বুধবার | ১৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১:৪৯
Logo
এই মুহূর্তে ::
বিমানযাত্রীদের নিরাপত্তার প্রশ্ন থেকেই গেল : তপন মল্লিক চৌধুরী স্মরণে মননে জন্মদিনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : রিঙ্কি সামন্ত হুগলি জেলায় কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় খালিয়াজুরি মৌজার প্রাচীন ইমারত : ফারুকুর রহমান চৌধুরী দুর্দৈবপীড়িত রবীন্দ্রনাথ : দিলীপ মজুমদার শান্তি সভ্যতার গুণ, যুদ্ধ তার অপরাধ … ভিক্টর হুগো : অশোক মজুমদার হরপ্পার ব্যুৎপত্তি নিয়ে নতুন আলোকপাত : অসিত দাস বল পয়েন্ট কলমের জার্নির জার্নাল : রিঙ্কি সামন্ত মহেঞ্জোদারো নামের নতুন ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস পরিসংখ্যানে দারিদ্রতা কমলেও পুষ্টি বা খাদ্য সংকট কি কমেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী অথ স্নান কথা : নন্দিনী অধিকারী তন্ত্র বিদ্যার বিশ্ববিদ্যালয় চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধুসভ্যতার ভাষায় ও স্থাননামে দ্রাবিড়চিহ্ন : অসিত দাস ধরনীর ধুলি হোক চন্দন : শৌনক দত্ত সিন্ধুসভ্যতার ভাষা মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবির নামে : অসিত দাস বিস্মৃতপ্রায় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় ভাষায় সিন্ধুসভ্যতার মেলুহার ভাষার প্রভাব : অসিত দাস বঙ্গতনয়াদের সাইক্লিস্ট হওয়ার ইতিহাস : রিঙ্কি সামন্ত নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘ঝড়ের পরে’ ভালো থাকার পাসওয়ার্ড (শেষ পর্ব) : বিদিশা বসু গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই প্রভু জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

ভারতের জাতীয় জাগরণ ও স্বামী বিবেকানন্দ : প্রণবেশ চক্রবর্তী

প্রণবেশ চক্রবর্তী / ১১৯৫ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২২

‘জাতীয় জাগরণ’ শব্দটা বহু ব্যবহৃত। সকলেই ব্যবহার করেন। অনেকে আবার তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে ‘Renaissance’ শব্দা ব্যবহার করে থাকেন। এখন এই শব্দের অর্থ কি? আমাদের দেশে সত্যই নবজাগরণ হয়েছিল কিনা— হলেও, তার চরিত্র কি? কতখানি সংকীর্ণ, কতখানি সাহেবী মতে আমরা পিছিয়ে আছি, এই সমস্ত নিয়ে আমাদের পণ্ডিতেরা ভয়ানক রকম ব্যস্ত, এবং তাঁরা অনেক সময় নিতান্ত বলার সঙ্গে বলে থাকেন যে, সত্য সত্যই আমাদের যে জাগরণ সেটা নিতান্ত সংকীর্ণ। এর সঙ্গে বৃহত্তর জনজীবনের কোন সম্পর্ক নেই, এর সঙ্গে ব্যাপক কর্মচেষ্টা যুক্ত ছিল না বলে তাঁরা যে মাপকাঠিটা পেয়েছেন বিদেশ থেকে, সেই মাপকাঠিটা উঁচিয়ে ধরেন আমাদের সামনে। উঁচিয়ে ধরেন মাপবার জন্যে এবং আমাদের মারবার জন্যেও বটে— এটা আমরা অনেক সময় দেখতে পাই।

এখানে দুটি শব্দকে আমরা নিতে চাইছি। একটাকে আমরা বলতে পারি ‘জাতীয় উত্থান;’ ‘regeneration’—A+ শব্দটি অনেক সময় নেওয়া হয়। আর একটাকে আমরা বলতে পারি ‘renascence’ বা ‘নবজাগরণ’— বাংলা করা মুস্কিল। ঠিক উত্থান বললেও ‘regeneration’ হয় আবার ‘renascence’ বললে নবজাগরণ হয় কিনা বলা মুস্কিল ব্যাপার। তবু দুটো শব্দই আমরা নিতে চাইছি। এই ‘regeneration’ এবং ‘renascence’ এই দুটো ব্যাপার স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবর্ষের ইতিহাসে সম্ভবপর করিয়েছিলেন।

আজকে আমি যে প্রশ্নের সম্মুখীন নিজের কাছে, সেটা হচ্ছে জাতীয় জাগরণের কথাটা উঠছে কেন? আমরা স্বামীজির আদর্শকে কি করে কাজে লাগাব, তারমধ্যে থেকে কোন প্রশ্নের মীমাংসা পাওয়া যাবে সেই নিয়ে আমাদের ব্যস্ত হওয়ার দরকার ছিল। জাতীয় জাগরণে তাঁর ভূমিকার কথাটা ওঠে কেন? তার কারণ হচ্ছে এর দ্বারা আমরা স্বামীজির ঐতিহাসিক ভূমিকার চেহারাটা বুঝে নিতে পারব। আমরা দেখে নিতে পারব যে স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন ইতিহাসের স্রষ্টা। নতুন ইতিহাস তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। যে মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, সেই মানুষের জীবনের যে কাহিনী রয়েছে, তার যে চেষ্টার কাহিনী রয়েছে, সেই কাহিনী ভবিষ্যতের ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে। সেই আকাঙ্ক্ষায় আমরা এখানে নবজাগরণের ক্ষেত্রে বা উত্থানের ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকার আলোচনা করছি। আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি, ড. নিমাই সাধন বসু তাঁর এক ভাষণে এমন ইঙ্গিত করেছেন যে, কিছু সংখ্যক ঐতিহাসিক আজকে ভারতবর্ষে স্বামীজির ঐতিহাসিক ভূমিকাকে নিতান্ত লাঞ্ছিত করবার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছেন। কিছু সংখ্যক ঐতিহাসিকের সঙ্গে, কিছু সংখ্যক যুক্তিবাদী বা rationalist যোগ দিয়েছেন; তাঁরা চেষ্টা করছেন স্বামীজির মূর্তিকে মলিন করবার জন্য। এ চেষ্টা আমরা দিনের পর দিন লক্ষ্য করছি। এ চেষ্টা কমবে না, বাড়বে।

যুবসমাজের সামনে আমাদের বলবার আছে যে, আপনারা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠানগুলির উপর আক্রমণের কথা শুনেছেন—এইবার আপনারা সচেতন হোন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবমূর্তির উপর আক্রমণের বিষয়ে। সেটাও কম মারাত্মক নয়। একটা প্রতিষ্ঠান, তার দুটো বাড়ি বোমায় ভাঙতে পারে। একটা প্রতিষ্ঠান কিছুদিন পরে বন্ধ হতে পারে। কিছুদিন আগে পুরুলিযা রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, পুরুলিয়ায় আবার খোলা হয়েছে। পুরুলিযা খোলবার পর পুরুলিয়ার ছাত্রদের শৃঙ্খলা কমেনি, পুরুলিয়ার result খারাপ হয়নি। আরও ভাল হয়েছে হয়তো। কিন্তু পুরুলিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিসের জন্য ঐ মধ্যবর্তীকালীন অবস্থা থেকে পরবর্তীকালীন অবস্থার পার্থক্য হল না? তার মূল কারণ হচ্ছে এই যে, ভাব এবং আদর্শ, যাঁরা পুরুলিয়া পরিচালনা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আছে, সেখানে আঘাত লাগেনি, সেটা অব্যাহত রয়েছে। সেইজন্যই পুনরায় এই প্রত্যাবর্তন সম্ভবপর হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ এঁদের যে মূর্তি আজকে জনসমাজের মধ্যে রয়েছে, যে মূর্তি মানুষের ভক্তিতে বিশ্বাসে, মানুষের আনুগত্যে নন্দিত মূর্তি, সেই মূর্তিকে চূর্ণ করবার জন্য কিছু সংখ্যক মানুষ আজ তাই সচেষ্ট হয়েছেন। যুবসমাজের কাছে আমাদের আবেদন, আপনারা এ বিষয়ে সতর্ক হবেন। চিন্তা করে দেখবেন যে, এই প্রচেষ্টার পিছনে কি পরিমাণে কুবুদ্ধি সক্রিয় রয়েছে। এ বিষয়ে আপনাদের চেতনার খুব প্রয়োজন রয়েছে।

ইতিহাসের পৃষ্ঠা যদি আমরা উল্ট দেখি, আমরা কি দেখি? আমি যখন জাতীয় জাগরণের কথা ভাবছি স্বামীজির প্রসঙ্গে, তখন আমাদের ভাবতেই হবে কি জাগরণ তিনি আনলেন! তাহলে নিশ্চয়ই তার আগে একটা অবস্থা ছিল, সেই অবস্থার বদল তিনি ঘটিয়েছেন। তবেই তো আমি বলব যে তিনি কি পরিবর্তন আনলেন। নিদ্রিত অবস্থায় ছিল, তিনি জাগরিত করলেন। আমরা দেখেছি স্বামী বিবেকানন্দের পূর্বে ভারতবর্ষে অনেক বৃহৎ মানুষ, সত্যিকারের বৃহৎ মানুষ জন্মেছিলেন। জন্মেছিলেন রাজা রামমোহন রায়—স্বামীজি যাঁর একান্ত অনুরাগী ছিলেন। স্বামীজি যাঁকে বলতেন man of gigantic intellect স্বামীজি তাঁর সম্বন্ধে অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান ছিলেন এতে কোনও সন্দেহ নেই। এসেছিলেন কেশবচন্দ্র সেন, সেই ধর্মোন্মাদ কেশবচন্দ্র যাঁকে—when Keshab speaks the whole world listens ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কার্যত ব্রাহ্ম সমাজের সংগঠক; শান্ত রসাস্পদ ধর্ম-জীবনের অনুসারী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিদ্যাসাগর ছিলেন— যে বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে স্বামীজি বলেছিলেন after Ramakrishna I follow Vidyasagar বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন, যিনি সাহিত্যক্ষেত্রে জাতীয়তা প্রবর্তন করেছিলেন বলে আমরা মনে করছি। ছিলেন মহারাষ্ট্রের মহাদেব গোবিন্দ রানাডে। সমাজ সংস্কারকরা ছিলেন। সেই প্রকান্ড বীর্যশালী ধর্মনেতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ছিলেন। পরে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে গিয়েছিলেন ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে, এটাও আমাদের সামনে রয়েছে। এঁদের ভূমিকা সম্বন্ধে আমাদের শ্রদ্ধায় আপনারা এতটুকু সন্দেহ করবেন না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে যাঁদের নাম করলাম, তাঁদের সম্বন্ধে আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে। তাঁদের ভূমিকাকে আমি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু এসব সত্বেও যখন ১৮৯২ সালের জুন মাস চিকাগো ধর্মসভার পরিকল্পনা ঘোষিত হল তখন দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত ‘হিন্দু’ পত্রিকায় একজন হিন্দু মানুষ লিখলেন, ‘‘The revival of Hinduism is an utter impossibility. The life of it is gone, the last word has long been said.’’ ভারতবর্ষের হিন্দু-ধর্মের শেষ কথা বলা হয়ে গেছে, তার ভাগ্যের উপর শীল মোহর পড়ে গেছে, আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এই যাঁদের আমি নাম করলাম, এঁরা অনেক কিছু দিয়েছেন, এঁরা চেতনার জাগরণ নিশ্চয়ই ঘটিয়েছেন। জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু গোটা ভারতবর্ষে এঁরা অংশে অংশে আলো জ্বালিয়ে ছিলেন। সমগ্র ভারতবর্ষের চিত্তকে তাঁরা মথিত করতে পারেননি।

সেই ভাবাই মথিত করতে পেরেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামী বিবেকানন্দ কি করেছিলেন, সেই একই কাগজে এক বছর কয়েক মাস বেশী পরে, ২৩ ডিসেম্বর ১৮৯৩ সালে লেখা হল যে, বিশ্ব জগতের সামনে বিবেকানন্দ নিজ ব্যক্তিত্বের দ্বারা শাক্যমুনি এবং শঙ্করাচার্যের আদর্শ ও শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমাদের দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে সবচেয়ে লাঞ্ছিত করতে যাঁরা বেশী সচেষ্ট ছিলেন, সেই খ্রিস্টান মিশনারিরা তাঁদের পত্রিকা— Madras Christian College Magazine তাতে ১৮৯৭ সালে লিখলেন, ‘‘A wave of restlessness is passing over it, that is in Indian. And the present time—it may not be inaptly described as the renaissance period, in the history of the Hindu.’’ ‘Hindu’ কথাটায় আপনারা বেশী আতঙ্কিত হবেন না। এখন ‘হিন্দু’ ভয়ানক খারাপ শব্দ, নোংরা শব্দ। আমরা তো অ-মুসলমান! আপনারা যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনের আগের ইতিহাসটা জানেন, তাঁরা জানেন তখন ‘হিন্দু’ বলে কোনও পদার্থ নেই, অ-মুসলমান। সুতরাং আমি যে পর্বের কথা বলছি তখন ‘হিন্দু’ বলতে ভারতবাসী বোঝান হত। তখন ‘হিন্দু’ এবং ভারতবাসী প্রায় সমার্থক ছিল। যাঁরা প্রাচীন আছেন, তাঁরাই এই কথার পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন। ‘Madras Times’ সাহেবদের কাগজে লেখা হল, ‘‘The movement is indeed a national fact.’’ স্বামীজি ফিরেছেন ফেব্রুয়ারি মাসে, প্রচণ্ড আন্দোলন আরম্ভ হয়ে গিয়েছে সেই সময়। ২ মার্চ ১৮৯৭ সালে এই কথা লেখা হচ্ছে, ‘‘The movement is indeed a national fact.’’

স্বামীজি বক্তৃতা শুরু করলেন ভারতবর্ষে ফেরবার পর। বক্তৃতা, না কি অগ্নিস্রোত? সমস্ত ভারতবর্ষের উপর দিয়ে সেই বাণীর স্রোত বইতে লাগল। মানুষ অনুভব করতে লাগল, আমরা মানুষ। প্রথম সর্ত ছিল যে, আমরা মানুষ— এইটা অনুভব করতে হবে। আমাদের সংস্কৃতবান হতে হবে; প্রয়জনে আমাদের উপর অস্ত্রোপচার করা হবে, আমাদের এই খারাপ অংশটা ভাল করতে হবে; আমার এই গালাটা কালো আছে ফরসা করতে হবে; আমার চেহারাটা ভাল নয়, একটু ভাল করে সাজিয়ে দিতে হবে; আমরা সংস্কৃত হব—এই একমাত্র চেষ্টা ছিল আমাদের যাঁরা মহাপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন তাঁদের। তাঁরা অনেকে ভাল চেয়েছিলেন। কিন্তু কেউ আমাদের বলেননি—তুমি মানুষ। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখানেও তুমি মানুষ। বিবেকানন্দ এই কথা বলেছেন—তোমার সমস্ত পতন নিয়েও, তোমার সমস্ত দুর্বলতা নিয়েও, তোমার মধ্যে যে অনন্ত সম্ভাবনা আছে তার দ্বারা তুমি মানুষ। এখনও তুমি মানুষ, এই মুহূর্তেও তুমি মানুষ। এই মুহূর্তে তোমার বস্তিতে যে মানুষগুলো বাস করে তাদের দেখো; আর পাশ্চাত্যের বস্তি দেখে এসো। সেই নরকের মাঝখানে যে মানুষগুলো রয়েছে— অনেক টাকা হয়তো তাদের আছে, ভোগ সুখের ব্যবস্থা আছে— মানুষ নেই সেখানে, পশুর মতো রয়েছে। আর তোমার বস্তিতে নিরন্ন মানুষগুলো, কম আবৃত মানুষগুলো—তারা মানুষ। বিবেকানন্দ এক জিনিস শিখিয়ে ছিলেন আমাদের, সেই পতিত ভারতবর্ষের মানুষকে বলেছিলেন যে, তোমরা মানুষ। এই একজন বলেছিলেন।

স্বামীজির একজন গুরুভাই বলেছিলেন, স্বামীজি আর কিছু করেননি, এই hypnotism-সম্মোহন ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। এই hypnotism ভেঙ্গে দেওয়াটাই জাতীয়তাবাদের সূচনা করেছিল। ভারতবর্ষ আত্মবিশ্বাস পেয়েছিল। ভারতবর্ষ স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে যেন এইকথা শুনেছিল যে, ‘আমার জীবনে, লভিয়া জীবন, জাগরে সকল দেশ।’ এতদিন আপনারা আবৃত্তি শুনেছেন, সেই আবৃত্তিতে বলা হচ্ছে যে, আমার কথা যদি না শোন তোমরা ডুববে। কিন্তু কি জান? আমিও তোমাদের সঙ্গে ডুববো। এই কথাটা বলবার লোক ছিল না। সবাই বলছিল তোমরা ডুববে। বিবেকানন্দ এসে বললেন আমি তোমার সঙ্গে ডুববো, আমি তোমার সঙ্গে উঠবো। ‘আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগরে সকল দেশ।’ সেই ইতিহাস স্মরণ করুন—ব্রহ্মবান্ধবের ইতিহাস। কিভাবে মানুষগুলো বেরিয়ে আসছেন যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলন সৃষ্টি করলেন। ঐসব ঐতিহাসিকদের কাছে আমাদের নিবেদন যে, কেন মিথ্যাবাদী হন আপনারা? আপনার কোন ‘বাদ’ আপনাকে শিখিয়েছে তথ্য গোপন করবার জন্য? আপনার বাদগুলোতে কেন তথ্যকে বিকৃতভাবে ব্যাখা করতে হয় বুঝতে পারি। আপনার বাদগুলি যদি বলে তথ্যগুলিতে বিকৃতভাবে ব্যবহার করুন, all right, ঠিক। কিন্তু কোন বাদ শিখিয়েছে আপনাকে মিথ্যাবাদী হতে? ঐ ঐতিহাসিকেরা কেন ব্রহ্মবান্ধবের কথা স্মরণ করেন না? যে ব্রহ্মবান্ধব বললেন— স্বামীজির দেহত্যাগের কথা শুনলাম। বুকের ভিতরে যেন শর বিঁধে গেল। মনে হল এই মুহূর্তে বিবেকানন্দ যা করতে বলেছেন তা করতে হবে। আমি দীনহীন সন্ন্যাসী, কিছু নেই— অকিঞ্চন। আমি চলে গেলাম সেই সামান্য কয়েক টাকা সম্বল করে বিদেশে। আমি অসামান্য কাজ করলাম। নিজের মুখে বলছি না, কিন্তু কাজটা অসামান্য হয়েছিল। যখন ভাবি কে একাজ করাল, তখন মনে হয়, বিবেকানন্দ এই কাজ করিয়েছেন। কে সেই বিবেকানন্দ যে এই কাজ করালেন আমাকে দিয়ে?

এটা কি কেবল ব্রহ্মবান্ধবের কথা? বিপ্লবীদের একজন আমাকে বলেছিলেন মনে আছে, ‘বিবেকানন্দ আমাদের কি শিখিয়েছেন? বলেছেন, তোরা মর। তোরা কিছু লোক যদি মরিস দেশটা বাঁচবে। তোরা মরতে পারিস? প্রাণ দিতে পারিস আদর্শের জন্য?’ বিবেকানন্দ এই কথা শিখিয়েছিলেন। জাতীয় জাগরণ তিনি সম্ভবপর করছিলেন, জাতীয় জাগরণ এসেছিল স্বামীজির দেহান্তের পরে। স্বদেশী-আন্দোলন আরম্ভ হল তিন বছর পরে। সেই স্বদেশী-আন্দোলন সম্বন্ধে অরবিন্দ যার প্রধান নেতা ছিলেন একজন, তিনি বলছেন— এই স্বদেশী-আন্দোলনের পিছনে স্বামী বিবেকানন্দের প্রেরণা ছিল, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রেরণা ছিল। গান্ধী-আন্দোলন এল। গান্ধীজী স্বীকার করলেন যে স্বামীজির কাছ থেকে কতখানি পেয়েছেন। এসে উপস্থিত হল সুভাষচন্দ্রের আন্দোলন। সুভাষচন্দ্রের কথা আপনারা অন্য সময় শুনেছেন যে সুভাষচন্দ্র কি ভাবে স্বামীজির কাছে প্রেরণা পেয়েছিলেন। তারও পূর্ববর্তীকালে তিলকের কথা স্মরণ করুন, যিনি স্বামীজিকে শঙ্করাচার্য বলেছেন। বিপিন পালের কথা স্মরণ করুন, যিনি বলছেন, স্বামী বিবেকানন্দ এদেশের nationalism- জাতীয়তাবাদের পিতার স্বরূপ। স্মরণ করুন অন্যান্য বিপ্লবীদের কথা, এনি বেসান্তের কথা, সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের কথা। এঁরা সকলে একবাক্যে বলছেন, বিবেকানন্দ আমাদের মধ্যে নতুন চেতনা দিয়েছেন, জাগরণ দিয়েছেন। আজকের এই যুবকবন্ধু যাঁরা আছেন, যাঁরা relevance চাইবেন, তাঁদের কাছে আমার বক্তব্য হচ্ছে এই, আমরা কি একটা স্বয়ম্ভু কিছু? কিম্বা আমরা হঠাৎ সৃষ্ট একটা বস্তু? আমরা কি গাছ থেকে লাফিয়ে পড়া একটা জন্তু? অথবা, আমার পিছনে একটা বড় ইতিহাস আছে— সেই ইতিহাসের যিনি স্রষ্টা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করা সবচেয়ে বড় নীচতা। সেই নীচতা আজকে কিছু মানুষ দেখাচ্ছেন, এই কথা আপনাদের সবাইকে স্মরণ করতে হবে। এবং প্রয়োজনক্ষেত্রে বিদ্যাবুদ্ধির দ্বারা যতটুকু পারেন তার প্রতিবাদও এই যুবক বন্ধুদের করতে হবে।

আর একটি প্রসঙ্গে মাত্র আমি আসব। সেই প্রসঙ্গ হচ্ছে এই যে renaissance-নবজাগরণ-এর কথা বলা হল, ইতিহাস শেষ হয়ে গেল কি? স্বামীজি অমুক চন্দ্র অমুক ছিলেন, অমুক অমুক কাজ তিনি করেছিলেন। শেষ? না। এই জাতীয় জাগরণ হচ্ছে একটা continuous process, এটা চলে। আমরা যখন renaissance-জাগরণ-এর কথা বলি, তখন আমরা ভুলে যাই যে এটা যতখানি revolution তার থেকে অনেক বেশী evolution হঠাৎ যদি কোনও একটা মানুষ কিছু করে দেয় তাহলে আমরা গণশক্তিকে সবচেয়ে বড় অবিশ্বাস করি। যে-আমরা গণশক্তির জন্যে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছি চতুর্দিক, সেই আমরা সমষ্টির শক্তিকে সবচেয়ে বেশী অস্বীকার করব যদি আমরা ঐ revolution-এ বিশ্বাস করি, evolution বিশ্বাস না করি। এই আমাদের সবাইকে স্মরণ করতে হবে, এই যে continuous process—ক্রমাগত renaissance-নবজাগরণ তার গতিবৃদ্ধি করেছেন; স্বামীজি সেই বিষয়টাকে সঠিক পথে চালিত করবার চেষ্টা করেছেন।

সমাজ সংস্কারের কথা পাঠকরা জানেন। স্বামীজি, এরকম বলা হয়, সমাজ সংস্কারের নাকি বিরোধিতা করেছিলেন। এরকম বলা হয় যে তিনি সমাজ সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন না। অনেক সময় রাগারাগি করেছেন সমাজ সংস্কারকদের বিরুদ্ধে। তিনি নাকি রক্ষণশীল ছিলেন। এক প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারক এক সাহেবের বাড়িতে গিয়ে নিমন্ত্রণে চা খাননি, নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন শুধু। সেই ব্যক্তিকে ফিরে এসে— তিনি ভয়ানক সংস্কারক ছিলেন— প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল।

আর, এই স্বামী বিবেকানন্দ সকলের সামনে মুসলমানের ঘরে খেয়েছেন, তার হাত থেকে খাবার কিনে খেয়েছেন, খ্রিস্টানের হাত থেকে খাবার কিনে খেয়েছেন, তাঁর সঙ্গে বসে খেয়েছেন। সমাজ সংস্কারের আড়ম্বর কেন করা হয়, যদি কাজে আর কথার মধ্যে এত বড় ফারাক থাকে? আমরা কাদের দেবতা করব? যাদের কাজে এবং কথার মধ্যে ফারাক আছে, তাদের দেবতা করব? না, যে মানুষটা সত্যনিষ্ঠ, তাকে দেবতা করব? এই প্রশ্নে আমি যুবক ভাইদের সামনে উপস্থিত করছি। স্বামীজি কোন সমাজ সংস্কার চাইলেন? বললেন, ‘তোমরা সমুদ্র লঙ্ঘন কর।’ এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? উনি বলতে চাইছিলেন, তুমি কূপমন্ডুক হয়ে আছ, তুমি পৃথিবী দেখনি। তুমি যে মুহূর্তে পৃথিবী দেখবে সেই মুহূর্তে আত্মশোধন করবে। তুমি আজকে ভারতবর্ষে অমুক চন্দ্র অমুক কাজটা করতে বলেছেন বলে করবে, না, তুমি নিজে বিচার-বিবেচনা করে করবে? এটা ছিল স্বামীজির বক্তব্য— যাও বাইরে চলে যাও, পৃথিবীকে তুমি দেখ। পৃথিবীকে দেখবার সময় গায়ে সবসময় ঐ নামাবলী জড়িয়ে পৃথিবী দেখবে? শুধু স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম যে সমাজ সংস্কারের জন্য আবেদন করেছিলেন সেটা হচ্ছে সমুদ্র লঙ্ঘনের পক্ষে। সবচেয়ে বড় সংস্কার, আমার তো নিজের ধারণা, এখন মনে হয় সবাই মেনে নেবেন যে, বিধবাদের বিয়ে দেওয়া নয়। বিধবাদের বিয়ে করবার ইচ্ছা হলে তাঁরা করবেন ঠিক। এরজন্য অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন দরকার আছে। কিন্তু এই যে উচ্চবর্ণ আর নিম্নবর্ণের পার্থক্য, মানুষকে মানুষ না মনে করা, কোন কোন মানুষের ছায়া লাগলে আমার জাত যাবে মনে করা, এই সংস্কারের চেষ্টা যিনি করেন, তিনি সমাজ সংস্কারক নন? আমি বলছি ‘নন।’ কারণ, যদি ঐ ‘বিপ্লবী’ শব্দটা ব্যবহার করতে হয় তবে তিনি ছিলেন তাই। তিনি সমাজ সংস্কারকদের চেয়ে অনেক বড় ছিলেন, তিনি ছিলেন ‘বিপ্লবী।’ এই ভেদের মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেছেন দার্শনিক ভাবেও। সে দার্শনিক তত্বের আলোচনা আমি করতে চাইছি না।

তিনি সচেতন করে দিলেন আমাদের এই বৃটিশ শাসনের সম্পর্কে। সেই পরশাসন, সেই colonialrule— আমাদের বড় বড় মানুষরা যার সম্বন্ধে তখন ভাবছিলেন যে British imperialism হচ্ছে Divine dispensation, স্বয়ং ঈশ্বর এই বৃটিশ শাসন আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন— Divine dispensation স্বামীজি বললেন— এটা হল বেনের রাজত্ব। এই বাইরে যুদ্ধ বোধ দেখছ, বাইরে পতাকার আড়ম্বর দেখছ, গুরু গুরু ধ্বনি শুনছ। কি আছে? এর পেছনে আছে দাঁড়িপাল্লা। এর পেছনে আছে বণিকের শোষন। এটা capitalist-দের শাসন ছাড়া আর কিছু নয়। এই বিষয়ে তিনি সচেতন করে দিলেন। তিনি সমাজতন্ত্রী ছিলেন— এ মুখে বললেই হয় না। সমাজতন্ত্রী ছিলেন কিসের জন্যে? তাঁকে বুঝতে হয়েছিল এই ধনতন্ত্রের আসল রূপটা কি! ধনতন্ত্রের আসল রূপটা না বুঝলে কারও পক্ষে সমাজতন্ত্র আনবার কথা ভাবা যায় না। স্বামীজি এ বিষয়ে সচেতন করে দিয়েছিলেন আমরা দেখতে পাব।

বিজ্ঞানচেতনা তিনি এনেছিলেন। ধর্ম আর বিজ্ঞানে যে পার্থক্য নেই, এ কথা সবাই বলছে, বারবার উচ্চারিত হয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, একবার বিরাট বিতর্ক হয়েছিল স্বামীজির একজন অনুরাগী, ‘প্রবুদ্ধ-ভারতের’ সাধক, স্বামী অশোকানন্দের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর। সে বিতর্কের বিষয় ছিল ‘স্বামীজি যন্ত্র শিল্পায়ন চাইতেন, কি চাইতেন না।’ এই বিরাট বিতর্কের সময় স্বামী অশোকানন্দ দেখবার চেষ্টা করেছিলেন যে স্বামীজি অনিবার্যতা— সমস্ত পৃথিবীর গতি যে দিকে— সেটার বিরুদ্ধে লড়াই করে শক্তি ক্ষয় করতে চানননি। স্বামীজি মনে করেছিলেন যে এটা আসবেই, এই যন্ত্র শিল্প আসবেই, বৃহৎ শিল্প আসবেই। কি করতে হবে? তাকে spiritualize করতে হবে। মানুষ যন্ত্রের মধ্যে থেকে যে দাসত্ব করবে, সেই দাস মানুষার মধ্যে আত্মচেতনা দিতে হবে। কি আশ্চর্যজনক প্রগতিশীল অথচ চিরায়ত বোধের সঙ্গে যুক্ত। স্বামীজির এ ধারণা ছিল। শিল্পের সাহিত্যের যে আদর্শ তার সম্বন্ধে তিনি কি বলেছেন আমি সে প্রসঙ্গে যাব না। শিল্প সম্বন্ধে সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর আশ্চর্য আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির বহু বর্ণনা ইদানীং আমরা শুনতে পাচ্ছি। ধর্ম-সমন্বয় প্রসঙ্গে ড. নিমাই সাধন বসু বলেছিলেন যে এই ভারতবর্ষের secular idea যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটা স্বামী বিবেকানন্দ-শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শ। আমি ছোট্ট একটা উদ্ধৃতি নেতাজী সুভাষচন্দরের লেখা থেকে দিচ্ছি। উনি বলেছিলেন, ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস সাধনার মধ্য দিয়া সর্বধর্মের যে সমন্বয় করিয়াছিলেন তাহাই স্বামীজির মূল মন্ত্র এবং ভবিষ্যৎ ভারতের জাতীয়তার ভিত্তি। এই সর্বধর্ম সমন্বয় ও সকল মত সহিষ্ণুতার প্রতিষ্ঠা না হইলে আমাদের এই বৈচিত্রপূর্ণ দেশে জাতীয়তাবোধ নির্মিত হইতে পারিত না।’ —‘পারিবে না’ নয়, এই ভাষার তফাৎটা লক্ষ্য করুন। ‘জাতীয়তাবোধ নির্মিত হইতে পারিত না।’ অর্থাৎ সুভাষচন্দ্র এই কথা বলছেন পরিষ্কার ভাষায় যে, এই ঠাকুর এবং স্বামীজির ধর্ম সমন্বয়ের যে ভিত্তি সেটাই হচ্ছে ভারতবর্ষের জাতীয়তার ভিত্তি।

আমি শেষপ্রসঙ্গ আপনাদের সামনে আনছি। স্বামী বিবেকানন্দের জাগরণ যেটা আমার বিষয়ের একটু বাইরে চলে যাচ্ছে, সেটা কেবল ভারতের জাতীয়-জাগরণ নয়, সেটা বিশ্ব-জাগরণ। সেটা কেবল ভারতের renaissance নয়, পৃথিবীর renaissance বিদেশীয় renaissance-এর সম্বন্ধে যারা আদেখলের মনোভাব দেখান, তাঁদের কাছে এই নিবেদনটা আমরা করতে পারি, জানাতে পারি যে, সভ্যতাটা এগিয়ে যাচ্ছে, পুরোনো কালে সেই যে ঐহিক যুক্তিবাদ সে আর সম্পূর্ণ টিঁকছে না। একদিকে আছে ক্ষুধার সঙ্গে সংগ্রাম, আর একদিকে আছে আত্মার সঙ্গে সংগ্রাম। দুটো সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ দুটো ভূমিকা নিয়েছিলেন। ভারতবর্ষে তিনি ক্ষুধার সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন, আর পাশ্চাত্যে যখন ছিলেন সেই আত্মবোধহীনতার বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করেছিলেন। এই দুটো সংগ্রাম আমরা যেন স্মরণ করি। আমরা আজকে জিজ্ঞাসা করতে ব্যস্ত। কিন্তু আমাদের সমস্ত জিজ্ঞাসা কেন বহির্জগতে থেমে যাবে, কেন অন্তর্জগতে পৌঁছবে না? আমরা আজকে atom-এর ভাঙ্গায় বিশ্বাস করছি, কিন্তু চেতনার আবরণ ভাঙ্গে বিশ্বাস করছি না কেন? এটাই হচ্ছে প্রশ্ন? atom-এর আমি ভাঙ্গতে পারি; তার দ্বারা বিপুল শক্তিকে আমরা উন্মোচন ক়রতে পারি। কিন্তু চেতনার আবরণ ভঙ্গ করে বিপুল শক্তিকে কেন উন্মোচন করব না? স্বামীজির সেই কথা, যে মানুষের মধ্যে অনন্ত শক্তি রয়েছে কুন্ডলী পাকিয়ে, সে কুন্ডলী খুলছে, ছড়িয়ে পড়ছে, নতুন নতুন দেহকে সে নিচ্ছে। সে দেহ আসক্ত হলে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। এরই নাম মানুষের ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, প্রগতির ইতিহাস। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন— নিজের বাইবেল নিজে রচনা কর, নিজের খ্রিস্টকে নিজে আবিষ্কার কর। বলেছিলেন, এই কথাটা আমি সকলের সামনে উপস্থিত করছি, ঘর যদি অন্ধকার থাকে, ‘অন্ধকার’ ‘অন্ধকার’ বলিয়া চিৎকার করিলে অন্ধকার দূর হইবে না, আলো লইয়া আইস। নিবেদিতার কথাই শেষ কথা— এই বিবেকানন্দের কাছ থেকে বেরিয়ে পড়া মানে যুদ্ধ পতাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়া। —এটাই আমাদের যুবক বন্ধুদের কাছে আমাদের শেষ কথা।


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন