সিন্ধুসভ্যতার আরেক নাম হরপ্পা-সভ্যতা। মেসোপোটেমিয়ার সঙ্গে স্থলপথে ও নৌপথে বাণিজ্য হত হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো ও সিন্ধু সভ্যতার অন্যান্য কেন্দ্রের। মেসোপটেমিয়ার সিল ও লিপিতে সিন্ধুসভ্যতার জনপদ ও ভূখণ্ডকে Meluha নামে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই মেলুহা নামটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে নানামুনির নানা মত। ফিনিশীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষক আস্কো পারপোলা বলেছেন শব্দটি দ্রাবিড়ীয়। দক্ষিণীভাষায় Mel মানে উচ্চ ও Akam মানে অঞ্চল। উচ্চভূমি বোঝাতে নাকি দ্রাবিড়ীয় ভাষায় অঞ্চলটিকে মেলাকাম বলা হত। তা থেকেই নাকি মেলুহা তথা Meluha. তিনি বলেছেন বালুচিস্তানের ব্রাহুই ভাষা দ্রাবিড়ীয় ঘরানার। তাই মেলুহা দ্রাবিড় থেকেই জাত।
আর এক বিশেষজ্ঞ বলেছেন পাঞ্জাবের মলয় নামক জাতি থেকেই নাকি মেলুহা।
ড সত্যনারায়ণ দাশ-প্রণীত বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ বইটিতে মলয় শব্দটিকে আবার দ্রাবিড় মলেই থেকে উদ্ভূত বলা হয়েছে।
সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি একশ বছরের চেষ্টাতেও।
দ্বিভাষিক লিপি আবিষ্কৃত না হওয়ার ফলেই এই বিপত্তি। Rosetta stone আবিষ্কার হওয়ার ফলে মিশরীয় হাইরোগ্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। মেসোপটেমীয় লিপি, পারসিক কিউনিফর্ম ও প্রাচীন গ্রিক লিপির উদ্ধারে দ্বিভাষিক লিপির সাহায্য নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু সিন্ধুসভ্যতার ক্ষেত্রে কোনও দ্বিভাষিক লিপি না মেলায় পণ্ডিতরা গভীর সমস্যায় পড়েছেন। যদিও পাঠোদ্ধার সম্ভব না হওয়ার নানাবিধ কারণ আছে।
প্রথমত, হরপ্পীয় লিপি এবং ভাষার অগম্যতা। সিন্ধু-সভ্যতার চরম পর্যায়ে তাঁরা যে বহির্বাণিজ্যে যুক্ত ছিলেন, তার অকাট্য প্রমাণ কিন্তু আমাদের কাছে আছে। এখন এই বর্হিবাণিজ্য, বা যাকে অন্যদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বলে, সেটা সার্থক ভাবে করতে গেলে কিন্তু একটা মোটামুটি চলনসই ভাষা আর ঐরকমই, খুব উন্নত না হোক, অন্তত একটি লেখ্য লিপির প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখা খুব জরুরি যে হরপ্পা লিপির পাঠোদ্ধার এখনও অবধি কেউ করতে পারেন নি,যতই আজগুবি দাবি আন্তর্জালিক জগতে ঘুরুক না কেন! এর স্বরূপ উদঘাটন একেবারেই অসম্ভব থেকে যেতো যদি না দ্বিভাষিক একটি হরপ্পীয় শিলালিপি এবং লেখনের একটি পরিচিত রূপ আবিষ্কৃত হতো। কি সেই দ্বিভাষিক শিলালিপি? এই শিলালিপিতে রয়েছে মানুষ ও স্থানের নাম। আমাদের পরিচিত নামগুলো থেকেই এই চিহ্নগুলি কীভাবে উচ্চারিত হতো তার প্রাথমিক সূত্রটি পাওয়া যায়। হরপ্পার লিপি সাংকেতিক। এটিতে ৩৭৫ থেকে ৪০০টি চিহ্ন আছে, মতান্তরে ছয় শতাধিক। কাজেই বর্ণমালার ধারণাটি বাতিল হয়ে যায়, কেননা একটি বর্ণমালায় সাধারণত ছত্রিশটির বেশি চিহ্ন থাকতে পারেনা। সুতরাং, আবার সেই সম্ভাব্যতা! সম্ভবত হরপ্পীয় ভাষা ছিলো যৌগিক অর্থাৎ এমন একটি ভাষা যেখানে একটি অপরিবর্তনীয় মূল চিহ্নের শেষে প্রত্যয়-বিভক্তি-কারক যুক্ত হতো। এই বিশিষ্টতা ঠিক ইন্দো-আর্য ভাষার মত নয়, বরং চারিত্রিক ভাবে এটি প্রাচীন দ্রাবিড়ীয় ভাষার সঙ্গে সাদৃশ্য যুক্ত। আর একটি প্রমাণিত তথ্য হলো, ইন্দো-আর্য ভাষার প্রথম পর্বের রচনাগুলিতে, যেমন ঋগ্বেদে, দ্রাবিড়ীয় ভাষার বেশ কিছু শব্দ ও প্রভাব।
মোট ২৭টি দ্রাবিড় শব্দের উপস্থিতি ঋগ্বেদে আছে। রেভারেন্ড কিটেল, কল্ডওয়েল ও গুন্ডার্ট সাহেব সংস্কৃতে আসা আরও দ্রাবিড় শব্দের সন্ধানদিয়েছেন।উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাচীন ইন্দো-আর্যরা দ্রাবিড় ভাষাভাষী মানুষজনের সংস্পর্শে এসেছিলো এমন ইঙ্গিত মেলে। পরবর্তীকালে অধ্যাপক টি বারো সংস্কৃতে গৃহীত আরও কিছু দ্রাবিড় শব্দের কথা লিখেছেন। বিজয়চন্দ্র মজুমদার মোট ৭৮টি দ্রাবিড় শব্দের একটি সূচি দিয়েছেন তাঁর বইয়ে। এমন কথা বলাই যায় যে, হরপ্পার মানুষজনের ভাষা ছিলো সম্ভবত প্রোটো-দ্রাবিড়ীয়।
এখন দেখা যাক সিন্ধুসভ্যতার ভূখণ্ডের মেলুহা বা
Meluha নামটি দ্রাবিড় আর কোনও ভাষা থেকে আসতে পারে কিনা।
তামিলে মল্লন শব্দটির অর্থ পাহাড়ি এলাকার অধিবাসী। সিন্ধু অববাহিকার পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকার নাম কি মল্লনাকাম ছিল? তা থেকেই অপভ্রংশে হল মেলুহা?
আবার কন্নড় ভাষায় মেল্ল মানে প্রাচুর্য, বাহুল্য বা উদ্বৃত্ত হওয়া। ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলেন সিন্ধুসভ্যতায় উৎপাদিত ফসল উদ্বৃত্ত হত। ড. অতুল সুর মহেঞ্জোদারো খননকার্যে নিজে সরেজমিনে দেখেছিলেন উদ্বৃত্ত ফসলের চিহ্ন। তাই মেল্ল থেকে মেল্লুয়া তথা মেলুহা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।