সোমবার | ৯ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | দুপুর ২:২৯
Logo
এই মুহূর্তে ::
মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় ভাষায় সিন্ধুসভ্যতার মেলুহার ভাষার প্রভাব : অসিত দাস বঙ্গতনয়াদের সাইক্লিস্ট হওয়ার ইতিহাস : রিঙ্কি সামন্ত নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘ঝড়ের পরে’ ভালো থাকার পাসওয়ার্ড (শেষ পর্ব) : বিদিশা বসু গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘সময়ের প্ল্যাকটফর্ম’ গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি : রঞ্জন সেন জামিষষ্ঠী বা জাময়ষষ্ঠী থেকেই জামাইষষ্ঠী : অসিত দাস কার্বাইডে পাকানো আম দিয়ে জামাইষষ্ঠীতে জামাই খাতির নয়, হতে পারে ক্যান্সার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ভক্তের ভগবান যখন জামাই (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত কাশ্মীর নিয়ে বিজেপির নেহরুকে দোষারোপ ধোপে টেকেনা : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্র নাটকের দুই ট্র্যাজিক রাজা : শৌনক দত্ত কবির মৃত্যু : দিলীপ মজুমদার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের সপ্তসঙ্গিনী : স্বামী তেজসানন্দ মহারাজ দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টার স্ট্রোক : সন্দীপন বিশ্বাস সিঁদুরে মেঘের গর্জন : অসিত দাস শতবর্ষে অন্য বিনোদিনী — তৃপ্তি মিত্র : শৌনক দত্ত আমার প্রথম অভিনয় দেখে সত্যেন বসুই বলেছিলেন— তোর হবে : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রজিৎ আমাকে ক্লান্ত করে কেবলই ক্লান্ত : তপন মল্লিক চৌধুরী মনোজ বসু-র ছোটগল্প ‘বাঁশের কেল্লা’
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

শ্রীরামকৃষ্ণের কালীসাধনা : সঞ্জীব চক্রবর্তী

সঞ্জীব চক্রবর্তী / ১৮৭৯ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ২ নভেম্বর, ২০২১

ভারতীয় শক্তিসাধনার দুটি ধারা— কালীকুল ও শ্রীকুল। শাস্ত্রনির্দেশে আমাদের বঙ্গভূমি কালীকুলের অন্তর্গত। কালীকুলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দক্ষিণাকালিকা। সে জন্য বাংলায় সাধকদের কাছে কালীর নিরঙ্কুশ প্রাধান্য। জন্মদাত্রীর মতোই কালীর সঙ্গে বঙ্গীয় সাধককুলের সম্পর্ক ও নির্ভরতা নিবিড়।

বাংলায় কালীসাধক অগুনতি। এঁদের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ আধুনিকতম। আধুনিকতম শুধু কালের প্রেক্ষিতে নয়, তিনি আধুনিকতম তন্ত্র রহস্যকে কলুষমুক্ত করে তার অন্তর্নিহিত ভাবটি উন্মোচনের জন্য, ভ্রমাত্মক ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে তন্ত্রসাধনের যথার্থ শাস্ত্রীয় পথ প্রদর্শনের জন্য যে পথ অসংযমী সাধকদের অনিবার্য পতন থেকে রক্ষা করে।

শৈশব থেকে যৌবনের প্রারম্ভ পর্যন্ত শ্রীরামকৃষ্ণের নিস্তরঙ্গ জীবনের নানা আকস্মিক ভাবতন্ময়তা ও জীবনচর্যার খণ্ড খণ্ড চিত্রগুলি তাঁকে যে ভবিষ্যতের এক তীব্র বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুত করছিল তার কিছুমাত্র আভাস ওই সময় স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ তো বটেই, তাঁর পরিবার-পরিজনেরাও আঁচ করতে পারেননি। কিন্তু এই অনিত্য জগতে দু-দিনের ভোগসুখ ও প্রতিষ্ঠা যে নিতান্ত ঝলমলে মরীচিকামাত্র, মনুষ্যজীবনের যে অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে এ ব্যতিক্রমী ভাবনাটা দুটি মর্মান্তিক বিয়োগযন্ত্রণার পরিণামে ওই অল্পবয়সেই তাঁর অন্তরে অঙ্কুরিত হয়েছিল; তাঁর চিন্তাশীল মন বৈরাগ্যের আগুনে ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হচ্ছিল।

কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে দক্ষিণেশ্বর দেবালয়ে না এলেও, প্রথম থেকেই শুধুমাত্র অন্তরের টানে, হয়তো-বা আপন সাধনপথ অন্বেষণের তাগিদে নিজের অজান্তেই গদাধর তপস্বীর মতো জীবনযাপন করছিলেন। দিনের অধিকাংশ সময় লোকালয় পরিহার করে নির্জনে ধ্যান-ধারণা করতেন, তন্ময় হয়ে গান গাইতেন, শিবপূজা করতেন এবং মাঝেমধ্যে ভাবসমাধিতেও ডুবে যেতেন। এই বহুগুণান্বিত যুবকের আকর্ষণে তখনই মথুর বাঁধা পড়লেন এবং গদাধরকে মন্দিরের কাজে বাঁধতে চাইলেন।

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে পূজকের পদে বৃত হয়ে গদাধর যেন হাতে চাঁদ পেলেন। শুধুমাত্র দেবসেবার কাজে নিযুক্তি তাঁকে যেন জীবনের অন্য উদ্দেশ্য খোঁজার পথটি ধরিয়ে দিল। অন্বেষণের দায়িত্ব তাঁর নিজের, একা।

তরুণ পুরোহিত প্রথম যেদিন মন্দির বিগ্রহের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন, সেদিন কিন্তু তিনি সাধক ছিলেন না। তাঁর উপাস্য দেবী দুর্জ্ঞেয়া ভয়ংকরী না কি আলোকময়ী হিতৈষিণী এসব তাত্ত্বিক ভাবনা সেদিন তাঁর মনে জাগেনি। কালীকে দেখে সেদিন গদাধরের অন্তত লালিত নিরবয়ব ঈশ্বরের এক মানবী রূপ তিনি খুঁজে পেলেন কালীবিগ্রহের মধ্যে। হৃদয়ের গভীর বিশ্বাস নিয়ে তিনি তাঁকে ‘মা’ বলে ডাকলেন। ‘মা’— অবোধ শিশুর কাছে জগতে যিনি সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য; যাঁর কাছে সব কথা খুলে বলা যায়, যা খুশি আবদার করা যায়, আনন্দ-দুঃখ, ক্ষোভ-অভিমান প্রকাশ করা যায়। তাঁর এই ‘মা’ সন্বোধনের মধ্যে কোন শিশুসুলভ চপলতা ছিল না। বরং ঈশ্বর যে সত্যসত্যই আমার খুব কাছের মানুষ এই অনির্বচনীয় আপনবোধের প্রকাশ ছিল, ছিল এক গভীর প্রত্যয়।

দেবীপূজায় নবীন পুরোহিতের কোনও পরিমিতিবোধ ছিল না। সময়-শৃঙ্খলার ব্যাপারে নিতান্তই উদাসীন। প্রায়শই উচিত-অনুচিতের সীমা পার হয়ে যেতেন। বড়ো বিচিত্র তাঁর পূজা। সকালে ফুল তুলে, মালা গেঁথে দেবীকে সাজাতেই অনেকটা সময় চলে যেত। পূজায় বসে যথাবিধি নিজের মাথায় একটা ফুল দিয়েই হয়তো দু-ঘণ্টা ধ্যানস্থ হয়ে রইলেন কিংবা অন্ননিবেদন করে মা গ্রহণ করছেন ভেবে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিলেন। দেবীকে প্রসন্না করতে কখনও পূজার মাঝখানে, কখনও-বা পূজান্তে গান গাইছেন। কখনও হৃদয়ের ব্যাকুলতায় মা-কে বলছেন, ‘মা তুই রামপ্রসাদকে দেখা দিয়েছিস, আমায় কেন তবে দেখা দিবি না? আমি ধন, জন, সুখভোগ কিছুই চাই না, আমায় দেখা দে’। প্রার্থনা করতে করতে চোখের জলে বুক ভেসে যেত, বুক ও মুখ লাল হয়ে উঠত। সন্ধ্যায় তন্ময় হয়ে মা-কে গান শোনাচ্ছেন, আরতি করতে কতটা সময় যাচ্ছে হিসেব রাখছেন না। বারবার মনে করিয়ে দিয়েও সময়ে কোনও কাজ শেষ হচ্ছে না। প্রথাবহির্ভূত সৃষ্টিছাড়া এই পূজা গদাধরকে কারও কাছে বিদ্রূপভাজন, কারও কাছে-বা শ্রদ্ধাসম্পন্ন করে তুলল।

দাপুটে জমিদার মথুরের বিষয়-অহংকারের আড়ালে অন্তরে যে এক মাতৃভক্ত শিশু লুকিয়েছিল তা অভাবনীয়। তরুণ পূজারির আধ্যাত্মিক ভাবরাশি তাঁর ভক্তদৃষ্টিকে এড়াতে পারেনি। দেবীপূজায় ‘অনাচার’-এর ভয়ংকর পরিণতির কল্পনায় যাঁদের কপালে ভাঁজ পড়েছিল, ভ্রূকুচকে উঠেছিল, মথুর সব দেখেশুনে তাঁদের অকারণ অনিষ্ট আশঙ্কাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন—অদ্ভুত পূজক পাওয়া গেছে, দেবী বোধহয় শীঘ্রই জেগে উঠবেন। (দ্র.লীলা/৬৪) কিন্তু কে কাকে জাগ্রত করবেন? পূজক দেবীকে না দেবী পূজককে? ভবিষ্যতে যাঁকে ‘যন্ত্র’ করে জগৎকল্যাণে নিযুক্ত করবেন সেই গদাধরকে জাগ্রত করে দেবী তাঁকে কর্মোপযোগী করে গড়ে তুলবেন না-কি পূজকের অনন্যসাধারণ পূজা ও ব্যাকুল আহ্বানে পরম পরিতুষ্টা জননী পাষাণবিগ্রহে অধিষ্ঠিতা হতে বাধ্য হবেন? হয়তো দুটোই। দু-জনকেই দু-জনের যে বড়ো প্রয়োজন।

দিনের পর দিন মা-র আহার-বিহারে, শয়ন-উত্থানে মা-র সঙ্গে থাকতে থাকতে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সত্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে জগন্মাতার অস্তিত্ব অনুভব করছিলেন, জননীও নিজের দেহগন্ধে, নিঃশ্বাসবায়ুর উষ্ণতায়, কণ্ঠস্বরের অনুরণনে, স্মিত হাসির মাধুর্যে, নূপুরের রিনঝিন শব্দে শ্রীরামকৃষ্ণকে আবিষ্ট, সন্মোহিত করে ফেললেন। মা-র মুখ তখনও তিনি দেখতে পাননি সত্য কিন্তু তাঁর উপস্থিতির সমস্ত লক্ষণ তিনি ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন। ফলত তাঁর হৃদয়ে মাতৃদর্শনের আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্রতর হয়ে উঠল। উন্মত্তের মতো মধ্যরাতে মন্দির-সংলগ্ন জঙ্গলে গিয়ে পরনের কাপড় এবং উপবীত খুলে রেখে পাশমুক্ত মনে আমলকী গাছতলায় বসে দিনের পর দিন ধ্যান করলেন, প্রার্থনা করলেন, মাকে ব্যাকুল হয়ে ডাকলেন, আকুল ক্রন্দনে বুক ভাসালেন এবং ব্যর্থ হলেন; পাষাণ-হৃদয় গলল না। অনিবার্যভাবেই তাঁর মনে এক অভাবনীয় সংশয় দেখা দিল— মা কি সত্যই আছেন, না কি শুধুই কল্পনা? কিন্তু যেহেতু ইতোপূর্বে তিনি একাধিকবার দিব্যজ্যোতি প্রত্যক্ষ করেছেন এবং যেহেতু দেবীর অস্তিত্বের নানা সংকেত অনুভব করেছেন তাই এই সংশয় দীর্ঘস্থায়ী হলো না, আকাঙ্ক্ষার প্রাবল্যও কমলো না। ‘কেউ যদি নিশ্চিত বুঝতে পারে যে— ইন্দ্রিয় দিয়ে যতটুকু প্রত্যক্ষ করা যায় তার বাইরে এক প্রকৃত সত্তা বর্তমান… এমন একজন আছেন যিনি অবিনশ্বর, অনন্ত আনন্দের সমষ্টি,… তাহলে সে কি করে তাঁকে পাওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা না করে চুপ করে বসে থাকতে পারে?… অসম্ভব! ব্যাকুলতার প্রাবল্যে সে পাগল হয়ে যাবে।’ রামকৃষ্ণও উন্মত্ত হলেন, দিশাহারা হলেন, বুক ও মুখ লাল হয়ে উঠল, দুই চোখ অশ্রুধারায় সিক্ত হলো, পুঞ্জীভূত যন্ত্রণা সহনশক্তির প্রান্তসীমায় পৌঁছলো—শুধু বিস্ফোরণের অপেক্ষা। অকস্মাৎ তিনি প্রত্যক্ষ করলেন এক অনির্বচনীয় আলোর উদ্ভাস। মাতা-পুত্রের মধ্যবর্তী অদৃশ্য আবরণটা হঠাৎই সরে গেল। শ্রীরামকৃষ্ণ দেখলেন, ‘ঘর, দ্বার, মন্দির সব যেন কোথায় লুপ্ত হইল—কোথাও যেন আর কিছুই নাই! আর দেখিতেছি কি, এক অসীম অনন্ত চেতন জ্যোতিঃসমুদ্র! —যেদিকে যতদূর দেখি, চারিদিক হইতে তার উজ্জ্বল ঊর্মিমালা তর্জন-গর্জন করিয়া গ্রাস করিবার জন্য মহাবেগে অগ্রসর হইতেছে! দেখিতে দেখিতে উহারা আমার উপর নিপতিত হইল এবং আমাকে এককালে কোথায় তলাইয়া দিল! হাঁপাইয়া হাবুডুবু খাইয়া সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িয়া গেলাম!… অন্তরে কিন্তু একটা অননুভূত জমাট-বাঁধা আনন্দের স্রোত প্রবাহিত ছিল এবং মার সাক্ষাৎ প্রকাশ উপলব্ধি করিয়াছিলাম!’

দুই

অপার্থিব জ্যোতিঃসমুদ্রে কালীর ক্ষণিক উদ্ভাস শ্রীরামকৃষ্ণের অশান্ত মনকে পরিতৃপ্ত না করে আরও উসকে দিল। যে কালীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর এত সংগ্রাম, এক ঝলক সেই কালীর দর্শন পেয়ে কীভাবে তৃপ্ত হবেন তিনি? অথচ মুহূর্তের জন্য মাকে দেখার পর তাঁকে ছাড়া শ্রীরামকৃষ্ণের পক্ষে বেঁচে থাকাও অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। জগন্মাতার অবাধ-অবিরাম দর্শনের আকাঙ্ক্ষায় তাঁর প্রাণে কান্নার রোল উঠত। এই উন্মত্ততা তাঁর শরীর-মনকে প্রভাবিত করল। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় তাঁর শরীর শুকিয়ে গেল, দেহের রোমকূপ থেকে রক্তক্ষরণ হতে লাগল, সেই সঙ্গে গাত্রদাহ। অব্যক্ত যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে মাটিতে লুটিয়ে গড়াগড়ি দিয়ে গোঙাতেন, মাটিতে মুখ ঘষে রক্তাক্ত হতেন। চারদিকে লোক দাঁড়িয়ে যেত, তাঁর হুঁশ থাকত না।

শরীর অবশ করা এরকম একটা দুঃসহ পরিস্থিতিতে শ্রীরামকৃষ্ণ যখনই বাহ্যসংজ্ঞা হারাতেন, অনুভব করতেন, মা-র অভয়মূর্তি সামনে এসে তাঁকে আশ্বাস দিচ্ছেন, সান্ত্বনা দিচ্ছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মনে হলো, মা তাঁর ওপর ভর করেছেন। ধ্যানে এখন শুধু মা-র অনিন্দ্যসুন্দর হাত-পা-মুখ নয়, পরিপূর্ণ বরাভয়করা চিন্ময়ীমূর্তির নিত্য আবির্ভাব। শুধু চোখ বন্ধ করে কেন, চোখ খুললেও তিনি আছেন। সকালে ফুল তোলা থেকে রাতে শয়ন দেওয়া পর্যন্ত শ্রীরামকৃষ্ণের সব কাজেই কালী তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ফেরেন। তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা, হাস্য-পরিহাস, আদর-আবদার চলে সকলের অলক্ষ্যে। মন্দিরের পাষাণমূর্তিতে এখন শুধু তাঁর আবির্ভাব নয়, এখন তিনি চিন্ময়ীরূপে স্বয়ং মন্দিরে বিরাজ করেন; নূপুরের রুনুঝুনু শব্দ তুলে চপলপায়ে মন্দিরের দোতলায় গিয়ে আলুলায়িত কেশে গঙ্গা দর্শন করেন। এখন মন্দিরে ঢুকলে গা কেমন ছমছম করে।

বৈধীপূজা কোনওদিনই তিনি করতেন না; কিন্তু যা করতেন, এখন সেটুকুও অসম্ভব হয়ে উঠল। পূজায় বসে প্রেমাভক্তির প্রাবল্যে তিনি যে কী করবেন কেউ জানে না, তিনিও নন। ফুল-বেলপাতার অর্ঘ নিজের পায়ে ঠেকিয়ে দেবীকে নিবেদন করছেন; পূজাসন ছেড়ে মা-র কাছে গিয়ে তাঁর চিবুক ধরে আদর করছেন, পরিহাস করছেন, হাত ধরে নাচছেন; পূজা না করে ভোগ নিবেদন করে দিচ্ছেন কিংবা নিবেদিত ভোগ নিজহাতে দেবীকে খাওয়াতে ব্যস্ত হচ্ছেন অথবা নৈবেদ্যর খানিকটা নিজেই খেয়ে উচ্ছিষ্টটা দেবীকে খেতে অনুনয় করছেন; মাতৃজ্ঞানে বিড়ালকে খাওয়াচ্ছেন আবার মাতৃআদেশ ভেবে মা-র খাটে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকছেন। উচিত-অনুচিতের বোধহীন হয়ে একদিন তো মন্দিরে বসে বিষয়-চিন্তা করার অপরাধে স্বয়ং রানিকেই আঘাত করে বসলেন। তিনি যে এসব করছেন তা কোনও পূর্বপরিকল্পনা নয়। এগুলি তাঁর অন্তরের গভীর আকাঙ্ক্ষার অবশ্যম্ভাবী ফলরূপে স্বতই উৎসারিত হতো। রামকৃষ্ণের আহার-নিদ্রার স্থিরতা ছিল না, চোখের পলক পড়ত না। ইচ্ছা করে তিনি আহার-নিদ্রা ত্যাগ করেননি, শরীর সম্পর্কে কষ্ট করে তাঁকে উদাসীন থাকতে হয়নি, তিনি দেহবোধ হারিয়েছিলেন সম্পূর্ণভাবে।

আরও একটা বিষয় লক্ষণীয়। এই সময় তাঁর সনাতনী ধ্যানধারণাগুলি ঝড়ের এঁটো পাতার মতো উড়ে গিয়েছিল। কৈবর্তের অন্নগ্রহণে একদা যিনি অপারগ ছিলেন এখন তিনিই অন্ত্যজ কাঙালিদের ভুক্তাবশেষ পরম পবিত্রজ্ঞানে গ্রহণ করলেন, জন্মগত ব্রাহ্মণ্য ও সংস্কারের অহংকার দূর করার জন্যে দীর্ঘ পরিচর্যাহীন জটাপাকানো চুলে অচ্ছুতের গৃহমার্জন করলেন, চন্দন ও বিষ্ঠা সমতুল্য জ্ঞানে নির্বিকার চিত্তে জিহ্বার অগ্রভাগ দিয়ে বিষ্ঠা স্পর্শ করলেন।

একটা কথা স্মরণে রাখতে হবে, শ্রীরামকৃষ্ণ মূলত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পূজারি। বিধিনিয়ম অনুসারে পূজাকর্ম নির্বাহ করাই তাঁর কাজ। কিন্তু তাঁর এই গণ্ডিভাঙা স্বভাব, সৃষ্টিছাড়া অসাধারণত্ব কোনওদিন কোনও বিধিনিয়মে বাঁধা পড়েনি। কেন? তিনি কি তাঁর যুগের থেকে এগিয়ে ছিলেন? হয়তো। মথুরবাবু পৌরহিত্য থেকে তাঁকে অব্যাহিত দিলেন কিন্তু মন্দির থেকে নয়।

দৈবদৃষ্টি ছাড়া শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যোন্মাদ অবস্থার অসাধারণ উচ্চতা অনুমান বা অনুভব করা সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত। স্বাভাবিকভাবেই চারদিকে খবর রটে গেল— রামকৃষ্ণ পাগল হয়েছে। রাসমণি ও মথুরের সুনজরে পড়েও যে নিজের সাংসারিক উন্নতির কিছুমাত্র চেষ্টা না করে ‘হরি’ বা ‘রাম’ বা ‘কালী কালী’ বলে দিন কাটায়, তাকে উন্মাদ ছাড়া আর কিই-বা বলা যাবে? অবিলম্বে ‘অলৌকিক’ রোগ নিরাময়ের জন্য ‘লৌকিক’ বিধান সাব্যস্ত হলো—বিবাহ।

কিন্তু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতীয় অধ্যাত্মপথযাত্রীদের কাছে ‘বিবাহ’ একটি নিষিদ্ধ শব্দ। কারণ, বিবাহ মানুষকে বিষয়মুখী করে, আত্মকেন্দ্রিক করে, আসক্তিপরায়ণ করে এবং ধর্মপথ অবরুদ্ধ করে। পারিবারিক জীবন তাঁদের কাছে বন্ধন। তথাপি শ্রীরামকৃষ্ণ বিবাহে সম্মতি দিয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এই বিবাহ ছিল জগজ্জননী-নির্দিষ্ট এক দিব্য-যোটক। স্ত্রী হয়ে যিনি এলেন, তিনি তাঁর ধর্মপথের সহযাত্রী, তাঁর মানবকল্যাণযজ্ঞের হোত্রী, তাঁর যথার্থ পরিপূরক এবং সর্বোপরি মন্দিরে পূজিতা মা-র জীবন্ত বিগ্রহ। একজনের মন যখন ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ, অন্যজন তখন ধীরে ধীরে ফুটে ওঠা ফুলের সৌরভে স্নিগ্ধ।

বিবাহ শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বপ্লাবী ঈশ্বর-উন্মাদনাকে কিছুমাত্র স্তিমিত করতে পারেনি। কালীর অপ্রতিরোধ্য আহ্বানে দক্ষিণেশ্বরে ফিরতে হলো তাঁকে। মা, দাদা, সংসারের অনটন এমনকী সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকেও বিস্মৃত হলেন তিনি। আগেকার দিব্যোন্মত্ততা আরও তীব্রভাবে ফিরে এল।

শ্রীরামকৃষ্ণের সাধন-প্রকৃতির একটা আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য হলো অতৃপ্তি যা অন্যান্য সাধকদের থেকে তাঁকে স্বতন্ত্র বলে চিহ্নিত করে। একটি আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলেই পরবর্তী উত্তরণের জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠতেন। মা-র অবাধ দর্শনের পর এখন নিরন্তর সান্নিধ্য চাই, ক্ষণিকের বিরামও তাঁর কাছে অসহ্য। কালীর নিত্য সান্নিধ্যের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় দিনে মন্দিরে এবং রাতে পঞ্চবটীতে আকুল হয়ে প্রার্থন করতেন। নানাভাবে কেঁদে কেঁদে মা-কে ডাকতেন, ভালোবাসা প্রকাশ করতেন, কখনও-বা ধৈর্য হারিয়ে মুখ করতেন যেন মাকে পাকড়ে আনছেন। যেন জাল ফেলে মাছ হড়হড় করে টেনে আনছেন। ভাবখানা যেন ‘এবার কালী তোমায় খাব।’ জগন্মাতাও নানাভাবে তাঁকে দর্শন দিতে লাগলেন— কখনও বালিকারূপে, কখনও বারাঙ্গনা বেশে; কখনও আলোরূপে তো কখনও চৈতন্যরূপে। রূপের সংকীর্ণতা তাঁর মন থেকে বিলীন হয়ে গেল। তিনি অনুভব করলেন, মা শুধু মূর্তিতে নন, তিনি সবকিছুর মধ্যেই আছেন, তিনিই সবকিছু। সামান্য উদ্দীপক কিছু চোখে দেখলে বা কানে শুনলে তিনি ভাবস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন। বারাঙ্গনার মধ্যে সীতাকে খুঁজে পেলেন, ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়ানো একটি ইংরেজ যুবকের মধ্যে কৃষ্ণকে প্রত্যক্ষ করলেন, সিংহ দেখে ঈশ্বরীয় উদ্দীপন হয়ে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। হঠাৎ একদিন কালীঘরে মা দেখিয়ে দিলেন— সব চিন্ময়; প্রতিমা, বেদি, কোশাকুশি, চৌকাট, মার্বেল পাথর, মানুষ, জীবজন্তু—সব চিন্ময়। এমনকী তাঁর নিজের মধ্যেও তিনি কালীর দুর্বার উপস্থিতি অনুভব করলেন; তিনিই হয়ে উঠলেন কালী।

তিন

এতদিন পর্যন্ত গুরুকরণের প্রয়োজন হয়নি শ্রীরামকৃষ্ণের। তাঁর বিশুদ্ধ মনের বিস্ময়কর পরিচালনায় সিদ্ধিপথে এগিয়েছেন তিনি। মনই তাঁর গুরু। মনই তাঁকে বলে দিত, কী করতে হবে। কিন্তু তবু তাঁর শান্তি ছিল না। তাঁর অনুভব-উপলব্ধি সম্পর্কে পণ্ডিত হলধারীর নানা কূট যুক্তিজাল তাঁকে বিচলিত করেছিল আর তাঁরই বিশুদ্ধ মঙ্গলচিন্তায় রাসমণি-মথুরের যৌথ উদ্যোগে অখণ্ড ব্রহ্মচর্য ভাঙিয়ে তাঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ‘গোপন কৌশলে’ তিনি হতবুদ্ধি হয়েছিলেন। প্রথম ক্ষেত্রে তিনি মায়ের পদতলে আশ্রয় নিয়ে শান্ত হয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তাঁর স্বাভাবিক উপায়ে নারীমাত্রে মাতৃজ্ঞানে সমাধিস্থ হয়ে রক্ষা পেয়েছিলেন। এতাবৎ তিনি যা করেছেন তা ঠিক কিনা সে বিষয়ে নিঃসংশয় ছিলেন না। নিশ্চিত ছিলেন না তাঁর এই ঈশ্বর উন্মত্ততা কোনও ব্যাধির লক্ষণ না কি ঈশ্বরের কৃপা। তদুপরি নিরন্তর মাতৃদর্শনের আনন্দের তীব্রতার মধ্যে এরকম ঘটনা তাঁর নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই তাঁকে সন্দিহান করে তোলে। নানা সংশয়ের অভিঘাতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এসময় তাঁর প্রয়োজন ছিল এমন একজন সমঝদার মানুষের, যিনি তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের অনুভব-উপলব্ধিগুলির যাথার্থ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। জগন্মাতা নিয়ে এলেন তন্ত্রসাধিকা যোগেশ্বরীকে, ভৈরবী ব্রাহ্মণী নামে যিনি সর্বজন-পরিচিতা। ভৈরবী শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম গুরু, সহায়ক, পথপ্রদর্শক।

ব্রাহ্মণী শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তাঁর সাধনযাত্রার অনুপুঙ্খ বর্ণনা— তাঁর নানা অভিজ্ঞতা, নানা দর্শন, মনের খেয়াল, শারীরিক লক্ষণ, দেহের স্বতঃস্ফূর্ত কম্পন, গাত্রদাহ ইত্যাদি শুনে পুঁথিপত্র খুলে দেখিয়ে দিলেন যে শ্রীরামকৃষ্ণ সঠিক পথেই চলছেন। বুঝলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরে এক অত্যুচ্চ আধ্যাত্মিক শক্তি প্রকাশের অপেক্ষায় দিন গুনছে। তিনি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে, আশ্বাস দিয়ে, তাঁর অন্তরের সুপ্ত শক্তি সম্পর্কে তাঁকে সচেতন করলেন, ধীরে ধীরে তাঁর আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলে তাঁকে তন্ত্রসাধনায় উৎসাহিত করলেন।

তন্ত্রসাধনা এমন একটি সাধনা যার দ্বারা সাধকের অন্তর্নিহিত দেবত্ব উন্মোচিত হয়। কালীকুলে বামাচারে তন্ত্রসাধনের বিধান আছে যা মুখ্যত পঞ্চতত্ত্ব বা পঞ্চ ‘ম’-কার (পঞ্চতত্ত্ব বা পঞ্চ ‘ম’-কার : মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন) নিবেদন ও নানা উগ্র সাধনার (উগ্রসাধনা : কপাল পাত্র, গ্রহণ, শবসাধনা, মুণ্ড সাধনা, শ্মশান ক্রিয়া ইত্যাদি) আয়ত্বাধীন। বামমার্গ বীরভাবের সাধন।

তন্ত্রসাধনে নিপুণা ও অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণী বেলতলায় ত্রিমুণ্ডায়ন (ত্রিমুণ্ডাসন : তিনটি নবমুণ্ড দ্বারা স্থাপিত) এবং পঞ্চবটীমূলে পঞ্চমুণ্ডাসন (পঞ্চমুণ্ডাসন : নর, বৃষ, শৃগাল, সর্প ও কুকুর—এই পাঁচটি মুণ্ডদ্বারা স্থাপিত।শাস্ত্রমতে সমস্ত মুণ্ডই পুরুষ প্রাণীর হওয়া চাই। কোন মুণ্ডই আগুন, গঙ্গাজল, গোময়, গোমূত্র, তুলসী ইত্যাদির স্পর্শহীন হওয়া চাই। ব্রাহ্মণী মুণ্ডগুলি কোনও গঙ্গাহীন প্রদেশ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।) স্থাপন করেন। পূর্ণাভিষেকের পর প্রয়োজনমতো কখনও বেলতলায় কখনও-বা পঞ্চবটীতে ব্রাহ্মণী শ্রীরামকৃষ্ণকে দিয়ে নানারকম সাধন করিয়েছেন। রাত্রিবেলা সাধনের সব আয়োজন করে ব্রাহ্মণী তাঁকে সাধনে প্রযুক্ত করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ জানিয়েছেন, ‘বিষ্ণু ক্রান্তায় প্রচলিত চৌষট্টিখানা তন্ত্রে যত কিছু সাধনের কথা আছে সবগুলিই ব্রাহ্মণী একে একে অনুষ্ঠান করিয়াছিল। কঠিন কঠিন সাধন— যাহা করিতে যাইয়া অধিকাংশ সাধক পথভ্রষ্ট হয়—মার (শ্রীশ্রী জগদম্বার) কৃপায় সে সকলে উত্তীর্ণ হইয়াছি।’

কী সেই কঠিন সাধন সে-সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ বিস্তৃতভাবে কখনও কিছু বলেননি। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে তিনি তাঁর তন্ত্রসাধনার যে খণ্ডচিত্রগুলি এঁকেছেন তা থেকে আমরা সে-সম্পর্কে খানিকটা অনুমান করতে পারি।

একদিন ব্রাহ্মণী রামকৃষ্ণকে এক পূর্ণযৌবনা বিবসনা নারীর কোলে বসে জগজ্জননীজ্ঞানে তন্ময়চিত্তে জপ করতে বললেন। আবার একদিন শবের খর্পরে মাছ রান্না করে রামকৃষ্ণকে দিয়ে তর্পণ করিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু ব্রাহ্মণী যেদিন গলিত নরমাংস এনে একইভাবে তর্পণ করিয়ে জিহ্বা দিয়ে স্পর্শ করতে বললেন, সেদিন ঘৃণায় তিনি শিউরে উঠেছিলেন। ব্রাহ্মণী নিজে জিভ দিয়ে তা স্পর্শ করে বললেন, ঘৃণা করতে নেই। তখন শ্রীশ্রীজগদম্বার প্রচণ্ড চণ্ডীমূর্তির উদ্দীপনায় মা মা বলতে বলতে ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়লে ব্রাহ্মণী ওই মাংস তাঁর মুখে দিলেন। এবার আর তাঁর ঘৃণা হয়নি। শেষে একদিন নর-নারীর মিলনদৃশ্য দেখে শিব-শক্তির লীলাবিলাস জ্ঞানে মুগ্ধ ও সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন। বাহ্যচৈতন্য ফিরে এলে ব্রাহ্মণী জানালেন, শ্রীরামকৃষ্ণ আনন্দাসনে সিদ্ধ হয়ে দিব্যভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সর্বজনসমক্ষে কুলাগার (কুলাগার—স্ত্রীযোনি) পূজানুষ্ঠান করে বীরভাবের তন্ত্রসাধন শেষ করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।

শ্রীরামকৃষ্ণ কম-বেশি দু-বছর তন্ত্রসাধনা করেছেন। নারীমাত্রে মাতৃজ্ঞান অক্ষুণ্ণ রেখে তন্ত্রোক্ত বীরভাবের সাধনার কথা শোনা যায় না। বীরাচারী সাধকদের দৃঢ় ধারণা, স্ত্রী এবং কারণ গ্রহণ না করলে সাধনায় সিদ্ধি আসে না। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ স্বপ্নেও কখনও স্ত্রীগ্রহণ করেননি। তা ছাড়া কারণের নাম বা গন্ধমাত্রেই তিনি জগৎকারণের উপলব্ধিতে আত্মহারা হয়ে যেতেন। স্ত্রী গ্রহণ এবং কারণ স্পর্শ না করে শ্রীরামকৃষ্ণ স্বল্পকালে সাফল্য লাভ করাতে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পঞ্চ ‘ম’-কার তন্ত্রসাধনার অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ নয়।

লক্ষণীয় বিষয়, যে-বীরভাবের আশ্রয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ সাধন করেছিলেন, পরবর্তীকালে তিনি সেই সাধন প্রক্রিয়ার নিন্দা করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মতে ওই ভাব সাধারণ সাধকের জন্য নয়, অসংযমী সাধকদের জন্য তো নয়ই। শ্রীরামকৃষ্ণ সচেতন করেছেন, ‘কি জান, আমার ভাব মাতৃভাব, সন্তানভাব। মাতৃভাব অতি শুদ্ধভাব, এতে কোনও বিপদ নাই।… স্ত্রীভাব—বীরভাব বড়ো কঠিন।… ঠিক রাখা যায় না।’

তন্ত্রসাধনে শ্রীরামকৃষ্ণের সিদ্ধি ও ঋদ্ধি দুটোই সমভাবে এসেছে। এখন তাঁর মনের যেমন পরিবর্তন ও পরিসরণ হয়েছে তেমনি নানা দর্শন-উপলব্ধি-ঐশ্বর্যে তিনি ঋদ্ধ হয়েছেন। দেবীচরণে দেহ-মন-প্রাণ আহুতি দিয়ে নিজে অন্তর-বাইরে জ্ঞানাগ্নি-পরিবৃত বোধ করেছেন। জগদ্‌ব্যাপী সদা নিনাদিত অনাহতধ্বনি শুনে তৃপ্ত হয়েছেন; অষ্টসিদ্ধির আবির্ভাব অনুভব করেছেন ও ঘৃণ্য জ্ঞানে পরিত্যাগ করেছেন; সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়রূপিণী মোহিনীমায়ামূর্তি, রূপ-লাবণ্যে অপরূপা ষোড়শীমূর্তি ও অন্যান্য নানা দেব-দেবী দর্শন করেছেন; মেরুদণ্ডের সুষুম্নামার্গে কুণ্ডলিনীর ঊর্ধ্বমুখ উত্তরণ ও মস্তকশীর্ষস্থ সহস্রারে তার সম্মিলন প্রত্যক্ষ করেছেন। সুষুম্নাদ্বারের উন্মুক্তি তাঁকে শিশুতে রূপান্তরিত করেছে। পরনের কাপড়, উপবীত চেষ্টা করেও শরীরে রাখতে পারছেন না। এটা যে ইচ্ছাকৃত তা নয়; তাঁর অজান্তেই এটা ঘটছে। সকল বস্তুতে অদ্বৈতভাব এত বেড়ে গেছে যে তুলসী ও সজিনা গাছের পাতা সমান পবিত্র বোধ করছেন।

নিজের একক প্রচেষ্টায় অন্ধের মতো চলতে চলতে শ্রীরামকৃষ্ণ আধ্যাত্মিকতার যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন, ব্রাহ্মণী নতুন পথে পরিচালিত করে তাঁকে স্বজ্ঞানে সেখানেই নিয়ে এলেন; রামকৃষ্ণ তাঁর পুরোনো অভিজ্ঞতাকে নতুন আলোয় নতুনভাবে উপলব্ধি করলেন। বরং বলা ভালো, শ্রীরামকৃষ্ণ শাস্ত্রের মধ্য দিয়েই শাস্ত্রের পার-এ উত্তীর্ণ হলেন। ব্রাহ্মণীও প্রমাণ করে দিলেন, প্রাচীন ঋষিরা অরণ্য-কুটিরে তালপাতায় যে শাস্ত্রবাক্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন আজও তা সমভাবে কার্যকরী ও প্রাসঙ্গিক।

শ্রীরামকৃষ্ণের কালীসাধনা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু হলো না। সাধনার শেষতম চূড়াটি এখনও যে তাঁর অধরা এবং সেখানে পৌঁছোনোই এখন তাঁর লক্ষ্য।

শ্রীশ্রীমা একদিন শ্রীরামকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আমাকে তোমার কি বলে মনে হয়?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘যে মা মন্দিরে আছেন, তিনিই এ শরীরের জন্ম দিয়েছেন ও এখন নহবতে বাস করছেন, আর তিনিই এখন আমার পদসেবা করছেন। সাক্ষাৎ আনন্দময়ীরূপ বলে তোমায় সর্বদা সত্য সত্য দেখতে পাই।’ এটা কোনও কথার কথা নয়, এটা তাঁর প্রাণের গভীর বিশ্বাস থেকে উৎসারিত চিরসত্য।

শুধু সহধর্মিণীকে কেন, নারীমাত্রেই তাঁর কাছে সাক্ষাৎ জগদম্বার প্রতিমূর্তি। জগতের প্রত্যেকের ওপর তাঁর মাতৃভাব ছিল। সেই মাতৃভাব বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে তাঁর প্রয়োজন হয়েছিল শ্রীশ্রীমাকে। পাষাণপ্রতিমায় যিনি প্রাণ সঞ্চার করতে পারেন তিনি এক মানবীর অন্তরের সুপ্ত দেবীভাবকে জাগাবেন এ আর আশ্চর্য কী! শ্রীরামকৃষ্ণ নির্জনে-নিভৃতে শ্রীশ্রীমাকে শক্তিমন্ত্রে অভিষিক্ত করে, শক্তি সঞ্চার করে, সসম্ভ্রমে অন্তরের পূজায় আত্মনিবেদন করে মাতৃত্বের আসনে তাঁকে আসীন করার প্রয়োজন উপলব্ধি করলেন। ষোড়শীপূজা সেই আত্মনিবেদন ও জাগরণের পূজা। এই পূজার মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীশ্রীমাকে বিশ্বমাতৃত্বের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। মাতৃশক্তি জাগরণের এই পূজা সমাপন করে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর মাতৃসাধনা সাঙ্গ করলেন আর সেই সঙ্গে বিশ্বের ধর্ম-ইতিহাসে সূচনা করে দিয়ে গেলেন এক বিস্ময়কর অধ্যায়।

চার

একদিন সকালে শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দ আর ধরে না। ঘুরে-ফিরে একই কথা বারবার বলছেন, ‘নরেন্দ্র কালী মেনেছে, বেশ হয়েছে— না?’ চরম দুঃখের মধ্য দিয়ে নরেন্দ্রকে কালী মানতে হলো। কেন মানতে হলো? স্বামীজি বললেন, ‘‘তা অত্যন্ত গুহ্য ব্যাপার,… তখন আমার অতি দুঃসময়।… মা সুবিধা পেলেন, আমাকে গোলাম করে ফেললেন। ঠাকুরের নিজের মুখের কথা, ‘তুই মায়ের গোলাম হবি।’ রামকৃষ্ণ পরমহংস আমাকে মায়ের হাতে সমর্পণ করলেন।’’

শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন, নরেন সাধারণ কেউ নয়। তাঁরই আহ্বানে জগন্মাতার বিশেষ যন্ত্ররূপে জগৎকে শিক্ষা দিতে তিনি এসেছেন। সেজন্য নরেনের ‘সমাধিঘরের চাবিটা’ নিজের কাছে রেখে দিয়ে ‘চাপরাশ’ লিখে দিলেন— ‘নরেন শিক্ষে দিবে।’ আদেশ করলেন, ‘তোকে কাজ করতে হবে।’

কী সেই কাজ? শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের সাধনবলে যে মহাশক্তিকে জাগিয়েছেন, সেই শক্তিতেই জগৎকে জাগাতে হবে— এই ছিল স্বামীজির কাজ। এই কাজ শক্তি সঞ্চারের জন্য নিজের ‘যথাসর্বস্ব’ দিয়ে ‘ফকির’ হয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। জগন্মাতা যে কার্যসিদ্ধির জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ-শরীরে আবির্ভূতা হয়েছিলেন, সেই একই প্রয়োজনে রামকৃষ্ণ শরীরের মাধ্যমে স্বামীজির শরীরেও পড়পড় করে ঢুকে পরেছিলেন। শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে স্বামীজি বলেছিলেন, ‘ঠাকুর যাকে ‘কালী’ ‘কালী’ বলে ডাকতেন… সেইটে এই শরীরে ঢুকে গেছে; সেইটেই আমাকে এদিক-ওদিক কাজ করিয়ে নিয়ে বেড়ায়— স্থির হয়ে থাকতে দেয় না,… আমার বোধহয়, ঐ শক্তিই আমাকে এ-কাজে সে-কাজে কেবল ঘুরোয়। বসে থাকবার জন্য আমার এ-দেহ হয়নি।’১০ বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন, তিনি সামান্য কাজেও মা কালী তাঁকে পরিচালনা করছেন, এমনকি তাঁকে দিয়ে যা খুশি তাই করছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্য সান্নিধ্যে এসে প্রথমদিকে বিবেকানন্দ যে স্নেহময়ী, লীলাময়ী, আনন্দময়ী ও সৌন্দর্যময়ী মা-কে চিনেছিলেন, জীবনসায়াহ্নে সেই কালীর রূপ তাঁর কাছে বদলে গেল— তাঁর কালী এখন ভীষমা, ভয়ংকরী। এখন তিনি ভয়ংকরের উপাসক। ভীষণের পূজাই এখন তাঁর মূলমন্ত্র। বিবেকানন্দের বক্তব্য, ‘সবাই সুখ চায় একথা বুল। প্রায় সমসংখ্যক লোক জন্মায় দুঃখকে বরণ করার জন্য।… মৃত্যু বা কালীকে উপাসনা করিতে সাহয় পায় কয়জন?’…১১

‘সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে

কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।’

এভাবেই কালীকে উপভোগ করেছেন স্বামীজি। জীবনকেও।

তথ্যসূচি :

১) শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ, স্বামী সারদানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৬০, ১ম ভাগ, সাধক ভাব, পৃ. ৬৪

২) শ্রীরামকৃষ্ণ—নবযুগের ধর্মসংস্থাপক, রিচার্ড শিফ্‌ম্যান, অনুবাদ : শৌটীর কিশোর চট্টোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৫, পৃ. ৪৪

৩) লীলাপ্রসঙ্গ, সাধকভাব, পৃ. ৬৫

৪) ঐ, পৃ. ১১৬

৫) শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম-কথিত, উদ্বোধন কার্যালয়, ১ম খণ্ড, ২০০৪, পৃ. ৫৯৪

৬) শ্রীমা সারদা দেবী, স্বামী গম্ভীরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০০৯, পৃ. ৩৮

৭) লীলাপ্রসঙ্গ, ২য় ভাগ, ২০০৬, ঠাকুরের দিব্যভাব ও নরেন্দ্রনাথ, পৃ. ১২৩

৮) যুগনায়ক বিবেকানন্দ, স্বামী গম্ভীরানন্দ, ১ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৯৯, পৃ. ১৬৩

৯) ঐ, পৃ. ১৫২

১০) স্বামী-শিষ্য-সংবাদ, শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০০২, পৃ. ১৯৭-৯৮

১১) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, উদ্বোধন কার্যালয়, ১০ম খণ্ড, পৃ. ২১৬, ২১৭


আপনার মতামত লিখুন :

2 responses to “শ্রীরামকৃষ্ণের কালীসাধনা : সঞ্জীব চক্রবর্তী”

  1. এস.ভট্টাচার্য says:

    অসাধারণ লেখনী।ঠাকুরের আত্মমননে মায়ের ভাবধারার মেলবন্ধন অপূর্ব।লেখকের কলমের মুন্সীয়ানা মুগ্ধ করেছে……..

  2. Koyel Chatterjee says:

    পুনরায় সমৃদ্ধ হলাম। বারবার পড়ে মনন ও চিন্তন উপযোগী লেখা । লেখকের প্রতি মা ভবতারিণী ও শ্রী শ্রী ঠাকুরের কৃপা প্রার্থনা করি ।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন