সোমবার | ২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ১০:৫০
Logo
এই মুহূর্তে ::
অসুখবেলার পাণ্ডুলিপি : পুরুষোত্তম সিংহ বাবু-ইংরেজি আর সাহেবি বাংলা : মাহবুব আলম সিন্ধুসভ্যতার ফলক ও সিলে হরিণের শিং-বিশিষ্ট ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি : অসিত দাস বৈশাখ মাসে কৃষ্ণপক্ষে শ্রীশ্রীবরুথিনী একাদশীর ব্রতকথা মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত সিন্ধুসভ্যতার লিপি যে প্রোটোদ্রাবিড়ীয়, তার অকাট্য প্রমাণ : অসিত দাস বাঙালির মায়াকাজল সোনার কেল্লা : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ট্যাটু এখন ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ : রিঙ্কি সামন্ত ফের আমেদাবাদে হিন্দুত্ববাদীদের অন্য ধর্মের উপর হামলা : তপন মল্লিক চৌধুরী লোকসংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য ও তাঁর চিঠি : দিলীপ মজুমদার নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ : শিবরাম চক্রবর্তী নববর্ষ গ্রাম থেকে নগরে : শিহাব শাহরিয়ার ফিরে আসছে কলের গান : ফজলুল কবির সিন্ধুসভ্যতার ফলকে খোদিত ইউনিকর্ন আসলে একশৃঙ্গ হরিণ : অসিত দাস একটু রসুন, রসুনের কথা শুনুন : রিঙ্কি সামন্ত ১২ বছর পর আরামবাগে শোলার মালা পরিয়ে বন্ধুত্বের সয়লা উৎসব জমজমাট : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কোনিয়াকদের সঙ্গে দু’দিন : নন্দিনী অধিকারী স্বচ্ছ মসলিনের অধরা ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস বাড়বে গরম, চোখের নানান সমস্যা থেকে সাবধান : ডা. তনুশ্রী চক্রবর্তী আঠালো মাটি ফুঁড়ে জন্মানো শৈশব : আনন্দগোপাল হালদার মাইহার ঘরানার সম্রাট আলি আকবর খান (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত ওয়াকফ হিংসার জের কি মুর্শিদাবাদেই থেমে গিয়েছে : তপন মল্লিক চৌধুরী এক বাগদি মেয়ের লড়াই : দিলীপ মজুমদার এই সেনসরশিপের পিছনে কি মতাদর্শ থাকতে পারে : কল্পনা পাণ্ডে শিব কম্যুনিস্ট, বিষ্ণু ক্যাপিটেলিস্ট : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘গায়ন’ থেকেই গাজন শব্দের সৃষ্টি : অসিত দাস কালাপুষ্প : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হোক বাঙালি-অস্মিতার প্রচারযাত্রা : দিলীপ মজুমদার মাইহার ঘরানার সম্রাট আলি আকবর খান (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত পেজফোর-এর নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩২ প্রকাশিত হল সিন্ধিভাষায় দ্রাবিড় শব্দের ব্যবহার : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সতীর ৫১ পীঠের (শক্তিপীঠ) শুলুক সন্ধানে (প্রথম পর্ব) : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় / ৩২৩৬ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ১ নভেম্বর, ২০২১

‘পীঠ’ কথাটির অভিধানগত অর্থ ‘দেব দেবীর আসন’, দেবতা যেখানে বিশেষভাবে বিরাজিত। পীঠনির্ণয়-তন্ত্র অনুসারে একান্নটি শক্তিপীঠ—

(১) তারাপীঠ, (২) ক্ষীরগ্রাম, (৩) কামাখ্যা, (৪) কালীঘাট,  (৫) হিংলাজ,  (৬)  ভৈরব পাহাড়, (৭) নলহাটি, (৮) অমরনাথ, (৯) অট্টহাস, (১০) বহুলা, (১১) বক্রেশ্বর, (১২) ভবানীপুর, (১৩) ছিন্নমস্তিকা (চিৎপূর্ণী), (১৪) গন্ধকী, (১৫) নাসিক, (১৬) জয়ন্তী, (১৭) যশোরেশ্বরী, (১৮) জ্বালামুখী, (১৯) অমরকণ্টক, (২০) কন্যাকুমারী, (২১) কঙ্কালীতলা, (২২) কর্নাট, (২৩) কিরীটেশ্বরী (কিরীট), (২৪) আনন্দময়ী, (২৫) ভ্রামরী, (২৬) মানস, (২৭) মণিবন্ধ, (২৮) মিথিলা, (২৯) নয়নাতিভু (মণিপল্লবম), (৩০) পশুপতিনাথ, (৩১) চন্দ্রনাথ পাহাড়, (৩২) পঞ্চসাগর, (৩৩) প্রভাস, (৩৪) প্রয়াগ, (৩৫) কুরুক্ষেত্র, (৩৬) ত্রিহুত, (৩৭) সাঁইথিয়া, (৩৮) রাজামুন্দ্রী,  (৩৯) নয়না দেবী, (৪০) শ্রীপর্বত,  (৪১) শ্রীশৈল, (৪২) সূচিদেশ (দন্তেওয়াড়া), (৪৩) সুগন্ধা, (৪৪) উদয়পুর, (৪৫) মানবক্ষেত্র, (৪৬) বারানসী, (৪৭) জলন্ধর, (৪৮) বর্গভীমা, (৪৯) বৃন্দাবন, (৫০) বৈদ্যনাথ ধাম, (৫১) পুরী (উৎকল)।

সাধারণভাবে এই একান্নটি শক্তিপীঠের নাম থাকলেও বিভিন্ন আধ্যাত্মিক রচনায় সংখ্যাটা অন্য।

জ্ঞানার্ণবতন্ত্রে পীঠের সংখ্যা পঞ্চাশ, কুব্জিকাতন্ত্রে বিয়াল্লিশ। শিবচরিতে একান্নটি পীঠের সঙ্গে সঙ্গে ছাব্বিশটি উপপীঠের বর্ণনা।

তন্ত্রসার গ্রন্থ অনুসারে মূল পীঠ চারটি: জলন্ধর, উড্ডীয়ান, পূর্ণগিরি, কামরূপ।

কালিকাপুরাণে মূল চারটি পীঠ: ওড্রা, জালশৈল, পূর্ণশৈল, কামরূপ। যদিও কালিকাপুরাণের অষ্টাদশ অধ্যায়ে পীঠসংখ্যা বাড়িয়ে সাত করা হয়েছে। দেবীকূট, উড্ডীয়ান, কামগিরি, কামরূপ, জলন্ধর, পূর্ণগিরি, কামরূপ সীমান্ত।

কুব্জিকাতন্ত্রে পীঠ: কর্ণসুবর্ণ, ক্ষীরগ্রাম, বৈদ্যনাথ, বিল্বক, কিরীট, অশ্বতীর্থ, মঙ্গলকোট, অট্টহাস

তন্ত্রচূড়ামণি মতে পীঠ: বহুলা, উজালী, ক্ষীরখন্ড, কিরীট, নলহাটি, বক্রেশ্বর, অট্টহাস, নন্দীপুর।

প্রতি পীঠে দেবী আলাদা নামে পূজিতা।

শক্তিপীঠ গড়ে ওঠার পিছনে যে পৌরাণিক কথা— দক্ষরাজার সভায় সতীর দেহত্যাগ, মহাদেবের প্রলয়নৃত্য থামাতে বিষ্ণুর সুদর্শনচক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ফেলা, আর সে দেহাংশ যে যে স্থানে পড়লো সেখানেই শক্তিপীঠ গড়ে ওঠা—অনুরূপ একটি গল্প মিশরের পুরাণে আছে। মিশরের প্রিয় দেবতা ওসিরিজ। মাথায় সাপ, পরনে বাঘছাল, বাহন এপিস নামের ষাঁড়। ঠিক যেন আমাদের মহাদেব। ওসিরিজের স্ত্রী দেবী আইসিস। ওসিরিজের ভাই সেট ওসিরিজের প্রতি ঈর্ষায় মত্ত হয়ে একদিন তাঁকে হত্যা করে নীলনদের জলে সে দেহ ভাসিয়ে দিলেন। আইসিস পাগলের মতো স্বামীকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। নীলনদের ধারে অবশেষে খুঁজেও পেলেন। সেই দেহ নিয়ে তিনি টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন। যে যে স্থানে ওসিরিজের দেহাংশ পড়ল, সেখানে একটি করে তীর্থস্থান গড়ে উঠল।

আমরা ইতিহাস থেকে জেনেছি, সেকালে ভারত এবং মিশরে বাণিজ্য ব্যবস্থা ছিল। প্রশ্ন জাগে, কোন পুরাণ-কথাটি বেশি প্রাচীন! এই গল্পকথা কি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই প্রচারিত হয়েছিল? ওসিরিজের শরীরের টুকরোগুলো মিশরেই পড়লো? সতীর দেহাংশ কেবল ভারতবর্ষে? সবচেয়ে মজার কথা, শক্তিপীঠ যে দেবীর দেহাংশ পড়েই গড়ে উঠেছে, সে তথ্য প্রথম জানা গেছে ষোড়শ শতাব্দীর আইন-ই-আকবরী থেকে। আমরা এখানে যতটা সম্ভব শক্তিপীঠের কিছুটা ইতিহাস জানাবার চেষ্টা করছি।

তারাপীঠ : সতীর ৫১ পিঠের একটি পীঠ। বীরভূম জেলার রামপুরহাটে এটি অবস্থিত। দেবীর দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যখন বিভিন্ন জায়গায় পরেছিল তখন, দেবীর দেহাংশের একটি অংশ এখানে পড়েছিল। সেটি হল নয়ন তারা। বশিষ্ঠ নামে এক ঋষি সেটি দেখতে পেয়েছিলেন এবং তারপর থেকেই এখানে দেবীকে তারা নামে পূজা করা হয়। হিন্দুদের কাছে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পীঠ। এটি হল সিদ্ধপীঠ। অর্থাৎ এখানে অনেকে বিভিন্ন বিষয়ে সাধনা করেন।

লোকমুখে প্রচারিত একটি কিংবদন্তী অনুসারে, বশিষ্ঠ এখানে তারাদেবীর তপস্যা করেছিলেন। কিন্তু তিনি অসফল হন। তখন তিনি তিব্বতে গিয়ে বিষ্ণুর অবতার বুদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বুদ্ধ তাঁকে বামমার্গে মদ্যমাংসাদি পঞ্চমকার-সহ তারাদেবীর পূজা করতে বলেন। এই সময় বুদ্ধ ধ্যানযোগে জানতে পারেন মন্দিরে তারামূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজার করার আদর্শ স্থান হল তারাপীঠ। বুদ্ধের উপদেশক্রমে বশিষ্ঠ তারাপীঠে এসে ৩ লক্ষ বার তারা মন্ত্র জপ করেন। তারাদেবী প্রীত হয়ে বশিষ্ঠের সম্মুখে উপস্থিত হন। বশিষ্ঠ দেবীকে অনুরোধ করেন বুদ্ধ যে শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা তারাদেবীকে ধ্যানে দেখেছিলেন, দেবী যেন সেই রূপেই তাঁকে দর্শন দেন। দেবী সেই রূপেই বশিষ্ঠকে দর্শন দেন এবং এই রূপটি প্রস্তরীভূত হয়। সেই থেকে তারাপীঠ মন্দিরে শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা মূর্তিতে দেবী তারা পূজিত হয়ে আসছেন।

ক্ষীরগ্রাম : বর্ধমানের এই গ্রামে পড়েছিল সতীর আঙুল-সহ ডান পায়ের পাতা। সতী এখানে যোগদায়া (যোগ্যাদ্যা)। শিবের নাম ক্ষীরকান্ত। মঙ্গলকোটের একটি আপাত নিরীহ জনপদ। সতীপীঠের অন্যতম একটি পীঠ হল এই গ্রাম। এখানকার দেবী হলেন মা যোগ্যাদ্যা। দেবী মহামায়ার অন্য এক রূপ। মার্কণ্ডেয় পুরাণে এই দেবীর বর্ণনা পাওয়া যায়। অবধূতা রামায়ণ অনুসারে মহাকালী বা ভদ্রকালী অর্থাৎ দেবী মহামায়ার সেবক মহীরাবণ অবতার রাম ও লক্ষণ কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে ছলনায় পাতালে নিয়ে আসে। মহাকালীর সামনে বলিদান দেওয়ার সময় মহীরাবণকেই বধ করে লক্ষণ, পরে দেবী মহামায়া-সহ সেবক হনুমান রাম ও লক্ষণকে উদ্ধার করে তিন দিন ধরে লাগাতার পাতাল পথে এই ক্ষীরগ্রামে ওঠে। অবতার রাম ও লক্ষণ রাঢ় অঞ্চলে থাকতে পারেননি। কিন্তু দেবী মহামায়া বা মহাকালী বা ভদ্রকালী যোগাদ্যা হয়ে রাঢ় বঙ্গে অন্ত্যজ শ্রেণির হাতে পূজিত হতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশকে রাজা কীর্তিচাঁদ রায় প্রায় ৮ বিঘা জমির উপর গ্রামের মূল ভূভাগ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায় মন্দির তৈরি করে দেন।

কামাখ্যা (অসম) : অসমের গুয়াহাটিতে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে নীলাচল পাহাড়ের উপরে দেবী কামাখ্যার মন্দির। পুরাণ বলে, এখানে দেবীর যোনি পড়েছিল। দেবীর নামও এখানে কামাখ্যা। জাগ্রত এই মন্দিরের কাছেই ব্রহ্মপুত্রের চরে আছে উমানন্দ মন্দির। শিবের নাম এখানে উমানন্দ। কামাখ্যা মন্দির হল ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতে। কামাখ্যা ৫১ সতীপীঠের অন্যতম। এই মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দিরও আছে। এই মন্দিরগুলিতে দশমহাবিদ্যা অর্থাৎ ভুবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী ও কমলা—এই দশ দেবীর মন্দিরও রয়েছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্যান্য দেবীদের জন্য পৃথক মন্দির আছে। কামাখ্যা মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে—গর্ভগৃহ ও তিনটি মণ্ডপ (যেগুলির স্থানীয় নাম চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির)। গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। অন্যগুলির স্থাপত্য তেজপুরের সূর্যমন্দিরের সমতুল্য। এগুলিতে খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্যভারতীয় মন্দিরের আদলে নির্মিত খোদাইচিত্র দেখা যায়। মন্দিরের চূড়াগুলি মৌচাকের মতো দেখতে। নিম্ন আসামের বহু মন্দিরে এই ধরনের চূড়া দেখা যায়। গর্ভগৃহটি আসলে ভূগর্ভস্থ একটি গুহা। এখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু একটি পাথরের সরু গর্ত দেখা যায়। গর্ভগৃহটি ছোটো ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। সরু খাড়াই সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে পৌঁছাতে হয়। ভিতরে ঢালু পাথরের একটি খণ্ড আছে যেটি যোনির আকৃতিবিশিষ্ট। এটিতে প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর একটি গর্ত দেখা যায়। একটি ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল বেরিয়ে এই গর্তটি সবসময় ভর্তি রাখে। এই গর্তটিই দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত এবং দেবীর পীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ।

কালীঘাট : কলকাতার ল্যান্ডমার্কগুলোর মধ্যে অন্যতম এই মন্দির। শিব এখানে নকুলিশবানকুলেশ্বর। কালীক্ষেত্র কালীঘাটে সতীর দক্ষিণ পদের চরটি খণ্ডিত আঙুল পড়েছিল। সাবর্ণ বংশের জীয়া গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতীদেবীর সন্তান না হওয়ায় তারা কালীক্ষেত্রে সাধনা করতে আসেন হালিশহর থেকে। সাধনা চলাকালীন পদ্মাবতীদেবী এক দৈববাণী শুনতে পেলেন যে—“তোদের সাধনায় আমি তুষ্ট হয়েছি, তোদের কোলে আমার বরপুত্র আসছে আর পদ্মাবতী যেখানে স্নান করছিস সেখানেই নিমজ্জিত রয়েছে আমার সতীঅংশ।” পদ্মাবতী সেই মুহূর্তে জীয়া গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেন আর আত্মারাম ঠাকুর সেই কালীকুণ্ডে নেমে উদ্ধার করেন সতীর দেহঅংশ। ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে জীয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের কুলমাতা মা ভুবনেশ্বরীর রূপদেখেই আত্মারাম ব্রক্ষ্মানন্দকে নির্দেশ দিলেন দেবীর মুখমণ্ডল খোদাই করতে। ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন বিকাল ৪-১৫ মিনিটে পদ্মাবতী জন্মদিলেন এক শিশুপুত্রের, নাম রাখা হল লক্ষ্মীকান্ত বা লক্ষ্মীনারায়ণ। লক্ষ্মীকান্তই কালীদেবীর সেবায়তগণকে ৫৯৫ বিঘা ৪ কাঠা ২ ছটাক নিষ্কর জমি দান করেছিলেন।

হিংলাজ : পুরাণ বলছে, এই মরুক্ষেত্রে সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েছিল। তাই একান্ন পীঠের মধ্যে এটিই শ্রেষ্ঠ বলে ধরা হয়। সতীর ‌যত পীঠ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে দুর্গম পথ এটাই। এবং মানা হয় সেই কারণেই এখানকার পবিত্রতা এখনও অক্ষুণ্ণ। সিন্ধ প্রদেশের প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলে দেবীর বাস, অথচ তাৎপ‌র্যপূর্ণ ভাবে দেখা ‌যায় এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ, পুজাচারে মুসলিমদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। পাকিস্তানের মুসলিমরা এই দেবীকে বড়ি নানি বলে সম্বোধন করে। আর এই গুহা মন্দিরকে নানি কি হজ বলেন। এখানে একটা কথা বলা ভালো, সতীর পীঠ নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক রয়েছে। কারণ ‌যত প্রাচীন সাহিত্য ঘাঁটা হয় তত দেবীর পীঠের সংখ্যা কমতে থাকে। কুলার্নভ তন্ত্রে সতীর ১৮টি পীঠের উল্লেখ রয়েছে, তার মধ্যে হিংলাজ মাতা তৃতীয় স্থানে। আবার কুব্জিকা তন্ত্রে ৪২টি পীঠের কথা রয়েছে, ‌যেখানে হিংলাজ মাতা পঞ্চম স্থানে। তন্ত্রচূড়ামণিতে ৪৩টি পীঠের নাম আছে, পরে অবশ্য মোট ৫১টি পীঠের সং‌যোজন হয়। করাচী হতে প্রায় ১২৫ কি.মি. উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানে এর অবস্থান। ব্রহ্মারন্ধ্র (মস্তিষ্কের অংশ) কোট্টরী বা কোটারি। ভয়ংকর তৃতীয় নয়নের জন্য শিব এখানে ভীমলোচন।

ভৈরবপাহাড়, অবন্তী : এই পীঠ ভারতবর্ষের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে উজ্জয়নী শহরে শিপ্রা নদীর কাছে ভৈরব পর্বতে অবস্থিত। দেবীর নাম অবন্তীকা বা অবন্তী ভৈরবের নাম লম্বকর্ণ। পীঠনির্ণয়তন্ত্র শাস্ত্রে লেখা আছে–ঊধের্বৌষ্ঠৌ ভৈরবপর্বতে/অবন্ত্যাঞ্চ মহাদেবী লম্বকর্ণস্তুত ভৈরবঃ। উক্ত তন্ত্র মতে ভৈরব পর্বতে মহামায়া সতী দেবীর ঊর্ধ্ব ওষ্ঠ পড়েছিলো। কিন্তু কবি ভারতচন্দ্র লিখেছেন—ভৈরবপর্বতে ওষ্ঠ পড়ে চক্র ঘায়।/নন্রকর্ণ ভৈরব অবন্তী দেবী তায়।।কবি ভারতচন্দ্র জানিয়েছেন এই পর্বতে কেবল দেবীর ওষ্ঠ পড়েছিলো। ঊর্ধ্ব না নিম্ন সেই বিষয়ে তিনি কিছু বলেন নি। উজ্জয়নীর পূর্ব নাম ছিলো অবন্তীকা। পুন্য সলিলা শিপ্রা নদীর পূর্ব নাম ছিলো অবন্তী। এই ভৈরব পর্বত তীর্থের কথা বহু পুরানে আলোচিত হয়েছে। পুরানে যে সাতটি মোক্ষ দায়ক তীর্থের কথা আছে তার একটি হোলো ভৈরব পর্বত।

নলহাটি : বীরভূমের এই স্থানও শক্তিপীঠ। কথিত, সতীর কণ্ঠনালী পড়েছিল এখানে। দেবীদুর্গা এখানে কালিকা এবং শিব হলেন যোগেশ। এটিও ৫১ সতীপীঠের একটি পীঠ। এখানে দেবী নলাটেশ্বরী নামে পরিচিত।

একান্ন পীঠের একপীঠ নলহাটির নলাটেশ্বরী কালী মা। একমাত্র কালীপুজোর রাতে ডাকের সাজ ও সোনার অলঙ্কারে সেজে ওঠেন মা নলাটেশ্বরী। নলরাজাদের গড় হিসেবে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ে মায়ের প্রাচীন মন্দির। এখানে মায়ের কণ্ঠনালি পড়েছিল। পরবর্তীকালে এলাকার রামস্মরণ দেবশর্মা স্বপ্নাদেশ পেয়ে মায়ের নল উদ্ধার করে নিত্যপুজোর প্রচলন করেন। পরে রানি ভবানী মায়ের মন্দির নির্মাণ করেন। এলাকার কুশলানন্দ ব্রহ্মচারী এখানে সিদ্ধিলাভ করেন। দেবীর নামানুসারে এই শহরের নাম নলহাটি। মন্দিরের সেবাইত আশিস চট্টোপাধ্যায় বলেন, কালীপুজোর নিশিরাতে দক্ষিণাকালী রূপে মা পূজিতা হবেন। ওইদিন মায়ের দু’বার ভোগ হবে। বলির পাঁঠার মাংস, কারনবারি ছাড়াও মায়ের ভোগে অবশ্যই পালং শাক থাকবে। নিশিরাতে মাকে সোনার মুকুট, অলঙ্কার সহ সাজে সাজানো হবে।

এটা মনে করা হয় যে, চৌদ্দশ বছর আগে কামদেব নলহাটি থেকে দেবীর বাকযন্ত্র তথা ‘নলা’ খুঁজে পান। আরও বেশ কিছু লোক ও কাহিনী কথিত আছে এই মন্দিরটিকে ঘিরে।অনেকের কথা অনুযায়ী, রামশরম দেব শর্মা প্রথম দেবীরে ‘নলা’ খুঁজে পান এবং পূজা শুরু করেন। তাই দেবীর নামকরণ হয় নলাটেশ্বরী এবং এই মন্দিরটির জন্যই জায়গাটি নলাটি নামে পরিচিত হয়। কথিত আছে, দেবীর মূর্তি ঠিক নিচেই নলাটি অবস্থিত এবং যতই জল ঢালা হোক না কেন এটি কখনো পূর্ণ হয়না। অনেকে এও বলেন, মানুষ জলপান বা অন্য কিছু পানীয় পান করলে যেমন ঢকঢক শব্দ ওঠে দেবীর ক্ষেত্রেও ঠিক একই শব্দ শোনা যায়। এই মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত শক্তিপীঠ ও দর্শন যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

অমরনাথ (শারদাপীঠ, ক্ষীরভবানী) : দেবী সতীর কণ্ঠদেশ এখানে পড়েছিল বলে বলা হয়। দেবীর নাম ভগবতী ভৈরবের নাম ত্রিসন্ধ্যেশ্বর। আবার কিছু পণ্ডিত দের মতে অমরনাথেই সতী অঙ্গ পতিত হয়। তন্ত্রে বলা হয় “কাশ্মীরে কণ্ঠদেশশ্চ ত্রিসন্ধ্যেশ্বর ভৈরবঃ।” যে স্থানে সতী দেবীর অঙ্গ পড়েছিল সেই স্থান অজ্ঞাত। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের সময় মুসলিম বাদশা সিকান্দার এই মন্দির চূর্ণ বিচূর্ণ করে মন্দির লুঠপাঠ করেন। কাশ্মীরের হিন্দু রাজা ১৯১২ সাল নাগাদ পুননির্মাণ করেন। শ্রীনগর থেকে ১২ মাইল দূরে এই মা ভবানীর মন্দির। মন্দিরের ভিতরে একটা ত্রিকোন কুণ্ড আছে। তার মাঝখানে একটি নবনির্মিত ছোট্ট মন্দির দেখা যায়। আগে ত্রিকোণ কুণ্ডটিই মাতৃ জ্ঞানে পূজিতা হতেন। নতুন মন্দিরে দেবীর একটি মূর্তি দেখা যায়। ভক্তরা পূজার দ্রব্য সেই কুণ্ডে নিবেদন করেন। কুন্ডের সামনে একটা ছোট্ট নাট মন্দির আছে। তবে এই সতী পীঠের যথার্থ স্থান নিয়ে মতভেদ আছে। এখানে অপর একটি শক্তিপীঠ দেখা যায়। সেটা হল শারদাপীঠ। কুব্জিকা তন্ত্র ও কাশ্মীরের কবি কলহনের রচনায় শারদাপীঠের নাম পাওয়া যায়। এই পীঠ খুব দুর্গম স্থানে। মহাভারত ও কিছু পুরান মতে মহর্ষি পুলস্ত এই শারদাপীঠে বসে তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেন। কাশ্মীরে দুটি শক্তিপীঠ দেখা যায় । দুটিকেই শক্তিপীঠ ধরা হয়। এখানে ভৈরব হলেন—অম্বরনাথ যা আমরা অমরনাথ নামে চিনি। অমরনাথ হল তুষারলিঙ্গ। দুর্গম বরফে ঢাকা পর্বতে এই ভৈরব মন্দির। অনেকেই ‘বরফানি’ নামেও ডাকে। অমরনাথ সৃষ্টি হয়েছিল হর গৌরীর লীলার দ্বারা। বস্তুত মা পার্বতী হলেন আদিশক্তি ব্রহ্মময়ী। কিন্তু লীলাচ্ছলে তিনি অমরনাথ সৃষ্টি ও একটি দিব্য ঘটনার জন্ম দেবার জন্য এমন লীলা করেছিলেন।

অট্টহাস : বীরভূমের এই শক্তিপীঠে সতীর অধর বা নিচের ঠোঁট পড়েছিল। দুর্গা এখানে ফুল্লরা নামে পূজিত। শিবের পরিচয় ভৈরব বিশ্বেশ বলে। সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শুকশারী কথা’ উপন্যাসে এই পীঠের নাম পাওয়া যায়। পূর্বে ফুল্লরা পীঠের নাম ছিলো অট্টহাস। পরবর্তীকালে নাম হয় শ্যামলাবাদ। এখানে চন্দনের গন্ধে ‘ম’ ‘ম’ করতো তাই নাম হয় চন্দনপুর। মায়ের মন্দিরের পাশেই ভৈরব বিশ্বেশ শিবের মন্দির। ৫১ পীঠের অন্যতম এই কেতুগ্রামের অট্টহাস। পুরাণে বলা হয়, সতীর অধর অর্থাৎ ঠোঁটের নিম্নাংশ এই জায়গায় পড়েছিল। দেবী এখানে অধরেশ্বরী নামে পূজিতা হন। কেতুগ্রামের নিরোল বাসস্ট্যান্ড থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে ফাঁকা জায়গায় জঙ্গলঘেরা এলাকায় দেবী মন্দির। এর উত্তরে বয়ে গিয়েছে ঈশানী নদী। অদূরেই শ্মশান। শাস্ত্র বলে যে কোনও শক্তিপীঠের পাশে নদী ও শ্মশান থাকা আবশ্যক। অট্টহাস মন্দিরে রয়েছে একটি প্রাচীন শিলামূর্তি। যার পাথরের ওপর খোদাই করা সাপের চিহ্ন। তার পাশে একসময় ছিল মহিষমর্দিনীর অষ্টধাতুর মূর্তি। তবে ওই মূর্তি চুরি হওয়ায় কয়েক বছর আগে একটি প্রস্তর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর এই মূর্তির পাশে একটি ছবি রেখে পুজো করা হয়। যা অট্টহাসের আদি মূর্তি দন্তুরা চামুণ্ডার ছবি। (চলবে)


আপনার মতামত লিখুন :

One response to “সতীর ৫১ পীঠের (শক্তিপীঠ) শুলুক সন্ধানে (প্রথম পর্ব) : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়”

  1. Md Rezaul Islam says:

    কাজলদিঘি ২৪০ এর পর কোথায় পাব

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন