বিভিন্ন সীমানায় সশস্ত্র ক্যাডার বাড়াতে থাকে সিপিএম। ৫ মার্চ থেকে ১০ মার্চের মধ্যে পুরো পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে যায়। ১০ তারিখে জেলাশাসকের সঙ্গে বৈঠকে বসেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। সেখানে লিখিত সিদ্ধান্ত হয়, প্রশাসন শান্তিরক্ষার জন্য রাস্তাঘাট ও ব্রিজ সারাবে। সে জন্য জরুরি প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সেই বৈঠকে অবশ্য ছিলেন না তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও প্রতিনিধি। কিন্তু বৈঠকের সিদ্ধান্ত পৌঁছে যায় প্রতিরোধ কমিটির অন্যতম দুই সেনাপতি শিশিরদা-শুভেন্দুর কাছে।

অনশনের জন্য গলব্লাডার নষ্ট হয়ে যাওয়ায় প্রথম দফায় নন্দীগ্রাম থেকে ঘুরে আসার পরেই আমার একটা অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি। ভেবেছিলাম, নন্দীগ্রাম শান্ত হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম, তা হলো না। রোজ বোমা-গুলি চলত। আমরা আমাদের দলের নেতাদের ঘনঘন সেখানে পাঠাতাম। ভেবেছিলাম, সরকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মর্যাদা দেবে। বারবার প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করেও কোনও লাভ হলো না। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার তখন পরস্পরের বিশেষ বন্ধু। তাই কারও কাছেই সহায়তা পাওয়া গেল না। বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। দেখে সাধারণ মানুষ নিজেরাই আত্মরক্ষার জন্য আবার জায়গায় জায়গায় রাস্তা কাটতে শুরু করলেন।

অস্ত্রোপচারের পরে চিকিৎকদের নির্দেশে বাড়িতে থাকলেও আমি নিয়মিত খোঁজ রাখতাম। নন্দীগ্রামে গণহত্যা ঘটানোর আগে থেকেই আমার কাছে খবর আসছিল, খেজুরিতে সিপিএম প্রচুর অস্ত্র মজুত করছে। বাইরে থেকে দুষ্কৃতী ভাড়া করে এনে খেজুরিতে রাখছে। প্রতিদিনই তালপাটি খালের ও-পার থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসছে এ-পারে।

কিন্তু ১৪ মার্চের মতো একটা ঘটনা ঘটতে পারে, সে সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। তবে কিছু কিছু তথ্য পাচ্ছিলাম। যেমন, কোলাঘাটের সমস্ত অতিথিশালা ‘বুক’ করে নেওয়া হয়েছিল। ১০ মার্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশের বড়োকর্তাদের সঙ্গে সিপিএমের নেতাদের নিয়মিত বৈঠক হচ্ছিল। পুলিশকে পথ দেখানো এবং আন্দোলনকারী নেতাদের চিনিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশবাহিনীর সঙ্গে সিপিএমের বাহিনীও ভিতরে যায়। ১০ মার্চের পর থেকেই সিপিএম এবং প্রশাসনের দাপাদাপি বেড়ে গিয়েছিল। উন্নয়নের জন্য গ্রামে ঢুকতে বাধা দেওয়া অনুচিত—এই বার্তা ছড়িয়ে যেতে আন্দোলনকারীরা কিছু কিছু রাস্তা পুলিশের যাতায়াতের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু শঙ্কা তাঁদের মনে ছিলই। কিছু কিছু খবরও বাইরে চলে আসছিল। পুলিশের একাংশের মাধ্যমে।

১৪ মার্চের ঘটনা তো আর বিশদে বলার কিছু নেই। পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। আরও অনেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন। তাঁদের এখনও খোঁজ মেলেনি।

অস্ত্রোপচারের জন্য আমার তখন গাড়িতে বেশি সময় যাতায়াত করা বারণ। বাড়িতেই খবর পেলাম নন্দীগ্রামের। কিছুক্ষণের জন্য বিহ্বল হয়ে গেলাম। তারপর সম্বিত পেয়ে ছুটলাম বাড়ির পাশের অফিসে। সেখানে দ্রুত জমিরক্ষা কমিটি ও তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের ডেকে পাঠালাম। তারপর সংক্ষিপ্ত সাংবাদিক বৈঠক করে রওনা দিলাম নন্দীগ্রামের পথে।

রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল। তাঁদের মুখে শুধু নন্দীগ্রাম-গণহত্যার কথা। কোলাঘাটে পৌঁছোনোর পরেই মুখোমুখি হলাম একদল সিপিএম ক্যাডারের। তারা আমার গাড়ি আটকাল। তারপর অকথ্য গালিগালাজ করতে লাগল সেখানে দাঁড়িয়ে। সে ভাবেই রাত ঘনিয়ে এল। সিপিএমের নেতাদের নির্দেশ ছিল, আমাদের যেন নন্দীগ্রামের দিকে যেতে না দেওয়া হয়। সুতরাং, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। প্রশাসন মূক-বধির-অন্ধ। ততক্ষণে সিপিএমের ক্যাডাররা বাকি মৃতদেহগুলো হলদি নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। আমরা তখন নন্দীগ্রামে পৌঁছোলে তো সকলে ব্যাপারটা জেনে যেত। রুখে দেওয়া হয়েছিল সংবাদমাধ্যমকেও। আসলে সরকার এবং প্রশাসন ভাবতে পারেনি, অসুস্থ শরীরেও আমি গণহত্যার কেন্দ্রস্থলের দিকে বেরিয়ে পড়তে পারি। তাই সেদিন আমাদের সারা রাত রাস্তায় আটকে রাখতে বাধ্য হয়েছিল তারা। নন্দীগ্রামের সমস্ত রাস্তাই বন্ধ করে রাখায় প্রায় মধ্যরাতে ঘুরপথে আমরা তমলুকে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। পরদিন সকালে যাতে অন্তত নন্দীগ্রাম পৌঁছোতে পারি, তার ব্যবস্থা করছিলাম। ফলে সরকারের পরিকল্পনা পুরোটা কার্যকর করা যায়নি। মাঝরাতে তমলুকে পৌঁছোনোর পরেও সিপিএমের ক্যাডাররা আমাদের গাড়ি ঘিরে উন্মত্ত তাণ্ডব চালিয়েছিল। কেউ বলছিল, ‘চল। সকলকে বাদ দিয়ে তোকে একা নিয়ে যাই।’ কেউ বলছিল, ‘একটা পেট্রোল বোমা নিয়ে আয়। মুখটা পুড়িয়ে দিই এখানেই!’ আমার সঙ্গে ছিল দোলা, পূর্ণেন্দুদা আর অনুরাধা পুততুণ্ড। প্রত্যেকেই ঘটনায় স্তম্ভিত।

অগত্যা মাঝরাতের পর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ফোনে ধরলাম। বললাম, ‘এখানে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটছে। কিছু একটা করুন।’

তিনি ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আর ফোন করলেন না। টেলিভিশনে লোকসভার বিরোধী দলনেতা সমস্ত দেখে ফোন করলেন। বললেন, ওখানে আইনের শাসন নেই। আমরা যেন ওখান থেকে সরে যাই। দিল্লি এবং কলকাতা থেকেও বহু হিতৈষীর ফোন আসছিল এলাকা ছাড়তে বলে। ফলে তমলুকে ফিরে যেতে হলো রাতে।

পরদিন সকালে আবার রওনা দিলাম নন্দীগ্রামের পথে। জানতাম, সিপিএম ক্যাডাররা আবার পথ আটকাবে। রেয়াপাড়ার মুখে ওরা যথারীতি আমাদের পথ আটকাল। বাধা পেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর পায়ে হেঁটেই রওনা দিলাম। অনেকদূর যাওয়ার পর দেখতে পেলাম প্রায় ১০ হাজার মানুষের একটা মিছিল আসছে নন্দীগ্রামের দিক থেকে। মিছিলের নেতৃত্বে শেখ সুফিয়ান। রেয়াপাড়ায় আমাদের আটকে দেওয়া হয়েছে খবর পেয়েই সুফিয়ানরা আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছিল।

প্রথমেই গেলাম হাসপাতালে। অবর্ণনীয় দৃশ্য। ভিতরে যখন আগতদের সঙ্গে কথা বলছি, বাইরে শুরু হলো কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া। হাসপাতালের মধ্যেই এসে পড়ল গ্যাসের শেল। কারও পেটে গুলি, কারও কোমরে, কারও পিঠে, কারও হাতে, কারও পায়ে গুলির আঘাত। মাথায় গুলি খেয়েও কেউ লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে।

পরের কয়েকদিন সংবাদের শিরোনামে রইল নন্দীগ্রাম। রাজ্যে, দেশে, বিদেশেও। রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী গেলেন হাসপাতালে। আহতদের সঙ্গে দেখা করতে। ১৬ তারিখে সিবিআইয়ের টিম গেল তদন্ত করতে। বামফ্রন্টের শরিক দল থেকে শুরু করে রাজ্যপাল, হাইকোর্ট থেকে সংসদ—কাঠগড়ায় দাঁড় করালো মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর সরকারকে। সমালোচিত হলেন ঘরে-বাইরে। দেশ ও বিদেশে। নন্দীগ্রামের ঘটনায় ব্যথিত তিন জন লেখক রাজ্যের দেওয়া পুরস্কার ফিরিয়ে দিলেন। আরও বহু বিশিষ্টজন ফিরিয়ে দিলেন রাজ্য সরকারের পুরস্কার। অনেকে পুরস্কারের অর্থমূল্য দান করলেন নন্দীগ্রামের নিহত-আহতদের জন্য ত্রাণ তহবিলে।

নন্দীগ্রামের গণহত্যার পর মানুষ ভেবেছিলেন, আর নয়। এ বার শেষ হবে অশান্তি। আন্দোলনকারী এবং সাধারণ মানুষ আবার বিচারের আশায় বুক বেঁধেছিলেন। হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত শুরু করে। কুখ্যাত জননী ইটভাটা থেকে সশস্ত্র সিপিএম হার্মাদদের গ্রেফতার করে। বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা হতে থাকে বোমা এবং অস্ত্রশস্ত্র। সিবিআই তদন্ত শুরুর পর থেকেই শাসকদল এবং সরকার খানিকটা পিছু হঠতে শুরু করেছিল। সিবিআই-ও তদন্ত করে তাদের রিপোর্ট আদালতে জমা দিয়েছিল। সকলেই উৎসুক ছিল, রিপোর্টের বিষয়বস্তু জানতে। কিন্তু কেউই তা জানতে পারেনি। আমি অনেকের কাছ থেকে শুনেছিলাম, তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থক সিপিএম নানা ছলচাতুরি করে এমন ব্যবস্থা করেছিল, যাতে ওই রিপোর্ট দিনের আলো না দেখতে পায়। তার মধ্যে এমনকী, রাজনৈতিক চাপও। ফলে সিপিএমের সরকার সিপিএম দলকে বার্তা দিল, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের বিরুদ্ধে কিছু করবে না।

শুনেছি, সেই খবর পেয়েই সিপিএম হার্মাদরা আবার নন্দীগ্রামে অত্যাচারের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল। খেজুরি তখন সম্পূর্ণভাবে হার্মাদদের দখলে। সেখানেই মজুত ছিল অস্ত্রভাণ্ডার। প্রতিদিনই গুলিগোলা চালানো শুরু হলো। খবর শুনে আমিও রোজই প্রায় রাজনৈতিক প্রতিনিধি দল পাঠাতে শুরু করলাম সেখানে। নিয়মিত যেতে শুরু করলেন মহাশ্বেতা দেবী, কবীর সুমন, শাঁওলি মিত্র, অপর্ণা সেন, কৌশিক সেন, ব্রাত্য বসু, অর্পিতা ঘোষ, শুভাপ্রসন্ন, বিভাস চক্রবর্তী, জয় গোস্বামী, দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনন্দ সান্যাল, তরুণ সান্যাল, অশোকেন্দু সেনগুপ্তরা। একবার নয়, বহুবার।

আমি নিজে যে কতবার গিয়েছিলাম, তার সংখ্যা আমিও জানি না।

সিবিআইয়ের রিপোর্ট হাইকোর্টে জমা পড়ার পর থেকেই কিন্তু আবার উল্টো বাতাস বইতে শুরু করল। পুজোর সময় পরিকল্পনা করে ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রামে ‘সূর্যোদয়’ ঘটানোর শুরু করল সিপিএম। তার আগে ২৮ অক্টোবর আমি গিয়েছিলাম সেখানে। একের পর এক অত্যাচারের ঘটনা ঘটতে থাকায় মানুষকে নৈতিক সমর্থন দিতে। তেখালি ব্রিজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করে ও-পাশ থেকে গুলি ছুটে এল। গাড়ির সামনে এসে পড়ল কার্তুজের ফাঁকা খোল। আমি গ্রামবাসীদের বললাম, ‘আপনারা ঝুঁকি নেবেন না। গুলি লাগতে পারে আপনাদের।‘ জবাবে ওঁরা বললেন, জীবন বাজি রেখে আমাদের রক্ষা করবেন। একটা ভ্যান রিকশার উপর মাইক লাগিয়ে ওঁরা সভা শুরু করে দিলেন। আমার ধারেকাছে তখন কোনও পুলিশ নেই। শুধু দুই ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী দ্বিবেদীদা আর স্বরূপ। ছিলেন সাংবাদিকরা। টানা দু-তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে সিপিএমের গুন্ডাদের চ্যালেঞ্জ করেছিলাম।

সেদিন সন্ধ্যায় কাঁথি পুরসভায় একটা কর্মসূচিতে যাওয়ার কথা ছিল। সকলে অনুরোধ করতে থাকল সেখানে যাওয়ার জন্য। অনেক রাত করে শেষপর্যন্ত সেখানে পৌঁছোলাম। সে রাতে কাঁথিতেই থেকে গেলাম। ঠিক করলাম, সকাল হলেই যাব নন্দীগ্রামের দিকে। কিন্তু খবর পেলাম, সিপিএম কাঁথির চারপাশে সমস্ত পথ অবরোধ করে রেখেছে। নন্দীগ্রাম থেকে কাউকে আসতে বা সেখানে কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। রাত পর্যন্ত অবরোধ উঠল না। পরদিন আবার নন্দীগ্রামের মানুষের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে আমাদের বাংলা বন্‌ধ ছিল। সে রাতে না-ফিরলে আর ফেরা যেত না। তাই চলে এলাম, বন্‌ধের দিন কলকাতায় থাকতে হবে। নন্দীগ্রামকে ঘিরে সেই অবরোধের নাম সিপিএম দিল ‘সূর্যোদয়’।

৬ নভেম্বর থেকে কালীপুজোর মধ্যে নন্দীগ্রামকে ঘিরে তাণ্ডব চালাল সিপিএম। নিহত ও আহত হন কয়েক জন। ২৯ অক্টোবর থেকেই নন্দীগ্রামে যাওয়ার সমস্ত রাস্তা অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল সিপিএম। সাংবাদিকদেরও প্রবেশে ছিল নিষেধাজ্ঞা। তখন আমি তৃণমূল ভবনে থাকতাম। ফোন বাজলেই মনে হত, কোনও দুঃসংবাদ নয়তো? ভাবতাম, কবে আবার নন্দীগ্রামের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারব। সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল, যখন শুনলাম, ১০ নভেম্বর কালীপুজোর দিন নন্দীগ্রামের মানুষেরা একটা শান্তিমিছিল করছিলেন আর তার উপর গুলি চালিয়েছে সিপিএম হার্মাদরা। অনেকে রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন। অনেকে আহত। অনেককে নাকি আবার টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হলদি নদীর দিকে। কালীপুজোর আলোর রাত কালো হয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে গেল দীপাবলির ঔজ্জ্বল্য। সেই রাতে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ফোন করে সাহায্য চাইলাম। কিন্তু কোনও সাড়া না পেয়ে ঠিক করলাম, নন্দীগ্রামে যেতেই হবে। পরদিনই বেরিয়ে পড়লাম। খবর পেলাম, আবার আমাদের বাধা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সিপিএম।

আবার গতবারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। পার্থদা বললেন, একজন পদস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে খবর পেয়েছেন, রাতে আমাদের প্রাণনাশের পরিকল্পনা করা হয়েছে। রাস্তায় যেন ওইভাবে দাঁড়িয়ে না থাকি। সকলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, কোলাঘাটের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অতিথিশালায় রাতের বাকি দু-এক ঘণ্টা কাটিয়ে দেব।

পরদিন ভোরবেলায় আবার শুনলাম, নন্দীগ্রাম চারদিক থেকে অবরুদ্ধ। কিন্তু আমরা কোলাঘাট থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বেরোনোর আগে এক শুভার্থীকে বললাম, ‘তুই শুধু তোর মোটরবাইকটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আয়।’

সিপিএম ক্যাডাররা আবার অবরোধে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমরা কোলাঘাটের পাশ দিয়েই যাব। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, পাঁশকুড়ার ভিতর দিয়ে এগোব। সিপিএম তা জানত না। তবে কয়েক কিলোমিটার ঢুকে পড়ার পর তারা খবর পেয়ে আবার পিছু ধাওয়া শুরু করল। আবার অবরোধ। আবার কটূক্তি। আমি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। লক্ষ্য করলাম, ওদের ক্রোধের মাত্রাটা। আর কী কী গালিগালাজ করছে। ভাবতে ভাবতেই দোলা আর কাকলি ঘোষদস্তিদারের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কথা বলতে বলতেই চোখের ইশারা করলাম বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সহকর্মীকে। চোখের পলকে সকলের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে আমি ঝট করে ওর বাইকে চড়ে বসলাম। আর বললাম, ‘খুব জোরে চালা। কোনওদিকে তাকাবি না। কোথাও থামবি না আমায় জিজ্ঞেস না করে।’

দ্রুত চলতে শুরু করল বাইক। ততক্ষণে পুলিশ-সিপিএম আমাদের গরুখোঁজা খুঁজছে। অনেক পথ পেরিয়ে যখন আমরা পাঁশকুড়া শেষ করে বড়ো রাস্তার উপর গিয়ে তমলুক যাওয়ার রাস্তার উপর, তখন দেখলাম, আবার কমরেডরা খোঁজখবর নিয়ে আমাদের রাস্তা আটকে দিয়েছে। ততক্ষণে মুকুলরাও কয়েকটা বাইক জোগাড় করে এসে আমাদের ধরে ফেলেছে। এবার একজনকে বললাম, কয়েক জন স্থানীয় ছেলেকে জোগাড় করতে। যারা গ্রামের ভিতরের রাস্তাগুলো চেনে। ততক্ষণে খবর পেয়ে দলে দলে মানুষ আমার পাশে জড়ো হতে শুরু করেছেন। তাঁরাও চাইছিলেন, আমরা যাতে নন্দীগ্রাম পৌঁছোতে পারি।

দু-তিন জন স্থানীয় যুবককে নিয়ে আমরা এক অচেনা রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করলাম। সিপিএমের কমরেডদের অবরোধের একেবারে উল্টোদিকে। তিনটে বাইকে আমরা ছ-জন। তিন-চারটে গ্রাম পেরোনোর পর দেখলাম, পিছনে বাইকের সংখ্যা বাড়ছে। পিছন থেকে আওয়াজ এল, ‘দিদি, আমরা সকলে আপনার সঙ্গে আছি। ঠিক যাচ্ছেন। আমরা আপনারই কর্মী। কোনও চিন্তা নেই। অনেক তৃণমূল কর্মী আছে আশেপাশে। খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। কেউ আটকাতে পারবে না আপনাদের। আপনাকে ঠিক তমলুকে পৌঁছে দেব।’

তমলুকে ঢোকার মুখেও অবরোধে পড়তে হবে, জানতাম। তাই মুখ ঘুরিয়ে বললাম, জেলার পুলিশ সুপারের অফিসের দিকে যাব। সমস্ত বাইকের মুখ যখন ঘুরে গিয়েছে, তখন একজনকে ইশারা করলাম হাসপাতালের দিকে যেতে। ওখানে ভর্তি আহতদের কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ পাব জানতাম। বোকার মতো সিপিএমের অবরোধকারীরা দৌড়োলো পুলিশ সুপারের অফিসের দিকে। আমরা ঢুকে পড়লাম হাসপাতালে। তার আগেও ওরা একবার বাধা দিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের অগ্রাহ্য করেছিলাম পুরোপুরি। হাসপাতালে যে বর্ণনা শুনলাম, ভয়ংকর। ঠিক করলাম, পুলিশ সুপারের অফিসের সামনে ধরনায় বসব। সেদিন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। কিন্তু সারা বাংলায় এক শোকের দিন। নন্দীগ্রামের পথে বেরিয়েও দুটো দিন কেটে গেল পথের ধুলোয়। মধ্যরাতে ফিরে গেলাম তমলুকের আশ্রয়ে। ভাবলাম, পরদিন যাব। প্রধানমন্ত্রী তখন রাশিয়ায়। সেখানে তাঁর অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে নন্দীগ্রামের অসহনীয় অত্যাচারের কথা জানালাম। সিআরপিএফ পাঠানোর অনুরোধ করলাম। সাহায্য চাইলাম গোটা রাজ্য, এমনকী, দিল্লিতেও আমাদের পরিচিতদের কাছে।

দিল্লিতে বুদ্ধিজীবীরা অনেকে রাস্তায় নামলেন। আর কলকাতা-সহ সারা বাংলার সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, কবি, নাট্যব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র জগৎ, সাংস্কৃতিক কলাকুশলীরা নামলেন পথে। প্রেসিডেন্সি থেকে যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীরা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামবাংলা—সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠল। তখন চলছিল কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। অভিনেতা, বুদ্ধিজীবীরা উৎসব বয়কট করলেন। ফিরিয়ে দিলেন তাঁদের অর্জিত পুরস্কার। কলকাতাকে উত্তাল করে রাজপথে হল মৌনমিছিল। মিছিলে অংশ নিয়ে প্রতিবাদে-প্রতিরোধের ঢেউ তুললেন সমাজের বিশিষ্টজনেরা। চিত্রশিল্পীরা ক্যানভাসে আঁকলেন নন্দীগ্রামের সন্ত্রাসের ছবি। শঙ্খ ঘোষ-জয় গোস্বামীদের কবিতা, প্রতুল মুখোপাধ্যায়-কবীর সুমনের গান, কৌশিক-ব্রাত্য-রেশমী-মণীশ-অর্পিতাদের নাটকের সংলাপের মধ্যে প্রতিবাদের ভাষা পেলেন বাংলার অগণিত মানুষ।

সারা দেশ তোলপাড় হয়ে গেল। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনীর জন্য তখনও অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সিপিএমকে অখুশি করতে চায়নি কেন্দ্রে তাদের ‘বন্ধু সরকার’। তমলুকে তিনদিন ধরে পড়েছিলাম সহকর্মীদের নিয়ে। যাতে নন্দীগ্রাম থেকে দূরে না যেতে হয়। সেখান থেকেই আন্দোলন সংগঠিত করেছি। নন্দীগ্রামের আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে ক্রমাগত যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। শেষমেশ সাংবাদিক বৈঠক করে বললাম, ‘যতক্ষণ না সিআরপিএফ নন্দীগ্রামে পৌঁছোবে, আমি এখান থেকে যাব না।’

শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন মহলের চাপে পড়ে, জনমতকে উপেক্ষা করতে না পেরে খানিকটা ঢোক গিলে হলেও কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাতে হয়েছিল নন্দীগ্রামে। ততদিনে রাজ্যপাল গোটা ঘটনাকে অনৈতিক-অগণতান্ত্রিক-অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দিয়েছেন। একই কথা বলেছেন অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞও। সেই সময়েই সংবাদমাধ্যম মারফত জানলাম, লোকসভার তৎকালীন বিরোধী দলনেতা নন্দীগ্রামে আসবেন। মুকুলকে বললাম, এবার তাঁর নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী আসবেই। বাস্তবেও তাই হলো। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হলো, যা হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি যেন আর না হয়।

টানা ১০ দিন নন্দীগ্রাম অবরুদ্ধ হয়ে থাকার পর সেখানে সিআরপিএফ এল।

বিরোধী দলনেতার কনভয়ের মধ্যে একটা গাড়িতে নন্দীগ্রামে চলে গেল পূর্ণেন্দুদারা। ফিরে এসে ওরা আমায় রিপোর্ট দেওয়ার পর শুরু করলাম ত্রাণের কাজ। হাজার হাজার মানুষ তখন ঘরছাড়া। স্কুল-কলেজ-সহ বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হল ত্রাণশিবির। সিআরপিএফের উপর মানুষের আস্থা জন্মেছিল। অলোক রাজ ছিলেন তাদের নেতৃত্বে। প্রায় প্রতিদিনই ত্রাণ পাঠানো হতো।

অসম্ভব মানসিক শক্তি দেখেছি আমি নন্দীগ্রামের মানুষের মধ্যে। অফুরন্ত বিশ্বাস দেখেছি। সংহতির মেলবন্ধন দেখেছি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে। সিঙ্গুর আন্দোলনের মতোই নন্দীগ্রামেও মা-বোনেদের মনের জোর দেখেছি বারবার। বহুবার। সংখ্যালঘুদের দৃঢ় মানসিকতা আর তফসিলি ভাই-বোনেদের প্রাণোন্মাদনা নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে ঐতিহাসিক করেছিল।

(মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বই থেকে সংগৃহীত)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন