শনিবার | ১৪ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩১শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | রাত ৩:৩৫
Logo
এই মুহূর্তে ::
বল পয়েন্ট কলমের জার্নির জার্নাল : রিঙ্কি সামন্ত মহেঞ্জোদারো নামের নতুন ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস পরিসংখ্যানে দারিদ্রতা কমলেও পুষ্টি বা খাদ্য সংকট কি কমেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী অথ স্নান কথা : নন্দিনী অধিকারী তন্ত্র বিদ্যার বিশ্ববিদ্যালয় চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধুসভ্যতার ভাষায় ও স্থাননামে দ্রাবিড়চিহ্ন : অসিত দাস ধরনীর ধুলি হোক চন্দন : শৌনক দত্ত সিন্ধুসভ্যতার ভাষা মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবির নামে : অসিত দাস বিস্মৃতপ্রায় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় ভাষায় সিন্ধুসভ্যতার মেলুহার ভাষার প্রভাব : অসিত দাস বঙ্গতনয়াদের সাইক্লিস্ট হওয়ার ইতিহাস : রিঙ্কি সামন্ত নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘ঝড়ের পরে’ ভালো থাকার পাসওয়ার্ড (শেষ পর্ব) : বিদিশা বসু গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘সময়ের প্ল্যাকটফর্ম’ গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি : রঞ্জন সেন জামিষষ্ঠী বা জাময়ষষ্ঠী থেকেই জামাইষষ্ঠী : অসিত দাস কার্বাইডে পাকানো আম দিয়ে জামাইষষ্ঠীতে জামাই খাতির নয়, হতে পারে ক্যান্সার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ভক্তের ভগবান যখন জামাই (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত কাশ্মীর নিয়ে বিজেপির নেহরুকে দোষারোপ ধোপে টেকেনা : তপন মল্লিক চৌধুরী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই প্রভু জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় / ১৪৯৮ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২০

লক্ষ্মীপূজা

শরৎকালে দুর্গাপূজার পর যে পূর্ণিমা আসে সে পূর্ণিমায় ঘরে ঘরে লক্ষ্মী দেবীর পূজা করা হয়। ঐ পূর্ণিমাকে কোজাগরী পূর্ণিমা বলা হয়। কোজাগরী অর্থ ‘‘কে জেগে আছো’’। ঐ পূর্ণিমার দিন লক্ষ্মীদেবী সবাইকে ডেকে বলেন ‘‘কে জেগে আছো’’। ঐ রাতে যারা জেগে থাকে কেবল তারাই দেবীর কৃপালাভ করতে পারেন।

লক্ষ্মী দেবীর উৎপত্তি

বিষ্ণু পুরাণ, ভাগবত, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থ অনুসারে লক্ষ্মী দেবীর উৎপত্তি হয়েছে সমুদ্র থেকে। দুর্বাসা মুনির শাপে স্বর্গ একদা শ্রীহীন বা লক্ষ্মী-ছাড়া হয়ে যায়। তখন বিষ্ণুর পরামর্শে স্বর্গের ঐশ্বর্য ফিরে পাবার জন্য দেবগণ অসুরদের সাথে নিয়ে সমুদ্র-মন্থন শুরু করেন। সেই ক্ষীর-সমুদ্র মন্থনের ফলে উঠে আসল নানা রত্ন, মণি-মাণিক্য, অমৃতসুধা আরও কত কি। এসব ছাড়াও সমুদ্র-মন্থনের ফলে উঠে আসলেন লক্ষ্মী লক্ষ্মী দেবী এবং ঠাই পেলেন বিষ্ণুর বক্ষে। সমুদ্র থেকে দেবীর উদ্ভব বলে দেবীকে বলা হয় সমুদ্রোদ্ভবা। সমুদ্র হল অশেষ ধন-রত্নের আধার। ধনরত্নে পরিপূর্ণ বলে সমুদ্রকে রত্নাকরও বলা হয়। যেহেতু লক্ষ্মী দেবী হলেন ধন-সম্পদের দেবী সেহেতু সমুদ্র থেকে দেবী লক্ষ্মীর উৎপত্তির কাহিনী কল্পিত হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। বিষ্ণু হলেন জগতের প্রতিপালক। প্রজাদের লালন-পালন করতে ধন-রত্নের প্রয়োজন রয়েছে আর সেজন্যই বিষ্ণু ধন-ঐশ্বর্যের লক্ষ্মী দেবীকে বুকে স্থান দিলেন।

লক্ষ্মী দেবীর বাহন

লক্ষ্মী দেবীর বাহন পেঁচা কেন? পেঁচা লক্ষ্মী দেবীর সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্ম ধারণ করে। পেঁচা কুৎসিত ও দিবান্ধ। যারা সারা জীবন শুধু ধনলাভের চিন্তায় মগ্ন থাকে, তারা ঐ পেঁচার মতই অন্ধ হয়ে যায়। তাই জ্ঞানের আলো তাদের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। পেঁচা যেমন কালো অন্ধকারে পথ চলে, ধনলোভীরাও তেমনি কালো পথে অর্থাৎ অসৎ পথে ধাবিত হয়। ধনের দেবী তাঁর সঙ্গে পেঁচা রেখে সকলকে জানিয়ে দেন, যিনি ভক্তিধন অন্বেষণ করবে, তিনি আমাকে পাবে আর যিনি পার্থিব-ধন অন্বেষণ করবে তিনি আমাকে নয় আমার পেচাঁকে লাভ করবে।

মা লক্ষ্মীর ১০৮ নাম। এই নাম উচ্চারণে দারিদ্রতা নিবারণ হয়।

১) প্রকৃতি ,২) বিক্রুতি , ৩) বিদ্যা , ৪) সর্বভূতহিতপ্রদা, ৫) শ্রদ্ধা , ৬) বিভূতি, ৭) সুরভি, ৮) পরমাত্মিকা , ৯) জয়প্রদা , ১০) পদ্মালয়া , ১১) পদ্মা , ১২) শুচী, ১৩) স্বাহা, ১৪) স্বাধা, ১৫) সুধা , ১৬) ধন্যা , ১৭) হিরন্ময়ী, ১৮) লক্ষ্মী , ১৯) নিত্যাপুষ্টা, ২০) বিভা, ২১) অদিত্যা, ২২) দিত্যা, ২৩) দীপা, ২৪) বসুধা, ২৫) ক্ষীরোদা, ২৬) কমলাসম্ভবা, ২৭) কান্তা, ২৮) কামাক্ষী, ২৯) ক্ষীরোদসম্ভবা , ৩০) অনুগ্রহাপ্রদা, ৩১) ঐশ্বর্য্যা , ৩২) অনঘা, ৩৩) হরিবল্লভী, ৩৪) অশোকা , ৩৫) অমৃতা, ৩৬) দীপ্তা, ৩৭) লোকাশোকবিনাশিনী, ৩৮) ধর্মনিলয়া, ৩৯) করুণা, ৪০) লোকমাতা, ৪১) পদ্মপ্রিয়া, ৪২) পদ্মহস্তা, ৪৩) পদ্মাক্ষী , ৪৪) পদ্মসুন্দরী, ৪৫) পদ্মভবা, ৪৬) পদ্মমুখী, ৪৭) পদ্মনাভপ্রিয়া, ৪৮) রমা, ৪৯) পদ্মমালাধরা , ৫০) দেবী, ৫১) পদ্মিনী, ৫২) পদ্মগন্ধিণী , ৫৩) পুণ্যগন্ধা, ৫৪) সুপ্রসন্না, ৫৫) শশীমুখী , ৫৬) প্রভা, ৫৭) চন্দ্রবদনা, ৫৮) চন্দ্রা , ৫৯) চন্দ্রাসহোদরী , ৬০) চতুর্ভুজা , ৬১) চন্দ্ররূপা , ৬২) ইন্দিরা, ৬৩) ইন্দুশীতলা, ৬৪) আহ্লাদিণী, ৬৫) নারায়নী , ৬৬) বৈকুন্ঠেশ্বরি ৬৭) হরিদ্রা ৬৮) সত্যা , ৬৯) বিমলা, ৭০) বিশ্বজননী, ৭১) তুষ্টি, ৭২) দারিদ্রনাশিণী, ৭৩) ধনদা , ৭৪) শান্তা, ৭৫) শুক্লামাল্যাম্বরা , ৭৬) শ্রী, ৭৭) ভাস্করী , ৭৮) বিল্বনিলয়া , ৭৯) হরিপ্রিয়া , ৮০) যশস্বীনি , ৮১) বসুন্ধরা , ৮২) উদারঙ্গা, ৮৩) হরিণী , ৮৪) মালিনী, ৮৫) গজগামিনী , ৮৬) সিদ্ধি , ৮৭) স্ত্রৈন্যাসৌম্যা , ৮৮) শুভপ্রদা, ৮৯) বিষ্ণুপ্রিয়া , ৯০) বরদা , ৯১) বসুপ্রদা, ৯২) শুভা , ৯৩)চঞ্চলা , ৯৪) সমুদ্রতনয়া , ৯৫) জয়া , ৯৬) মঙ্গলাদেবী, ৯৭) বিষ্ণুবক্ষাস্থলাসিক্তা , ৯৮) বিষ্ণুপত্নী, ৯৯) প্রসন্নাক্ষী , ১০০) নারায়নসমাশ্রিতা, ১০১) দারিদ্রধ্বংসিণী, ১০২) কমলা, ১০৩) সর্বপ্রদায়িনী, ১০৪) পেঁচকবাহিণী, ১০৫) মহালক্ষ্মী, ১০৬) ব্রহ্মাবিষ্ণুশিবাত্মিকা, ১০৭) ত্রিকালজ্ঞানসম্পূর্ণা, ১০৮) ভুবনমোহিনী।

লক্ষ্মীর পাঁচালী

গণেশ বন্দনা

বন্দ দেব গজানন বিঘ্ন বিনাশন।

নমঃ প্রভু মহাকায় মহেশ নন্দন।।

সর্ববিঘ্ন নাশ হয় তোমার শরণে।

অগ্রেতে তোমার পূজা করিনু যতনে।।

নমো নমো লম্বোদর নমঃ গণপতি।

মাতা যার আদ্যাশক্তি দেবী ভগবতী।।

সর্বদেব গণনায় অগ্রে যার স্থান।

বিধি-বিষ্ণু মহেশ্বর আর দেবগণ।।

ত্রিনয়নী তারার বন্দিনু শ্রীচরণ।

বেদমাতা সরস্বতীর লইনু শরণ।।

শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর আবাহন

এস মা লক্ষ্মী, কমল বরণী, কমলালতিকা দেবী কমলিনী-

কমল আসনে, বিরাজ কমলা, কমলময়ী ফসলবাসিনী।।

কমল বসন, কমল ভূষণ, কমনীয় কান্তি অতি বিমোহন।

কোমল করে, শোভিছে কমল, ধান্যরূপা, মাতঃ জগৎপালিনী।।

কমল কিরিটি মণি মনোহরে, কমল সিঁদুরে শোভে দেখি শিরে।

কোমল কন্ঠে কমল হারে, কোমল বদন দেখি যে সুন্দরে।।

কমল চরণে কমল নূপুর, কমল অলক্ত মরি কি সুন্দর।

দীন মধুসূদনের সন্তাপ হর তুমি নারায়ণী শান্তিপ্রদায়িনী।।

শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর বরণ

তুমি মাগো লক্ষ্মীদেবী কমল বরণী।

কমললতিকা কৃপা কর নারায়ণী।।

সাজায়ে রেখেছি মাগো ধান্য-গুয়া-পান।

আসিয়া মাগো কর ঘটেতে অধিষ্ঠান।।

ঘরেতে ধূপ ধূনা আর ঘৃতবাতি।

হৃদয় কমলে ওমা করহ বসতি।।

পদ্মাসনে পদ্মদল রাখি থরে থরে।

শঙ্খ বাদ্যে বরণ করি তোমা ছরে।।

সবে করি লক্ষ্মীপূজা অতি সযতনে।

আশিস করহ মাতঃ আমা সব জনে।।

শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর বারমাসি পাঁচালী

বছরে বৈশাখ মাস প্রথম যে হয়।

পূজা নিতে এস গো মা আমার আলয়ে।।

জৈষ্ঠ্য মাসে ষষ্ঠী পূজা হয় ঘরে ঘরে।

কৃপা করি এস ওমা পূজা যে বা করে।।

আষাঢ়ে আসিতে মাগো নাহি কর দেরী।

পূজা হেতু রাখি মোরা ধান্য-দূর্বা ধরি।।

শ্রাবণের ধারা দেখ চারিধারে পড়ে।

পূজিবারে শ্রীচরণ ভেবেছি অন্তরে।।

ভাদরের ভরা নদী কূল বয়ে যায়।

কৃপা করে এস গো মা যত শীঘ্র হয়।।

আশ্বিনে অম্বিকা সাথে পূজা আয়োজন।

কোজাগরী রাতে পুনঃ করিব পূজন।।

কার্তিকে কেতকী ফুল চারিধারে ফোটে।

বসো এসে মাগো মোর পাতা এ ঘটে।।

অঘ্রাণে আমন ধান্যে মাঠ গেছে ভরে।

লক্ষ্মীপূজা করি মোরা অতি যত্ন করে।।

পৌষ পার্বণে মা গো যে মনের সাধেতে।

প্রতি ঘরে লক্ষ্মী পূজি নবান্ন দানেতে।।

মাঘমাসে মহালক্ষ্মী মহলে রহিবে।

নতুন ধান্য দিয়া পূজা করি মোরা সবে।।

ফাল্গুনে ফাগের খেলা চারিধারে হয়।

এস গো মা বিষ্ণুজায়া পূজিব তোমায়।।

চৈত্রেতে চাতকসম চাহি তব পানে।

এস ওমা পদ্মালয়া অধিনী ভবনে।।

লক্ষ্মীদেবী বারমাসি হৈল সমাপন।

দীন ভক্তজন দুঃখ কর নিবারণ।।

কাতরে ডাকিছে যত ভক্ত সন্তান।

ভক্তজন মাতা হয়ে করহ কল্যাণ।।

বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা

শরৎ পূর্ণিমার নিশি নির্মল গগন।

মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় পবন।।

লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ।

বৈকুন্ঠধামেতে বসি করে আলাপন।।

হেনকালে বীণা হাতে আসি মুনিবর।

হরিগুণগানে মত্ত হইয়া বিভোর।।

গান সম্বরিয়া উভে বন্দনা করিল।

বসিতে আসন তারে নারায়ণ দিল।।

মধুর বচনে লক্ষ্মী জিজ্ঞাসিল তায়।

কিবা মনে করি মুনি আসিলে হেথায়।।

কহে মুনি তুমি চিন্ত জগতের হিত।

সবার অবস্থা আছে তোমার বিদিত।।

সুখেতে আছয়ে যত মর্ত্যবাসীগণ।

বিস্তারিয়া মোর কাছে করহ বর্ণন।।

লক্ষ্মীমার হেন কথা শুনি মুনিবর।

কহিতে লাগিলা তারে জুড়ি দুই কর।।

অপার করুণা তোমার আমি ভাগ্যবান।

মর্ত্যলোকে নাহি দেখি কাহার কল্যাণ।।

সেথায় নাই মা আর সুখ শান্তি লেশ।

দুর্ভিক্ষ অনলে মাগো পুড়িতেছে দেশ।।

রোগ-শোক নানা ব্যাধি কলিতে সবায়।

ভুগিতেছে সকলেতে করে হায় হায়।।

অন্ন-বস্ত্র অভাবেতে আত্মহত্যা করে।

স্ত্রী-পুত্র ত্যাজি সবাই যায় দেশান্তরে।।

স্ত্রী-পুরুষ সবে করে ধর্ম পরিহার।

সদা চুরি প্রবঞ্চনা মিথ্যা অনাচার।।

তুমি মাগো জগতের সর্বহিতকারী।

সুখ-শান্তি সম্পত্তির তুমি অধিকারী।।

স্থির হয়ে রহ যদি প্রতি ঘরে ঘরে।

তবে কি জীবের এত দুঃখ হতে পারে?

নারদের বাক্য শুনি লক্ষ্মী বিষাদিতা।

কহিলেন মুনি প্রতি দোষ দাও বৃথা।।

নিজ কর্মফলে সবে করে দুঃখভোগ।

অকারণে মোর প্রতি কর অনুযোগ।।

শুন হে নারদ বলি যথার্থ তোমায়।

মম অংশে জন্ম লয় নারী সমুদয়।।

তারা যদি নিজ ধর্ম রক্ষা নাহি করে।

তবে কি অশান্তি হয় প্রতি ঘরে ঘরে।।

লক্ষ্মীর বচন শুনি মুনি কহে ক্ষুণ্ন মনে।

কেমনে প্রসন্ন মাতা হবে নারীগণে।।

কিভাবেতে পাবে তারা তব পদছায়া।

দয়াময়ী তুমি মাগো না করিলে দয়া।।

মুনির বাক্যে লক্ষ্মীর দয়া উপজিল।

মধুর বচনে তারে বিদায় করিল।।

নারীদের সর্বদুঃখ যে প্রকারে যায়।

কহ তুমি নারায়ণ তাহার উপায়।।

শুনিয়া লক্ষ্মীর বচন কহে লক্ষ্মীপতি।

কি হেতু উতলা প্রিয়ে স্থির কর মতি।।

প্রতি গুরুবারে মিলি যত বামাগণে।

করিবে তোমার ব্রত ভক্তিযুক্ত মনে।।

নারায়ণের বাক্যে লক্ষ্মী অতি হৃষ্টমন।

ব্রত প্রচারিতে মর্ত্যে করিল গমন।।

মর্ত্যে আসি ছদ্মবেশে ভ্রমে নারায়ণী।

দেখিলেন বনমধ্যে বৃদ্ধা এক বসিয়া আপনি।।

সদয় হইয়া লক্ষ্মী জিজ্ঞাসিল তারে।

কহ মাগো কি হেতু এ ঘোর কান্তারে।।

বৃদ্ধা কহে শোন মাতা আমি অভাগিনী।

কহিল সে লক্ষ্মী প্রতি আপন কাহিনী।।

পতি-পুত্র ছিল মোর লক্ষ্মীযুক্ত ঘর।

এখন সব ছিন্নভিন্ন যাতনাই সার।।

যাতনা সহিতে নারি এসেছি কানন।

ত্যাজিব জীবন আজি করেছি মনন।।

নারায়ণী বলে শুন আমার বচন।

আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন।।

যাও মা গৃহেতে ফিরি কর লক্ষ্মী ব্রত।

আবার আসিবে সুখ তব পূর্ব মত।।

গুরুবারে সন্ধ্যাকালে মিলি এয়োগণ।

করিবে লক্ষ্মীর ব্রত করি এক মন।।

কহি বাছা পূজা হেতু যাহা প্রয়োজন।

মন দিয়া শুনি লও আমার বচন।।

জলপূর্ণ ঘটে দিবে সিঁদুরের ফোঁটা।

আম্রের পল্লব দিবে তাহে এক গোটা।।

আসন সাজায়ে দিবে তাতে গুয়া-পান।

সিঁদুর গুলিয়া দিবে ব্রতের বিধান।।

ধূপ-দীপ জ্বালাইয়া রাখিবে ধারেতে।

শুনিবে পাঁচালী কথা দূর্বা লয়ে হাতে।।

একমনে ব্রত কথা করিবে শ্রবণ।

সতত লক্ষ্মীর মূর্তি করিবে চিন্তন।।

ব্রত শেষে হুলুধ্বনি দিয়ে প্রণাম করিবে।

এয়োগণে সবে মিলি সিঁদুর পরিবে।।

দৈবযোগে একদিন ব্রতের সময়।

দীন দুঃখী নারী একজন আসি উপনীত হয়।।

পতি তার চির রুগ্ন অক্ষম অর্জনে।

ভিক্ষা করি অতি কষ্টে খায় দুই জনে।।

অন্তরে দেবীরে বলে আমি অতি দীনা।

স্বামীরে কর মা সুস্থ আমি ভক্তি হীনা।।

লক্ষ্মীর প্রসাদে দুঃখ দূর হৈল তার।

নীরোগ হইল স্বামী ঐশ্বর্য অপার।।

কালক্রমে শুভক্ষণে জন্মিল তনয়।

হইল সংসার তার সুখের আলয়।।

এইরূপে লক্ষ্মীব্রত করি ঘরে ঘরে

ক্রমে প্রচারিত হল দেশ দেশান্তরে।।

এই ব্রত করিতে যেবা দেয় উপদেশ।

লক্ষ্মীদেবী তার প্রতি তুষ্ট সবিশেষ।।

এই ব্রত দেখি যে বা করে উপহাস।

লক্ষ্মীর কোপেতে তার হয় সর্বনাশ।।

পরিশেষে হল এক অপুর্ব ব্যাপার।

যে ভাবে ব্রতের হয় মাহাত্ম্য প্রচার।।

বিদর্ভ নগরে এক গৃহস্থ ভবনে।

নিয়োজিত বামাগণ ব্রতের সাধনে।।

ভিন দেশবাসী এক বণিক তনয়।

সি উপস্থিত হল ব্রতের সময়।।

বহুল সম্পত্তি তার ভাই পাঁচজন।

পরস্পর অনুগত ছিল সর্বক্ষণ।।

ব্রত দেখি হেলা করি সাধুর তনয়।

বলে এ কিসের ব্রত এতে কিবা ফলোদয়।।

বামাগণ বলে শুনি সাধুর বচন।

লক্ষ্মীব্রত করি সবে সৌভাগ্য কারণ।।

সদাগর শুনি ইহা বলে অহঙ্কারে।

অভাবে থাকিলে তবে পূজিব উহারে।।

ধনজন সুখভোগ যা কিছু সম্ভব।

সকল আমার আছে আর কিবা অভাব।।

কপালে না থাকে যদি লক্ষ্মী দিবে ধন।

হেন বাক্য কভু আমি না করি শ্রবণ।।

ধনমদে মত্ত হয়ে লক্ষ্মী করি হেলা।

নানা দ্রব্যে পূর্ণ তরি বানিজ্যেতে গেলা।।

গর্বিত জনেরে লক্ষ্মী সইতে না পারে।

সর্ব দুঃখে দুঃখী মাগো করেন তাহারে।।

বাড়ি গেল, ঘর গেল, ডুবিল পূর্ণ তরি,

চলে গেল ভ্রাতৃভাব হল যে ভিখারী।।

কি দোষ পাইয়া বিধি করিলে এমন।

অধম সন্তান আমি অতি অভাজন।।

সাধুর অবস্থা দেখি দয়াময়ী ভাবে।

বুঝাইব কেমনে ইহা মনে মনে ভাবে।।

নানা স্থানে নানা ছলে ঘুরাইয়া ঘানি।

অবশেষে লক্ষ্মীর ব্রতের স্থানে দিলেন আনি।।

মনেতে উদয় হল কেন সে ভিখারী।

অপরাধ ক্ষম মাগো কুপুত্র ভাবিয়া।।

অহঙ্কার দোষে দেবী শিক্ষা দিলা মোরে।

অপার করুণা তাই বুঝালে দীনেরে।।

বুঝালে যদি বা মাগো রাখগো চরণে।

ক্ষমা কর ক্ষমাময়ী আশ্রিত জনেরে।।

সত্যরূপিনী তুমি কমলা তুমি যে মা।

ক্ষমাময়ী নাম তব দীনে করি ক্ষমা।।

তুমি বিনা গতি নাই এ তিন ভুবনে।

স্বর্গেতে স্বর্গের লক্ষ্মী ত্রিবিধ মঙ্গলে।

তুমি মা মঙ্গলা দেবী সকল ঘরেতে।

বিরাজিছ মা তুমি লক্ষ্মী রূপে ভূতলে।।

দেব-নর সকলের সম্পদরূপিনী।

জগৎ সর্বস্ব তুমি ঐশ্বর্যদায়িনী।।

সর্বত্র পূজিতা তুমি ত্রিলোক পালিনী।

সাবিত্রী বিরিঞ্চিপুরে বেদের জননী।।

ক্ষমা কর এ দাসের অপরাধ যত।

তোমা পদে মতি যেন থাকে অবিরত।।

শ্রেষ্ঠ হতে শ্রেষ্ট তারা পরমা প্রকৃতি।

কোপাদি বর্জিতা তুমি মূর্তিমতি ধৃতি।

সতী সাধ্বী রমণীর তুমি মা উপমা।।

দেবগণ ভক্তি মনে পূজে সবে তোমা।।

রাস অধিষ্ঠাত্রী দেবী তুমি রাসেশ্বরী।

সকলেই তব অংশ যত আছে নারী।।

কৃষ্ণ প্রেমময়ী তুমি কৃষ্ণ প্রাণাধিকা।

তুমি যে ছিলে মাগো দ্বাপরে রাধিকা।।

প্রস্ফুটিত পদ্মবনে তুমি পদ্মাবতী।

মালতি কুসুমগুচ্ছে তুমি মা মালতি।।

বনের মাঝারে তুমি মাগো বনরাণী।

শত শৃঙ্গ শৈলোপরি শোভিত সুন্দরী।

রাজলক্ষ্মী তুমি মাগো নরপতি পুরে।

সকলের গৃহে লক্ষ্মী তুমি ঘরে ঘরে।

দয়াময়ী ক্ষেমঙ্করী অধমতারিণী।

অপরাধ ক্ষমা কর দারিদ্র্যবারিণী।।

পতিত উদ্ধার কর পতিতপাবনী।

অজ্ঞান সন্তানে কষ্ট না দিও জননী।।

অন্নদা বরদা মাতা বিপদনাশিনী।

দয়া কর এবে মোরে মাধব ঘরণী।।

এই রূপে স্তব করি ভক্তিপূর্ণ মনে।

একাগ্র মনেতে সাধু ব্রত কথা শোনে।।

ব্রতের শেষে নত শিরে করিয়া প্রণাম।

মনেতে বাসনা করি আসে নিজধাম।।

গৃহেতে আসিয়া বলে লক্ষ্মীব্রত সার।

সবে মিলি ব্রত কর প্রতি গুরুবারে।।

বধুরা অতি তুষ্ট সাধুর বাক্যেতে।

ব্রত আচরণ করে সভক্তি মনেতে।।

নাশিল সাধুর ছিল যত দুষ্ট সহচর।

দেবীর কৃপায় সম্পদ লভিল প্রচুর।।

আনন্দে পূর্ণিত দেখে সাধুর অন্তর।

পূর্ণতরী উঠে ভাসি জলের উপর।।

সাধুর সংসার হল শান্তি ভরপুর।

মিলিল সকলে পুনঃ ঐশ্বর্য প্রচুর।।

এভাবে নরলোকে হয় ব্রতের প্রচার।

মনে রেখ সংসারেতে লক্ষ্মীব্রত সার।।

এ ব্রত যে রমণী করে এক মনে।

দেবীর কৃপায় তার পূর্ণ ধনে জনে।।

অপুত্রার পুত্র হয় নির্ধনের ধন।

ইহলোকে সুখী অন্তে বৈকুন্ঠে গমন।।

লক্ষ্মীর ব্রতের কথা বড়ই মধুর।

অতি যতনেতে রাখ তাহা আসন উপর।

যে জন ব্রতের শেষে স্তব পাঠ করে।

অভাব ঘুচিয়া যায় লক্ষ্মীদেবীর বরে।।

লক্ষ্মীর পাঁচালী কথা হল সমাপন।

ভক্তি করি বর মাগো যার যাহা মন।।

সিঁথিতে সিঁদুর দাও সব এয়োমিলে।

হুলুধ্বনি কর সবে অতি কৌতুহলে।।

দুই হাত জোড় করি ভক্তিযুক্ত মনে।

নমস্কার করহ সবে দেবীর চরণে।।

লক্ষ্মীদেবীর স্তুতি

লক্ষ্মীস্তং সর্বদেবানাং যথাসম্ভব নিত্যশঃ।

স্থিরাভাব তথা দেবী মম জন্মনি জন্মনি।।

বন্দে বিষ্ণু প্রিয়াং দেবী দারিদ্র্য দুঃখনাশিনী।

ক্ষীরোদ সম্ভবাং দেবীং বিষ্ণুবক্ষ বিলাসিনীঃ।।

লক্ষ্মীদেবীর ধ্যান মন্ত্র

ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ সৃণিভির্যাম্য সৌম্যয়োঃ।

পদ্মাসনাস্থাং ধায়েচ্চ শ্রীয়ং ত্রৈলোক্য মাতরং।।

গৌরবর্ণাং স্বরূপাঞ্চ সর্বালঙ্কারভূষিতাম্।

রৌক্‌নোপদ্মব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।

শ্রীশ্রীলক্ষ্মী স্তোত্রম্

ত্রৈলোক্য পূজিতে দেবী কমলে বিষ্ণুবল্লভে।

যথাস্তং সুস্থিরা কৃষ্ণে তথা ভবময়ি স্থিরা।।

ঈশ্বরী কমলা লক্ষ্মীশ্চলা ভূতি হরিপ্রিয়া।

পদ্মা পদ্মালয়া সম্পদ সৃষ্টি শ্রীপদ্মধারিণী।।

দ্বাদশৈতানি নামানি লক্ষ্মীং সম্পূজ্য যঃ পঠেত।

স্থিরা লক্ষ্মীর্ভবেৎ তস্য পুত্রদারারদিভিংসহ।।

(তিন বার পাঠ করতে হবে)

পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র

নমস্তে সর্বদেবানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে।

যা গতিস্তং প্রপন্নানাং সা মে ভূয়াত্বদর্চবাৎ।।

শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর প্রণাম মন্ত্র

ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।

সর্বতঃ পাহি মাং দেবী মহালক্ষ্মী নমোহস্তু তে।।

 

শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা-পাঁচালি

দোলপূর্ণিমা নিশীথে নির্মল আকাশ।

মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস।।

লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ।

কহিতেছে নানা কথা সুখে আলাপন।।

হেনকালে বীণাযন্ত্রে হরি গুণগান।

উপনীত হইলেন নারদ ধীমান।।

ধীরে ধীরে উভপদে করিয়া প্রণতি।

অতঃপর কহিলেন লক্ষ্মীদেবী প্রতি।।

শুন গো, মা নারায়ণি, চলো মর্ত্যপুরে।

তব আচরণে দুখ পাইনু অন্তরে।।

তব কৃপা বঞ্চিত হইয়া নরনারী।

ভুঞ্জিছে দুর্গতি কত বর্ণিবারে নারি।।

সতত কুকর্মে রত রহিয়া তাহারা।

দুর্ভিক্ষ অকালমৃত্যু রোগে শোকে সারা।।

অন্নাভাবে শীর্ণকায় রোগে মৃতপ্রায়।

আত্মহত্যা কেহ বা করিছে ঠেকে দায়।।

কেহ কেহ প্রাণাধিক পুত্রকন্যা সবে।

বেচে খায় হায় হায় অন্নের অভাবে।।

অন্নপূর্ণা অন্নরূপা ত্রিলোকজননী।

বল দেবি, তবু কেন হাহাকার শুনি।।

কেন লোকে লক্ষ্মীহীন সম্পদ অভাবে।

কেন লোকে লক্ষ্মীছাড়া কুকর্ম প্রভাবে।।

শুনিয়া নারদবাক্য লক্ষ্মী ঠাকুরানি।

সঘনে নিঃশ্বাস ত্যজি কহে মৃদুবাণী।।

সত্য বাছা, ইহা বড় দুঃখের বিষয়।

কারণ ইহার যাহা শোনো সমুদয়।।

আমি লক্ষ্মী কারো তরে নাহি করি রোষ।

মর্ত্যবাসী কষ্ট পায় ভুঞ্জি কর্মদোষ।।

মজাইলে অনাচারে সমস্ত সংসার।

কেমনে থাকিব আমি বল নির্বিকার।।

কামক্রোধ লোভ মোহ মদ অহংকার।

আলস্য কলহ মিথ্যা ঘিরিছে সংসার।।

তাহাতে হইয়া আমি ঘোর জ্বালাতন।

হয়েছি চঞ্চলা তাই ওহে বাছাধন।।

পরিপূর্ণ হিংসা দ্বেষ তাদের হৃদয়।

পরশ্রী হেরিয়া চিত্ত কলুষিত ময়।।

রসনার তৃপ্তি হেতু অখাদ্য ভক্ষণ।

ফল তার হের ঋষি অকাল মরণ।।

ঘরে ঘরে চলিয়াছে এই অবিচার।

অচলা হইয়া রব কোন সে প্রকার।।

এসব ছাড়িয়া যেবা করে সদাচার।

তার গৃহে চিরদিন বসতি আমার।।

এত শুনি ঋষিবর বলে, নারায়ণি।

অনাথের মাতা তুমি বিঘ্নবিনাশিনী।।

কিবা ভাবে পাবে সবে তোমা পদছায়া।

তুমি না রাখিলে ভক্তে কে করিবে দয়া।।

বিষ্ণুপ্রিয়া পদ্মাসনা ত্রিতাপহারিণী।

চঞ্চলা অচলা হও পাপনিবারণী।।

তোমার পদেতে মা মোর এ মিনতি।

দুখ নাশিবার তব আছে গো শকতি।।

কহ দেবি দয়া করে ইহার বিধান।

দুর্গতি হেরিয়া সব কাঁদে মোর প্রাণ।।

দেবর্ষির বাক্য শুনি কমলা উতলা।

তাহারে আশ্বাস দানে বিদায় করিলা।।

জীবের দুঃখ হেরি কাঁদে মাতৃপ্রাণ।

আমি আশু করিব গো ইহার বিধান।।

নারদ চলিয়া গেলে দেবী ভাবে মনে।

এত দুঃখ এত তাপ ঘুচাব কেমনে।।

তুমি মোরে উপদেশ দাও নারায়ণ।

যাহাতে নরের হয় দুঃখ বিমোচন।।

লক্ষ্মীবাণী শুনি প্রভু কহেন উত্তর।

ব্যথিত কি হেতু প্রিয়া বিকল অন্তর।।

যাহা বলি, শুন সতি, বচন আমার।

মর্ত্যলোকে লক্ষ্মীব্রত করহ প্রচার।।

গুরুবারে সন্ধ্যাকালে যত নারীগণ।

পূজা করি ব্রতকথা করিবে শ্রবণ।।

ধন ধান্য যশ মান বাড়িবে সবার।

অশান্তি ঘুচিয়া হবে সুখের সংসার।।

নারায়ণ বাক্যে লক্ষ্মী হরষ মনেতে।

ব্রত প্রচারণে যান ত্বরিত মর্তেতে।।

উপনীত হন দেবী অবন্তী নগরে।

তথায় হেরেন যাহা স্তম্ভিত অন্তরে।।

ধনেশ্বর রায় হয় নগর প্রধান।

অতুল ঐশ্বর্য তার কুবের সমান।।

হিংসা দ্বেষ বিজারিত সোনার সংসার।

নির্বিচারে পালিয়াছে পুত্র পরিবার।

একান্নতে সপ্তপুত্র রাখি ধনেশ্বর।

অবসান নরজন্ম যান লোকান্তর।।

পত্নীর কুচক্রে পড়ি সপ্ত সহোদর।

পৃথগন্ন হল সবে অল্প দিন পর।।

হিংসা দ্বেষ লক্ষ্মী ত্যাজে যত কিছু হয়।

একে একে আসি সবে গৃহে প্রবেশয়।।

এসব দেখিয়া লক্ষ্মী অতি ক্রুদ্ধা হল।

অবিলম্বে সেই গৃহ ত্যজিয়া চলিল।।

বৃদ্ধ রানি মরে হায় নিজ কর্মদোষে।

পুরীতে তিষ্ঠিতে নারে বধূদের রোষে।।

পরান ত্যজিতে যান নিবিড় কাননে।

চলিতে অশক্ত বৃদ্ধা অশ্রু দুনয়নে।।

ছদ্মবেশে লক্ষ্মীদেবী আসি হেন কালে।

উপনীত হইলেন সে ঘোর জঙ্গলে।।

সদয় কমলা তবে জিজ্ঞাসে বৃদ্ধারে।

কিবা হেতু উপনীত এ ঘোর কান্তারে।।

লক্ষ্মীবাক্যে বৃদ্ধা কহে শোন ওগো মাতা।

মন্দভাগ্য পতিহীনা করেছে বিধাতা।।

ধনবান ছিল পিতা মোর পতি আর।

লক্ষ্মী বাঁধা অঙ্গনেতে সতত আমার।।

সোনার সংসার মোর ছিল চারিভিতে।

পুত্র পুত্রবধূ ছিল আমারে সেবিতে।।

পতি হল স্বর্গবাসী সুখৈশ্বর্য যত।

একে একে যাহা কিছু হল তিরোহিত।।

ভিন্ন ভিন্ন হাঁড়ি সব হয়েছে এখন।

অবিরত বধূ যত করে জ্বালাতন।।

অসহ্য হয়েছে এবে তাদের যন্ত্রণা।

এ জীবন বিসর্জিতে করেছি বাসনা।।

বৃদ্ধা বাক্যে নারায়ণী কহেন তখন।

আত্মহত্যা মহাপাপ শাস্ত্রের বচন।।

ফিরে যাও ঘরে তুমি কর লক্ষ্মীব্রত।

সর্ব দুঃখ বিমোচিত পাবে সুখ যত।।

গুরুবারে সন্ধ্যাকালে বধূগণ সাথে।

লক্ষ্মীব্রত কর সবে হরষ মনেতে।।

পূর্ণ ঘটে দিবে শুধু সিঁদুরের ফোঁটা।

আম্রশাখা দিবে তাহে লয়ে এক গোটা।।

গুয়াপান দিবে তাতে আসন সাজায়ে।

সিন্দূর গুলিয়া দিবে ভক্তিযুক্ত হয়ে।।

ধূপ দীপ জ্বালাইয়া সেইখানে দেবে।

দূর্বা লয়ে হাতে সবে কথা যে শুনিবে।।

লক্ষ্মীমূর্তি মানসেতে করিবেক ধ্যান।

ব্রতকথা শ্রবণান্তে শান্ত করে প্রাণ।।

কথা অন্তে ভক্তিভরে প্রণাম করিবে।

অতঃপর এয়োগণ সিঁদুর পরাবে।।

প্রতি গুরুবারে পূজা যে রমণী করে।

নিষ্পাপ হইবে সে কমলার বরে।।

বার মাস পূজা হয় যে গৃহেতে।

অচলা থাকেন লক্ষ্মী সেই সে স্থানেতে।।

পূর্ণিমা উদয় হয় যদি গুরুবারে।

যেই নারী এই ব্রত করে অনাহারে।।

কমলা বাসনা তার পুরান অচিরে।

মহাসুখে থাকে সেই সেই পুত্রপরিবারে।।

লক্ষ্মীর হাঁড়ি এক স্থাপিয়া গৃহেতে।

তণ্ডুল রাখিবে দিন মুঠা প্রমাণেতে।।

এই রূপে নিত্য যেবা সঞ্চয় করিবে।

অসময়ে উপকার তাহার হইবে।।

সেথায় প্রসন্না দেবী কহিলাম সার।

যাও গৃহে ফিরে কর লক্ষ্মীর প্রচার।।

কথা শেষ করে দেবী নিজ মূর্তি ধরে।

বৃদ্ধারে দিলেন দেখা অতি কৃপা ভরে।।

লক্ষ্মী হেরি বৃদ্ধা আনন্দে বিভোর।

ভূমিষ্ট প্রণাম করে আকুল অন্তর।।

ব্রত প্রচারিয়া দেবি অদৃশ্য হইল।

আনন্দ হিল্লোলে ভেসে বৃদ্ধা ঘরে গেল।।

বধূগণে আসি বৃদ্ধা বর্ণনা করিল।

যে রূপেতে বনমাঝে দেবীরে হেরিল।।

ব্রতের পদ্ধতি যাহা কহিল সবারে।

নিয়ম যা কিছু লক্ষ্মী বলেছে তাহারে।।

বধূগণ এক হয়ে করে লক্ষ্মীব্রত।

স্বার্থ দ্বেষ হিংসা যত হইল দূরিত।।

ব্রতফলে এক হল সপ্ত সহোদর।

দুঃখ কষ্ট ঘুচে যায় অভাব সত্বর।।

কমলা আসিয়া পুনঃ আসন পাতিল।

লক্ষ্মীহীন সেই গৃহে লক্ষ্মী অধিষ্ঠিল।।

দৈবযোগে একদিন বৃদ্ধার গৃহেতে।

আসিল যে এক নারী ব্রত সময়েতে।।

লক্ষ্মীকথা শুনি মন ভক্তিতে পুরিল।

লক্ষ্মীব্রত করিবে সে মানত করিল।।

কুষ্ঠরোগগ্রস্থ পতি ভিক্ষা করি খায়।

তাহার আরোগ্য আশে পূজে কমলায়।।

ভক্তিভরে এয়ো লয়ে যায় পূজিবারে।

কমলার বরে সব দুঃখ গেল দূরে।।

পতির আরোগ্য হল জন্মিল তনয়।

ঐশ্বর্যে পুরিল তার শান্তির আলয়।।

লক্ষ্মীব্রত এই রূপে প্রতি ঘরে ঘরে।

প্রচারিত হইল যে অবন্তী নগরে।।

অতঃপর শুন এক অপূর্ব ঘটন।

ব্রতের মাহাত্ম্য কিসে হয় প্রচলন।।

একদিন গুরুবারে অবন্তীনগরে।

মিলি সবে এয়োগন লক্ষ্মীব্রত করে।।

শ্রীনগরবাসী এক বণিক নন্দন।

দৈবযোগে সেই দেশে উপনীত হন।।

লক্ষ্মীপূজা হেরি কহে বণিক তনয়।

কহে, এ কি পূজা কর, কিবা ফল হয়।।

বণিকের কথা শুনি বলে নারীগণ।

লক্ষ্মীব্রত ইহা ইথে মানসপূরণ।।

ভক্তিভরে যেই নর লক্ষ্মীব্রত করে।

মনের আশা তার পুরিবে অচিরে।।

সদাগর এই শুনি বলে অহংকারে।।

অভাগী জনেতে হায় পূজে হে উহারে।।

ধনজনসুখ যত সব আছে মোর।

ভোগেতে সদাই আমি রহি নিরন্তর।।

ভাগ্যে না থাকিলে লক্ষ্মী দিবে কিবা ধন।

একথা বিশ্বাস কভু করি না এমন।।

হেন বাক্য নারায়ণী সহিতে না পারে।

অহংকার দোষে দেবী ত্যজিলা তাহারে।।

বৈভবেতে পূর্ণ তরী বাণিজ্যেতে গেলে।

ডুবিল বাণিজ্যতরী সাগরের জলে।

প্রাসাদ সম্পদ যত ছিল তার।

বজ্র সঙ্গে হয়ে গেল সব ছারখার।।

ভিক্ষাঝুলি স্কন্ধে করি ফিরে দ্বারে দ্বারে।

ক্ষুধার জ্বালায় ঘোরে দেশ দেশান্তরে।।

বণিকের দশা যেই মা লক্ষ্মী দেখিল।

কমলা করুণাময়ী সকলি ভুলিল।।

কৌশল করিয়া দেবী দুঃখ ঘুচাবারে।

ভিক্ষায় পাঠান তারে অবন্তী নগরে।।

হেরি সেথা লক্ষ্মীব্রত রতা নারীগণে।

বিপদ কারণ তার আসিল স্মরণে।।

ভক্তিভরে করজোড়ে হয়ে একমন।

লক্ষ্মীর বন্দনা করে বণিক নন্দন।।

ক্ষমা কর মোরে মাগো সর্ব অপরাধ।

তোমারে হেলা করি যত পরমাদ।।

অধম সন্তানে মাগো কর তুমি দয়া।

সন্তান কাঁদিয়া মরে দাও পদছায়া।।

জগৎ জননী তুমি পরমা প্রকৃতি।

জগৎ ঈশ্বরী তবে পূজি নারায়ণী।।

মহালক্ষ্মী মাতা তুমি ত্রিলোক মণ্ডলে।

গৃহলক্ষ্মী তুমি মাগো হও গো ভূতলে।।

রাস অধিষ্ঠাত্রী তুমি দেবী রাসেশ্বরী।

তব অংশভূতা যত পৃথিবীর নারী।।

তুমিই তুলসী গঙ্গা কলুষনাশিনী।

সারদা বিজ্ঞানদাত্রী ত্রিতাপহারিণী।।

স্তব করে এইরূপে ভক্তিযুক্ত মনে।

ভূমেতে পড়িয়া সাধু প্রণমে সে স্থানে।।

ব্রতের মানত করি নিজ গৃহে গেল।

গৃহিণীরে গৃহে গিয়া আদ্যান্ত কহিল।।

সাধু কথা শুনি তবে যত নারীগণ।

ভক্তিভরে করে তারা লক্ষ্মীর পূজন।।

সদয় হলেন লক্ষ্মী তাহার উপরে।

পুনরায় কৃপাদৃষ্টি দেন সদাগরে।।

সপ্ততরী জল হতে ভাসিয়া উঠিল।

আনন্দেতে সকলের অন্তর পূরিল।।

দারিদ্র অভাব দূর হইল তখন।

আবার সংসার হল শান্তি নিকেতন।।

এইরূপে ব্রতকথা মর্ত্যেতে প্রচার।

সদা মনে রেখো সবে লক্ষ্মীব্রত সার।।

এই ব্রত যেই জনে করে এক মনে।

লক্ষ্মীর কৃপায় সেই বাড়ে ধনে জনে।।

করজোড় করি সবে ভক্তিযুক্ত মনে।

লক্ষ্মীরে প্রণাম কর যে থাক যেখানে।।

ব্রতকথা যেবা পড়ে যেবা রাখে ঘরে।

লক্ষ্মীর কৃপায় তার মনোবাঞ্ছা পুরে।।

লক্ষ্মীর ব্রতের কথা বড়ো মধুময়।

প্রণাম করিয়া যাও যে যার আলয়।।

লক্ষ্মীব্রতকথা হেথা হৈল সমাপন।

আনন্দ অন্তরে বল লক্ষ্মী-নারায়ণ।।

শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর বারমাস্যা

বছরের প্রথম মাস বৈশাখ যে হয়।

পূজা নিতে এস ওমা আমার আলয়।।

জ্যৈষ্ঠ মাসে ষষ্ঠী পূজা হয় ঘরে ঘরে।

এসো বসো তুমি ওমা পূজার বাসরে।।

আষাঢ়ে আসিতে মাগো নাহি করো দেরি।

পূজা হেতু রাখি মোরা ধান্য দুর্বা ধরি।।

শ্রাবণের ধারা দেখ চারি ধারে পড়ে।

পূজিবারে ও চরণ ভেবেছি অন্তরে।।

ভাদ্র মাসে ভরা নদী কুল বেয়ে যায়।

কৃপা করি এসো মাগো যত শীঘ্র হয়।।

আশ্বিনে অম্বিকা সাথে পূজা আয়োজন।

কোজাগরী রাতে পুনঃ করিব পূজন।।

কার্তিকে কেতকী ফুল চারিধারে ফোটে।

এসো মাগো এসো বসো মোর পাতা ঘটে।।

অঘ্রাণে আমন ধান্যে মাঠ গেছে ভরে।

লক্ষ্মীপূজা করি মোরা অতি যত্ন করে।।

পৌষপার্বনে মাগো মনের সাধেতে।

প্রতি গৃহে লক্ষ্মী পূজি নবান্ন ধানেতে।।

মাঘ মাসে মহালক্ষ্মী মহলেতে রবে।

নব ধান্য দিয়া মোরা পূজা করি সবে।।

ফাল্গুনে ফাগের খেলা চারিধারে হয়।

এসো মাগো বিষ্ণুজায়া পূজিগো তোমায়।।

চৈত্রেতে চাতক সম চাহি তব পানে।

আসিয়া বস ওমা দুঃখিনীর ভবনে।।

লক্ষ্মীদেবী বারমাস্যা হৈল সমাপন।

ভক্তজন মাতা তুমি করহ কল্যাণ।।

ছবি কৃতজ্ঞতা : শিল্পী রবি ভার্মা


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন