মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক ২৫ মার্চের নির্মম হত্যাকাণ্ড, সারাদেশে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, হিন্দুজনগোষ্ঠীসহ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সাহসী সংগ্রাম, যুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ সাধারণ মানুষের যন্ত্রণাদগ্ধ দিনাতিপাত, বর্বর শত্রু ও রাজাকার দ্বারা বন্দিশিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবর্ণনীয় অত্যাচার ও নির্যাতন, পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দালালদের দ্বারা নারী ধর্ষণ, হত্যা ও নিপীড়ন প্রভৃতি কাহিনির সঙ্গে যুদ্ধোত্তর নতুন জীবনের আকাঙ্ক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্নময় রূপালি চিত্র রূপায়িত হয়েছে। উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধোত্তর সোনালি প্রত্যাশার সমাধি ও পাকিস্তানি দালালদের পুনর্বাসন চিত্রণ স্বতন্ত্র তাৎপর্যে অঙ্কিত। বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের সংঘর্ষের কাহিনিও কতগুলো উপন্যাসের মূল বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তি এবং পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর অনুচর ও সহযোগী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিল। তাদেরকে রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামে অভিহিত করা হয়। তারাই আমাদের উদ্দিষ্ট খল চরিত্র। অর্থাৎ এই খলরা ‘পাকিস্তানি দালাল’ হিসেবেও চিহ্নিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে জামায়াতে ইসলামী যে সশস্ত্র দল গঠন করেছিল সেই রাজাকারবাহিনীর সদস্য ছিল এরা। এই রাজাকারদের ‘আলবদর’ এবং ‘আলশামস’ বলে ডাকা হতো। অবশ্য তার আগে থেকেই ছিল ‘শান্তিকমিটি’ নামক পাকিস্তানি দালালচক্রের অপতৎপরতা। জনৈক গবেষকের মন্তব্য, ‘বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো বন্ধু ছিল না, তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কিছু দেশদ্রোহী। বাংলাদেশের মানুষ এদের সবাইকে নির্বাচনে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই দেশদ্রোহী মানুষগুলো ছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগের খাজা খয়েরউদ্দিন, কনভেনশন মুসলিম লীগের ফজলুল কাদেরচৌধুরী, কাইয়ুম মুসলিম লীগের খান এ সবুর খান, জামায়াতে ইসলামীর গোলাম আযম এবং নেজামে ইসলামীর মৌলভী ফরিদ আহমেদ। এদের মাঝে জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটির কথা আলাদা করে বলতে হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্যে দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে রাজাকারবাহিনী তৈরি করা হয়েছিল- সেটি ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামীরই সশস্ত্র একটি দল। সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক প্রতিনিধি দল জেনারেল নিয়াজীর কাছে এটা নিয়ে অভিযোগ করলে জেনারেল নিয়াজী তার অধস্তন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয় তখন থেকে রাজাকারদের আলবদর এবং আলশামস বলে ডাকা হতো। এই রাজাকার কিংবা আলবদর ও আলশামসের মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা বা সাহস কোনোটাই ছিল না, কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদলেহী হিসেবে থেকে এরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর যে অত্যাচার এবং নির্যাতন করেছে তার অন্য কোনো নজির নেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই দেশের মানুষকে চিনত না- আলবদর, আলশামস প্রকৃত অর্থ যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের মানুষের কাছে এর চাইতে ঘৃণিত কোনো শব্দ নেই, কখনো ছিল না, কখনো থাকবে না।’
জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের সময় একাধিক ভাষণে তার দলের নেতা-কর্মীদের দালালি কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেছে যা ১৯৭১ সালে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতিকারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের মোকাবেলা করার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য আবেদন করেছিল— ‘দুষ্কৃতিকারীদের ধ্বংস করার কাজে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে।’ অন্যত্র আছে— ‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি মুসলমান নিজ নিজ এলাকার দুষ্কৃতিকারীদের তন্ন তন্ন করে তালাশ করে নির্মূল করবে।’ উপরন্তু— ‘গোলাম আযম বলে, পূর্ব পাকিস্তানে জামাতে ইসলামের কর্মীরা বেশীরভাগ রেজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছে এবং প্রাণ দিচ্ছে। এখানে জামাতের অবদানই বেশী সুতরাং পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হলে জামায়েত থেকেই হতে হবে।’ স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে, ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করে। তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলে। এরা পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে কাজ করেছিল। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্য ঢাকায় ‘শান্তিকমিটি’ গঠন করা হয়। এর সদস্য ছিল পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। গোলাম আযমও এই কমিটির সদস্য ছিল। শান্তিকমিটির উদ্যোগে মে-জুন মাসে সারাদেশে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ১ জুন টিক্কা খান ‘পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স-১৯৭১’ জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করে। তবে এর নেতৃত্বে ছিল পাকিস্তানপন্থী স্থানীয় নেতাদের হাতে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এ জারিকৃত এক অধ্যাদেশ বলে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়।’ তবে প্রথম থেকেই সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় দালালরা সারা দেশে পাকিস্তানি উন্মাদনায় মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রদ্রোহী, সমাজবিরোধী, দুষ্কৃতিকারী, ভারতের চর, জারজসন্তান ও পঞ্চমবাহিনী বলে গালিগালাজ করত। উপরন্তু তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থক ও সহায়তাকারীদের নির্মমভাবে নির্যাতন এবং পাকিস্তানিদের সঙ্গে গণহত্যায় সামিল হয়।
গণহত্যার সহযোগী গোলাম আজমসহ তার প্রধান সহকারীদের প্রায় সকলেই স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের আনুকূল্যে গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে সাময়িকভাবে বাংলাদেশে আসে এবং কোন ভিসা ছাড়াই ১৯৭৮-১৯৯৪ পর্যন্ত বাস করে। ১৯৭৯ সালের মে মাস থেকে এই কুখ্যাত ব্যক্তি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সঙ্গে পুনরায় জড়িত হয়। বাংলাদেশের এই ধর্মীয় রাজনৈতিক দল যাদের অধিকাংশই ১৯৭১ সালে দেশ বিরোধী কাজে লিপ্ত ছিল তাদের আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। উল্লেখ্য, সারা বাংলাদেশের সকল থানায়ই শান্তিকমিটির উপকমিটি ছিল এবং এর মাধমে নির্মম অত্যাচার চালানো হয়। এদেশের পাকিস্তানভক্ত মানুষের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য টিক্কাখান এ কমিটি করে। ‘টিক্কা খান ৯ এপ্রিল প্রাদেশিক গভর্ণর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার পরপরই ১৪০ সদস্যের ঢাকা নাগরিক শান্তিকমিটি গঠিত হয়।’ শান্তিকমিটির প্রধান কাজ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালান। পাকিস্তানি আদর্শের প্রতি অনুগত থেকে বাঙালিদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে দমন ছিল প্রচারের আরো উদ্দেশ্য। মুক্তিযোদ্ধাদের সবসময় তারা ‘দুষ্কৃতিকারী’ হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং তাদের প্রতিরোধে আহবান জানিয়েছে। তাদের স্লোগান ছিল, ‘নারায়ে তকবীর-আল্লাহু আকবর’, ‘পাকিস্তান-জিন্দাবাদ’, ‘কায়েদে আজম-জিন্দাবাদ’, পাকিস্তানের সংহতি ও আদর্শ অক্ষুণ্ন রাখুন। হিন্দুস্তানি দূরভিসন্ধি ও মিথ্যাচার প্রচার বন্ধ করো। দেশপ্রেমিক ভাই সব এক হও। দুঃখজনক হলেও সত্য, একাত্তরের পর স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় পাকিস্তানি দালালরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলসমূহ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের সহযোগী করে তুলেছেন। এই বিনষ্ট-রাজনীতি ও সমাজের চিত্র রয়েছে বিভিন্ন লেখকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসে।
কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের ‘রাজাকারতন্ত্র’ (১৯৮৯) উপন্যাসে খল চরিত্র বা পাকিস্তানি দালাল বা রাজাকারের সংজ্ঞা হলো—
‘১. সাধারণভাবে আপনারা ভাবেন আপনাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানি মিলিটারি ভাইদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে, তাদের সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা করেছে, বাঘের সঙ্গে, নরখাদক বাঘের সঙ্গে ফেউর মতো ঘুরে বেড়িয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানা ইত্যাদি খোঁজ খবর নিয়ে, সেই সংবাদ পাচার করেছে মিলিটারিদের কাছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের না পেলে ধরিয়ে দিয়েছে তদের আত্মীয়-পরিজনদের, মা বাবা ভাই বোনকে এমনকি বাড়ির অসহায় চাকরবাকরদের পর্যন্ত, তাদেরকেই তো রাজাকার বলেন আপনারা?
২. কখনও কখনও পাকিস্তানি মিলিটারি ভাইদের হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাইফেল স্টেনগান এল এম জির মতো অস্ত্রহাতে যেসব কুকুরছানা তস্য কুকুরছানা ফাইট দিয়েছে, আপনারা তাদেরকেও রাজাকার বলেন।
৩. কখনও কখনও পাকিস্তানি ভাইরা সুখ নিদ্রায় মগ্ন হয়েছে, রাত জেগে অস্ত্র হাতে ওরা তাদের পাহারা দিয়েছে। মিলিটারি ভাইদের সুখনিদ্রার সুযোগে বিচ্ছু মুক্তিযোদ্ধারা এসে যেন তাদের হাপিস করে দিতে না পারে সেই ব্যবস্থা করেছে। পথঘাট চিনিয়েছে, গলি ঘুপচি চিনিয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাবারদাবার জোগাড় করে দিয়েছে। গরু, ছাগল, মুরগি, মেয়েমানুষ।… পাকিস্তানি মিলিটারিদের সর্বান্তকরণে সাহায্যকারীদের নাম রাজাকার।’ (উপন্যাসসমগ্র, পৃ ২৭-২৮)
বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়ে সংসদে ‘দালাল’ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইন গৃহীত হয়। মামলার সংখ্যাধিক্য এবং অন্যান্য বিবিধ কারণে পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, দালাল আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত ছাড়া বাদবাকিদের জন্য ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেন। এই সাধারণ ক্ষমা যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। বরং তাদের বিচার অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া চালু ছিল। কিন্তু ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই ঐ বছরই ৩১ ডিসেম্বর ‘দালাল আইন’ বাতিল করা হয়। আবার ওই ৩১ ডিসেম্বরই দালাল আইনের যে রক্ষাকবচ ছিল প্রথম তফসিলে তা তুলে নেয়া হয়, এবং বিচারপতি সায়েম ও জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার দালাল আইন বাতিল করার পরিপ্রেক্ষিতে যে ১১ হাজার অভিযুক্তের বিচার চলছিল তারা আপিল করে বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়। এরপর… (ঘোষণা) জারি করে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী এবং দখলদার পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সহযোগী দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়, ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় হতে আবেদন করতে বলা হয় এবং সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়া হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান আমাদের সংবিধান এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র যা আমাদের সংবিধানের ৪ মূল স্তম্ভ হিসেবে ছিল, এক এক করে সংবিধান থেকে সেই গুরুত্বপূর্ণ ৪ স্তম্ভের অপসারণের নীলনকশার বাস্তবায়ন করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে আবারো আমরা দেখি যে মাত্র ৯ বছরেই ক্রমশ রাষ্ট্রক্ষমতার খুব কাছে চলে এসেছে স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তিরা ’৭১ সালে যাদের হীন সহযোগিতায় ও ঘৃণ্য কৌশলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে আমাদের অযুত নিরস্ত্র মানুষদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের মর্মন্তুদ নৃশংস গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ ঘটানো সম্ভবপর হয়। সেই পলাতক এবং অন্তর্ধানে থাকা অংশ যারা স্বাধীনতার বিরোধীপক্ষ তারা স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র ৫ বছরের ভেতরই বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ’৭৯ এর নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ পায়। এখানে স্বাধীনতা বিরোধী ও দেশের বিরুদ্ধে গণহত্যা, ষড়যন্ত্রকারী, যুদ্ধাপরাধীরা ক্রমশ সংগঠিত হয়েছে এবং তাদের জন্য তৈরি করে দেওয়া পথে একটি পর্যায়ক্রমিক পুনর্বাসনের দিকে এগিয়ে গেছে…।’ (হুমায়ূন রেজা, যুদ্ধাপরাধ এবং বিচার বাস্তবতা)
দুই.
বাংলাদেশের অনেক কথাসাহিত্যিকই মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে খল চরিত্রের রূপায়ণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাসেই খল বা পাকিস্তানি দালাল চরিত্রের অনিবার্য আবির্ভাব লক্ষ করা যায়। উপন্যাসের নামগুলো যথাক্রমে- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘একটি কালো মেয়ের কথা’(১৯৭১), আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ (১৯৭৩), শওকত ওসমানের ‘জাহান্নম হইতে বিদায়’ (১৯৭১), ‘নেকড়ে অরণ্য’ (১৯৭৩), ‘দুই সৈনিক’ (১৯৭৩) এবং ‘জলাংগী’ (১৯৭৬), সৈয়দ শামসুল হকের ‘নীল দংশন’ (১৯৮১), ‘নিষিদ্ধ লোবান’ (১৯৮১), ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ (১৯৮৪), ‘অন্তর্গত’ (১৯৮৪), ‘মৃগয়ায় কালক্ষেপ’ (১৯৮৬), ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ (১৯৮৯, ৯০) এবং ‘ত্রাহি’ (১৯৮৮), রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারী সূর্য’ (১৯৭৪), সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ (১৯৭৬), ‘যুদ্ধ’ (১৯৯৮), হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামলছায়া’ (১৯৭৬), ‘সৌরভ’ (১৯৮৪), ‘১৯৭১’ (১৯৮৬), ‘অনিল বাগচীর একদিন’ (১৯৯২), ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ (২০০৪), রশীদ হায়দারের ‘খাঁচায়’ (১৯৭৫), ‘অন্ধ কথামালা’ (১৯৮১), ‘নষ্ট জোছনায় এ কোন অরণ্য’ (১৯৮২), মিরজা আবদুল হাইয়ের ‘তোমার পতাকা’ (১৯৮৪), ইমদাদুল হক মিলনের ‘কালোঘোড়া’ (১৯৮১), ‘ঘেরাও’ (১৯৮৫), ‘দ্বিতীয় পর্বের শুরু’ (১৯৮৮), ‘রাজাকারতন্ত্র’ (১৯৮৯), ‘মহাযুদ্ধ’ (১৯৮৯), ‘বালকের অভিমান’ (১৯৯০), ‘একজনা’ (১৯৯১), ‘সুতোয় বাঁধা প্রজাপতি’ (১৯৯৮), ‘জীবনপুর’ (২০০৯), ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’ (২০১৫), ‘নয়মাস’ (২০১৭); মঈনুল আহসান সাবের রচিত ‘পাথর সময়’ (১৯৯০), ‘সতের বছর পর’ ( ১৯৯১ ), ‘কবেজ লেঠেল’ (১৯৯২), ‘ফিরে আসা’ (১৯৯৯); শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ (১৯৮৮); মাহবুব তালুকদারের ‘বধ্যভূমি’ (১৯৯৭), আবুবকর সিদ্দিকের ‘একাত্তরের হৃদয়ভস্ম’ (১৯৯৭), আল মাহমুদের ‘উপমহাদেশ’ (১৯৯৩), মাহবুব সাদিকের ‘বারুদগন্ধ দিন’ (১৯৭৩), বেগম জাহান আরার ‘অয়নাংশ’ (১৯৮৩), খুরশীদ আলমের ‘দাহ’ (১৯৯৭), সালাম সালেহ উদদীনের ‘ছায়াশরীর’ (১৯৯৮), মোস্তফা কামালের ‘জনক জননীর গল্প’ (২০১১), মহীবুল আজিজের ‘যোদ্ধাজোড়’ (২০১৪) ইত্যাদি অন্যতম।
আনোয়ার পাশার (১৯২৮-৭১) রাইফেল রোটি আওরাত (১৯৭৩) উপন্যাসের রচনাকাল ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে এপ্রিল মাস। বাংলাদেশের সাহিত্যে এটিই মুক্তযুদ্ধভিত্তিক প্রথম উপন্যাস। অবশ্য ১৯৭১ সালে প্রকাশিত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কালো মেয়ের কথায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরা হয়। হানাদারবাহিনীর তাঁবেদার জাফরউল্লাহ নামের জনৈক পাঞ্জাবি অসহায় বাঙালি নারী নাজমাকে ধর্ষণ করে। তবে পরিণতিতে সে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা নিহত হয়। হানাদারবাহিনীর এই তাঁবেদার জাফর আসলে পাকিস্তানি দালাল। রাইফেল রোটি আওরাত উপন্যাসে যেমন পাকিস্তানি দালাল চরিত্র আছে তেমনি শাসকশ্রেণির আস্থাভাজন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের মনোভাবের পরিচয় ব্যক্ত করা হয়েছে। মালেক ও খালেক চরিত্র দু’টি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালি ও স্তুতিবাদের মাধ্যমে নিজেদের জীবনে স্বস্তি আনে ও শাসকগোষ্ঠীর প্রিয়ভাজন হবার চেষ্টা করে। এদের সম্পর্কে সুদীপ্ত শাহীনের একটি বাক্য হলো- ‘পাকিস্তানে এখন দালালীর জয়জয়কার প্রচণ্ড নির্লজ্জ দালালী তোষামদ আর উৎকোচ।’ অন্যদিকে নির্ভীক হাশেম শেখ তার মামা ফিরোজকে উদ্দেশ্য করে বলেছে- ‘আপনারও এখানে আর থাকা চলবে না মামা। জামায়াতে ইসলাম ও মুসলিম লীগের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সলাপরামর্শ চলছে শুনলাম।…চার শ্রেণীর মানুষকে ওরা দেশ থেকে নির্মূল করবে… বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী লীগার, কম্যুনিস্ট ও হিন্দু।’ হাশেম শেখের এই উক্তির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে জামায়াতে ইসলাম ও মুসলিম লীগের সুসম্পর্ক চিহ্নিত।
শওকত ওসমানের (১৯১৭-১৯৯৮) জাহান্নম হইতে বিদায় (১৯৭১), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), দুই সৈনিক (১৯৭৩) এবং জলাংগী (১৯৭৬) উপন্যাসে পাকিস্তানি দালালদের ভূমিকা চিহ্নিত হয়েছে। পাঞ্জাবি সৈন্যদের সহযোগী হয়ে এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা আছে জাহান্নম হইতে বিদায় উপন্যাসে। পাকিস্তানি সৈন্যরা জোরপূর্বক কয়েকজন লোককে দিয়ে নরসিংদী বাজার লুট করায়, তার মধ্যে অনিচ্ছুক জনৈক বৃদ্ধও ছিলেন। যিনি সৈন্যদের সহযোগী মানুষদের চোখের দিকে তাকিয়ে আত্মপীড়ন অনুভব করেছেন- ‘আমাগো মুজিবুর রহমান যে কইছে পশ্চিম পাকিস্তান গোস্ত খায় আর আমরা তার হাড় চুষি। … মনে মনে আল্লারে ডাকি, হে আল্লা ইমান খুয়াইয়া বেঈমান হওনের লাইগ্যা তুমি পাকিস্তান বানাইছিলে, জোয়ানকালে কত খোওয়াব দেখছি, পাকিস্তান হইব, মানুষ হইতা পারব হগ্গলে। কতো খাডছি ভোটদিছি। পাকিস্তান হইল। কত রিফিউজি আইল। তাগোর জায়গা দিছি, খাওয়াইছি। …হেয়াও শুনি অহন মিলিটারীর লগে। আল্লা বেইমান হইয়া এই যনমে মরণের লাই পাকিস্তান বানাইছিলাম।’— উদ্ধৃতিতে ‘হেয়াও শুনি অহন মিলিটারীর লগে’- এখানে দালালির বাস্তবতা স্পষ্ট। দুই সৈনিক উপন্যাসে একাত্তরে একটি গ্রামে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক বাঙালি নারী ধর্ষণ, নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতনের ছবি রয়েছে। আরো উঠে এসেছে, গ্রামীণ পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এদেশীয় দালাল ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা ও অবস্থান। এ উপন্যাসের মখদুম মৃধা আইয়ুব শাহের আমলের মৌলিক গণতন্ত্রের অনুসারী হয়ে চেয়ারম্যান হলেও সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল ভোটে জয় দেখে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর তার দালালি চরিত্র প্রকাশিত হয়। আখ্যানে তার নিজের কথায় পাকিস্তানপ্রীতি উন্মোচিত— ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালবাসি। এখন দ্যাখো ভালোবাসা মার্গে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ঠ্যালার নাম কয় বাবাজী। আর যে সে গুঁতো নয়, একদম পাঞ্জাবী মিলিটারী। …এহন দ্যাহো, হালার পুৎ হালারা। তোগোর বাবা মুজিব আছে কি নাই। পশ্চিম পাকিস্তানে জেলের মদ্যি বাপ-বাপ ডাক ছাইড়ছে। …পঁচিশে মার্চ। ও আল্লারে আল্লা। তুমি ঠিক কইয়া দিছলে, মাবুদ। অহন আর ‘‘জয় বাংলা …জয় বাংলা’’ কোন খান্কীর পুতের মুখে শুনি না। হব গুয়ার মদ্দি ঢুকছে। … তিন হপ্তা অইল মাত্র। আজ এপ্রিলের বিশ। শোকর তোমার দয়ায় পরওয়ার দেগার। …আল হামদো লিল্লাহ… এক মাসের মদ্দি তুমি কি না দ্যাহাইলে? কাফেরদের হাত থেকে যুগে যুগে তুমি এই ভাবে এম্নি ধারায় কতোবার ইসলামকে বাঁচিয়েছে।’ দালাল মৃধার বাড়িতে আশ্রিত সৈন্যরা আদর-আপ্যায়নে বিহ্বল হয়ে ওঠে। তার মনে হয় পাকিস্তান ও ইসলামের রক্ষাকারী ওই সৈন্যরা কোন সাধারণ সৈন্য নয় ফেরেশতা সমতুল্য। মোসাহেব সায়ীদ মাতবর পরিচর্যায় নিযুক্ত থাকে; সঙ্গে মৃধার দুই কলেজ পড়ুয়া কন্যা সাহেলী ও চামেলীও সম্পৃক্ত হয় যারা প্রতিদিন রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনে আর নিজেদের মধ্যে দেশের অবস্থা ও যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু মৃধার পাকিস্তানপ্রীতি এই দু’ই কন্যাকে রক্ষা করতে পারেনি। বরং ফেরেশতা স্বরূপ পাকিস্তানি সৈন্যরা তার দুই কন্যাকে তুলে নিয়ে যায়। পরিণতিতে মৃধা আত্মগ্লানিতে আত্মহত্যা করে।জলাংগী উপন্যাসটিতে বাঁকাজোল গ্রামের প্রতীকে শওকত ওসমান যুদ্ধকালীন জীবন বাস্তবতার একটি সামগ্রিক চিত্র অঙ্কন করেছেন। চাচাতবোন ও প্রেমিকা হাজেরার খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জামিরালি একদিন ধরা পড়ে পার্শ্ববর্তী কাজীর চর গ্রামের কয়েকজন রাজাকারের হাতে। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে রাজাকাররা তার প্রকৃত পরিচয় না পেলেও তার কাছ থেকে খুঁজে পাওয়া একটি চিরকুটে হাজেরার নাম দেখতে পায়। দালালরা এক পর্যায়ে জামিরালিকে তুলে দেয় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পের মেজর হাশেমের কাছে, যে পাকিস্তানি মেজরের অত্যাচার ও নির্যাতনের কুখ্যাতি অনেক আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল। ক্যাম্পে আগে থেকেই বন্দি হয়েছিল জামিরালির প্রেমিকা হাজেরা। আরো অনেক মেয়েদের মতো তাকেও এখানে বন্দি করা হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য। মেজর গ্রামের শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান মোসাহেব আলীর মাধ্যমে কয়েকজন গ্রামবাসীর সামনে জামিরালি ও হাজেরার তথাকথিত ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে বিচারের সম্মুখীন করে। বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে হাশেম তাদের পাথর বেঁধে মেঘনা নদীতে ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু উপস্থিত জনতা এই রায় ও তার বাস্তবায়ন কোনোটিতেই আগ্রহ দেখায় না। তবে জামিরালি-হাজেরার করুণ পরিণতির পিছনে রাজাকারদের ভূমিকা স্পষ্ট।
সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের রচয়িতা হিসেবে বিশিষ্ট। আশির দশকে যতগুলি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে তিনি তার অন্যতম লেখক। ‘তাঁর উপন্যাসগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক চেতনা ও তাৎপর্যকে ধারণ করে। এই বিষয়ে তাঁর উপন্যাসে তিনি বিভিন্ন কৌণিক দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়পরম্পরাকে অবলোকন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের অনিঃশেষ চেতনার অঙ্গীকারে তিনি নির্দিষ্ট কালখ- থেকে মুক্তি দিয়ে এক আবহমান তাৎপর্যে অভিষিক্ত করেছেন বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে।’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলো হচ্ছে- নীল দংশন (১৯৮১), নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১), দ্বিতীয় দিনের কাহিনী (১৯৮৪), অন্তর্গত (১৯৮৪), মৃগয়ায় কালক্ষেপ (১৯৮৬), ত্রাহি। তবে কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ যেভাবে একজন রাজাকার চরিত্র রূপায়ণে সার্থক তেমন আর দেখা যায় না। ‘মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলো- রক্তকরোজ্জ্বল প্রাগ্রসর চেতনার দিকে যেখানে অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ অভিন্ন বোধের কেন্দ্রে মিলিত।’সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাসটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও বিহারিরা কেবল ঢাকা শহরে নয়, বাংলাদেশের মফস্বল শহর ও গ্রাম-গঞ্জে যে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে এবং বাঙালি নারীদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করেছে তারই শিল্পিত উপস্থাপন। বাংলাদেশের মফস্বল শহরগুলো পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হতে শুরু করে ২৫ মার্চের তিন-চার মাস পরে। তারা সমগ্র দেশে যে হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ চালিয়েছে তার চালচিত্র ঔপন্যাসিক জলেশ্বরীর আক্রমণের মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত করেছেন।নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১) মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ইতিহাস নয়, একটি খণ্ডিত অংশকে স্বল্প পরিসরে নিয়ে আসা হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, আখ্যানের সময়কাল মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি। ঢাকা থেকে বিলকিস তার নিজ গ্রাম জলেশ্বরীতে ফিরে আসে। পিতা-মাতা, ভাই হারানো বিলকিস দেখতে পায় জলেশ্বরীর বাজারে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ও তাদের দোসর বিহারিদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা। অসংখ্য লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বাজারে, তার মধ্যে বিলকিসের ভাই খোকনেরও মৃতদেহ রয়েছে। এক পর্যায়ে সিরাজের সহায়তায় বিলকিস মৃতদেহগুলোকে দাফনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এরই মধ্যে হানাদার বাহিনীর দোসর বিহারিদের দ্বারা ধৃত হয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে বন্দি হয়ে আসে। ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’তে(১৯৮৪) স্থানীয় এম.পি. হাফেজ মোক্তার স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির প্রতীক। যুদ্ধোত্তর তার হাতেই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মাজহার নিহত হন। ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ মূলত যুদ্ধ পরবর্তী জলেশ্বরীর কাহিনি যা সারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে।’সৈয়দ শামসুল হকের ‘অন্তর্গত’ (১৯৮৪) বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেনকে শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হয় স্বাধীনতাবিরোধীর হাতে। আকবর হোসেনের নামে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা গ্রামবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জুটমার্চেন্ট আব্দুর রহমান এবং তার সুন্দরী বান্ধবী শেফালী। ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ (১৯৯৮) বিস্তৃত পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি রূপায়িত হয়েছে। একইসঙ্গে প্রেম ও ইতিহাস একীভূত এর কাহিনিধারায়। ধার্মিক পরিবারের সন্তান মহিউদ্দিন পাকিস্তানি কুসংস্কার থেকে বের হয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। পক্ষান্তরে তার চাচা সৈয়দ আবদুস সুলতান মনে করে, মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রয়োজন ছিল না; এসব ভারতের কারসাজি। ‘না, যাব না। তোমাদের সব পাগলামি, তোমাদের ঈমান নষ্ট হয়ে গেছে, ইন্ডিয়ার সব প্রোপাগান্ডা, দেশের মিলিটারি নিরীহ মানুষ মারতে পারে না। এই জলেশ্বরীতে মিলিটারি যদি বন্দুক তোলেও- তাদের বন্দুক থেকে গুলি বেরুবে না। এটা কুতুব শাহের জায়গা, বড় মরতবার স্থান।’ঔপন্যাসিক এই ব্যক্তির কথার অসারতা প্রমাণ করেছেন। ইসলামের পক্ষে থেকেও সাধারণ মানুষকে পাক শাসক ও তাদের দোসররা ভুল বুঝিয়েছে। নির্বিচারে এদেশের মুসলমানদের হত্যা করেছে। এছাড়া ‘ত্রাহী’ উপন্যাসে স্বাধীনতা পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের চরিত্রসমূহের আচরণ গ্রামীণ পটভূমিতে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘এক মুঠো জন্মভূমি’ (১৯৯৭) মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন লেখক। অন্যদিকে ‘স্মৃতিমেধ’ (১৯৮৬) মুক্তিযুদ্ধোত্তর রাজাকার আব্দুস সবুরের সামাজিক প্রতিষ্ঠার চালচিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারী সূর্য’ (১৯৭৪) উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজধানী ঢাকা শহরের নয় মাসের নাভিশ্বাস জীবনচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সেসময় ঢাকায় থাকা একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন জীবনযাপনের কাহিনি বর্ণনার মধ্য দিয়ে লেখক রাজধানীর বাস্তবতা তুলে ধরেছেন; পাশাপাশি ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা তৎপরতা, বিহারিদের লুটপাট, অত্যাচার, রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পার্শ্ববর্তীদেশের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ততা ও বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকাসহ নানা আনুষঙ্গিক বিষয় উপন্যাসে অভিব্যক্ত। অন্ধ পাকিস্তানপ্রীতি সত্ত্বেও করিম সাহেবের বড় ছেলে খালেদকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় রাজাকারদের ক্যাম্পে। সে রাজাকারদের নির্যাতনে নিজের চোখ ও স্ত্রীর সম্ভ্রমের মধ্য দিয়ে তার পাকিস্তানকে ভালোবাসার ফল লাভ করে; উপলব্ধি করে বাঙালি হিসেবে তার আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার উপযুক্ত প্রতিদান কী ভয়ঙ্কর?
ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন ‘হাঙর নদী গ্রেনেডে’ (১৯৭৬) গ্রামীণ পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেছেন। ‘যুদ্ধ’ (১৯৯৮) উপন্যাসেও লেখক মুক্তিযুদ্ধকে অবলোকন ও কাহিনির সংস্থান করেছেন গ্রামীণ পটভূমিতে। একদিকে লেখকের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি, বাস্তববোধ, অন্যদিকে তাঁর কল্পনাশক্তি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার সমন্বয়ে ঔপন্যাসিক ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি সার্থক চিত্র উপস্থাপন করেছেন ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসে। অন্যদিকে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের সময় নয় মাস পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারের পাশাপাশি কিছু সংখ্যক সুযোগ সন্ধানী এদেশীয় দালাল ও হানাদার সৈন্যদের সহায়তা দানের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট শান্তিকমিটি, রাজাকারবাহিনী ও আলবদর বাহিনীর অত্যাচারের মাত্রা পাকিস্তানি সৈন্যদেরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দালালদের ব্যক্তিগত লালসা চরিতার্থ করা ও একইসঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের খুশি করার দিকটিও সার্থকভাবে উন্মোচিত হয়েছে নীতা বৈরাগিনীর উপ-কাহিনির মধ্যে। মূলত ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ১৯৪৭-এর বিভাগোত্তর সময় থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় পর্যন্ত পটভূমি বিস্তৃত। এই বিস্তৃত পটভূমিতে রাজাকার বাহিনীর হাতে কলীমের মৃত্যু ও ফুলির ধর্ষিত হওয়া দেখে স্বাধীনতার জন্য অজপাড়াগাঁয়ের বুড়ির মনে দৃঢ়প্রত্যয় জাগ্রত হয়। আখ্যানের বয়ানে বুড়ির সই বৈরাগিণী নীতার হার্দ্য জিজ্ঞাসা- ‘শান্তি বাহিনীর নামে ওরা মা বোনের সম্ভ্রম নিলো, ওরা এই মাটির শত্রু নয় শত্রু হলাম আমরা।’
হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামলছায়া’র (১৯৭৬) কাহিনিতে আত্মকথনের রীতিতে উঠে এসেছে রাজকারপ্রসঙ্গ ও মুক্তিবাহিনীর প্রতি গ্রামবাসীর ভিন্নতর মনোভাব। মিলিটারির ভয়ে মুক্তিবাহিনীকে গ্রামবাসীদের স্থান না দেয়া, নিতান্ত আর্থিক কারণে হানাদারদের সহযোগী রাজাকার বাহিনীর সদস্য হওয়াসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন চিত্র লেখক বিশ্বস্ততার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসে হাসান আলীর রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধায় রূপান্তরের উদাহরণ এরকম- ‘তখনও আমরার গ্রামের মধ্যে রাজাকার দল হয় নাই। আমরা হইলাম পরথম দল।…মিলিটারীরা যতন কইরা সব শিখাইল। তারাসব সময় কইত ‘তুম সাচ্চা পাকিস্তানী, মুক্তিবাহিনী একদম সাফা কর দো।’ মনডার মধ্যে শান্তি পাইনা। বুকটা কান্দে। রাইতে ঘুম হয় না।… মিলিটারী যা করে তাই করি। নিজের হাতে আগুন লাগাইলাম সতীশ পালের বাড়ী, কানু চক্রবর্তীর বাড়ি, পণ্ডিত সাহেবের বাড়ি। ইস্ মনে উঠলেই কইলজেটা পোড়ায়। শেষমেশ মিলিটারীরা শরাফত সাহেবের বড় পুলাডারে ধইরা নিয়া আইল। ছেলেটা আমার দিকে চাইয়া কইল-হাসান ভাই আমারে বাঁচান ক্যাপ্টেন সাহেবের পাও জড়াইয়া ধরলাম। লাভ হইল না। …আমি একটা কুত্তার বাচ্চা কিছু করবার পারলাম না।… সেই রাইতেই গেলাম মসজিদে। পাক কোরান হাতে লইয়া কিরা কাটলাম এর শোধ তেলুবাম।… এর শোধ না তুললে আমি বেজন্মা কুত্তা।’হুমায়ূন আহমেদের ‘সৌরভ’ (১৯৮৪)-এ ইজাবুদ্দিন শান্তিবাহিনীর একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। শফিকের কাজের লোক কাদের মিয়াকে একদিন মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যায়। শফিক তার এক পূর্ব পরিচিত ব্যক্তিকে দিয়ে পাকিস্তানি দালাল ইজাবুদ্দিনের মাধ্যমে কাদেরকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। অন্যদিকে ‘১৯৭১’ (১৯৮৬) উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি সৈন্যদের গ্রামে প্রবেশ ও হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা, রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা এবং মুক্তিবাহিনীর সংবাদ প্রভৃতি বিষয়গুলো ঔপন্যাসিক স্বল্পপরিসরে বিশ্বস্তভাবে চিত্রিত করেছেন। ১৯৭১ সালের মে মাসে সংঘটিত ঘটনায় ময়মনসিংহ জেলার নীলগঞ্জ গ্রামের সম্পদশালী মাতব্বর জয়নাল মিয়া পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগী হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি সৈন্যদের অকারণে হত্যা, ধর্ষণ ও এইসব বিকৃত রুচির সাক্ষী হয়ে থাকে তাদের বাঙালি সহযোগী রফিক। যদিও এই পাকিস্তানি দালাল চরিত্রটি ব্যতিক্রমী। সে মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে তোলে হানাদার বাহিনীকে। ফলে উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে দেখা যায় রফিককে হত্যা করতে বিলের ধারে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। একাত্তর সালে ক্ষমতাসীন শাসক ও হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মীয় দলগুলো- কনভেনশন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষ মদদে সৃষ্ট রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর চালিয়েছিল অত্যাচার, লুটতরাজ ও নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। হুমায়ূন আহমেদের ‘অনিল বাগচীর একদিন’ মুক্তিযুদ্ধকালীন এ ধরনের অপতৎপরতার বাস্তবতাকে ধারণ করে আছে। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ দশম পর্বে কবি শামসুর রাহমানকে বলেছে- ‘গ্রামে আপনার নিরাপত্তা নাই। শান্তিকমিটি আলবদর কত কিছু তৈরি হচ্ছে। কখন আপনাকে ধরে নিয়ে যায়- এইটাই আমার ভয়। এরা যদি ধরে নিয়ে যায় তার হিসাব থাকবে না। মিলিটারি ধরলে তার হিসাব থাকবে।’ নীলগঞ্জ থানায় একদল মিলিটারি অবস্থান কালে তাদের প্রধান ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ বাসেতের উদ্যোগে সেখানে স্থানীয়ভাবে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। মাওলানা ইরতাজউদ্দিন এর প্রেসিডেন্ট। কমিটির প্রধান কাজ শান্তি বজায় রাখা। শান্তিকমিটির আরেক চেয়ারম্যান হাশেম। এ উপন্যাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ৮ম খণ্ড থেকে নেওয়া ৩৩৩-৩৩৯। এক জায়গায় আছে- ‘পাকবাহিনী সোনাগাজী ও মতিগঞ্জে শিবির স্থাপন করিয়া স্থানীয় দালাল ও রাজাকারদের সহায়তায় শিবিরের আশেপাশের গ্রামগুলি আক্রমণ করিত।’
রশীদ হায়দারের ‘খাঁচায়’ (১৯৭৫), ‘অন্ধ কথামালা’ (১৯৮১), ‘নষ্ট জোছনায় এ কোন অরণ্য’ (১৯৮২) উপন্যাসত্রয়ে পাকিস্তানি দালাল চরিত্র আছে। ‘খাঁচায়’ উপন্যাসে ডিসেম্বরের ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর মাত্র তের দিনের কাহিনিতে পাকিস্তানি দালাল হিসেবে বিহারিদের অত্যাচার, ইসলামী ছাত্রসংঘসহ ডানপন্থী দলগুলোর কর্মকা- চিত্রিত হয়েছে। আর ‘অন্ধকথামালা’ উপন্যাসের কাহিনিতে দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধা বেলাল হোসেনকে (বেলু) গ্রামের শান্তিকমিটির লোকজন চোখ হাত পা বেঁধে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ তারা পাঁচ বন্ধু নওশের, গনি, কাসেম ও মোকসেদ মিলে পরিকল্পনা করেছিল হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর গ্রামে প্রবেশের একমাত্র সেতু বুড়িদ’র সাঁকোটি উড়িয়ে দেবে। পাবনা শহর পতনের পর হানাদার বাহিনী যে কোনো সময় গ্রামে প্রবেশ করতে পারে- কিন্তু তাদের এই গোপন পরিকল্পনাটি ফাঁস হয়ে যায়। চোখ-হাত-পা বাঁধা বেল্টু শত্রু সম্পর্কে ধারণা করতে পারে নি। কিন্তু একসময় তার বন্ধু মোকসেদ নিজেই পরিষ্কার করে দেয় তার বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এ দেশীয় সহযোগী শান্তিকমিটি ও রাজাকারবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তারই বন্ধু মোকসেদ। মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে ওরা বেল্টুকে তুলে দেয় গ্রামের শান্তিবাহিনীর সেক্রেটারি হান্নানের কাছে। অন্যদিকে ‘নষ্ট জোছনায় এ কোন অরণ্য’ উপন্যাসটি মূলত দুটি আলাদা কাহিনির সমন্বয়ে রচিত হলেও প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধ। অবশ্য ঘটনার সময়কাল ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি। এখানে অঙ্কিত হয়েছে যুদ্ধোত্তর কালে মুক্তিযোদ্ধাদের সীমাহীন হতাশা, অপ্রাপ্তি ও তার বেদনা, বিপথগামিতা এবং সর্বোপরি আর্থসামাজিক অবক্ষয়। উপন্যাসটি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের তৎকালীন সময় ও সমাজের নিখুঁত আখ্যান। তবে গুরুত্ব পেয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থান ও তাদের সুসংহত সামাজিক অবস্থান। সাবু গিয়েছিল তার আরেক বন্ধুর বাবার পাওনা টাকা ফেরত চাইতে। কিন্তু যে গুলিটা সাবুর গায়ে লেগেছিল সেটি এসেছিল বাড়ির ভেতর থেকে; ওই বাড়ির মালিক আকবরউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল একজন চিহ্নিত রাজাকার। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর আকবরউদ্দিনের মত স্বাধীনতাবিরোধী সুবিধাবাদী চরিত্রের লোকেরা নিজেদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে, প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন করেছে উপন্যাসে তা তুলে ধরা হয়েছে। আবার যুদ্ধকালীন বাস্তবতাও রয়েছে কাহিনিতে। শান্তিবাহিনীর সদস্য আব্দুল মান্নানের কথায় পাকিস্তানি দালালদের ভূমিকা উন্মোচিত হয়েছে এভাবে- ‘মেজর সাহেব তো পরিষ্কার বললেন, যারা পাকিস্তান রক্ষার জন্য কাজ করবে তাদের মালাউনদের ছেড়ে যাওয়া সমস্ত জমিজমা বাড়িঘর, টাকা পয়সা, মালমাত্তা সমান ভাগে ভাগ করে দেয়া হবে।’ অর্থাৎ উপন্যাসে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ-বর্ণনা না থাকলেও যুদ্ধের ভয়াবহতা ও বিভীষিকাময় রূপটি শান্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে লেখক তুলে ধরেছেন- ‘বাতাসে তাহলে সত্যিই লাশের গন্ধ ভাসমান? এই গ্রামের ফোরকান ঢাকা শহরের মিরপুর নামে কোন জায়গায় বিহারী এলাকায় হারিয়ে গেল, প্রাণের ভয়ে কয় পুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে হরিশ ঘোষ সরোজ ঘোষরা পালিয়ে গেল, সন্তান হারিয়ে বৌ হারিয়ে সিরাজ স্যার কয়েকদিনের জন্য এসে ইন্ডিয়া গিয়ে আর কোন খবর দিলো না, শহর থেকে অনেকগুলো পরিবার এসে ভীত আর শূন্য চোখ নিয়ে গ্রামে আর হাটে উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায়, এই, এই পর্যন্তই, এ ছাড়া গ্রামে এখনো মিলিটারীদের হামলা হয়নি, যা শোনা যায় সেই শান্তিকমিটির সদস্যদের শান্তির নামে অত্যাচার এখনো শুরু হয়নি, তা সত্ত্বেও কাশেমের মতো এখন আমি বুঝতে পারি, বাতাসে সত্যিই লাশের গন্ধ ভাসমান।’
কথাসাহিত্যিক মিরজা আবদুল হাইয়ের ‘তোমার পতাকা’ (১৯৮৪) উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে গ্রামে শান্তিকমিটি গঠিত হওয়ার কথা আছে। গাজীপুরের মফস্বল শহরে একসময় হানাদার পাকিস্তানি মিলিটারি প্রবেশ করে। গঠিত হয় শান্তিকমিটি। যথারীতি কমিটির চেয়্যারম্যান নিযুক্ত হয় আইনুদ্দিন এবং উঠতি ব্যবসায়ী তার ছেলে নুরুজ্জামান পাকিস্তানিবাহিনীর অন্যতম সহযোগীতে পরিণত হয়। একসময় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন চিকিৎসাকেন্দ্র ‘আরোগ্য কুটিরে’ ও হানা দেয়। ডাক্তার সুবলের অনুপস্থিতিতে নার্স লিলি বিশ্বাসকে সতর্ক করে দেয়া হয় যাতে কোন মুক্তিবাহিনীর সদস্য এখানে চিকিৎসা না পায়। লেখক মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর আক্রমণ ও নৃশংসতার বর্ণনার পাশে সহযোগী শান্তিবাহিনীর তৎপরতার পরিচয় দিয়েছেন পল্লির একটি চিকিৎসালয়কে কেন্দ্র করে।
মুক্তিযুদ্ধ ইমদাদুল হক মিলনের কথাসাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ। এখানে তাঁর দৃষ্টি ও ভাবনার জগত প্রসারিত; তাঁর উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধোত্তর হতাশামগ্ন সমাজের চিত্র একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস অন্বেষায় তিনি নির্মোহ। মূলত তিনি নিজ জীবনের অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যে উপস্থাপন করেছেন। ‘কালোঘোড়া’ (১৯৮১), ‘ঘেরাও’ (১৯৮৫), ‘দ্বিতীয় পর্বের শুরু’ (১৯৮৮), ‘রাজাকারতন্ত্র’ (১৯৮৯), ‘মহাযুদ্ধ’ (১৯৮৯), ‘বালকের অভিমান’ (১৯৯০), ‘একজনা’ (১৯৯১), ‘সুতোয় বাঁধা প্রজাপতি’ (১৯৯৮), ‘জীবনপুর’ (২০০৯) তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এসব উপন্যাসে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি, তাই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা করতে চেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ভিন্ন অনুসন্ধানী আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে উপন্যাসগুলোতে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস রচনার অভিজ্ঞতাকে ইমদাদুল হক মিলন বৃহৎ ক্যানভাসে বিশদ করে তুলেছেন সাড়ে তিন হাত ভূমিতে(২০১৫)। অন্যদিকে নয়মাসও(২০১৭) একটি অন্যতম উপন্যাস। নয়মাসের প্রথম অংশে আছে পাকিস্তানি কিশোরী মায়মুনা হায়দার খানের কাহিনি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুনে যে নিজে বদলে যায় আর পাকিস্তানে ফেরত যেতে বাধ্য করে পিতামাতাকে। মায়মুনার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে তার জবানিতে যথাক্রমে ‘আমি ও বাংলাদেশ’, ‘ইতিহাসের কয়েক পাতা’, ‘দ্বিতীয় পর্ব’, ‘হত্যাকাণ্ড ও নারী নির্যাতনের বিবরণ’, ‘আমার সিদ্ধান্ত’, ‘ক্ষমা করো, ক্ষমা করো’- এসব শিরোনামাঙ্কিত অংশে। নয়মাসের দ্বিতীয়াংশের নাম ‘ঘা’। পাঁচটি পরিচ্ছেদে লেখকের জার্মানি প্রবাসী বন্ধু মিনহাজের আগমনসূত্রে যে আত্মস্মৃতি প্রকাশ পেয়েছে তাতে বাংলাদেশের এগিয়ে চলার ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধে বীর সন্তানদের বিশেষত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে দরদের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’তে(২০১৫) উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই বর্ষাকাল থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণের কাছে দিশেহারা হানাদার বাহিনী। তাছাড়া নারী সমাজের একটি বড় অংশ অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছেন। রাজাকার, আলশামস, আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানিরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় গণহত্যা চালালেও ভারতের নানান ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে ক্রমাগতই মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিতে আক্রমণ চলছে। ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’ (২০১৫) উপন্যাসে রয়েছে পাকিস্তানিদের গণহত্যা, নৃশংসতা-নিষ্ঠুরতা, রাজাকারদের অত্যাচার, লুণ্ঠন। যুদ্ধ শেষে নায়ক রবিউল যখন বীরেরবেশে বাড়ি ফিরল তখন দেখল রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা মরণ কামড় দিয়ে গেছে তার পরিবারে। রবিউলের বাবার লাশ পড়ে আছে উঠানে, মায়ের লাশ বসার ঘরে, বোনের ছিন্নভিন্ন লাশ তার শোবার ঘরে, স্ত্রীর লাশ বাড়ির ভিতর দিকের উঠানে। এসব রচনাতে লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ অভিজ্ঞানের পাশাপাশি, মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর সময়কালের অস্থিরসময় এবং সমাজচিত্র যেমন ধরা পড়েছে তেমনি লেখক তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী ব্যক্তি মানুষের (অনেকাংশে তারুণ্যের) সঙ্কট ও হতাশার নানামুখী চিত্র। ইমদাদুল হক মিলনের ‘কালোঘোড়া’ উপন্যাসে শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান সিরাজের অপকর্ম ও তার করুণ পরিণতি দেখানো হয়েছে। এটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা; একটি গ্রামকে ঘিরে এর কাহিনি আবর্তিত। গ্রামের বেশকিছু তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, তারা গ্রামে এসে যাতে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে সেজন্য চেয়ারম্যান সিরাজ শান্তিকমিটি গঠন করে। পাকিস্তানি মিলিটারিদের প্রিয় পাত্র হয়। খোকার বাপ দফাদারসহ অনেককে ডেকে এনে শাসিয়ে দেয়। গ্রাম থেকে বহুদূরে ক্যাম্প পাকিস্তানি মিলিটারিদের, তবুও সিরাজ তাদের হয়ে অশান্তির মূল হোতায় পরিণত হয়। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা তরুণদের অবস্থান জানানো এবং সেই সংবাদ মিলিটারিদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ শান্তিকমিটির। মুক্তিযোদ্ধদের তথ্য জানার জন্য সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতন চালানো ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। কিভাবে তারা নারী নির্যাতন করেছে তারও একটি বিবরণ দেখা যায় ‘কালোঘোড়া’ উপন্যাসে। বাড়ি ঢুকে রতনলালের বোবা মেয়েকে ধর্ষণ করে সিরাজ। শান্তিবাহিনীর লোকেরা গ্রামের যুবক মুক্তিযোদ্ধা খোকা, কাদের, মনা ও আলমদের আশ্রয় দেবার অপরাধে রতনলালের কর্মচারি নয়নাকে ধরে এনে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে। তবে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামে এসেছে এ খবর পৌঁছাতে দিগলী গিয়ে সেখান থেকে ফেরার পথে তাদের হাতে মারা পড়ে চেয়ারম্যান। তাকে হত্যার মাধ্যমে এরা নিরপরাধ নয়না হত্যার প্রতিশোধ নেয়। অনেক ঘটনা ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তারা একসময় দেখতে পায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। ‘ঘেরাও’ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ না পাওয়া এক যুবকের অন্তর্দহন ও অপরাধবোধের গল্প। এ উপন্যাসের সময়কাল ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র বুলবুল একটি মফস্বল শহরের কলেজ পড়–য়া ছেলে। শহরের অধিবাসীরা পাকিস্তানি আর্মির ভয়ে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। যুদ্ধ শুরু হলেও সৈন্যরা এতদিন এই শহরে পা ফেলেনি। পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগী, কিছু রাজাকার আলবদর এবং শান্তিবাহিনীর অত্যাচার ও উৎপাত ছাড়া শহরের লোকজনের জীবনযাত্রা এতদিন স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু যেদিন মুক্তিবাহিনীর চোরাগোপ্তা আক্রমণে শহরের রেলস্টেশনের কাছে দু’জন রাজাকার নিহত হল, তার চারদিনের মাথায় পাকিস্তানি সৈন্যরা শহরের কলেজে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করল। ‘মহাযুদ্ধ’ (১৯৮৯) উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। সাধারণ ক্ষমার পর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর অনেকে মুক্তিবাহিনীর নামে ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাইয়ে যুক্ত হয়; দলে দলে মুক্তিবাহিনী সাজার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। হানাদার মুক্ত স্বদেশে কাদের, মজনু, হান্নান, দুলাল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে ডাকাতি করে বেড়ায়। কাদের মুক্তিযোদ্ধা নয় দালালি করেছিল পাকিস্তানি সেনাদের। পাড়ায় শান্তিবাহিনী করে টাকা কামিয়েছে। মাঝে মধ্যে অসহায় নারীদের সাপ্লাই দিয়েছে হানাদার বাহিনীকে। নিজেও সুযোগ পেয়ে ভাগ বসিয়েছে। তবুও মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। ‘মহা হারামী পোলা কাদের। মুক্তিবাহিনীতে যায়নি। মিলিটারিদের দালালি করেছে। পাড়ায় শান্তিবাহিনী করে টাকা পয়সা কামিয়েছে। মাঝে মাঝে মেয়ে সাপ্লাই দিয়েছে মিলিটারিদের। নিজেও ভাগটা নিয়েছে। তবুও দেখো কি রকম বেঁচে গেল মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে। স্বাধীন হওয়ার দু’চারদিন পরই দেখা গেলো দুলাল আর মজনুকে নিয়ে দিব্যি মুক্তিবাহিনী সেজে চক্কর খাচ্ছে পাড়ায়। ততদিনে লোকের মুখে রটিয়ে দিয়েছে শান্তিবাহিনীতে সে মুক্তিবাহিনীর লোক হয়েই কাজ করছিল। স্বাধীনতার পর দুলাল আর মজনুকে নিয়ে মুক্তিবাহিনী সেজে পাড়ায় চক্কর দেওয়া শুরু করে। প্রচার করে শান্তিবাহিনীতে সে মুক্তিবাহিনীর পক্ষেই কাজ করেছিল। ক্রমান্বয়ে দলে এসে ভিড়ল হান্নান, কাদের হল তাদের কমান্ডার। রাজাকার কাদের ভুয়া-মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার থেকে ডাকাতের কমান্ডারে পরিণত হল। স্বাধীনতার পরে হাজার হাজার রাজাকার এভাবেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজেছিল। গবেষকের ভাষ্য- ‘সুযোগ সন্ধানী সিক্সটিনথ ডিবিশন সৃষ্ট এই ব্যাধি অচিরেই সংক্রমিত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের মধ্যে। তারপর কে যে সিক্সটিনথ ডিবিশনের লোক কে যে মুক্তিযোদ্ধা আর কে যে দল পরিবর্তনকারী রাজাকার-সব যেন একাকার হয়ে এমন এক লুটপাটের রাজত্ব শুরু করে যে ঢাকা শহরে নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার সর্বাধিক জরুরি দায়িত্ব পালন ছাড়াও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়।’ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে কিছু ব্যতিক্রমী পাকিস্তানি খল বা দালাল চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এরা প্রাণের দায়ে রাজাকার হতে বাধ্য হয়েছিল। মনে-প্রাণে হানাদার বাহিনীর কর্মকা-কে সমর্থন করেনি। যেমন, ইমদাদুল হক মিলনের ‘জীবনপুর’ (২০০৯) উপন্যাসের কয়েকটি রাজাকার চরিত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। উপন্যাসের আখ্যানে আমরা দেখতে পাই, রাজাকার কেরামত আলী, ফজল আলীরা ঘোষণা করেছে যাদের ঘরে চারজন পুরুষ আছে তাদের দুজনকে অবশ্যই রাজাকার হতে হবে। সেজন্য অনেকে পাকিস্তান প্রীতিতে, অনেকে প্রাণের ভয়ে রাজাকারিতে যোগদান করে। যারা প্রাণের ভয়ে রাজাকারিতে যোগ দিয়েছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছিল। কেউ অস্ত্রসহ পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়, কেউবা পাকিস্তানি মিলিটারিদের গতিবিধি লক্ষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিত। ফলে পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য আক্রমণের খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পারতো ও সুযোগ বুঝে আক্রমণও করতে পারত। যেমন, ক্যাম্পের আর্মিদের সকল খবর রাজাকাররা যোদ্ধা লালকে বলে দেয়। লাল সেখানকার খবর পাচার করে জব্বারের কাছে। তবে লাল একদিন আর্মিদের হাতে ধরা পড়ে। আবার দেখা যায় ঈশ্বরগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালাতে পারে কোনো দিন- এই ভয়ে রাজাকাররা পালাতে শুরু করে। রাজাকারদের সহায়তায় ঈশ্বরগঞ্জ বাজারে হামলা চালিয়ে হানাদার বাহিনী আওয়ামীলীগের ছোটবড় নেতাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। গ্রামের চেয়ারম্যান ফজল আলী, তার ভাই কেরামত আলি, টাকি মোল্লা প্রভৃতি ব্যক্তি শান্তিকমিটি গঠন করে এবং নিজেরা বড়লোক হতে থাকে। নিজ দেশের মানুষের সঙ্গে তারা বেঈমানি করে। পাকিস্তানি মিলিটারি নরপশুগুলোর চেয়েও তা ছিল নিকৃষ্ট। যুদ্ধ শেষে রাজাকার টাকি মোল্লাকে জনসমক্ষে গুলি করে হত্যা করা হলেও বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর দেশের ক্ষমতায় যাঁরা আসীন হয় তারা মূলত ছিল পাকিস্তানের দোসর। তাই পাকিস্তান আমলেই মানুষ সুখে ছিল এমন একটি সুখচিত্র নির্মাণের জন্য চরিত্র সৃজন করা হয়েছে কাহিনিতে। দেশ চলে যায় রাজাকারদের হাতে। ইমদাদুল হক মিলনের দীর্ঘ উপন্যাস ‘সুতোয় বাঁধা প্রজাপতি’তে (১৯৯৮) মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিতা চম্পার জীবনের কথা ব্যক্ত হয়েছে। এ আখ্যানে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মিলিটারি ও রাজাকার আলবদরদের হাতে আটক হওয়া নারীরা অসহায়, নিপীড়িত। রাজাকার আলবদররা গ্রামে গ্রামে ঘুরে সুন্দরী যুবতী মেয়েদের সাপ্লাই দিত মিলিটারি ক্যাম্পে। নিজেরাও ভাগ বসাতে দ্বিধা করত না। ‘আমাদের এই মা বোনেরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও তারা কিন্তু পাকিস্তানি এবং কিছু সংখ্যক বিপথগামী কুলাঙ্গার বাঙালিদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে। এতে প্রায় দুই থেকে চার লাখ নারী তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। পাকিস্তানিরা তো জানত না যে, কোন বাড়িতে অপ্রাপ্ত বয়স্কা মেয়েরা ও মা বোনেরা আছে। এ কাজে পাক হায়েনাদের সহযোগিতা করেছে সেই সব রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।’ নির্যাতিত নারীরা কেউ কেউ মারা যেত, যারা বেঁচেছিল অধিকাংশ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলত। এমনি এক ভারসাম্যহীন নারী চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে এ কাহিনি। উপন্যাসে শান্তিকমিটি ও আলবদর বাহিনীর তৎপরতা আরো আছে ইতনা স্কুল চত্বরে তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হওয়ার খবর প্রদান ও সেখানকার গণহত্যা সংঘটনের মধ্যে।
ইমদাদুল হক মিলনের ‘রাজাকারতন্ত্র’ (১৯৮৯) উপন্যাসটি উত্তম পুরুষে রচিত পাকিস্তানি দালালদের পরিপূর্ণ বয়ান। প্রধান চরিত্র ওহাব। সে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার দলে যোগ দেয়। স্বাধীনতা বিরোধী হয়েও প্রাণে বেঁচে স্বাধীন বাংলাদেশে শেকড় গেড়ে বসে। যুদ্ধের সময় পুরান ঢাকার একটি থানার শান্তিমিটির চেয়ারম্যান ছিল ওহাব। নিজবাড়িতে তার অফিস। বাড়ির একটি হল রুমে বসে সে মিটিং করে। আলবদর, আলশামস, রাজাকার বাহিনীর লোকেরা তার সঙ্গে পরামর্শ করতে আসে। সারাদিন তার ঘরের বাইরে যেতে হয় না। প্রথম প্রথম নিকটস্থ মিলিটারি ক্যাম্পে যেত, কিন্তু পরবর্তীতে আর্মি অফিসারই তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। মাঝে মাঝে সে তার দলবল নিয়ে বের হয়, সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেয় এবং দলভারি করার প্রচেষ্টা চালায়। নয়ন নামের এক মুক্তিযোদ্ধা যুবক ট্রেনিং শেষে গোপনে বাড়ি এসে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। ওহাবের কাছে নিয়ে আসা হয় তাকে। ওহাব তাকে পাকিস্তানি মিলিটারিদের হাতে তুলে দেয়। মিলিটারিদের জিপে উঠার সময় এক দলা থুথু মেরে দেয় ওহাবের মুখে। এভাবে সংশপ্তক যোদ্ধারা রাজাকারদের বিরুদ্ধে সুযোগ পেলেই প্রতিবাদ করেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস নানা অপতৎপরতায় সময় পার করলেও ১৫ ডিসেম্বর সে নিশ্চিত হয় যে পরাজয় আসন্ন, তখন জীবন বাঁচানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘটনাক্রমে সে বেঁচে যায় এবং ১৯৭৫ সালের পর শত শত রাজাকারের মতো সেও সমাজে আধিপত্য কায়েম করে। রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা পায় রাজাকারতন্ত্র। ওহাবের নিজের চরিত্র ও রাজাকারদের চরিত্র ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে। রাজাকাররা বাংলাদেশে আবার কিভাবে সংগঠিত হয়েছে, তাদের কর্মতৎপরতা, সাংগঠনিক শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি, মানসিক শক্তি প্রভৃতি উপস্থাপিত এ উপন্যাসে।
স্বাধীনতার পরে রাজাকাররা সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় হয়ে উঠে; বিস্তার করতে থাকে ষড়যন্ত্রের জাল। এরকম একটি কাহিনি নিয়ে আবর্তিত হয়েছে ‘দ্বিতীয় পর্বের শুরু’ (১৯৮৮)। সাধারণ ক্ষমা রাজাকারদের জন্য একটি বড় আশীর্বাদ ছিল। বঙ্গবন্ধুর নেওয়া সিদ্ধান্তের সঙ্গে ক্ষমার একটি প্রবাহ চলছিল সারা বাংলাদেশ জুড়ে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের কমান্ডাররাও নানা অজুহাতে রাজাকারদের ক্ষমা করতে থাকেন। এ ক্ষমার মাশুল বঙ্গবন্ধুকে যেমন সপরিবাওে নিহত হয়ে দিতে হয়েছিল, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকেও নানাভাবে এ মাশুল দিতে হয়েছে। যারাই ক্ষমা পেয়েছে এবং যার কাছ থেকে ক্ষমা পেয়েছে তারই ক্ষতি করেছে। রাজাকাররা চির অকৃতজ্ঞ। দ্বিতীয় পর্বের শুরু উপন্যাসে মাজেদ মিয়া ১৯৭১ সালের রাজাকারদের একটি প্রতিনিধি চরিত্র। এলাকায় শান্তিকমিটি গঠন করে সে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা করে। তার কারণে সৈনিকরা সরাসরি গ্রামে না এলেও যে সমস্ত সন্তান মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে তাদের বাবা মা, ভাই-বোনদের ধরে নিয়ে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ সহ নানা অপকর্ম করত। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে লুটপাটও তারা করত। আশেপাশের বেশ কয়েক গ্রামে মাজেদ মিয়ার ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। যুদ্ধের সময় মাজেদ মিয়ার নামে সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত্র ছিল। আসলে মুক্তিযুদ্ধে রাজাকাররা হেরে গিয়ে আবার এক যুদ্ধে নামে, সে যুদ্ধ কৌশলের যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা সরল, আবেগী, দয়ার্দ্রচিত্ত হওয়ায় মাজেদের মত লোকদের কাছে বারবার হেরে যায়। সম্মুখ যুদ্ধে রতন সেরা হলেও কৌশল যুদ্ধে মাজেদ মিয়াদেরই জয় ঘোষিত হয়। মাজেদ মিয়া যুদ্ধের সময় এলাকায় শান্তিকমিটি গঠন করে। মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর সে পাকিস্তানি ক্যাম্পে সরবরাহ করত। যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি অক্ষুণ্নই রয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাধারণ ক্ষমাই গ্রাম-গঞ্জে, আনাচে-কানাচে এ বিষবৃক্ষগুলোকে রক্ষা করেছিল। তার প্রতিফলও পেতে হয়েছে। মাজেদ মিয়া এতটাই অকৃতজ্ঞ যে সে নিজের জীবন দাতাকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জেলে ঢোকাতে দ্বিধা করেনি।
কথাশিল্পী মঈনুল আহসান সাবের পাকিস্তানি দালাল চরিত্র রূপায়ণে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে- পাথর সময় (১৯৯০), সতের বছর পর (১৯৯১), কবেজ লেঠেল (১৯৯২), ফিরে আসা (১৯৯৯) প্রভৃতি। তাঁর উপন্যাসে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে স্বৈরশাসক নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধাদের হেয়প্রতিপন্ন করা ও পাকিস্তানি চেতনার পুনর্জাগরণ চিত্র বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পরাজয় (১৯৯০), কেউ মানে না (১৯৯০), সতের বছর পর (১৯৯১) উপন্যাসগুলোতে একাত্তরের পরাজিত শক্তির পুনরুত্থান, মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায় অবস্থাও চিত্রিত।
পাকিস্তানি দালাল তথা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শ্রেণির ক্ষমতাবান সামাজিক শক্তি হয়ে ওঠার কাহিনি রয়েছে পাথর সময় (১৯৮৯) উপন্যাসে। বিডি, রফিক আখন্দ প্রভৃতি চরিত্রের বর্তমান অবস্থান ও পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এভাবে— ‘বিডি পুরানো বন্ধু, আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মতো। সেই একাত্তর সালে একই লাইনে কাজ করতে গিয়ে পরিচয়।… কোন ফিক্সড চাকুরী কিংবা ব্যবসা কোনটাই নেই বিডির। একাত্তর সালে পাক-আর্মির সঙ্গে ঘেঁষটিয়েছে। বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে বিভিন্ন ধরনের সাপ্লাই দিয়ে মোটা পয়সা কামিয়েছে। ‘বিডি’ ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানি আর্মিদের লালসা নিবৃত্তের জন্য বাঙালি নারী যোগান দিত, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারি, স্বাধীন বাংলাদেশের পরিবর্তিত সামাজিক কাঠামোয় তারা আজ ক্ষমতাবান। গ্রামেও ‘বিডি’র বন্ধুর দাপট চিত্রের রূপায়ণ— ‘আখন্দ ’৭১ সালে পাকিস্তানীদের দালালী করেছে। শান্তিকমিটির মেম্বার ছিল। অবশ্য ৭২-এর শেষ থেকেই সে জোর গলায় বলতে আরম্ভ করেছে- ঠিকই করেছে সে। সে না থাকলে পাকিস্তানীরা ধ্বংস করে দিত এগ্রাম। সে যা করেছে তা গ্রাম আর গ্রামবাসীদের বাঁচানোর জন্যই করেছে। এমন কথাই শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল। সুতরাং ’৭১-এর রফিক আখন্দ চেয়ারম্যান, দু’তিন বছরের মধ্যে আবার সেই চেয়ারম্যান।’ বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ; তারই চাচাতো ভাই ‘সে’ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদকে উদ্দেশ্যে করে ‘সে’র ছেলে ইস্তিয়াকের উক্তি— ‘দেশের জন্য যুদ্ধ করলে তুমি-কিন্তু পেলে না, কেউ তোমাকে মনে রাখলো না। আর বাবাকে দেখ, তোমাদের বিপক্ষে কাজ করেও সে এখন কোথায়, হিজ পাওয়ারফুল নাউ, রিয়েল পাওয়ারফুল।’ অথচ একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদের ভাই বলেই প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল ইস্তিয়াকের বাবা। উপন্যাসে স্বাধীনতাবিরোধী ‘সে’ চরিত্রের সন্তান রুম্পা ও শম্পার নৈতিকতাহীন জীবনাচার, পুত্র ইস্তিয়াকের মাদকাসক্তি স্বয়ং তাদের পিতার মদ্যপান ও বাড়িতে বসে নীলছবি দর্শন প্রভৃতি চিত্রগুলি পাকিস্তালি দালাল চরিত্রের ক্ষয়িষ্ণু পরিণতি।
মঈনুল আহসান সাবেরের ‘সতের বছর পর’ (১৯৯১) উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম রব্বানির মুক্তিযুদ্ধের সতের বছর পর ঢাকায় ফিরে আসার কাহিনি। রব্বানি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকার তথ্য মন্ত্রণালয়ে সরকারি চাকরি করতো। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী ও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী রব্বানি নভেম্বর মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, নিরীহ বাঙালিদেরকে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। গোলাম রব্বানির সঙ্গে ব্যবসা করে আবদুল্লাহ সাঈদের কথামতো তার ব্যবসায়িক পার্টনার স্বাধীনতাবিরোধী বিডিরা। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামোয় মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবর্তে তার মতো একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তি ও ব্যক্তিবর্গেরই প্রবল প্রতিপত্তি জয়জয়কার। একসময়ের গোলাম রব্বানির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও কলিগদের অনেকেই সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা ও সচিবের পদে আসীন, এমনকি কেউ কেউ আবার মন্ত্রীর পদও অলংকৃত করেছেন। বাংলাদেশে এসে গোলাম রব্বানির উপলব্ধি— এক সময় যে এলাকাতে রব্বানির বসবাস ছিল, ঢাকা শহরের সেগুনবাগিচায় যে বাড়িটায় সে বসবাস করত তার পাশের বাড়ির বড় ছেলেকে মুক্তিবাহিনীর সদস্য বলে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল যে রব্বানী; সেই বাড়িতেই পায় আন্তরিক অভ্যর্থনা। এই উপন্যাসে সে ও বিডি চরিত্রের পরিচয় হলো বাঙালি হয়েও তারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। একাত্তরে কৃত অপরাধের জন্য তাদের কোন অনুশোচনা বা গ্লানিবোধ নেই। বাঙালিদের দেশচালনা নিয়ে বিডির বন্ধু ‘সে’ কটাক্ষ করলে বিডির উক্তি— ‘বাঙালীরা দেশ চালাচ্ছে বলেই না তুই এত ওপরে উঠতে পেরেছিস। সেভেন্টি ওয়ানে দালালী করেছিলি পাকিস্তানীদের পক্ষে, বাঙালীদের বিপক্ষে। দেশ স্বাধীন করে বাঙালীরা উল্টো তোকে তোর দালালীর জন্য রিওয়ার্ড দিয়ে এত উপরে তুলেছে। শালা, তোর কি মিনিমাম কৃতজ্ঞতাবোধও নেই?’ এদের কৃতজ্ঞতাবোধ তাদের প্রভু, পাঞ্জাবিদের প্রতি, এদের প্রভুভক্তি পোষাপ্রাণীকেও হার মানায়। তাইতো উপন্যাসে দেখা যায় স্বাধীনতাবিরোধী, বর্তমানে নারী পাচারকারী গডফাদার ‘সে’ চরিত্রের সদম্ভ উচ্চারণ- মাস দুয়েক আগে সে শেষ চালান পাঠিয়েছে পাকিস্তানে। জনা তিরিশেক মেয়ে, বারো থেকে তিরিশ বছরের মধ্যে ; একটা ব্যাপারে সে বেশ গর্ব অনুভব করে। একাত্তর সালে সে মূলত যে কাজ করতো, এখনো তার মূল কাজ বলতে গেলে সেটাই। একাত্তর সালে সে মেয়ে পাঠাতো পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষায় ব্যস্ত সেনা অফিসারদের। অভাবের তাড়নায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পিওনের চাকুরি করছে রাজাকারের অফিসে। ‘ফিরে আসা’ (১৯৯১) মঈনুল আহসান সাবেরের যুগল উপন্যাস একই মলাটের অন্তর্ভুক্ত দু’টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাহিনীর সংকলন। একটির নাম স্বজন অপরটি কেউ জানেনা। স্বজন এর কাহিনিও পূর্ববর্তী সতের বছর পর উপন্যাসের অনুরূপ। এখানেও দেখতে পাওয়া যায়, বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পালিয়ে যাওয়া একজন পাকিস্তানি নাগরিকের বিশ বছর পর বাংলাদেশে ফিরে আসার কাহিনির মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানি নাগরিকদের মনস্তত্ত্ব, স্বাধীনতাবিরোধীদের সামাজিক উত্থান, বাঙালিদের পাকিস্তানপ্রীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপর্যয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা এবং হানাদারবাহিনীকে সহযোগিতা করার কারণে যাকে একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসে পালিয়ে যেতে হয়েছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে; স্বাধীনতার দুই দশক পরে তাকেই আবার বরণ করে নিল এলাকার বাঙালি প্রতিবেশীরা পরম মমতায়, ভালোবাসায়, একান্ত স্বজনের মতো। আশে পাশের কেউ কেউ দুঃখ প্রকাশ করল তার বাসার মালপত্র লুঠ হয়ে গেলেও তারা কিছু করতে পারেনি বলে। মহল্লার লোকদের আন্তরিক অভ্যর্থনা ও সাদর সম্ভাষণে সে বিস্মিত ও নিশ্চিত হয়, একাত্তরে কৃত অপরাধ, পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে তার সখ্য ও সহযোগিতা এরা বিস্মৃত হয়েছে। আলোচ্য উপন্যাসেও স্বাধীনতাবিরোধী ‘বিডি’ চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষণীয়। ঔপন্যাসিক এই ‘বিডি’ চরিত্রটিকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন উপন্যাসে নানাভাবে বিকশিত করেছেন। জমির দাবিদার রহমত আলীকে সাহানার সামনে হাজির করে বিডি এবং তাকে মাফ চাইতে বাধ্য করে ও ভবিষ্যতে জমি নিয়ে আর কোন ঝামেলা করবে না বলেও প্রতিশ্রুতি আদায় করে। বিডির এধরনের ক্ষমতায় সাহানা বিস্মিত হয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় বিডি ছিল সরাসরি পাকিস্তানিদের পক্ষে। শুধু পক্ষে নয়, তাদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে ছিল সে। সাহানা পরে শুনেছে তার নানা অপকীর্তির কথা। মারুফের বন্ধু, সহযোদ্ধারা বলেছে, খবরের কাগজেও তার ছবি ছাপা হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাদের সব ধরনের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করে দেয়া আর চাহিদা মেটানোর জন্য বিডি ছিল সদা তৎপর। আর তার কাজ ছিল পাকিস্তানিদের কাছে প্রয়োজনীয় খবর সরবরাহ করা। এই বিডির ক্ষমতার উৎস ও বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে সাহানা কিছুই আঁচ করতে পারে না কিন্তু সে বুঝতে পারে বিডির জন্যই মারুফের কেনা জমিটি রক্ষা পেয়েছে। ঔপন্যাসিক মঈনুল আহসান সাবের ‘ফিরে আসা’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দুটি ভিন্ন কাহিনির সমন্বয়ে তুলে ধরেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে মু্ক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তিসমূহের উত্থানপর্ব, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্তি এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অসহায়ত্বের চালচিত্র।
পাকিস্তানি দালালরা কিভাবে ভোল পাল্টিয়ে যুদ্ধশেষে কিছু অসৎ রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের সহায়তায় আবারো সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পক্ষান্তরে হারেস মাস্টারের মতো মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে স্বাধীনতার পর অবহেলিত ও এসব অপশক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিল তার অনন্য উদাহরণ কবেজ লেঠেল (১৯৯২) উপন্যাস। ‘জিয়াউর রহমানের পরে জেনারেল এরশাদ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে এবং পরে দেশের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের সহায়তায় রাষ্ট্রপতি হয়ে তার পুরো শাসনামলে প্রথমত সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম করেন যার ফলে দেশে মৌলবাদীদের ছায়ায় এতকাল বেড়ে ওঠা যুদ্ধাপরাধীদের চারাগাছ মহীরুহ হয়ে উঠার সুযোগ পায়।’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কবেজ গ্রামের মাতব্বর আকমল প্রধানের ভাড়াটিয়া লেঠেল এবং একজন পেশাদার খুনী। গ্রামের আরেকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি রমজান শেখ। একদিন গ্রামেও মিলিটারি প্রবেশ করে। আকমল প্রধান ও রমজান শেখের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সৈন্যরা শুরু করে গ্রামে অত্যাচার, লুটপাট, নারী নির্যাতনসহ নানা অপকর্ম। পাকিস্তানি সৈন্যদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় এই দু’জন। কবেজও এই সমস্ত কাজে আকমল প্রধানের বিশ্বস্ত সঙ্গী। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী কর্তৃক অকারণে গ্রামের নিরীহ মানুষ হত্যা ও অত্যাচার পুরোপুরি সমর্থন করতে পারে না কবেজ। এগুলো তার কাছে নিরর্থক মনে হয়। সে নিজে খুনী হলেও কারণ ছাড়া মানুষ খুন করে না। কিন্তু কবেজ লক্ষ করে পাকিস্তানি সৈন্যরা অকারণেই মানুষ হত্যা করছে। এ কারণে ধীরে ধীরে পাকিস্তানি সৈন্য ও আকমল প্রধানের উপর কবেজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আকমল প্রধান কবেজকে দিয়ে কৌশলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রমজান শেখকে খুন করে। খুনের ঘটনাটি মুক্তিবাহিনীর উপর চাপিয়ে দেয়। বিষয়টি বুঝতে পেরে কবেজ আকমল প্রধানকেও খুন করতে যায়, কিন্তু ব্যর্থ হয়। কবেজ পালিয়ে সীমান্তের ওপারে চলে যায়। সেখানে তার গ্রামেরই মু্ক্তিযোদ্ধা স্কুলমাস্টার হারেছের সহায়তায় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে তার নিজ গ্রামে কবেজ ফিরে এসে দেখতে পায় তার কোন আশ্রয় নেই, কাজ নেই। পুরোনো প্রভু আকমল প্রধান যুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার কারণে এখন পলাতক। অন্যদিকে সুযোগ বুঝে পলাতক আকমল প্রধান ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সমঝোতা করে এক সময় গ্রামে ফিরে আসে। চতুর আকমল প্রধান স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে তার হৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও পূর্বের অবস্থানে ফিরে যেতে সক্ষম হয়। নিজের প্রয়োজনেই আকমল একদিন কবেজকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। কবেজ যে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং আকমলই তাকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিল কৌশলে গ্রামে এটি প্রচার করে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় রচনা ঔপন্যাসিক শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ (১৯৯৪)। আখ্যানে মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকারদের পৈশাচিকতার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় দেড় দশক পর লেখক উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আব্দুল মজিদের স্মৃতিচারণার অন্তরালে তুলে ধরেছেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হত্যা, নির্যাতন, নৃশংসতা এবং সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ চিত্র। ২৫ মার্চের পর থেকে সমগ্র লক্ষ্মীবাজার এলাকায় দু’জন লোকের মাত্র উপস্থিতি ছিল। এদের একজন বদু মাওলানা। অন্যজন এলাকার প্রবীণ মুসলমান খাজা আহমেদ আলী যাকের শেষপর্যন্ত মসজিদে আজান দেয়া অবস্থায় বদু মাওলানা ও তার লোকজনেরা হত্যা করেছিল। হিন্দু বাড়িগুলো ২৫শে মার্চের পর জনশুন্য হলেও সেগুলি আর কখনো পূর্বতন অধিবাসীদের দ্বারা পূর্ণ হয়নি, এমনকি ১৬ ডিসেম্বরের পরেও। পাঠক মজিদের স্মৃতির অনুষঙ্গে আরো অবগত হয় কিভাবে ২৫ মার্চের কালোরাত্রির পর বদু মাওলানা বদলে যায়— এবং সে পুরো মহল্লার শত্রু হয়ে যায় একাত্তর সনে নয়াবাজারের লেলিহান আগুনে আকাশ জ্বলে ওঠার পরের দিনগুলোতে। তখন সে হঠ করে কাঁধের ওপর কালো কালো খোপ খোপ চেকের স্কার্ফটি ফেলে এগিয়ে আসে এবং মহল্লার লোক পাঞ্জাবী মিলিটারির পাশে তাকে দেখে বুঝতে পারে না সে বাঙালি কিনা এবং লক্ষ্মীবাজারে যারা শেষপর্যন্ত টিকে থাকে তারা পুরোটা বছর তার কাক ওড়ানো দেখে।— এভাবে উপন্যাসে লেখকের অনন্য বর্ণনার ভেতর দিয়ে উন্মোচিত হতে থাকে পাকিস্তানি সৈন্যদের পাশাপাশি, বাঙালি হয়েও বাঙালিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার কাহিনি। রাজাকার বাহিনী কর্তৃক আব্দুল মজিদের বোন মোমেনাকে অপহরণ পরবর্তী ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যা, ৩১শে ডিসেম্বর ধরা পড়া রাজাকার আব্দুল গণির স্বীকারোক্তি, বদু মাওলানার নিদের্শে লক্ষ্মীবাজার ও তার আশেপাশে অসংখ্য মানুষকে জবাই করে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার লোমহর্ষক বিবরণ, লুটপাটসহ অসংখ্য নির্যাতনের বিবরণ রয়েছে আখ্যানে। উনিশশো একাত্তর সাল অতিক্রান্ত হলেও বদু মাওলানা এবং তার দল, সেই দলের আদর্শ ও রাজনীতি এখনও যে সমান মাত্রায় ক্রিয়াশীল, এই সহজ সত্যটা আব্দুল মজিদ উপলব্ধি করতে সক্ষম।
মাহবুব তালুকদারের ‘বধ্যভূমি’ (১৯৯৭) উপন্যাসটির মাসুদ জানে যুদ্ধের সময় আব্বাস রাজাকার হিসেবে পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। অথচ যুদ্ধশেষে সুযোগ বুঝে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিয়ে দোকান লুট করছে। আব্বাস কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হল মাসুদের প্রশ্নের জবাবে আব্বাসের উত্তর- আমি তো প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধা। অতিশয় সাবলীল কণ্ঠে বলে গেল আব্বাস। মাঝখানে অবশ্য রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছিলাম। সবাই তো অরিজিন্যাল মুক্তিযোদ্ধা হয়ে রাজাকার সেজে থাকার সুবিধা কত ! তলে তলে রাজাকারদের সব এ্যাকশন ফাঁস করে দিতাম মুক্তিবাহিনীর কাছে। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবুবকর সিদ্দিকের ‘একাত্তরের হৃদয়ভস্ম’ নব্বইয়ের দশকের একটি উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস এবং বাংলাদেশের উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। উপন্যাসে একাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক গতিধারা, সামরিক শাসনসৃষ্ট অপরাজনীতির কারণে স্বাধীনতাবিরোধীদের সামাজিক প্রতিপত্তি ও উত্থান, সমকালীন বামরাজনীতির গতি প্রকৃতি বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইদ্রিস ইজেদ্দার ছিল সবচেয়ে বড় রাজাকার ও পাকিস্তানিদের সহযোগী দোসর; অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী। ক্ষমতাসীন স্বৈর শাসকের তৈরি দলের সমর্থক ও তার এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি। পাকিস্তানি দালালের নির্মম আচরণের অসাধারণ চিত্রণ রয়েছে উপন্যাসটিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইদ্রিস ইজেদ্দার ছিল সবচেয়ে বড় রাজাকার ও পাকিস্তানিদের সহযোগীদোসর; অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী। বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ও এই এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি। কিভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্রে একটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমাগত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছেন এবং এই কর্মের মূল হোতা উপজেলা চেয়ারম্যান ইদ্রিস ইজেদ্দার যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে- তার বিবরণ অসাধারণ। এখানকার অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা কিভাবে এদের পর এক চেয়ারম্যান ইদ্রিস ইজেদ্দারের প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত হয়েছেন তার প্রমাণ মেলে মুক্তিযোদ্ধা আওয়ালকে খুনের মামলার আসামি হিসেবে থানায় ধরে এনে নির্যাতন করার চিত্রের বর্ণনায়। উপমহাদেশ (১৯৯৩) এক অর্থে কবি আল মাহমুদের আত্মজৈবনিক উপাখ্যান। একাত্তর সালে ক্ষমতাসীন শাসক ও মিলিটারি তাদের এদেশীয় দোসরসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর চালিয়েছিল নির্যাতন-নিপীড়ন- তার নিবিড় বিবরণ আছে এ উপন্যাসে। মাহবুব সাদিকের ‘বারুদগন্ধ দিন’ উপন্যাসটি ১৯৭৩ সালে রচিত। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর দালাল-রাজাকারদের হত্যাযজ্ঞ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের বিবরণ লিপিবদ্ধ। কেন্দ্রীয় চরিত্র বামপন্থি মানস ঢাকা থেকে এক পাহাড়ি অঞ্চলের কুমারপাড়ায় এক মুক্তিযোদ্ধা যুবকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে একটি ব্রিজ অপারেশনের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মুক্তিযোদ্ধা যুবকটি নিহত হলে পাড়ার লোকজনকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে মানস তাদের সংগঠিত করে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য। হানিফ, আনজা নামের দালাল-রাজাকাররা তার বিরোধিতা করলে সংঘর্ষ বাধে। হানিফ ধরা পড়ে আর আনজা পালিয়ে গিয়ে শহর থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে আসে। ফলে প্রতিরোধ যুদ্ধে মানস মারা যায়। আপাতদৃষ্টিতে পাকিস্তানি দালালদের জয় ঘোষিত হলেও বিজয়ের ছবি ভেসে উঠেছে। বেগম জাহান আরা রচিত ‘অয়নাংশ’ (১৯৮৩) উপন্যাসের সালাম ও জমিলা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্র। সালামের চাচা শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান। সালাম দেশের মাটি ছুঁয়ে তাকে হত্যার শপথ গ্রহণ করে। অপরদিকে জমিলার স্বামী পাকিস্তানি বাহিনীর দালাল হওয়া সত্ত্বেও সে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় কামনা করে। অর্থাৎ দালালরা কেউ কেউ ব্যতিক্রম ছিল এই চিত্র আখ্যানে ব্যক্ত হয়েছে। খুরশীদ আলমের ‘দাহ’ (১৯৯৭) উপন্যাসে আছে স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনরুত্থান ও রাষ্ট্রক্ষমতায় পুনর্বাসন। এই উপন্যাসে এক সময়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা সবুর কৃষকের সন্তান। যুদ্ধশেষে সরকারি আহবানে অস্ত্র জমা দিলেও গ্রামের স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্তে বাড়িতে অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে সবুর কারাবরণ করে। একদিন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ও গ্রামের স্বার্থান্ধগোষ্ঠী হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধা রতনকে। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতে রতনের নিহত হওয়ার মধ্যে দিয়ে এই সত্যই প্রকট হয়ে উঠল- যারা মুক্তিযুদ্ধের দালালি করল তারাই বহাল তবিয়তে আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের খবর কেউ রাখে? রাজনীতিতে তাদের নামটা ব্যবহার করা ছাড়া তাদের কেউ খোঁজ নেয় না।… তিনদিন যাবৎ খুন হল, কই পুলিশ-মিলিটারি, গ্রামবাসী কেউই খুনীদের খুঁজে বের করতে পারল না। তবে কি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আবেদন নিঃশেষ।ছায়াশরীর (১৯৯৮) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এ উপন্যাসের কাহিনি বিন্যাসে সালাম সালেহ উদদীন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কাহিনিতে ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। হাতনী গ্রামের সিরাজ কাজী একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে ফিরে এসে গ্রামের বিচিত্র পরিবর্তনের সম্মুখীন হয় সে। পাকিস্তানের দালাল লালু চেয়ারম্যানের দাপট দেখে সে আশ্চর্য বনে যায়। উপন্যাসের কাহিনি মোটামুটি আরিফ কাজী ও নোয়াই শিকদারের পরিবারকে ঘিরে অর্ধেকের বেশি আবর্তিত হয়ে এসে শেষের দিকে জড়িয়ে গেছে আবুল মওলানা ও তার ছেলে লালু মিয়ার স্বাধীনতার পরে যে লালু চেয়ারম্যান; তার ঘটনার সঙ্গে। আবুল মওলানা ও তার ছেলে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর সহযোগী ছিল এবং ছিল পাকবাহিনীর সকল দুষ্কর্মের সঙ্গী। যুদ্ধ আরম্ভ হবার তিন মাস পর পাক আর্মি হাতনী গ্রামে আসে এবং হরিপদ ডাক্তারসহ বহু লোককে খুন করে। হাটবাজার তছনছ করে দেয়। নিহতের মধ্যে সিরাজ কাজীর ছোট ভাইও ছিল। ধরে নিয়ে যায় প্রতিবাদী ও সদ্য পুত্র হারা আরিফ কাজীকে যে আর ফিরে আসে না। আবুল মওলানা আর্মির লোকদের আপ্যায়ন করতে থাকে এবং তার ছেলে লালু আর্মির ক্যাম্পে মেয়ে সরবরাহ করার দায়িত্ব নেয়। তুলে দেয়া সেসব হতভাগিনীর মধ্যে সিরাজ কাজীর বড় ভাইয়ের মেয়েও থাকে। দেশের এই করুণ দশা দেখতে পেয়ে সিরাজ কাজী গ্রামের ছেলেদের উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধে যায় দেশকে হানাদারমুক্ত করার সঙ্কল্প নিয়ে। যুদ্ধ শেষে দ্রুত দৃশ্যপট বদলে যায়। সরকার কর্তৃক দালালদের ক্ষমা ঘোষণায় আবুল মওলানা জেল থেকে ফিরে আসে। তার ছেলে লালু অসদুপায়ে পয়সা করে বড়লোক হয়ে যায় এবং পয়সার জোরে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। যুদ্ধ থেকে ফেরার পর সিরাজ কাজীকে মানুষ যোদ্ধা হিসেবে সংবর্ধনা দিয়েছিল। কিন্তু লালু ও তার সঙ্গীদের দাপটে মানুষ অচিরে সিরাজ কাজীর যোদ্ধা হিসেবে অবদানের কথা ভুলে যায়। তবে দালালের শাস্তি বিধানের জন্য কথাসাহিত্যিক সালাম সালেহ উদদীন কৌশল অবলম্বন করেন। প্রবল পরাক্রান্ত লালু চেয়ারম্যানকে স্বগৃহে জবাই করে হত্যা করান তিনি। এতে শিল্প কুশলতার বিঘ্ন সৃষ্টি হয়নি একটুও। মোস্তফা কামালের জনক জননীর গল্প উপন্যাসটি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের নতুন আখ্যান। উপন্যাস শেষে রাজাকার সলিমুল্লাহ চৌধুরী নিহত হয়েছে; তবে তার সমাধি হয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। রাজাকার সলিমুল্লাহর কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পর্বের সুখের জীবন ও সমাজে তার প্রতিষ্ঠার চিত্র লক্ষ করা যায়। যুদ্ধের সময় এই রাজাকার এক পর্যায়ে তার মার অনুরোধে বরিশালে শ্বশুরালয়ে গমন করলে রংপুরে তার গৃহ পুড়িয়ে দেয়া হয়। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে সে প্রচার করে বরিশালে যুদ্ধে গমন করায় তার ঘরবাড়ি রাজাকাররা পুড়িয়ে দিয়েছে। সে তার ভৃত্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সনদও সংগ্রহ করে। জিন্নাহ টুপি যার প্রিয় পরিধেয় সেই ব্যক্তি ধীরে ধীরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিরাপদ জীবন খুঁজে পায়। তবে শেষ রক্ষা যে করতে পারে নি সে ঘটনাও আমরা জেনেছি উপন্যাসটি পাঠ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় হরিচরণ মাস্টারের স্ত্রী কমলা রাণীকে ভাগিয়ে এনে বিবাহ করার মধ্যে সলিমুল্লাহ অপরাধ খুঁজে পায়নি। কিন্তু অনেক দিন পরে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার গঠনের পূর্বে তার ভেতর ভয় প্রবেশ করে। নিজগৃহে সবাই ঘুমিয়ে থাকলেও সে বিনিদ্র রাত্রি অতিবাহিত করে, অনুশোচনা জাগে তার অন্তরে। তবে তা প্রকাশের আগেই হরিচরণ এক রাতে তাকে হত্যা করে। দেশের সঙ্গে বেঈমানির শাস্তি প্রাপ্তি ঘটে। অন্যদিকে রাজাকার পিতার সন্তান করবী পাগল হয়ে যায়; শেষে আত্মহত্যা করে। সুইসাইড নোটে লিখে রাখে, ‘যেই বাবা দেশের সঙ্গে বেঈমানি করেছিলেন, বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন; সেই বাবার সন্তান হয়ে আমি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চাই না। তাই আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলাম। আমার এই আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়।’করবী বর্তমান প্রজন্মের প্রতীক; যারা দেশের মুক্তিসংগ্রামের সঠিক ইতিহাস জেনেছে। আর তাদের বোধে সেই ইতিহাসচেতনা সবসময় জাগ্রত। এজন্য তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। না পারলে নিজের জীবন বিনষ্ট করে। পাকিস্তানি দালালদের নিজ সন্তানের কাছেও ঠাঁই নেই।
তিন.
মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার কারণ কেবল পাকিস্তানি সেনাদের ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র টার্গেট নয় বরং রাজাকার-আলবদরদের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতাও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। উপন্যাসের বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিত না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাসটিতেই গণহত্যা বা জেনোসাইডের উন্মোচন লক্ষণীয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কালো মেয়ের কথা একাত্তরে বাংলাদেশের যুদ্ধের বাস্তবতায় গণহত্যা ও ধর্ষণের নির্মম চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত উপন্যাসে ২৫ শে মার্চ রাতের গণহত্যার বিবরণ রয়েছে। হত্যার লক্ষ্যবস্তু কারা তা জানিয়েছেন লেখক- ‘জামায়াতে ইসলাম ও মুসলিম লীগের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সলাপরামর্শ চলছে শুনলাম।…চার শ্রেণীর মানুষকে ওরা দেশ থেকে নির্মূল করবে… বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী লীগার, কম্যুনিস্ট ও হিন্দু।’ শওকত ওসমানের দুই সৈনিক উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি গ্রামে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক বাঙালি নারী ধর্ষণ, পাশবিক অত্যাচার ও নির্যাতনের চিত্র রয়েছে। নেকড়ে অরণ্যেও পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী কর্তৃক সংঘবদ্ধভাবে বাঙালি নারী ধর্ষণ ও পাশবিক অত্যাচারের কাহিনি বিবৃত হয়েছে। ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থের উপন্যাস বন্দী দিন বন্দী রাত্রিতে ধর্ষণের চিত্র রয়েছে— ‘খান সেনারা বাংলার বুকে তখন ফুলের মতো বাংলার নারীকে ধর্ষণ করে চলে। স্তন কেটে ওরা পৈশাচিক খুশীতে লোফালুফি করে। পাশবিক উল্লাসে ওরা ফেটে পরে যখন বেয়নেটের নির্মম খোঁচায় কোন নারীর গোপন অঙ্গ থেকে রক্ত ঝরে।’রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’-এ যুদ্ধে বিপন্ন নারীর কথাই চিত্রিত হয়েছে। পাকিস্তানের এ ধরনের কর্মকাণ্ড ছিল জেনোসাইডের অংশ। রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারী সূর্য’ উপন্যাসে হত্যাযজ্ঞের বিবৃতি এরকম— ‘বাসায় ফেরার পথে এক লোকের মুখে শুনলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাঙালি সদস্যদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সংঘাত এবং অগুণিত লাশের কথা। স্টেশনের মালগাড়ি ভর্তি অগুণিত লাশ আর লাশ। কারফ্যু, ত্রাস, গোলাবৃষ্টি তার মধ্যেও খবর চাপা থাকেনি। ইয়াহিয়ার নেকড়ে সেনারা শহরের মধ্যে অগুণিত লোক হত্যা করেছে। বুদ্ধিজীবীদের ঘর থেকে ডেকে গুলি করেছে ট্রাকভর্তি কুলকন্যাদের ধরে নিয়ে গেছে ক্যান্টনমেন্টে। আক্রান্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, কয়েকটি ছাত্রাবাস, পত্রিকা অফিস, প্রেস ক্লাব, বাংলা একাডেমি আক্রমণ থেকে রেহাই পাইনি পূত শহীদ মিনার, ছাত্রীবাস, মেডিক্যাল হাসপাতাল।… পাকিস্তানি সৈন্যরা আগে খুঁজতো আওয়ামী লীগার এখন খোঁজে ‘মুক্তিলোগ’।’ সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড, যুদ্ধ এবং গেরিলা ও বীরাঙ্গনা উপন্যাসত্রয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার বিবরণ এবং দেশের মধ্যে গণহত্যার ঘটনা উপস্থাপিত হয়েছে। রশীদ হায়দারের অন্ধকথামালায় হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন স্পষ্ট— ‘মেজর সাহেব তো পরিষ্কার বললেন, যারা পাকিস্তান রক্ষার জন্য কাজ করবে তাদের মালাউনদের ছেড়ে যাওয়া সমস্ত জমিজমা বাড়িঘর, টাকা পয়সা, মালমাত্তা সমান ভাগে ভাগ করে দেয়া হবে।’
ইমদাদুল হক মিলনের কালোঘোড়া, ঘেরাও, মহাযুদ্ধ, রাজাকারতন্ত্র, বালকের অভিমান, সাড়ে তিন হাত ভূমি প্রভৃতি উপন্যাসে পাকিস্তানবাহিনীর বর্বরতা নিপুণ বর্ণনায় উন্মোচিত হয়েছে। কালোঘোড়ায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর দেশত্যাগের কথা আছে। মোস্তফা কামালের জনক জননীর গল্প উপন্যাসে বাঙালির বিরুদ্ধে রাজাকারদের ভূমিকার অনুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায়। উপরন্তু অগ্নিসংযোগ, হত্যাকাণ্ড এবং নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গও রয়েছে তাঁর উপন্যাসে। অন্যদিকে সৈয়দ শামসুল হকের একাধিক উপন্যাসে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কাহিনি রয়েছে। বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ এবং অন্তর্গত-এর কাহিনিতে জেনোসাইডের অনেক উপকরণ উপস্থাপিত হয়েছে। নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাসে জলেশ্বরীতে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ও তাদের দোসর বিহারীদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার বিবরণ আছে, আছে নারী নির্যাতনেরও কথা। অনুরূপভাবে হুমায়ূন আহমেদের একাধিক উপন্যাসে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা, রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা চিত্রিত হয়েছে। তাঁর অনিল বাগচীর একদিন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন এবং নিপীড়নের চিত্র হিসেবে অনন্য। আমজাদ হোসেনের যুদ্ধযাত্রার রাত্রি উপন্যাসে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কথা আছে।
বিশ শতকের জেনোসাইডের তালিকায় পাকিস্তান একটি অপরাধী রাষ্ট্রের নাম। কারণ লাখো বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে তারা সেদিন তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছিল। অথচ বাঙালি জাতিগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর কোনোরূপ অন্যায় পীড়ন করেনি। তবু বাঙালির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বর্বর ও নৃশংস আচরণ বিশ্বের কাছে তাদের ঘৃণ্য মানসিকতাকে প্রকাশ করে দিয়েছিল। পাকিস্তানিদের আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড ছিল ফ্যাসিস্টদের মতো। তাই তারা পোষণ করেছিল জাতি বা ধর্ম সম্প্রদায় বিদ্বেষ; হত্যা করেছিল নিরীহ নিরপরাধ জনসাধারণকে। সেই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড আমাদের সাহিত্যের নানান আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ করেছে বাস্তবতার আঙিনা দিয়ে।
চার.
উপন্যাসে উপস্থাপিত পাকিস্তানি দালাল বা খল চরিত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ :
ক) হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে দালাল চরিত্রগুলো অত্যন্ত আপনজন মনে করত।
খ) নিজ নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের লিস্ট করে তা পাকিস্তানি সৈনিকদের হাতে জমা দিত। সেই লিস্ট অনুযায়ী তারা বাঙালি যুবকদের ধরে নিয়ে আসতো ও হত্যা করত।
গ) উপন্যাসের আখ্যানে দেখা এ ধরনের চরিত্র মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ির আশেপাশে দলবদ্ধভাবে ওঁৎ পেতে থাকত। রাতে মুক্তিযোদ্ধারা যখন তাদের মা-বাবা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে দেখা করতে যেত, তাদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পে পাঠাতো। মিলিটারিরা তাদের ধন্যবাদ দিত। এতেই তারা অনেক পেয়েছে মনে করত। পাকিস্তানি মিলিটারিদের বাহবা পেতে দালালরা বাঙালি যুবক-যুবতীদের ধরে নিয়ে যেত ক্যাম্পে।
ঘ) পাকিস্তানিদের চেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঙালি নিধনে দালালরা বেশি তৎপর ছিল। পাকিস্তানি আর্মি পাকিস্তানে ফিরে গেলেও শুধু রাজাকাররাই বাংলাদেশকে পাকিস্তান করে রাখতে পারবে- এটা ছিল তাদের বিশ্বাস। এজন্য পাকিস্তানিদের পক্ষে দেশে জনমত গঠনের জন্য মিছিল মিটিং, সভাসমিতি করতো ও ভাষণ দিতো। কোন প্রকার অপমান, ঘৃণা, অবহেলা তাদের টলাতে পারেনি। অর্থাৎ রাজাকাররা বেহায়া ধরনের। চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুষি, লাথি, জুতো যত রকমের মারই দেয়া হোক না কেন, রাজাকারদের তা গায়ে লাগত না। যত অপমানই করা হোক না কেন ওদের কাছে তা অপমান বলেই মনে হতো না।
ঙ) দালালদের দলের কেউ দালালি করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা গেলে নিজেদের মধ্যে তাকে শহিদ বলে প্রচার করতো।
চ) ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর পাকিস্তানি দালালরা মনে করেছে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ছিল একটা দুর্বলতা, মুক্তিযোদ্ধাদের ভুল। এজন্য তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে সবসময়। রাজাকাররা অত্যন্ত চালাক। তারা মনে করে তাদের বেসিক সংখ্যা ৩০ লক্ষ অর্থাৎ ৩০ লক্ষ শহীদের সমান।
ছ) স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নতুন রাজাকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা যে কোন অপকর্ম, যত নিকৃষ্টই হোক না কেন, করতে পারে।
জ) স্বাধীনতার পরও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য অসীম ধৈর্যে হানাদার বাহিনীর অপমান সহ্য করেছে। দেশের উর্দুভাষীদের প্রতি এদের অপার আগ্রহ।
ঝ) চরিত্রগুলোর দিকে লক্ষ করলে বোঝা যাবে যে তারা পাকিস্তানের কোন সুসংবাদ শুনলে আনন্দে আটখানা হয়ে ওঠে। এদের কারো কারো দ্বারা তৈরি হয় নব্য রাজাকারবৃন্দ।
ঞ) বুদ্ধি দিয়ে পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছে রাজাকাররা। বুদ্ধিজীবী রাজাকারদের বুদ্ধির কুটচালেই স্বাধীনতার পরও তারা ব্যাপক শক্তির অধিকারী হয়। ধীরে ধীরে তারা ফর্মে চলে আসে। খুব কৌশলে এগিয়েছে ক্ষমতার দিকে।
ট) স্বাধীনতার পর রাজাকাররা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে রাজাকাররা প্রতিষ্ঠিত করে ধর্মীয় রাজনীতি। স্বাধীনতার পরে স্বৈরশাসকের আমলে সংঘর্ষ, হত্যা, গুম, নৈরাজ্য, সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়। প্রকৃত গণতন্ত্রের পরিবর্তে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত আমরা স্বৈরতন্ত্রের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হতে থাকি। কারণ এসময় নব্য-রাজাকাররা তরুণদের দিয়ে সংগঠন তৈরি করেছে হত্যাকারীদের সঙ্গে নিয়ে। একাত্তরে যে ভুলের জন্য মার খেয়েছে তা শুধরে নিয়ে নতুন প্রেরণায় সামনে এগিয়েছে তারা। যার পরিচয় আছে উপন্যাসের আখ্যানে।
ঠ) উপন্যাসের আখ্যানে আছে- কেউ কেউ প্রাণে বাঁচার জন্য রাজাকার হয়েছিল, পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর পক্ষ নিয়েছিল।
পাঁচ.
মূলত একাত্তর এবং একাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের উপন্যাস ও ঔপন্যাসিকদের চেতনা ও মনোভূমিতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল; তাদের জীবনদর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেছিল কীভাবে- সে সমস্তের পরিচয় পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে পাকিস্তানি দালাল বা খল চরিত্র উপস্থাপনে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষ সকল মানুষ সেদিন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। আর মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই ছিল গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব মধ্যবিত্তের হাতে থাকলেও, মধ্যবিত্তের তুলনায় মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণই ছিল সর্বাধিক। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি সহযোগী এদেশীয় দালালরা ছিল সুযোগ সন্ধানী, গ্রাম্য মাতব্বর ও পুঁজিপতি শ্রেণির অপরাধী। তাদের স্বরূপ উন্মোচনে মুক্তিযুদ্ধের ঔপন্যাসিকরা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com