মঙ্গলবার | ১৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৩:২৮
Logo
এই মুহূর্তে ::
স্মরণে মননে জন্মদিনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : রিঙ্কি সামন্ত হুগলি জেলায় কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় খালিয়াজুরি মৌজার প্রাচীন ইমারত : ফারুকুর রহমান চৌধুরী দুর্দৈবপীড়িত রবীন্দ্রনাথ : দিলীপ মজুমদার শান্তি সভ্যতার গুণ, যুদ্ধ তার অপরাধ … ভিক্টর হুগো : অশোক মজুমদার হরপ্পার ব্যুৎপত্তি নিয়ে নতুন আলোকপাত : অসিত দাস বল পয়েন্ট কলমের জার্নির জার্নাল : রিঙ্কি সামন্ত মহেঞ্জোদারো নামের নতুন ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস পরিসংখ্যানে দারিদ্রতা কমলেও পুষ্টি বা খাদ্য সংকট কি কমেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী অথ স্নান কথা : নন্দিনী অধিকারী তন্ত্র বিদ্যার বিশ্ববিদ্যালয় চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধুসভ্যতার ভাষায় ও স্থাননামে দ্রাবিড়চিহ্ন : অসিত দাস ধরনীর ধুলি হোক চন্দন : শৌনক দত্ত সিন্ধুসভ্যতার ভাষা মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবির নামে : অসিত দাস বিস্মৃতপ্রায় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় ভাষায় সিন্ধুসভ্যতার মেলুহার ভাষার প্রভাব : অসিত দাস বঙ্গতনয়াদের সাইক্লিস্ট হওয়ার ইতিহাস : রিঙ্কি সামন্ত নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘ঝড়ের পরে’ ভালো থাকার পাসওয়ার্ড (শেষ পর্ব) : বিদিশা বসু গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই প্রভু জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

ডাক-হরকরা : ছোট গল্প লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় / ৩৯৩২ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ডাক্তার ডাকে চলিয়াছে।

শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি, তাহার উপর আকাশে দুর্যোগ। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে তারা নাই, সাধারণ অন্ধকারের মধ্যে থাকে যে স্বল্প স্বচ্ছতা, তাহাও নাই; ঘন মেঘের কালো ছায়ায় প্রগাঢ় নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে পৃথিবী যেন হারাইয়া গিয়াছে। চারিপাশে শুধু অজস্র সঞ্চরমাণ জোনাকির দীপ্তি জ্বলে আর নেবে— জ্বলে আর নেবে, যেন অসীম অনন্ত গাঢ় মৃত্যু-পরিব্যাপ্তির মাঝখানে ক্ষণস্থায়ী জীবনদীপ্তি জন্মজন্মান্তরের মধ্য দিয়া বিকাশ পাইয়া পাইয়া চলিয়াছে।

অকস্মাৎ রাস্তার একটা কাদা-ভরা গর্তে গরুর গাড়িখানা পড়িয়া একটা ঝাঁকুনি খাইতেই ডাক্তারের চিন্তার ঘোর কাটিয়া গেল। চারিপাশে জল-ভরা মাঠে ব্যাঙের চিৎকার, আশেপাশে বৃক্ষপল্লবের মধ্যে ঝিঁঝির ডাক, তাহারই সঙ্গে গরুর গাড়িখানার চাকার বিনাইয়া বিনাইয়া কানার সুরের মত একটি সকরুণ দীর্ঘ শব্দ বেশ শোভনভাবেই মিশিয়া গিয়াছে। রাস্তার পাশের গাছগুলির পাতায় পাতায় জল ঝরিতেছে টুপটাপ— টুপটাপ। ডিস্ট্রিক্ট-বোর্ডের পাকা রাস্তার নুড়ি-পাথরের কঠিন বন্ধুরতার উপর দিয়া গাড়িখানা মন্থরগতিতে চলিয়াছে। ডাক্তার একদৃষ্টে সম্মুখের অন্ধকারের দিকে চাহিয়া ছিল। দূরে যেন একটা জোনাকি অনির্বাণ দীপ্তিতে জ্বলিতেছে, অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সেটা এই দিকেই আসিতেছে!

ডাক্তার গাড়োয়ানকে জিজ্ঞাসা করিল, ওটা কি আলো অটল?

বর্ষার রাতে অটল ঘুমে ঢুলিতেছিল, সে একবার জোর করিয়া চোখ খুলিয়া দেখিয়া বলিল, কে জানে মশায়! অঁই— অঁই— ই গরুকে কি বলতে হয় বল দেখি!— বলিয়া গরু দুইটিকে একবার তাড়না করিয়া আবার ঢুলিতে আরম্ভ করিল।

হ্যাঁ, আলোই ওটা, ক্রমশ দীপ্তিটা উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিতেছে, বিন্দুর আকার হইতে ক্রমশ আকারে বড় মনে হইতেছে। আলোটা দ্রুতবেগে এই দিকেই আসিতেছে। ডাক্তার উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। এই দুর্যোগ মাথায় করিয়া কে এমন ছুটিতে ছুটিতে আসিতেছে। রোগীর বাড়ির লোক নয়তো!

ঝুন-ঝুন-ঝুন— মৃদু ঘণ্টার শব্দ ডাক্তারের কানে আসিল। ডাক্তার হাঁকিল, কে? কে? কে আসছে?

উত্তর আসিল, ডাক— সরকার-বাহাদুরের ডাক। ডাক-হরকরা আমি। —বলিতে বলিতে লোকটি নিকটে আসিয়া পড়িল। ঘণ্টাধ্বনি স্পষ্টতর হইয়া উঠিল, লোকটির হাতের আলোতেই ডাক্তার দেখিল— বেঁটে, কালো, আধা-বয়সী এক জোয়ান কাঁধের উপর মেল ব্যাগ ঝুলাইয়া সমান একটি তাল বজায় রাখিয়া ছুটিতে ছুটিতে চলিয়াছে। তাহার মাথায় ছেঁড়া একটি মাথালি, এক হাতে একটি বল্লম; ওই বল্লমটারই ফলার সঙ্গে ঝুলানো ঘণ্টা ঝুনঝুন শব্দে বাজিতেছে।

ডাক্তার প্রশ্ন করিল, কে রে— দীনু?

দীনু ডোম ডাক-হরকরা— মেল-রানার, সাত মাইল দূরবর্তী আমদপুর স্টেশন হইতে ডাক লইয়া চলিয়াছে হরিপুর পোস্ট-আপিসে।

সচল দীনু উত্তর দিল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

কতটা রাত্রি হ’ল বল্ দেখি দীনু?

আজ্ঞে, তা— রাত ভেঙে এসেছে, তিন পহর গড়িয়ে এল আর!— দীনুর কথার শেষ অংশের সাড়া আসিল গাড়ির পিছন দিক হইতে। মেল-রানার সমান বেগে ছুটিয়া চলিয়াছে। কথা বলিতে বলিতেই সে গাড়ি অতিক্রম করিয়া চলিয়া গিয়াছে। ঘণ্টার শব্দ ক্রমশ মৃদুতর হইয়া আসিতেছিল, আলোর শিখাটা ক্রমশ আবার পরিধিতে হ্রাস পাইয়া বিন্দুতে পরিণত হইতে চলিয়াছে।

অটল কখন জাগিয়া উঠিয়াছিল, সে সহসা জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, ওই বস্তার ভিতরে কি থাকে?

ডাক্তার হাসিয়া বলিল, চিঠি রে চিঠি। কত দেশ-দেশান্তরের খবর, বুঝলি? এক শো দু শো পাঁচ শো ক্রোশ দূরে যা সব ঘটছে সেই সব খবর ওই ব্যাগের মধ্যে থাকে।

অটল নীরবে কিছুক্ষণ চিন্তা করিল। দেশ-দেশান্তরের খবর! কিন্তু বেশী বুঝিতে পারিল না। অবশেষে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, উঃ, সাধে বলে— বায়ের আগে বাত্তা ছোটে!

বায়ুরও আগে বার্তা নাকি ছুটিয়া চলে। ডাক্তার পিছনের অন্ধকারের দিকে চাহিয়া ওই কথাটাই ভাবিতে ভাবিতে ডাক-হরকরার সন্ধান করিতে চেষ্টা করিল। ঘণ্টার শব্দ আর শোনা যায় না, অসংখ্য খদ্যোৎদীপ্তির মধ্যে ডাক-হরকরার আলোক জোনাকির আলোর মতই ক্ষুদ্র হইয়া হারাইয়া গিয়াছে। ডাক্তার অটলকে বলিল, বায়ের আগে বাত্তা ছোটে— কথাটা বেশ অটল।

ডাক্তারের গাড়ি অন্ধকার পথ ধরিয়া যেন কাঁদিতে কাঁদিতে চলিয়া গেল।

ডাক-হরকরা তাহার অভ্যস্ত নির্দিষ্ট গতিতে ছুটিতে ছুটিতে চলিতেছিল। হাতের হারিকেনটার শিখা দ্রুতগমনের জন্য কাঁপিয়া কাঁপিয়া ধোঁয়ায় চিমনিটাকে প্রায় কালো করিয়া তুলিয়াছে। দীনুর হাতে বল্লমটা বেশ দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ। মাথায় মাথালিটা দড়ি দিয়া চিবুকে বাঁধা। ইহাতে শুধু মাথাই বাঁচিয়াছে, দীনুর সমস্ত শরীর জলে ভিজিয়া গিয়াছে। হঠাৎ বৃষ্টিটা জোরে নামিল।

দীনু কিন্তু সমান বেগে চলিতেছিল। এই ছুটিয়া চলাটা তাহার বেশ অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। তাহার কাঁধে সরকারী ডাক, পথে তাহার এক মিনিট বিশ্রাম করিবার উপায় নাই— হুকুম নাই। গতি পর্যন্ত শিথিল করিতে পাইবে না। ডাকবাবু বলেন, এক মিনিটের ফেরে হাজার হাজার লোকের সর্বনাশ হয়ে যাবে দীনু।

দীনুর বুকটা শঙ্কায় কেমন গুরগুর করিয়া উঠে। আবার একটু গৌরবও অনুভব করে।

তাহাদের পাড়ায় নোটন ডোম চৌকিদারি কাজ করে, দীনু তাহাকে বলে, এ বাবা তোমাদের চৌকিদারি কাজ লয় যে, ঘরে শুয়েই জানালা থেকে দুটো হাঁক মেরেই খালাস, চাকরি হয়ে গেল! এ হ’ল সরকারী ডাকের কাজ, এক মিনিট দেরি হ’লেই— বাস, হাতে হাতকড়া।

আজ সাত বৎসর দীনু ডাক-হরকরার কাজ করিতেছে; প্রত্যহ রাত্রে সে ডাক লইয়া যায়, লইয়া আসে; কিন্তু কোনদিন তাহার এক মিনিট বিলম্ব হয় নাই। বরং সেবার পুল ভাঙিয়া একদিন কলিকাতার ডাকগাড়ি আসে নাই, একদিন পথে মালগাড়ি ভাঙিয়া রাস্তা বন্ধ হওয়ায় পশ্চিমের ডাকগাড়ি আসতে পাঁচ ঘণ্টা দেরি হইয়াছিল, কিন্তু দীনু ঠিক সময়ে যায়, ঠিক সময়ে আসে।

শ্রাবণ-রাত্রির আকাশে মেঘ যেন জমাট অন্ধকার, মধ্যে মধ্যে সে অন্ধকার বিদীর্ণ করিয়া অজগর-জিহ্বার মত বিদ্যুৎরেখা আঁকিয়া-বাঁকিয়া খেলিয়া যাইতেছিল। সঙ্গে সঙ্গে বর্ষার মেঘের গম্ভীর মৃদু গর্জন— দূরে পুলের উপর ডাকগাড়ির শব্দের মত দীনুর মনে হয়। অকস্মাৎ একটা সুতীব্র নীল আলোকে দীনুর চোখ যেন ঝলসিয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গেই ভীষণ কঠোর বজ্রধ্বনিতে সমস্ত যেন থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। মুহূর্তের জন্য ত্রাসে বিহ্বল হইয়া দীনু বলিয়া উঠিল, রাম— রাম— রাম!

দূরে কোথায় বাজ পড়িয়াছে। মুহূর্তপরেই প্রকৃতিস্থ হইয়া দীনু আবার তাহার অভ্যস্তগতিতে ছুটিয়া চলিল। বল্লমের ঘণ্টা বাজিতে আরম্ভ করিল— ঝুনঝুন— ঝুনঝুন।

ডাকঘরে যখন সে পৌঁছিল, তখন ভোর হইয়াছে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের পুঞ্জিত মেঘস্তর পরিষ্কাররূপে চোখের সম্মুখে ফুটিয়া উঠিয়াছে। ডাক নামাইয়া দীনু একটা বিড়ি ধরাইয়া বলিল, উঃ, বাজ যা আজ একটা পড়ল বাবু, সাঙিন বাজ! বাপ রে, বাপ রে!

পোস্টামাস্টার বলিলেন, ওঃ, বিছানাতে থেকেই আমি লাফিয়ে উঠেছিলাম দীনু। তারপর দীনুর দিকে চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন, এঃ, ভিজে গিয়েছিস যে রে— অ্যাঁ! দাঁড়া বাবা, ইনসিওর-রেজিস্ট্রিগুলো দেখে নিয়ে তোর ছুটি ক’রে দিই, তুই বাড়ি গিয়ে কাপড়চোপড়গুলো ছেড়ে ফেল্।

দীনু বলিল, তামাক দেন কেনে একটুকু, সাজি একবার। উঃ, বড্ড কাঁপুনি লেগেছে মশায়।

অতঃপর পোস্টমাস্টার ইনসিওর-রেজিস্ট্রি লইয়া বসিলেন, পিয়ন চিঠিগুলির উপর খটখট শব্দে ছাপ মারিতে আরম্ভ করিল, দীনু আপন মনে তামাক সাজিয়া টানিতে বসিল। তাহার শীত করিতেছিল, কিন্তু উপায় নাই, ডাক না মিলিলে তাহার ছুটি হইবে না।

কই হে, কাগজখানা দাও দেখি যুদ্ধের খবরটা একবার দেখি!— ইহারই মধ্যে, এই ভোরেই জনকয়েক লোক পোস্ট-আপিসের দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। কালীবাবুর সংবাদপত্রের সংবাদের জন্য উৎকট নেশা, তিনি হাত বাড়াইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। আর ছিল গোবিন্দ রায়। লোকটি স্কুলমাস্টার, তাহার নেশা যত ফ্রী-স্যাম্পলের। ‘বিনামূল্যে’ দেখিলেই গোবিন্দ রায় সেখানে চিঠি লিখিয়া বসিবে। জার্মানি হইতে বিনামূল্যে সে তার কোষ্ঠী তৈয়ারি করাইয়া আনিয়াছে। সে প্রত্যহ আসে, পাছে তাহার স্যাম্প্ল্ গোলমাল করিয়া অন্য কেহ লইয়া যায়। আর আসিয়াছিল— আঁকাবাঁকা হাতের লেখা চিঠির জন্য কয়জন যুবক। প্রৌঢ় রামনাথ চাটুজ্জেও আজ আসিয়াছিল, দূর দেশে তাহার জামাইয়ের খুব অসুখ; চাটুজ্জে উৎকণ্ঠিত হইয়া এক পাশে দাঁড়াইয়া ছিল। প্রত্যেকখানি চিঠির ঠিকানা পিয়ন পড়িয়া শেষ করে, এ দিকে চাটুজ্জে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে— এ চিঠি তাহার নয়।

ইনসিওর-রেজিস্ট্রির কাজ শেষ হইয়া গেল। দীনুর এবার ছুটি, সে বাড়ি চলিল। হাতে তাহার খান-দুই রঙিন খাম— কাহার ছেঁড়া চিঠির ফেলিয়া-দেওয়া খাম, সে-কয়খানা সে নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিতে দেখিতে চলিয়াছিল।

পোস্টমাস্টার বলিলেন, গরুটার ঘাস দিতে এত দেরি করিস কেন দীনু? একটু সকালে সকালে দিস।

ডাকবাবুর গরুর জন্য ঘাস দীনুকে দিতে হয়।

তাই আনব।— বলিয়া দীনু চলিয়া গেল।

পথে রামনাথ চাটুজ্জের বাড়িতে তখন মেয়েদের বুক-ফাটা কান্নার রব উঠিয়াছে। সে ধ্বনির মর্মচ্ছেদী বেদনাস্পর্শে এই প্রভাতেও শ্রাবণের আকাশ যেন কাঁদি-কাঁদি করিতেছিল।

দীনু চলিতে চলিতেই একবার আপন মনে বলিল, আহা!

বাড়িতে আসিয়া পাঁচ বছরের মেয়ে লক্ষ্মীর হাতে খাম দুইখানি দিয়া দীনু বলিল, কেমন খাম এনেছি, দেখ্ নক্ষ্মী! কেমন ছবি, আবার কেমন সুবাস উঠছে, দেখ! বেলাত থেকে এসেছে চিঠি।

লক্ষ্মী খাম দুইখানি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখিতে দেখিতে বলিল, চিঠি কি বাবা?

কালি দিয়ে কাগজে সব নেকা থাকে মা।

কি নেকা থাকে বাবা?

এই— তুমি কেমন আছ, আমি ভাল আছি।

আর?

আর কি থাকে— দীনুর মনে সেটা যোগাইল না, সে চুপ করিয়া রহিল।

মেয়ে আবার প্রশ্ন করিল, আর?

অকারণে বিরক্ত হইয়া দীনু এবার বলিল, জানি না মা। আবার কি থাকবে?

লক্ষ্মী শান্ত মেয়ে, বাপের বিরক্তি দেখিয়া সে আর প্রশ্ন করিল না, খাম দুইখানি লইয়া চলিয়া গেল।

দীনু স্ত্রীকে প্রশ্ন করিল, নেতাই কোথা, মাঠে গিয়েছে?

নিতাই দীনুর একমাত্র পুত্র। স্ত্রী বলিল, জানি না বাপু, কাল সনজেতে সেই বেরিয়েছে, এখনও ফেরে নাই। সারা রাত আখড়াতে মদ খেয়েছে, আর ঢোল বাজিয়ে সব চেঁচিয়েছে। দুবার আমি ডাকতে গেলাম তো, আমাকে তেড়ে মারতে এল।

দীনুর মেজাজ গরম হইয়া উঠিল, সে রুক্ষ্মস্বরে বলিল, লবাবের বেটা লবাব! হারামজাদা আমার রোজকারে খাবেন আর টেরি ফাটিয়ে লব্বাগি ক’রে বেড়াবেন! তাকে আমার ঘরে ঢুকতে দিও না ব’লে দিচ্ছি, হ্যাঁ।

নিতাইয়ের মা বলিল, সে তুমি ব’লো বাপু, আমি লারব।

দীনু উত্তরোত্তর উত্তপ্ত হইয়া উঠিতেছিল, সে আরও রুক্ষস্বরে বলিল, কেনে, লারবি কেনে, শুনি?

ব’লে কে মার খাবে বাপু? ছেলের চোখ যেন লাল কুঁচ, আর লাটাই-ঘোরা হয়ে ঘুরছেই।

দীনু চিৎকার করিয়া উঠিল, মারবে! সে হারামজাদা কত বড় মরদের বেটা দেখে লোব আমি।— বলিয়া সে কোদাল এবং ঘাস কাটিবার জন্য কাস্তে ও ঝুড়ি লইয়া মাঠে যাইতে উঠিয়া পড়িল। স্ত্রী পিছন হইতে ডাকিয়া বলিল, এই দেখ, নিজের করণটা একবার দেখ— খাওয়া নাই, কিছু নাই, মরদ চললেন রাগ ক’রে। খেয়ে যাও বলছি। সারা রাত দৌড় দিয়ে হাঁটা—

দীনু ফিরিল, বলিল, ট্যাক-ট্যাক করা তোর এক স্বাভাব। দে তাই, মদের ভাঁড়টা বার ক’রে দে— ওই খেয়েই যাই এখন। যে জল সমস্ত রাত, জমির আল-টাল আর কি আছে! সময়ে না দেখলে খাবি কি ধুমসী?

দীনুর স্ত্রী স্থূলাঙ্গী। স্ত্রী বলিল, এই দেখ, গতর খুঁড়ো না বলছি।— মদের ভাঁড়টা স্বামীর হাতে দিয়া ফিক করিয়া হাসিয়া বলিল, তা বাপু, গতর যদি একটুন কমে তো বাঁচি—

নিঃশেষে ভাঁড়ের মদটুকু পান করিয়া দীনু বাহির হইয়া গেল। ডাক লইয়া ফিরিয়া প্রাতঃকালে এটুকু তাহার না হইলেই নয়। সে বলে, এ আমার চা।

ঘণ্টা-দুয়েক পরে কর্দমাক্ত দেহে মাথায় ঝুড়িতে এক বোঝা ঘাস ও আঁচলে এক আঁচল কই-মাগুর মাছ লইয়া সে বাড়ি ফিরিল। মাঠে মাছগুলি সে ধরিয়াছে। বাড়ির বাহির হইতেই সে শুনিল, তাহার ‘লবাবপুত্তুর’ নিতাই বেশ জড়িতস্বরে উচ্চকণ্ঠে গান ধরিয়া দিয়াছে—

হায় কি কঠিন রোগ উঠেছে ওলাউঠো

লোক মরিছে অসম্ভব।

মাছ পাইয়া দীনুর মেজাজ বেশ খুশী হইয়া উঠিয়াছিল, আর খালি পেটে মদের নেশাটাও আজ জমিয়াছে ভাল। সে ছেলেকে কোন কটু কথা বলিল না, ঘরে ঢুকিয়া বেশ হাসিয়া বলিল, গানের ছিরি দেখ দেখি বেটার! তাই, একটা ভাল গান গা রে বাপু।— বলিয়া সে নিজেই আরম্ভ করিল—

ওরে আমার কালো মেয়ে ভোবন করেছে আলো।

নিতাই বলিয়া উঠিল, থাম, থাম বাপু, ষাঁড়ের মত আর চেঁচিও না তুমি। আমি গাই, শোন—

দীনু অত্যন্ত চটিয়া গেল, সে গান থামাইয়া বলিল, রাখ্ তোর গান। বলি— আমার কথার জবাব দে দেখি আগে। মাঠ যাস নাই কেনে, শুনি?

নিতান্ত তাচ্ছিল্যভরে নিতাই জবাব দিল, ধু—রো, মাঠ গিয়ে কি হবে? মাঠ গিয়ে কে কবে বড়নোক হয়েছে, শুনি?

দীনু অবাক হইয়া গেল।

নিতাইয়ের কথা তখনও শেষ হয় নাই, সে বলিতেছিল, এই একরাশ ধান বেচলে তবে তোর একটা টাকা। ধু—রো, মাঠ গিয়ে কি হবে?

নিতাইয়ের মা বলিল, ওরে লবাবের বেটা লবাব, খুব যে মুখে টাকা দেখাইছিস, বলি— একটা পয়সা কখনও এনেছিস তুই?

নিতাই ট্যাঁক খুলিয়া ঠং করিয়া একটা টাকা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল— যেন নিতান্ত তুচ্ছ বস্তু সেটা। তারপর বলিল, ওই লে, ফের যদি টিকটিক করবি, তো বুঝতে পারবি।

মা তাহার অবাক হইয়া গেল! দীনু কিন্তু গম্ভীর স্বরে বলিল, তুই টাকা কোথা পেলি রে নেতাই?

হি-হি করিয়া হাসিয়া নিতাই উত্তর দিল, রাজারা মানিক কোথা পায়?

দীনু গম্ভীরতর স্বরে বলিল, হাসি-তামাশা নয় নেতাই। বল্ তুই টাকা কোথা পেলি?

নিতাই বিরক্তভরে উঠিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া যাইতে যাইতে বলিল, র্ম তুই ওইখানে বকবক ক’রে, হ্যাঁ।

দীনু উঠিয়া পিছন পিছন দুয়ার পর্যন্ত আসিয়া তাহাকে ডাকিল, নেতাই, শোন্, শুনে যা, ফিরে আয় বলছি।

নিতাই তখন গলা ছড়িয়া গান ধরিয়া আখড়ায় চলিয়াছে—

পীরিতি হ’ল শূল সখী, পীরিতি হ’ল শূল।

ও আমি বসিলে উঠিতে লারি, আমার হাত ধ’রে তুল গো।

দীনু ফিরিয়া আসিয়া দাওয়ার উপর অপ্রসন্ন গম্ভীর মুখে বসিয়া রহিল। নিতাইয়ের ভাবগতিক তাহার বেশ ভাল লাগে না। তাহার পোশাক-পরিচ্ছদের বাহার ও বিড়ি-সিগারেটের প্রাচুর্য দেখিয়া দীনু সন্দেহ করিত স্ত্রীকে— সে-ই বোধ হয় নিতাইকে গোপনে পয়সা-কড়ি দিয়া থাকে। কিন্তু আজ পুরা একটা টাকা এমন তাচ্ছিল্যভরে ফেলিয়া দেওয়ায় দীনুর চিত্ত সন্দিগ্ধ হইয়া ইঠল, শেষ পর্যন্ত চিন্তা করিতে করিতে সে শঙ্কিত না হইয়া পারিল না।

স্ত্রী বলিল, মুড়ি দিয়েছি, খাও। খেয়ে একটুকুন গড়াও, বিছানা ক’রে দিয়েছি। ঘাস আমি মাস্টারবাবুর বাড়িতে দিয়ে আসছি।

দীনু স্ত্রীকে প্রশ্ন করিল, আচ্ছা নেতাই টাকা কোথা পেলে বল্ দেখি?

স্ত্রী বলিল, ভ্যালা মানুষ তুমি বাপু! ওই নিয়ে তুমি ভাবতে বসলে? বেটাছেলে, কোথাও হয়তো পেয়েছে।

দীনু কিন্তু নিশ্চিন্ত হইতে পারিল না।

অপরাহ্ণে আহারের সময় পিতাপুত্রে আবার সাক্ষাৎ হইল। তখন দীনুর মদের নেশা কাটিয়াছে, কিন্তু নিতাইয়ের চোখ তখনও লাল। দীনু নিতাইয়ের আপাদমস্তক বেশ করিয়া দেখিয়া লইল। দীনুর চোখ জুড়াইয়া গেল। ভরা-জোয়ান হইয়াছে নিতাই। সুন্দর সুগঠিত সবল দেহখানি কে যেন কালো পাথর কুঁদিয়া তৈয়ারি করিয়াছে। সর্বাঙ্গ ব্যাপিয়া একটা অস্থির চঞ্চলতা খেলা করিতেছে, মনে হয়, ইচ্ছা করিলে নিতাই আকাশে উড়িয়া যাইতে পারে। দীনু পরিতুষ্ট চিত্তে স্নেহার্দ্র কণ্ঠস্বরে বলিল, এইবার তো জোয়ান হয়েছিস নেতাই, এইবার একটা কাজে-কম্মে লেগে যা। ডাকঘরের কাজেই লেগে পড়্। নতুন ডাকঘর হচ্ছে আবার রামলগরে— এই ফাঁকে লেগে যা।

নিতাই বাপের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, ঢের লোক আছে তোর কাজ করবার। উ কাজ আমি লারব। বাবাঃ, সারা পথ ধুকুর-ধুকুর ক’রে ছোটা, উ কি মানুষে পারে?

নিতাইয়ের মা বলিল, কেনে, তোর বাবা পারে, আর তুই পারবি না কেনে? তোর বাবা কি মানুষ লয় নাকি?

নিতাই বাপের মুখের দিকে চাহিল : উ একটা আস্ত ভূত। লইলে, হ্যাঁঃ—

দীনু আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, লইলে কি?

যাও যাও, ব’কো না বেশি তুমি। বুদ্ধি থাকলে এতদিন বড়নোক হয়ে যেতে তুমি কোন্ দিন।

তার মানে?

মানে আবার কি? বললাম, তুমি ভেবে দেখ কেনে!— বলিয়া নিতাই হাত-মুখ ধুইয়া শিস দিতে দিতে চলিয়া গেল। দীনু নির্বাক স্তম্ভিত হইয়া তাহার গমন-পথের দিকে চাহিয়া রহিল।

স্ত্রী বলিল, হতভাগা উ কি বললে বল দেখি?

দীনু সে কথার কোন উত্তর দিল না, তাহার আর সময় ছিল না, সে বল্লম পেটি মাথালি ও লণ্ঠন লইয়া বাহির হইয়া গেল। ডাক যাইবার সময় হইয়াছে।

ঝুনঝুন— ঠুনঠুন।

ডাক-হরকরা মৃদুতালে ছুটিতে ছুটিতে চলিয়াছে। এই গতি তাহাকে বরাবর সমানভাবে বজায় রাখিয়া চলিতে হইবে। পথে একদণ্ড বিশ্রাম করিবার উপায় নাই, গতি শিথিল করিবার উপায় নাই, সামান্য বিলম্ব ঘটিলে কি হইবে দীনু কল্পনা করিতে পারে না, কিন্তু তাহার ভয় হয়। তাহার উপর পথে কোথাও ওভারসিয়ার হয়তো লুকাইয়া আছে, কোন জঙ্গলের মধ্যে কিংবা কোন গাছের ডালে বসিয়া ডাক-হরকরার গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছে। সামান্য একটু শৈথিল্য দেখিলেই সে রিপোর্ট করিয়া বসিবে, সঙ্গে সঙ্গে উপর হইতে জরিমানার হুকুম আসিয়া পড়িবে।

দীনু একবার মাত্র জরিমানা দিয়াছে। গতি-শৈথিল্যের জন্যও নয়, পথে সে বিশ্রাম করে নাই, তবুও তাহাকে জরিমানা দিতে হইয়াছে। তখন সে নূতন কাজে ভর্তি হইয়াছে, বয়সও তাহার তখন অল্প। ওভারসিয়ারকে সে ঠকাইয়াছিল। সেদিন যে পথে ওভারসিয়ার লুকাইয়া থাকিবে— এ সংবাদ হরিপুরের পিয়ন তাহাকে পূর্বেই জানাইয়া দিয়াছিল : দীনু, আজ সাবধান, পথে আজ থাকবে। কে থাকিবে, সে কথা দীনু পিয়নের ভ্রূ-নৃত্য দেখিয়াই বুঝিয়া লইয়াছিল। পথে সে সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়াই সেদিন আসিতেছিল। সেদিন চাঁদিনী রাত্রি— পৃথিবী যেন দুধে ম্লান করিয়া উঠিয়াছে। সুন্দরীপুরের বুড়ো-বটতলার অল্প দূরে আসিয়া দীনুর মনে হইল, গাছের একটা ডাল যেন অল্প অল্প দুলিতেছে। তরুণ দীনুর তরল চিত্তে দুষ্টবুদ্ধি জাগিয়া উঠিল, সে পাকা রাস্তা ছাড়িয়া মাঠের পথে নামিয়া পড়িল। গাছটাকে পাশে খানিকটা দূরে ফেলিয়া স্থানটা সন্তর্পণে অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল। বল্লমের ঘণ্টাটা হাতের মুঠার মধ্য চাপিয়া ধরিয়াছিল, ঘণ্টারও কোন শব্দ হইল না। তারপর ও-পাশে আবার পাকা রাস্তায় উঠিয়া স্টেশনে ছুটিল। সেদিন খুব একচোট হাসিয়া সে আপন মনেই বলিয়াছিল, থাক বাবাধন, পথের পানে তাকিয়ে গাছের ওপর ব’সে।

ওভারসিয়ার এদিকে গাছের উপর বসিয়া ঘন ঘন ঘড়ি দেখিতেছিল, নির্দিষ্ট সময় পার হইয়া গেল, তবু মেল-রানার আসিল না দেখিয়া সে চিন্তিত হইয়া পড়িল। অবশেষে সে নিজেই ছুটিতে ছুটিতে হরিপুর পোস্ট-আপিসে আসিয়া হাজির হইল। সেখানে আসিয়া তাহার চিন্তার পরিমাণ দ্বিগুণিত হইয়া উঠিল, কোথায় গেল মেল-রানার! সে আবার আমদপুর স্টেশন রওনা হইল। দীনু তখন সেখানকার ডাক লইয়া নির্দিষ্ট সময়েই হরিপুরে ফিরিয়া আসিতেছে। ওভারসিয়ার রিপোর্ট করিয়া বসিল। মিথ্যা বলিলে দীনুর জরিমানা হইত না, বরং ওভারসিয়ারেরই লাঞ্ছনা হইত। কিন্তু দীনু মিথ্যা বলিতে পারে নাই। পিয়ন তাহাকে বার বার বলিয়া দিয়াছিল, তুই বলবি— আমি ঠিক গিয়েছি হুজুর, ইষ্টিশানের টাইম দেখুন; আবার ঠিক সময়ে ফিরেছি, এখানকার টাইম দেখুন। ওভারসিয়ারবাবু হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

দীনু চিন্তিত মুখে উত্তর দিয়েছিল, তা আজ্ঞে, কি ক’রে বলব আমি?

সুন্দরীপুরের বটতলার নিকট আসিয়া দীনুর প্রায়ই কথাটা মনে পড়ে। সে অল্প একটু হাসে। আরও কতবার এইখানে ওভারসিয়ারের সহিত তাহার দেখা হইয়াছে। জঙ্গলের মধ্য হইতে এখনও কোন কোন দিন কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ডাক-হরকরা?

দীনু উত্তরে প্রশ্ন করে, টায়েন ঠিক আছে বাবু?

জঙ্গলের ভিতর হইতেই উত্তর আসে অথবা হাসিতে হাসিতে ওভারসিয়ার রাস্তার উপর আসিয়া বলে, ঠিক আছে রে। তোর কিন্তু এক দিনও দেরি হ’ল না দীনু।

ডাক-হরকরা কিন্তু দাঁড়ায় না, ওভারসিয়ারের এ ছলটুকুও সে জানে। সে তাহাকে অতিক্রম করিয়া চলিয়াই যায়। তাহার বর্শার ফলায় বাঁধা ঘণ্টা ঝুনঝুন শব্দে বাজিতেই থাকে।

ঝুনঝুন— ঝুনঝুন।

আজও দীনু নিয়মিত গতিতে ছুটিয়া চলিয়াছিল। ওভারসিয়ারের কথা মনে পড়ায় নিতাইয়ের চিন্তা ভুলিয়া সে প্রফুল্ল হইয়া উঠিয়াছে।

শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রি, আজও আকাশে মেঘ জমিয়া আছে। তারকাদীপ্তিহীন মেঘলা আকাশ যেন অন্ধকারের মধ্যে মাটির বুকে নামিয়া আসিয়াছে। দীনুর হাতের আলোটা ধোঁয়ার কালিতে অন্ধ চক্ষুর মত জ্যোতিহীন পাণ্ডুর।

অন্ধকার বটবৃক্ষের তলদেশ হইতে একটি মানুষ আসিয়া পথের উপর দাঁড়াইল। দীনু প্রশ্ন করিল, উপরস্যারবাবু?

উত্তরে লাঠির আঘাতে তাহার হাতের লণ্ঠনটা চুরমার হইয়া গেল।

ডাকাত। ডাক লুটিতে আসিয়াছে।

মুহূর্তে দীনু ক্ষিপ্রগতিতে সরিয়া দাঁড়াইয়া হাতের বল্লমটা উঁচু করিয়া ধরিল; বলিল; খবরদার, সরকারের ডাক।

এই দেখ, বস্তাটা দাও বলছি।

দীনুর হাতের বল্লমটা থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল, সে বিকৃত কণ্ঠস্বরে বলিয়া উঠিল, কে—নেতাই?

নিতাই ধাঁ করিয়া দীনুর কম্পিত হস্ত হইতে বল্লমটা কাড়িয়া লইল। পর-মুহূর্তে সে শিকারী পশুর মত মেল-ব্যাগের উপর লাফাইয়া পড়িল। দীনু পড়িয়া গেল, মাথার মাথালিটা গড়াইয়া চলিয়া গেল, কিন্তু তবুও দীনু সবলে মেল-ব্যাগ নিজের বুকের মধ্যে আঁকড়াইয়া ধরিয়া বলিল, সব্বনাশ হবে নেতাই— কালাপানি— ফাঁসি হয়ে যাবে—।

নিতাই ক্ষুধার্ত পশুর মত ব্যাগটা ধরিয়া টানিতেছিল, টানিতে টানিতেই হিংস্রভাবে সে বলিল, তখন বললে না কেনে— বলে রেখে দিলাম এমন ক’রে? দাও বলছি, রাতারাতি দেশ ছেড়ে পালাব, চল।

দীনু এবার উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিল, ডাকাত— ডাকাত।

নিতাই বিপুল হিংস্রতায় ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল।

সহসা একটা আলোকরশ্মির আভাসে গাঢ় অন্ধকার ঈষৎ চকিত হইয়া উঠিল। চমকিয়া উঠিয়া নিতাই সেই দিকে ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল, একটা ক্ষুদ্র কিন্তু উজ্জ্বল আলো দ্রুত অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। ক্রমশ আলোর প্রভায় স্থানটা প্রদীপ্ততর হইয়া উঠিতেছে। সে এবার শেষ চেষ্টা করিল, হাতের লাঠিটা কুড়াইয়া লইয়া সজোরে দীনুর মাথায় বসাইয়া দিল। মুহূর্তে ফিনকি দিয়া কালো একটা তরল ধারা ছুটিয়া বাহির হইয়া দীনর মুখখানাকে বীভৎস করিয়া তুলিল। দীনু কাতর স্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল, বাবা গো!

আলোটা অতি নিকটে আসিয়া পড়িয়াছিল, নিতাই ব্যস্তভাবে আর একবার ব্যাগটা ধরিয়া আকর্ষণ করিল, কিন্তু দীনুর জ্ঞান তখনও লুপ্ত হয় নাই, অগত্যা নিতাই ব্যাগটা ছাড়িয়া দিয়া ছুটিয়া অন্ধকারের মধ্যে মিশিয়া গেল।

আলোটা একটা বাইসিক্লের আলো। আরোহী পথিক রক্তাক্ত দীনুকে দেখিয়া ভয়ে চিৎকার আরম্ভ করিল। অন্ধকার দুর্যোগের মধ্যেও মানুষের প্রয়োজনের শেষ নাই, পথে পথিকের পথ-চলার বিরাম নাই, কিছুক্ষণ পরেই দূরে মানুষের সাড়া আসিল। কে যেন সাড়া দিল।

দীনুর জ্ঞান হইলে সে দেখিল, প্রকাণ্ড একটা পাকা ঘরে একখানা লোহার খাটের উপর সে শুইয়া আছে, মাথায় ভয়ানক যন্ত্রণা, কপালে হাত দিয়া অনুভব করিল, কাপড় দিয়া মাথাটা তাহার বাঁধিয়া দিয়াছে। তাহার খাটের পাশেও সারি সারি লোহার খাটে আরও কত লোক শুইয়া আছে। দীনু বুঝিল, এটা হাসপাতাল। সে পূর্বে কয়বার শহরে আসিয়া হাসপাতাল দেখিয়া গিয়াছে।

ধীরে ধীরে দীনুর সব মনে পড়িতে লাগিল।

কিছুক্ষণ পরই পোস্ট-আপিসের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট সাহেব আসিয়া প্রসন্ন হাসি হাসিয়া বলিলেন, এই যে, জ্ঞান হয়েছে তোমার।

দীনু সাহেবকে চিনিত, কিন্তু এখন সে তাঁহার মুখপানে ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল শুধু। সাহেব বলিলেন, খুব বাহাদুর তুমি। সরকার তোমার ওপর খুশী হয়েছেন। তুমি যে নিজের মাথা দিয়েও সরকারের ডাক বাঁচিয়েছে, এর জন্যে তুমি রিওয়ার্ড— মানে পুরস্কার পাবে।

দীনু তবুও নির্বাক।

সাহেব তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া বলিলেন, কতজন ছিল তারা? কাউকে তুমি চিনতে পেরেছ?

দীনু এবার ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

সাহেব নিজে পাখাটা লইয়া বাতাস দিয়া বলিলেন, ভয় কি, কাঁদছ কেন? কোনও ভয় নেই, শিগগির ভাল হয়ে যাবে তুমি। ডাক্তার বলেছেন, কোনও ভয় নেই তোমার।

তিনি নিজে রুমাল দিয়া তাহার চোখ মুছাইয়া দিলেন। তারপর বলিলেন, আচ্ছা, সুস্থ হয়ে ওঠ তুমি, আমি আবার আসব, রোজ এসে তোমায় দেখে যাব। ও-বেলায় ফল পাঠিয়ে দেব আমি।

দীনু অকস্মাৎ যেন বলিয়া উঠিল, হুজুর!

কিছু বলবে আমায়? কি বলবে বল?

দীনু অতি কষ্টে বলিল, হুজুর, আমার ছেলে—।

তোমার ছেলে— তোমার ছেলেকে তুমি দেখতে চাও?

দীনু নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল, কহিল, হ্যাঁ হুজুর।

আচ্ছা।

সাহেব চলিয়া গেলেন।

তাহার পর আসিল পুলিস। পুলিসের বড় সাহেব নিজে আসিয়া তাহাকে প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি কিন্তু ডাকসাহেবের মত এত সহজে দীনুকে নিষ্কৃতি দিলেন না। তিনি বার বার তাহাকে প্রশ্ন করিলেন, কাউকে তুমি চিনতে পার নি?

দীনু উত্তর দিল, অন্ধকার হুজুর।

কতজন ছিল তারা?

ভাবিয়া চিন্তিয়া দীনু আবার বলিল, অন্ধকার হুজুর।

আচ্ছা, কি রকম দেখতে বল তো? খুব জোয়ান?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

ভদ্রলোক, কি ছোটলোক?

দীনু, চুপ করিয়া রহিল। সে ভাবিতেছিল, কি বলিবে, কাহার নাম সে করিবে! মিথ্যা করিয়া অন্য কাহারও নাম—।

দীনু শিহরিয়া উঠিল।

সাহেব তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে দীনুকে লক্ষ্য করিতেছিলেন; তিনি বলিলেন, দেখ, তুমি তাদের জান, চিনতে পেরেছ; বল তুমি, সে কে?

দীনু বিবর্ণ মুখে সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সাহেব এবার রক্তচক্ষু হইয়া কঠোর স্বরে বলিলেন, বল।

দীনু বিহ্বলের মত চাহিয়া থাকিতে থাকিতে বলিল, হুজুর, আমার ছেলে নেতাই।

সাহেব বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গেলেন না, তবুও সামান্য বিস্মিত না হইয়া পারিলেন না, বলিলেন, সে তোমার ছেলে?

উপরের দিকে মুখ তুলিয়া রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, হ্যাঁ হুজুর।

আর? আর কে?

আর কেউ না।

পুলিস কিন্তু নিতাইকে পাইল না। সেই রাত্রি হইতেই নিতাই নিরুদ্দেশ। তাহার উদ্দেশ করিতে পুলিস উঠিয়া-পড়িয়া লাগিল।

তারপর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হইয়া গেল— এগারো বৎসর। দীনু আজও ডাক-হরকরার কাজ করিতেছে। অন্ধকারে জ্যোৎস্নায়, বাদলে বর্ষায়, দুরন্ত শীতের রাত্রে এখনও সে তেমনই কোমরে পেটি বাঁধিয়া বল্লম আলো হাতে ডাক লইয়া যায় আসে। এখনও তেমনই তাহার ঘড়ির কাঁটার মত গতি।

নিতাই কিন্তু সেই যে নিরুদ্দেশ হইয়াছে, আজও তাহার কোনও সন্ধান মিলে নাই। সরকারের মুলুকে সর্বত্র থানায় থানায় নাকি তাহার আকৃতির বিবরণ দিয়া হুলিয়া বাহির করা হইয়াছে। কিন্তু কোথায় নিতাই!

দীনুর স্ত্রী সময় সময় ঘরের মধ্যে অতি মৃদুস্বরে বিনাইয়া বিনাইয়া কাঁদে; দীনু বাড়িতে থাকিলে নির্বাক হইয়া বাহিরে দাওয়ার উপর দুই হাতে মাথা ধরিয়া মাটির দিকে চাহিয়া থাকে। সান্ত্বনাও দিতে পারে না, বিরক্তিও প্রকাশ করে না।

পাড়াপড়শীরা দীনুর নাম দিয়াছে— যুধিষ্ঠির। তাহাদের অশিক্ষিত জড়তাযুক্ত জিহ্বায় তাহারা বলে— যুজিষ্টির।

লজ্জায় দীনুর মাথাটা নুইয়া আসে। মাথা হেঁট করিয়া পাড়ার পথে সে যাওয়া-আসা করে। পোস্ট-আপিসেও তাহার সম্মান খুব বাড়িয়া গিয়াছে। যে কেহ নূতন ডাকবাবু কি ডাকসাহেব আসেন, তিনিই জিজ্ঞাসা করেন, দীনু কে?

দীনু মাথা হেঁট করিয়া আসিয়া সেলাম করিয়া দাঁড়ায়। সেদিন সে অন্তরে অন্তরে অত্যন্ত রুক্ষ হইয়া উঠে, অকারণে পিয়নদের সঙ্গে ঝগড়া বাধাইয়া বসে। সেদিন তাহাদের বাসন মাজিয়া দেয় না, ডাকবাবুর গরুর ঘাস আসে অত্যন্ত কম।

পিয়ন বলে, এত গরম ভাল নয় রে, বুঝলি?

সেদিন কার্তিক মাসের একটি স্বল্প শীতকাতর রাত্রি। কার্তিক মাসেই শীত এবার ঘন হইয়া আসিয়াছে। দীনু ডাক লইয়া নির্দিষ্ট সময়েই আমদপুর পোস্ট-আপিসে হাজির হইল। এই আমদপুরেই রেলওয়ে স্টেশন, এখানকার পোস্ট-আপিস হইতে আবার ডাক লইয়া দীনু হরিপুর ফিরিবে। ডাক ফেলিয়া দিয়া সে তাহার নির্দিষ্ট চটখানা বিছাইয়া বারান্দায় শুইয়া পড়িল। আপ-ডাউন মেল-ট্রেন চলিয়া গেলে ডাক লইয়া তাহাকে আবার রওনা হইতে হইবে। পাশে আরও কয়েকজন মেল-রানার শুইয়া আছে। তাহারা গল্প করিতেছিল ওভারসিয়ারকে লইয়া। জরিমানার প্রত্যক্ষ কারণ এই লোকটি কখনই ভাল লোক নয়, এই তাহাদের প্রতিপাদ্য ছিল। ও-পাশে দুইজন বোধ হয় ঘরের সুখ-দুঃখের কথা কহিতেছিল।

ওদিকে স্টেশনে আপ-মেলের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল।

দীনু বিরক্তভাবে বলিল, একটুকুন ঘুমো বাপু সব। পশ্চিমের ডাকগাড়ির ঘণ্টা হয়ে গেল। কলকাতার গাড়ি এলেই তো আবার সেই তল্পি কাঁধে তোল্।

একজন ব্যঙ্গ করিয়া মৃদুস্বরে বলিল, চুপ চুপ, ধম্মপুত্তুর যুজিষ্টির রেগেছে।

চাপা হাসির গুঞ্জনের শব্দে দীনু স্তব্ধ হইয়া গেল। সে কাঠ হইয়া পড়িয়া রহিল। মনে পড়িয়া গেল নিতাইকে। নিতাই মরিয়া গেলে দীনু এতদিনে হয়তো তাহাকে ভুলিত। জীবন্ত মানুষ হারাইয়া যাওয়ার চেয়ে সে শতগুণে ভাল; এ যে প্রতি প্রভাতে মনে হয়, আজ সে আসিবে; দিন ফুরাইবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, কাল সে আসিবে।

সকলের চেয়ে বড় আক্ষেপ দীনুর— নিতাইয়ের সন্ধান সে করিতে পাইল না। সেদিন একজন যাত্রী এই স্টেশনেই একটা আনি হারাইয়া সমস্ত রাত্রি পথের ধূলা ঘাঁটিয়া খুঁজিয়াছে। আর একটা মানুষ—।

ভাবিতে ভাবিতে কখন সে ঘুমাইয়া পড়িল। সে ঘুম ভাঙিল তাহার পিয়নদের ডাকে। ডাউন মেল-ট্রেন চলিয়া গিয়াছে। ঘরের মধ্যে বিভিন্ন পোস্ট-আপিসের জন্য ডাক বাঁধা হইতেছিল। হরকরারা আপন আপন পেটি বল্লম লণ্ঠন লইয়া প্রস্তুত হইয়া বসিল। প্রস্তুত হইয়া দীনু তামাক সাজিতে বসিল। ওদিকে ছোকরারা একটা আগুন জ্বালাইয়া হাত-পা গরম করিতে বসিয়াছে।

ঘরের ভিতর হইতে পোস্টমাস্টার বলিলেন, ও দীনু, আফ্রিকাতে তোর কে আছে রে, অ্যাঁ— ইনসিওর ক’রে টাকা পাঠাচ্ছে?

দীনু আশ্চর্য হইয়া গেল, বলিল, সি আজ্ঞে, কোথা বটেন?

ওঃ, সে জাহাজে ক’রে যেতে হয় রে, সমুদ্দর পেরিয়ে! কাফ্রীর মুলুক সে, মানুষে সেখানে মানুষ খায়, প্রকাণ্ড বড় বড় বন, সিংহী গণ্ডার বাঘ ভাল¬ুক ভর্তি সেসব।

দীনু আরও বিস্মিত হইয়া বলিল, আজ্ঞে, সে দেশের নামই আমি শুনি নাই কখুনও!

দাঁড়া দাঁড়া, কে পাঠাচ্ছে দেখি। এ যে দেখছি সাউথ আফ্রিকান স্টীম নেভিগেশন কোম্পানি— জাহাজ-কোম্পানি! ওঃ, এ যে দেখছি টাকা রে— সাড়ে পাঁচ শো টাকা!

দীনু অবাক হইয়া ভাবিতেছিল। সহসা সে বলিল, আজ্ঞে দেখি বাবু একবার।

পোস্টমাস্টার বলিলেন, দেখে আর কি করবি বাবা, একেবারে হরিপুর পোস্ট-আপিসেই গিয়ে নিবি।

ডাক বাঁধিয়া দীনুর কাঁধে তুলিয়া দিয়া দীনুকে তিনি বিদায় করিয়া দিলেন। আকাশে শেষরাত্রির জ্যোৎস্না তখন ঘোলাটে হইয়া আসিয়াছে। চাঁদ পাণ্ডুর, সাত ভাই, তারাগুলিও ডুবিল বলিয়া। শেষরাত্রির বাতাসে যেন হিম ঝরিতেছে। দীনু জনহীন পথে চলিয়াছে, ঝুনঝুন— ঝুনঝুন। চলিতে চলিতে সে ভাবিতেছিল— কোন্ দেশ-দেশান্তর হইতে জাহাজ-কোম্পানি তাহাকে টাকা পাঠাইল, কিসের জন্য!

অল্প টাকা নয়, সাড়ে পাঁচ শো টাকা— উঃ, সে কত টাকা! ব্যাগটা যেন দীনুর ভারী মনে হইতেছিল। সহসা দীনুর খেয়াল হইল— এ কি, সে নিস্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে যে! সে আবার ছুটিতে আরম্ভ করিল। চলিতে চলিতে সে পথের কোন্খানে কতদূর আসিল বুঝিতে পারিল না, কিন্তু মন তাহার দেশ-দেশান্তরের এক অজ্ঞাত রাজ্যে চলিয়া গেল। কে সে কোম্পানি? কিসের জন্য তাহাকে এত টাকা পাঠিয়েছে সে? সে যেন দেখিতেছিল— বিশাল অন্ধকার অরণ্য, বাঘ সিংহ ভালুক সেখানে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। কিন্তু তাহার মধ্যে কোম্পানি কই? দীনু তাহার পিছনটা দেখিতেছে, সে যেন পিছন ফিরিয়া বসিয়া আছে।

সহসা তাহার মনে হইল, ওই কোম্পানি তাহার নিতাই নয়তো? নিতাই হয়তো দেশান্তরে পলাইয়া গিয়া অগাধ ঐশ্বর্য লাভ করিয়াছে। পাকা বাড়ি গাড়ি ঘোড়া চাকর—। কল্পনার গভীর অরণ্যে মুহূর্তে গড়িয়া উঠে বাবুদের চুনকাম-করা পাকা বাড়ির মত বাড়ি।

দীনুর সর্বশরীর থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল, হিম-শীতল রাত্রির শীতজর্জর সেই শেষ প্রহরেও সে ঘর্মাক্ত হইয়া উঠিল। কাঁধের কাগজের বস্তা যেন সোনায় বোঝাই বস্তার মত গুরুভার হইয়া উঠিয়াছে। একটি পরম উত্তেজিত মুহূর্তে কাঁধ হইতে ব্যাগটা ধপ করিয়া মাটির উপর ফেলিয়া সে এক অদ্ভুত ভঙ্গীতে তাহার পাশে দাঁড়াইল। চোখ দুইটা যেন জ্বলিতেছে। বুকের মধ্যে উৎকণ্ঠার পরিমাণ হয় না, হৃৎপিণ্ডটা শরবিদ্ধ পশুর মত যেন ছটফট করিতেছে। দীনুর ইচ্ছা হইল, এই মুহূর্তে— এইখানেই ব্যাগটা টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া চিঠিখানা বাহির করিয়া লয়।

পর-মুহূর্তে সে আবার ব্যাগটা ঘাড়ে তুলিয়া ছুটিতে আরম্ভ করিল, প্রাণপণে ছুটিল।

এ কি, পাখীরা কলকল করিয়া ডাকিয়া উঠিল যে! ভোর কি হইয়া গেল নাকি? কই, আকাশে ‘ভুল্কো’ তারা কই? কিন্তু দীনুর যে এখনও অনেক পথ বাকি। এই তো ষোল মাইলের পাথর সে পার হইল! এখনও যে তিন মাইল তাহাকে যাইতে হইবে!

দীনু যখন হরিপুর পোস্ট-আপিসে পৌঁছিল, তখন বেলা সাড়ে সাতটা, প্রায় আড়াই ঘণ্টা দেরি হইয়া গিয়াছে। পোস্টমাস্টার, পিয়ন, সংবাদ-প্রার্থীর দল উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষায় দাওয়ার উপর দাঁড়াইয়া ছিলেন। দীনু ক্লান্তভাবে ব্যাগটা ফেলিয়া দিয়া অবসন্ন হইয়া বসিয়া পড়িল।

তাহার মুখের দিকে চাহিয়া পোস্টমাস্টার বলিলেন, এত দেরি কেন হ’ল রে? এ কি, তোর কি অসুখ করেছে দীনু?

দীনু হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, ডাকটা কেটে ফেলেন বাবু।

আচ্ছা আচ্ছা, ব’স্, শিগগির তোর ছুটি ক’রে দিচ্ছি।

ডাক কাটিয়া পোস্টমাস্টার বলিলেন, এ কি রে, তোর নামে যে একটা ইনসিওর দীনু! টাকাও তো কম নয়, সাড়ে-পাঁচ শো! ওঃ, এ যে আফ্রিকা থেকে আসছে দেখছি!

দীনু কথা কহিতে পারিল না, শুধু হাত পাতিয়া দাঁড়াইল, হাতটা তাহার থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল।

পোস্টমাস্টার হাসিয়া বলিলেন, দাঁড়া একটু, জমা ক’রে নিই।

পিয়ন বলিল, আমাদের কিন্তু পাঁচ টাকা দিতে হবে, মিষ্টি খাব।

দীনু নির্বাক। জমা করিয়া লইয়া পোস্টমাস্টার বলিলেন, এইখানে একটা টিপ-ছাপ দে তো দীনু। হ্যাঁ— নে, এই নে।

খামখানা হাতে লইয়া দীনু ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিল, জাহাজের ছবি আঁকা সুন্দর খাম, ছাপার হরফে নাম লেখা।

মাস্টার বলিলেন, দে, দেখি খুলে।

সন্তর্পণে ছুরি দিয়া খামখানা কাটিয়া সর্বাগ্রে তিনি নোট কয়খানা দেখিয়া বলিলেন, নে, ঠিক আছে সব। এ নোট আবার তোকে ভাঙাতে হবে। এই যে, চিঠিও রয়েছে।

চিঠিখানা তিনি মনে মনে পড়িতে আরম্ভ করিলেন।

ওদিকে পিয়ন ডাক বিলি করিতেছিল—।

পরম কল্যাণীয়া জগত্তারিণী দাসী, কুড়িগ্রাম।

রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়— এই যে বাঁড়–জ্জে মশায়, চিঠি।

এটা আবার হিন্দী। কি? ডাংখানা হরিপুর। সু— সুখন চৌবে।

দীনু বলিল, বাবু!

বাবু ভাবিতেছিলেন, কি বলিবেন! নিতাইয়ের সংবাদ, নিতাই সেখানে জাহাজের খালাসীর কাজ করিত, সে মারা গিয়াছে। কোম্পানি তাহার অন্তিম-নির্দেশমত তাহার সঞ্চিত অর্থ দীনুকে পাঠাইয়াছে।

দীনু আবার প্রশ্ন করিল, বাবু?

কি লিখেছে ভাল বুঝতে পারছি না রে! আচ্ছা নিতাই কে? নিতাই তো তোর সেই ছেলে?

হ্যাঁ হ্যাঁ, কেমন আছে সে? কোথা আছে?

পোস্টমাস্টার নীরবে মাথা নত করিয়া রহিলেন।

অনেকক্ষণ তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া দীনু বলিল, নেতাই নেই?

পোস্টমাস্টার নীরব হইয়াই রহিলেন। দীনুও মাটির দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। চোখ দিয়া তাহার মধ্যে মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা জল মাটির বুকে ঝরিয়া পড়িয়া ধীরে ধীরে শুকাইয়া যাইতেছিল। কত কথা এলোমেলোভাবে তাহার শোকাতুর মনে জাগিয়া উঠিতেছিল— সবই নিতাইয়ের কথা।

পোস্টমাস্টার অপরাধীর মত বলিলেন, আনন্দ ক’রে চিঠিটা খুললাম দীনু, কিন্তু শেষে আমিই তোকে এই খবরটা দিলাম!

দীনু চমকাইয়া উঠিল, তাহার মনে পড়িল, সে নিজেই তো চিঠিখানা আনিয়াছে।

থাকিতে থাকিতে অকস্মাৎ তাহার মনে হইল, উঃ, এমন সংবাদ এই দীর্ঘকাল ধরিয়া নিত্য নিত্য কত সে বহিয়া আনিয়াছে। কত— কত— কত— সংখ্যা হয় না। মনে হইল, আজ পর্যন্ত যত রোদনধ্বনি সে শুনিয়াছে, সে সমস্ত দুঃসংবাদ সে-ই বহন করিয়া আনিয়াছে।

চোখের জল মুছিয়া সে ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমি আর কাজ করব না বাবু, কাজে জবাব দিলাম।


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন