শুক্রবার | ৩রা জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ২:২২
Logo
এই মুহূর্তে ::
নিঃসঙ্গ ও একাকিত্বের আখ্যান : পুরুষোত্তম সিংহ ভিয়েতনামের গল্প (পঞ্চম পর্ব) : বিজয়া দেব অন্তরের আলো জ্বালাতেই কল্পতরু উৎসব : সন্দীপন বিশ্বাস কল্পতরু — এক উত্তরণের দিন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী চলচ্চিত্র উৎসবে পানাজি থেকে কলকাতা (শেষ পর্ব) : সায়র ব্যানার্জী ফেলে আসা বছরে দেশের প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া না ঝড় : তপন মল্লিক চৌধুরী কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (শেষ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার জোয়ানিতা ম্যালে-র ছোটগল্প ‘নাইট জব’ অনুবাদ মনোজিৎকুমার দাস দেশজ ফসলের বীজকে কৃষির মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে হবে নদিয়া বইমেলা মুখপত্র : দীপাঞ্জন দে চলচ্চিত্র মহোৎসবে পানাজি থেকে কলকাতা (প্রথম পর্ব) : সায়র ব্যানার্জী শৌনক দত্ত-র ছোটগল্প ‘গুডবাই মাষ্টার’ হেলান রামকৃষ্ণ শিশু বিতানের রজত জয়ন্তী বর্ষপূর্তি উৎসব পালিত হল মহাসমারোহে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (ষষ্ঠ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার জীবনানন্দ দাশের স্বপ্নের নদী ধানসিঁড়ি আজও আছে কিন্তু মৃতপ্রায় : মনোজিৎকুমার দাস মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘শঠে শাঠ্যং’ যথোচিত মর্যাদায় পালিত হল খানাকুলের রূপকার শান্তিমোহন রায়ের জন্মদিন : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় আবার দেখা যদি হলো সখা প্রাণের মাঝে আয় — নেতাজী নগর বিদ্যামন্দিরের পুনর্মিলন : সুশান্ত দাস মোদি বনাম মনমোহন: ইতিহাস বারবার এই বিশ্লেষণ করবে : সন্দীপন বিশ্বাস কবির লড়াইয়ের স্রষ্টা হলেন রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারী : অসিত দাস চল্লিশতম নদিয়া বইমেলা স্মরণিকা : দীপাঞ্জন দে ভাগ্নার পদধূলিতে ধন্য হল মামার বাড়ি, বেলুড় মঠ ও মিশন অধিগ্রহণ করে মর্যাদা দিল : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ভিয়েতনামের গল্প (চতুর্থ পর্ব) : বিজয়া দেব কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (পঞ্চম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার ভিয়েতনামের গল্প (তৃতীয় পর্ব) : বিজয়া দেব চব্বিশে ভোট আর ফলাফলে ছিল উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন : তপন মল্লিক চৌধুরী কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (চতুর্থ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী-র ছোটগল্প ‘জিঙ্গল বেল’ নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার : মনোজিৎকুমার দাস কার্ল মার্কসের পরিজন, পরিকর (তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই ২০২৫ ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কাজলদীঘি, ২১২ নং কিস্তি

জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় / ৫৬৮৯ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০
kajaldighi

২১২ নং কিস্তি

দেখলাম বড়োমা গাড়ির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। ছোটোমাকে সুরো জড়িয়ে ধরেছে।

বৌদি আমার দিকে আঙুল তুলেছে। দিদি হেসে কুটি কুটি খাচ্ছে।

মেয়েরা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ ছোট করে হেসে চলেছে।

ব্যাপারটা এরকম, কেমন দিলাম বলো।

অনিকা নে ও স্টরি বাতা দিয়া। বসির আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে।

আমি হাসছি।

কি স্টোরি রে! চিকনা আমার মুখের দিকে তাকাল।

শুনে নিস।

তোরও সখ আছে।

এখানে বেশি সময় নষ্ট করিস না। যা ভ্যাপসানি গরম, কালবৈশাখী উঠলে গণ্ডগোল।

এখন এক হাঁটু কাদা পেরতে হবে না।

সে না হোক।

ওরা এদিকে আসার আগেই পরিদার দোকানে ঢুকলাম।

ভোলা হাসছে। সঙ্গে ছেলে কৃষ্ণও আছে।

কিরে ভোলা খাওয়া হয়েছে?

তোমরা গেলে যাব। ছেলে খেয়ে চলে এসেছে। ও এখন সামলাবে।

হাফ এসেছে। হাফ বিকেলের দিকে ঢুকবে।

শুনেছি।

তাই তো, তুই এখন রিপোর্টার।

বসির আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। বাংলা বুঝছে না।

চিকনা দেখলাম জোরে হেসে উঠলো।

ছুঁচ্চা এউ কথা তোনকাকে কইছে। আজ ওকে মরাইব দাঁড়া।

আমি মুচকি মুচকি হাসছি।

আবার একচোট হই-চই।

পরিদার দোকানে চা খাওয়া, মিষ্টি খাওয়া। বেশ লাগে। আমরা যখন সব দল বেঁধে কলকাতা থেকে আসি, তখন পরিদার দোকানে সচরাচর কেউ ঢোকে না। দূরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিংবা পাশে একটা ছোট্ট নতুন দোকান হয়েছে সেখানে যায়।

আমরা শহুরে মানুষ। তাই চেয়ে চেয়ে দেখে।

এখানেও প্রায় একটা ঘণ্টা নষ্ট হলো।

নেপলার আশা পূরন হলো না। মেয়েরা জোর করে আমাকে ওদের গাড়িতে তুললো।

এবার সুন্দর ড্রাইভিং সিটে বসেছে। খুব ধীর-স্থির ভাবে গাড়ি চালাচ্ছে।

বসির, শুভ সামনের সিটে। সুন্দর ইংরেজিতে বর-বর করে চলেছে।

বসির একবার সামনের দিকে একবার জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায় চোখ মেলেছে।

বসিরের প্রশ্নের সমস্ত উত্তর সুন্দর-শুভ দিচ্ছে মাঝে মাঝে অনিসা।

অনিকা, পক্কেরাও প্রথম এসেছে। ওদের চোখেও সর্বগ্রাসী ক্ষুধা।

উনা মাস্টারের বাড়ি কাছাকাছি আসতে সুন্দর গাড়িটাকে একটু আস্তে করলো।

দিদিভাই।

বল।

এটা ড্যাডের উনামাস্টারের বাড়ি।

সবাই ঘাড় ঘোরাল। দুটো মাঠ পেরিয়ে স্যারের বাড়ি। অন্য সময় হলে সবুজধানে মোড়া থাকতো। এখন ধান পেকে হামারে উঠে গেছে।

নামবি না। অনিকা বললো।

এখন না কালকে। আমরা একা একা আসবো। ড্যাডের প্রিয় জায়গাগুলো তুই যদি একা থাকিস তাহলে ভীষণ ভাল অনুভব করতে পারবি। আমি আমার ব্যক্তিগত মতামত বললাম। এবার তোরা যে যা বলবি।

তুই ঠিক বলেছিস সুন্দরদা কাল আমরা ভোর ভোর বেরবো। শুভ বললো।

সুন্দরদা একবার ক্যালভার্টটায় অন্ততঃ থামিস। অনিসা বললো।

অবশ্যই। তোরা না বললেও থামতাম। ওই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে দু-দিকটায় না তাকালে ঠিক মন ভরে না। ওটা ড্যাডের গ্রামের এনট্রান্স।

দু-পাশে ধানখেত। কেউ ধান কেটে নিয়েছে। কারুর ধানে এখনও সবুজের ছোঁয়া। ওরা হয়তো একটু দেরি করে চারা গাছ লাগিয়েছে।

বিস্তীর্ণ মাঠে টান টান হয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে কালো পিঁচের রাস্তা।

এই দুপুরে খাঁ খাঁ করছে মাঠ।

আমাদের গাড়ির কাঁচ তোলা। এসি চলছে। বাইরের দাবদাহ কিছুই আঁচ পাচ্ছি না।

বসির অবাক হয়ে সামনে তাকিয়ে।

ওরা মরুভূমির দেশের মানুষ। এই রকম অজ গাঁ আগে দেখেনি। আমার কাছে গল্প শুনেছে। মেলাবার চেষ্টা করছে। হয়তো কিছুটা মিলছে, হয়তো মিলছে না।

নীপার স্কুল আসতে সুন্দর গাড়িটা আস্তে করে দিল। আবার বসিরকে বোঝাল। হাল্কা করে এই স্কুলের ইতিহাসটাও বসিরকে বললো।

কয়েক হাত দূরে ক্যালভার্ট। গাড়িটাকে অলসভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে এনে ক্যালভার্টের ওপর তুললো। থামাল।

বসিরভাই এবার নামো। এই সেই জায়গা। একদিকে ড্যাডের স্কুল আর পীরবাবার থান আর একদিকে সেই শ্মশান।

বসির তাড়াহুড়ো করে নেমে এলো। আমিও নামলাম।

বসির চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে। ওর মুখ চোখ দেখে বুঝতে পারছি। ওর কিছুতেই আস মিটছে না। একবার আমার দিকে তাকায় আবার দূরের পানে চোখ রাখে।

রদ্দুরটা বেশ চড় চড় করছে। চোখের ওপর হাত রেখে একবার রাস্তার দিকে তাকালাম।

স্কুলের কাছে চিকনা গাড়ি থেকে নেমে দিদিকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে।

বসিরভাই দূরে ওই টালির বাড়িটা দেখতে পাচ্ছ।

বসির কোনও কথা বলছে না। শুধু তাকিয়ে আছে।

একটু বাঁদিকে লক্ষ্য করো, একটা ঝাঁকরা অশ্বত্থ গাছ দেখতে পাচ্ছ।

বসির চোখ ফেরাল। সুন্দরের মুখের দিকে তাকাল।

ওটা পীরসাহেবের থান। ড্যাড বহুরাত ওখানে একা একা বসে থেকেছে।

বসিরের চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছি ও ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।

এবার এদিকটা তাকাও।

ওই যে জঙ্গলটা দেখতে পাচ্ছ। ওটা শ্মশান। দিদা-দাদাইকে ওখানে দাহ করা হয়েছিল।

তোমাকে সেই গল্প বলেছি।

বসির আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজলো।

অনিকা, পক্কে, ঘণ্টা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

পক্কে স্খলিত পায়ে কাছে এগিয়ে এলো। অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো।

জানো মামা, এতদিন আমাদের ভেতর ভেতর একটা গর্ব ছিল আমরাই পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্ট করে মানুষ হয়েছি। আমাদের মতো কষ্ট করে কেউ বড়ো হতে পারেনি। আজ সেই গর্বের বেলুনে তুমি পিন মেরে দিল।

বসির, পক্কের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ বসিরভাই। আমি ঘণ্টা কোনওদিন বাবা-মাকে দেখিনি। এই জীবনে তাদের সঙ্গে দেখা হবে না। দিদিভাই তবু তার বাবার পরিচয় পেয়েছে। আমরা তিনজনেই মায়ের ছবি দেখেছি। মামা আমাদের কাছে মা-বাবা। অরফ্যানদের লাইফটা কিরকম তুমি জানো। তারা কি ভাবে বড়ো হয়ে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকে, তাও তুমি জেনেছো, কিছুটা দেখেছো। মামা কিন্তু আমাদের কোনও দিন সেই অভাবটুকু বুঝতে দেয়নি।

আমাদের মতো মামাও অরফ্যান। এই জায়গায় থেকে মামা আজ কোথায় পৌঁচেছে। নিজেকে ভীষণ চার্জড মনে হচ্ছে বসিরভাই। এক তিলার্ধ জমি ছারবো না বসিরভাই, তাহলে মামাকে অপমান করা হবে।

মামার টাইটেলটা আমার নামের সঙ্গে সেঁটে আছে সেটার সঠিক মর্যাদা অবশ্যই দেব।

তুই একা একা ভাবছিস কেন নিজেকে। অনিকা বললো।

দিদিভাই, আমার কর্মের ভাগীদার তুই হবি না। আমার কর্মজগৎটা আমাকে বুঝে নিতে হবে। সেখানে তুই আমার কেউ নোস। তোর জায়গায় তুই, আমার জায়গায় আমি। মামা কাউকে তার কর্মের ভাগ দিয়েছে। মামাকে সাহায্য করেছে, কর্মটা মামাকে করতে হয়েছে। তোরা আমার সাহায্যকারী।

অনিকা, পক্কের চোখে চোখ রাখতে পারলো না। চোখ নামিয়ে নিল।

দিদিভাই তোর সেইদিনটার কথা মনা আছে? ঘণ্টা বললো।

কোনটা বল!

টোডির ঘটনা ঘটার মাসখানেক আগে মামা আমাদের সঙ্গে দেখা করেছিল। তুই মামাকে মুখ ঝামটা দিয়েছিলি। যা নয় তাই বলেছিলি, তখন তুই স্কুলে পড়াচ্ছিস।

মামা কিন্তু তোর কথার একটারও প্রতি উত্তর করেনি। বরং তোকে জড়িয়ে ধরে একটা কথাই বলেছিল। আমি পাঁকে পদ্মফুল ফুটিয়েছি। কেন তোরা নিজেকে পদ্মের পাঁপড়ির মতো মেলে ধরছিস না। একবার মেলে ধরেই দেখ না। তোদের সব অর্গল খুলে যাবে।

সেদিনের সেই কথাটা এখনও কানে বাজে।

আমরা মামার কথা নিয়ে কতো আলোচনা করতাম বল। তার সারমর্ম কিছু উদ্ধার করতে পারতাম? কিন্তু মামা তার কর্মের মধ্যে আমাদের সেই কথার সারমর্ম লিখে রেখেছে। একটু ভাব, দেখবি উত্তর পেয়ে যাবি।

আমি ওদের কথা শুনছি। একবার করে সামনের দিকে তাকাই। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ।

পেছন থেকে কেউ যেন জড়িয়ে ধরলো।

হাতদুটো দেখে বুঝলাম দিদি।

পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম সবাই লাইন দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে।

একমাত্র মাসিমনি চেয়ারে। নীরু ঠেলছে।

আমরা হেঁটে যাব।

দিদির মুখের দিকে তাকালাম। ফর্সা মুখে বেদানার রং।

অনেকটা রাস্তা, পারবে না।

পারবো।

মিত্রার মুখের দিকে তাকালাম।

বড়োমা বলেছে, ভেতর দিয়ে নদী পার হয়ে যাবে।

জল আছে।

চিকনা বলেছে জল নেই। থাকলেও তোকে পার করতে হবে না। চিকনা পার করে দেবে।

আমি চিকনার দিকে তাকালাম।

নীপাকে বলেছি নদীর ধারে চলে আসছে।

তোদের সত্যি….।

চ না দিদির মন চেয়েছে।

গাড়িগুলো এখানে থাকবে?

কেন চুরি হয়ে যাবে। নেপলা দায়িত্ব নিয়েছে। সঞ্জু-ভানু আসছে।

মাসীমনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। বৌদি ছাতা খুলেছে।

আমি ধীর পায়ে কাছে এগিয়ে যেতে আমার হাতটা চেপে ধরলো। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। ঠোঁট দুটো থিরি থিরি কেঁপে উঠলো কোনও শব্দ হলো না। চোখ তুলে শ্মশানের দিকে তাকালাম। মাসিমনি আমার চোখে চোখ রেখে একবার সেদিকে তাকাল।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমার মুখের দিকে তাকাল।

একবার নিয়ে যাবি।

কিছু বললাম না। মাসীমনি তখনও আমার হাতটা ধরে। পাশে তিয়া, তিন্নী, বিনয়দা। সকলেরই মুখ-চোখের অবস্থা ভাল নয়। আমার মুখের দিকেও চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।

চলো অনেক রোদ।

হাঁটতে শুরু করলাম।

সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েরা এগিয়ে গেছে চিকনার পেছন পেছন।

বড়োমাকে তনু ধরেছে, মিত্রা সোনা আন্টিকে, ইসি জ্যেঠিমনিকে।

কিছুটা যায় আবার একটু থামে। বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে বেরা ঘরের পেছনে আম গাছটার কাছে আসতেই দেখলাম পিঁপড়ের চাকের মতো ছেলে-মেয়ারা গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে।

আমাদের দেখে মেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।

দিদান বাবার সেই আম গাছ। পেছন ফটাস।

কথার ছিড়ি দেখ মেয়ের। ছোটো দে তো ওর ঠোঁটটা টিপে রক্ত বার করে। বড়োমা গজ গজ করে উঠলো।

তনু হাসলো।

তুই হাসছিস কেনরে।

তনু একবারে না। ছেলে কখনও অন্যায় করতে পারে না। এমনি এমনি ওর প্যাণ্ট ফেটেছিল। মিত্রা বললো।

আবার বাজে কথা বলে।

গিয়ে দেখবে চলো না। কোন ডালে উঠেছিল। পিলে চমকে যাবে। বুড়ো বয়সে ছোঁড়া হওয়ার সখ জেগেছিল তাই না।

তোরা খাসনি। চেয়ে চেয়ে দেখেছিলি।

মিত্রা হেসে ফেললো।

পারলি। বৌদি মিত্রার দিকে তাকাল।

কেন শুধু শুধু মুখ লাগাতে যাস।

আমি চুপ-চাপ। মৌনতাই এখানে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।

গাছটার কাছে আসতেই সেদিনের সেই বাচ্চাটাকে দেখতে পেলাম।

কইচা সেদিন এউ ঢ্যাঙা লোকটা গাছে উঠছিল তাই না।

চিকনার কথায় বাচ্চাটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে হেসে ফেললো।

মিত্রা বড়োমার দিকে তাকিয়ে একটা বিটকেল হাসি হাসলো।

বড়োমা নিজেও হেসে ফেললো। আমার মুখের দিকে তাকাল।

সত্যি তুই এই গাছে উঠেছিলি?

তুমি বিশ্বাস করো। এই বয়সে এই গাছে ওঠা সম্ভব?

মাসীমনি হেসে ফেললো। বনি, সুরো বড়োমার পেছনে দাঁড়িয়ে ফিক ফিক করছে।

ওই যে কঁয়েতবেল গাছটা দেখছো। ওটায় উঠতে গিয়ে প্যাণ্টের পেছন ফাটিয়েছিল। আমি পরে খোঁজ নিয়েছি। আমগাছে ও জাঙ্গিয়া পরে উঠেছিল। চিকনা বললো।

থাম, বাঁদর কোথাকার। বড়োমা দাঁতে দাঁত চেপে খিঁচিয়ে উঠলো।

বৌদি, আন্টি, জ্যেঠিমনি মুখ ঘুরিয়ে হাসছে।

তুমি প্রমাণ চাও।

তোকে আর প্রমাণ দেখাতে হবে না।

বাচ্চাটা ততক্ষণে দেখলাম তর তর করে গাছে উঠে বেশ কয়েকটা আম নিচে ছুঁড়ে ফেলেছে। সবাই গাছের তলায় পিঁপড়ের চাকের মতো জড়ো হয়েছে। দিদি, বসিরও দেখলাম মেয়েদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আম কুড়চ্ছে। সবার হাতেই আম।

কঁয়েৎ বেলও গোটা কয়েক পারা হলো।

হই হই এর মধ্যেই নীপা এসে পরলো।

তাই বলি তোমাদের এতো দেরি কেন।

এগিয়ে এসে মাসীমনিকে জড়িয়ে ধরলো।

কেমন দেখছো আমাদের গ্রাম।

মাসীমনি হাসছে।

সঞ্জু, বাসুরা সব এগিয়ে এসে মাসীমনিকে প্রণাম করলো।

তোরা এখনও ওখানে যাসনি! আগে এদের নদী পার করে দে। আমি বললাম।

এক চাক্ষর জল আছে। কাউকে পার করতে হবেনি। ভানু বললো।

আমি ভানুর দিকে তাকিয়ে হাসছি।

হ রে। চিকনাটা মিছছা মিছু কইতিছে।

ঠিক আছে চল না। যখন বলছে।

কাঠ পুল দিয়ে চলি যাক।

সে তো দু-পাশে ন্যাড়া করে রেখেছিসি। একজনের জায়গায় দুজন উঠলেই দুলে উঠবে।

না তাকে দড়া দিয়া বাঁধছি।

ছোটোমা ভানুর কথায় হেসে গড়াগড়ি খায়।

আন্টি বলে উঠলো। ও ছোটো, ভানু কি বলে?

দেশোয়ালী ভাষা। তুমি বুঝবে না।

দড়াটা কি বলতো। আন্টি বললো।

সঞ্জু হেসে উঠলো। দড়ি গো দড়ি।

এক চাখর।

সঞ্জু আঙুল দিয়ে বেগত মেপে দেখাল। এটা।

অনি।

বলো।

অজু আসার সময় পই পই করে বলে দিয়েছে, শাক পাতা জোগাড় করতে। তোকে যেন একবারটি মনে করিয়ে দিই।

ওর নোলা বার করছি, একবার আসতে দাও। বড়োমা আবার তেতে উঠলো।

তুমি আবার মাথা গলাও কেন। ও তো অনির সঙ্গে বুঝবে, তোমার কি।

বড়োমা চুপ করেগেল। কথা বারাল না। যে যার মতো এদিক ওদিক মুখ ঘুরিয়ে হাসছে।

আন্টি নদী পার হতে পারবে তো? বাসু বললো।

না পারলে তোরা আছিস। ঘারে করে পার করে দিবি।

সঞ্জু মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।

হাসছিস কেনরে বাঁদর? আন্টি সঞ্জুকে ধমকাল।

তোমাকে কাঁধে করে পার করবার সাধ্যি আমাদের নেই।

আন্টি কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো।

যে রকম হেলে দুলে হাঁটছে, বেশ বুঝতে পারছি হাঁটুর ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে।

শুধু শুধু তুমি এতটা পথ হাঁটলে। আমি বললাম।

না-রে জায়গাটা বেশ ভাল লাগছে। মিত্রা, দিদির মুখে শুনেশুনে, মনেমনে একটা ছবি এঁকেছিলাম। অনেকটা মিলে যাচ্ছে।

একটু থামলো।

জানিস অনি।

বলো।

আর কিছু হোক না হোক শব্দ দূষণের হাত থেকে বেঁচেছি।

আন্টি ধীর পায়ে হাঁটছে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পরছে।

মাঝে মাঝে বেশ উত্তেজনা অনুভব করছি।

আমি সোনা আন্টির মুখের দিকে তাকিয়ে।

গ্রাম দেখিনি বললে ভুল হবে। রাজস্থানে আমাদেরও গ্রামের বাড়ি ছিল। কিন্তু এত সবুজ দেখিনি।

একটু থামলো।

সেই গ্রামের রূপের মধ্যে রুক্ষতার ছোঁয়া ছিল।

আন্টির মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগলো।

তোর শৈশব, কৈশোর এখানে কেটেছে?

একেবারে জন্মের মুহূর্ত থেকে ক্লাস টেন পাশ করা অবধি। তারপর কলকাতা। তখন এই অঞ্চলে আরও বেশি গাছ-পালা ছিল। ঘন জঙ্গল বলতে যা বোঝায়।

আন্টি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।

হ্যাঁগো। রাতে নাকি ভূতটুত বেরতো। যে পথে এই মুহূর্তে হাঁটছো এই পথেও দু-একটা ভূত দেখা যেত। তবে আমার ভাগ্যে জোটেনি।

বড়োমারা সবাই দাঁড়িয়ে পরেছে।

আমি আন্টির দিকে তাকিয়ে।

বিশ্বাস করো। চিকনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারো কাকার মুখ থেকে আমি যেমন গল্প শুনেছি, ওরাও শুনেছে। তবে ওরা কোনও দিন এই খাঁ খাঁ দুপুরে এ তল্লাটে আসতো না। রাতের কথা ছেড়ে দাও। তখন এতো মানুষজন ছিল না। আমি আসতাম। ভূতের সঙ্গে সক্ষ্যতা করতে। আমার দুর্ভাগ্য। তারা কেউ আমার সামনে কোনও দিন আসেনি।

ছোটোমা আমার পাশে এসে দাঁড়াল।

মনাকাকার মুখে শুনেছিলাম, বাবা পীরসাহেবের দেখা পেয়েছিলেন। তার এগার মাসের মধ্যে আমার জন্ম। লোকে বলে আমি পীরসাহেব। হাসি পায় বুঝলে। অমাবস্যার ঘুট ঘুটে অন্ধকারে অনেক রাত পর্যন্ত পীরসাহেবের থানে বসে থাকতাম। তাঁকে দেখার আশায়। চর্ম চক্ষে তাকে দেখিনি।

কোনও দিন কোন কিছু অনুভব করিসনি?

একবার।

সেদিন অন্ধকার পক্ষ ছিল। দোষ না করেও উনা মাস্টারের কাছে মার খেয়েছিলাম। মনটা খুব খারাপ হয়েছিল। পীরসাহেবের থানে অনেক রাত পর্যন্ত বসেছিলাম। শরীরটা ভীষণ ভারি হয়েগেছিল। গাছের তলা থেকে মিনিট পনেরো উঠতে পারিনি। কিন্তু কাউকে দেখিনি। ব্যাশ এই টুকু।

রাতে একা একা ফিরেছিলি!

হ্যাঁ। সঙ্গে কে থাকবে?

কোনও অসুবিধে হয়নি!

না।

সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি স্বাভাবিক।

মনাকাকার মুখে শুনতাম এই পথেই মনাকাকা নিত্যদিন ভূত দেখতো।

এ্যাঁ!

আমি হাসলাম।

তখন এখানকার জমিদার দত্তদের বাড়ি মনাকাকা পূজো করতে যেতেন। মনাকাকার বাবা দত্তদের বাড়ির পুরহিত ছিলেন। তখন এই তল্লাটে একটাই ব্রাহ্মণ পরিবার। রাতের পূজো সেরে এই তিন মাইল কাকা হেঁটে আসতেন। দেরি হওয়ার কারণ, কাকাকে নিজের হাতে ঠাকুরের ভাগ রান্না করতে হতো।

ফেরার সময় ক্ষীর মুড়কি ফল-পাকর সঙ্গে আনতেন। রাস্তায় নাকি মনাকাকাকে ভূত ঘিরে ধরতো। মনাকাকার সঙ্গে তারা কথাও বলতো।

আমি বলে যাচ্ছি, ওদের কারুর চোখে পলক পরছে না।

ভূতেরা নাকি মনাকাকাকে বলতো, খাবার নিয়ে যাচ্ছিস, আমাদের দে। খাবার না দেওয়া পর্যন্ত তারা কিছুতেই পথ ছাড়তো না। তাই মনাকাকা মাঠের মধ্যে ওইসব খাবার রেখে চলে আসতো।

পরের দিন কাকা যখন স্কুলে যেত তখন দেখতো শুকনো কলাপাতা পরে আছে। মানুষ যেমন খেলে কলাপাতায় আঙুলের দাগ পরে কলাপাতাতেও সেই আঙুলের দাগ থাকতো।

ছোটোমা আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।

তুই এতো স্বাভাবিক ভাবে বলছিস যেন ব্যাপারটা কিছুই নয়। দেখ আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

ছোটো থেকেই ওর ভীষণ সাহস ছোটোমা। চিকনা বললো।

এখন তোমার সাহস হয়েছে।

হ্যাঁ।

আগে অন্ধের মতো এইসব বিশ্বাস করতাম। একদিন ও বললো সাহস করে দেখ না। খুব বেশি হলে কি হবে। ভূত গলা টিপে তোকে মেরে দেবে। তুই মরে যাবি। এর বেশি কিছু তো করতে পারবে না।

ওর কথাটা একটু ভাবলাম। কথাটা মনে ধরলো। সাহস করে একদিন অনেক রাত পর্যন্ত পীরবাবার থানে বসেছিলাম। একা একাই ফিরলাম। তারপর আর ভয়-টয় পাইনি।

বড়োমা, জ্যেঠিমনি আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।

কিগো, কি ভাবছো?

বড়োমার দীর্ঘশ্বাস পরলো।

গ্রামের ঘরে সূর্য ডুবলেই অন্ধকার। কেউ সচরাচর ঘর থেকে বেরয় না। তাই ভূতেরা রাজত্ব করে।

জ্যেঠিমনি হাসলো।

জানিস একদিন অজুকে বলেছিলাম, ডাক্তারী শাস্ত্র অনুযায়ী অনি ঠিক আর দশজনের মতো স্বাভাবিক নয়। ওর মধ্যে সব সময় একটা পাগলামো লক্ষ্য করি। কেন?

আমি আন্টির দিকে তাকিয়ে হাসছি।

তখন অজু বললো, তুমি ওকে ওপর ওপর দেখছো সোনা। ওর ভেতরটা দেখতে হলে তোমাকে ও কোন পরিবেশে শৈশব থেকে বড়ো হয়েছে সেটা তোমায় দেখতে হবে, তাহলেই তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। আমি কিন্তু ওকে আর দশজনের মতো খুব স্বাভাবিক দেখি।

কথাটা শুনে আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। ভালোপাহাড়ে তোকে অনেক কাছ থেকে দেখলাম। তুই কতো তাড়াতাড়ি ওদের আপন হয়ে গেলি। আমাদের ক্ষেত্রে ওরা একটা অর্গল তুলে রাখলো।

কনিষ্ক, নীরুকে ব্যাপারটা বললাম, তোরা এতবার এখানে এসেছিস। তোরা শ্যামাদের এত কাছের মানুষ, তবু তোদের সঙ্গে শ্যাম এরকম দূরত্ব রাখছে।

কনিষ্ক হাসতে হাসতে বলেছিল, আন্টি আমরা সকলে গেস্ট, অনি ওদের ঘরের লোক। যেদিন এখানে প্রথম এসেছিলাম, সেদিন থেকে আজও ওরা এটা মেইনটেন করে। কেন করে সে প্রশ্ন যদি করো, উত্তর দিতে পারবো না।

এখানে এসে অনুভব করছি, এই উদার প্রকৃতি তোর মনকে অনেকটা শাসন করে। যেটা আমরা কেউ করতে পারি না।

চলো।

আন্টি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো।

আমরা নদীর পারে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম মেয়েরা নদীর ওপারে চলে গেছে। নম্রতারা নদী বাঁধের ওপর থেবড়ে বসে পড়েছে।

আমাকে দেখে মেয়ে তার স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো।

বাবা, শুভ ধপাস।

আমি হাসলাম। ও কোথায়?

চলে গেছে।

কিগো কাঠের পুল দিয়ে যাবে। বড়োমার দিকে তাকালাম।

কেন!

জলে নামার সখ আছে।

বড়োমা মুচকি মুচকি হাসছে।

মিত্রারা সব নদীগর্ভে নেমে জলের ধারে দাঁড়িয়ে। চিকনা হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে। দিদি ওপরের দিকে তাকিয়ে হেসেই চলেছে।

বড়োমাদের হাত ধরে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলাম।

আগের মতো অতোটা খাঁড়াই ঢাল নেই। মাটি কেটে কেটে শিঁড়ির মতো ধাপ তৈরি করা হয়েছে। বড়োমাদের নামতে খুব একটা অসুবিধে হলো না।

কাছে আসতে চিকনা চেঁচিয়ে উঠলো।

তোকে ছাড়া কেউ পার হবে না।

কেন!

গুরুমাকে জিজ্ঞাসা কর।

আমি মিত্রার দিকে তাকালাম।

তুই আগে নেমে দেখে আয়।

মেয়েরা পার হলো কি করে?

ওই জন্য শুভ ধপাস। তবু দুই মেয়ে, নম্রতা চিকনাকে জাপ্টে ধরে পার হয়েছে।

ভজু, ভেঁদোদা কোথায়?

তারা পার হয়ে এতক্ষণে ঘরে চলে গেছে।

কাপর তোল।

কেন!

তনু জোরে হেসে উঠলো।

দিদি তুমি না….।

মিত্রা তখনও অবাক চোখে তাকিয়ে তনুর দিকে।

কিরে দিদিভাই তনু হাসছে!

বাঁদরটা কি বললো শুনিসনি।

খেয়াল করিনি।

বাড়িতে চল বলছি।

আমি তনুর দিকে তাকিয়ে।

আমাদের কথা বলার ফাঁকেই সঞ্জু-ভানু আন্টি, বড়োমা, জ্যেঠিমনি, দামিনীমাসিকে ধরে ধরে নদী পার করছে। মাসীমনিও জোড়করে ওদের সঙ্গে জলে নেমে নদী পার হলো। নীরু-কনিষ্ক দু-পাশে এক তিলার্ধের জন্যও মাসীমনির কাছ ছাড়া হলো না। তিন্নি, তিয়া বিনয়দাও এক সঙ্গে পার হয়ে গেল। ছোটোমা সবার আগে কারুর সাহায্য ছাড়া।

নীপা পথ দেখাচ্ছে। সুরো, বনিও নীপার সঙ্গে পেরিয়ে গেল।

দিদি। আন্টি ডেকে উঠলো।

এখন কথা বলো না। আগের বার উল্টে পরতে পরতে বেঁচেছি।

জল বেশি নেই।

দেখলাম ছোটোমা তর তর করে পেরিয়ে গেল।

মিত্রা চলে আয়। একবারে কাদা নেই। বালি। ছোটোমা ওপারে গিয়ে চেঁচাল।

ও ছোট তুই দাঁড়া আমি আগে যাই।

নীপা আবার জল ঠেঙিয়ে এপারে এলো।

মিত্রাদি চলে এসো।

চল। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়েছে।

চিকনা হাসছে।

জলে নাম আমি যাচ্ছি।

তোর হাত ধরি।

হাত ধরতে হবে না।

তুই আগে ওদের দুটোকে রেখে আয়। দিদি বললো।

তারপর তুমি ইসি যাবে?

আমি, ইসি, নয়না একসঙ্গে যাব।

একসঙ্গে চলো কিচ্ছু হবে না।

সবাই হাত ধরা ধরি করে জলে নামলাম। ভানুর এক চাখর মানে এক হাঁটু।

কাদা একবারে নেই বললে ভুল হবে। তবে বালির ভাগ বেশি। অসুবিধে হলো না। নয়না একবার টাল খেয়েছিল চিকনা পাশেই ছিল ধরে ফেলেছে।

জলে দাঁড়িয়েই এক চোট হাসাহাসি হলো।

দিদি, নীপার হাত ছাড়েনি।

মিত্রা ডাঙায় উঠেই বললো।

আগেরবারের থেকে কাদাটা কম তাই না ছোটোমা।

ওই জন্য তোকে বললাম চলে আয়।

আর বিশ্বাস করি। আগের বারে যা গুবলেট করেছিল।

মিত্রা আমার দিকে তাকাল। হ্যাঁরে সেই তেচোখ মাছ দেখতে পেলাম না।

তোদের ভয়ে পালিয়ে গেছে।

অনিকা আমার দিকে তাকিয়ে।

কিরে?

পুকুরে স্নান করবো।

ন্যাংটো হয়ে কাপর ছাড়তে হবে।

দেব না এমন। ঘুসি পাকিয়ে আমার দিকে তেরে এলো।

সবাই হাসছে।

মুখে কিছু আটকায় না, তাই না।

অতো রেগে যাচ্ছিস কেন। আমার কাছে ছবি আছে।

থাকুক।

ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এলাম।

নদীর চেহারায় কোনও পরিবর্তন নেই। কোথাও শুকনো কোথাও জল।

নদীর পার বরাবর বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি।

নিঝুম দুপুর।

হাওয়ার ধাক্কায় বাঁশ গাছ দুলছে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হচ্ছে। এই ঠাটাপোরা দুপুর রোদে ঝিঁ ঝিঁ পোকার তারস্বর চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। বেড়াকলমির পাতাগুলো রোদের তাতে ঝিমিয়ে পড়েছে।

পুকুরধারে আসতে দেখলাম একটা বাঁধান ঘাট হয়েছে। মিলিরা সকলে জলে নেমে পড়েছে। শুভ, সুন্দর মাঝ পুকুরে। সঙ্গে বসিরও রয়েছে।

ওদের দেখে হেসে ফেললাম।

বসির চেঁচিয়ে উঠলো।

মামা সুইমিং পুল বহুত আচ্ছা।

দিদি বসিরের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

বুবুন। তারস্বরে মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।

পেছন ফিরে তাকালাম।

দুটো পেয়ারা পেরে দিবি।

ওরা পেয়ারা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওপরের দিকে তাকিয়ে।

চিকনাকে বল।

আমি এগিয়ে গেলাম। কাকীমা, সুরোমাসি এগিয়ে এসেছে। জড়িয়ে ধরলো। প্রণাম করলাম।

মাসীমনি কোথায়?

সামনের বারান্দায়।

কেন!

কতো লোক দিদিকে দেখতে এসেছে।

ওখানে কে আছে?

নীরু, কনিষ্ক আছে।

ঘরে ঢোকার মুখে মেয়েদের সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। টাওয়েল কাঁধে পুকুরে চলেছে।

নম্রতা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো।

অভ্যাস নেই বেশিক্ষণ জলে থাকিস না।

কিছু হলে নীরুমামা আছে। নম্রতা বললো।

নয়না পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

সকলে ঠাকুর নমস্কার করে বাইরের বারান্দায় এলাম।

মাসীমনি বেঞ্চে বসে। মৌসুমিমাসি পায়ের কাছে। নীরু, কনিষ্ক দুই পাশে।

বন বন করে দুটো স্ট্যান্ড ফ্যান দুদিক থেকে ঘুরে চলেছে। তিতাস, বিনয়দাদের দেখতে পেলাম না। কে কোথায় আছে ঠিক বুঝতে পারছি না।

খামারে গ্রামের অনেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাউকে চিনি, কাউকে চিনি না।

সুজিতদা, বৌদি গুবলুরা গেল কোথায়?

মাসীমনি চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে। আমি সামনে এসে দাঁড়ালাম। মাসীমনি হাতটা চেপে ধরলো।

তোর ঘরে নিয়ে চল।

জল খেয়েছো?

তোমাকে আর ফর ফর করতে হবে না।

পেছন ফিরে তাকালাম। নীপা।

ট্রেতে গ্লাস সাজানো।

বারান্দায় ওপাশেও দেখলাম অনেকগুলো স্ট্যান্ড ফ্যান ঘর ঘর শব্দে করে ঘুরছে।

চারদিকে পরিচিত অপরিচিত মানুষ।

নীপা একটা গ্লাস মাসীমনির হাতে দিল।

খেলাম তো।

আর একটু খাও। বোনপোর কথা শুনলে না।

মসীমনি হাসলো।

তোমার গরম জল রেডি।

ও নীপা। মৌসুমিমাসি ডেকে উঠলো।

বলো।

ছোটবৌকে টুকু সরবৎ দিছু।

দিয়েছি।

ক্যামলার পো এঠি আছে।

না। সে বাড়িতে।

ডাইক।

কেন।

পইরা ঘরে দই-এর কথা কইছি।

কি হবে?

ছোটগিন্নী খাইতে ভালোবাসতো।

আমি নীপার দিকে তাকালাম।

আর বলো না সেই সূর্য ওঠার আগে থেকে এসে বসেছে। তুমি আসবে। কানে ঠিক ঠিক শুনতে পায় না। তারস্বরে চেল্লাতে হয়। তবে তোমার ঠোঁট নাড়া দেখে ঠিক বুঝে যায় তুমি কি বলছো।

কাছের জিনিস দেখতে পায়। দূরের জিনিষ দেখতে পায় না।

ওই ঘটনার পর চিকনাদার একদিন ধুম জ্বর। সারারাত চিকনাদার মাথার শিয়রে জেগে বসে থাকলো। এক ধারসে সবার বাপ চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে ছেড়ে দিল। সকাল হতেই লাঠি ঠুকে ঠুকে গুণীন দাদুর কাছে গেছে। কি সব নিয়ে এল।

অতো দূরে! আমার গলা থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো।

তুমি বলো না।

তোমরা কিছু বলো না?

হুঁ তাহলেই হয়েছে। সকালে নাতি নাতনিদের জন্য টবা থেকে কই-সিঙ্গি-মাগুর মাছ ধরেছে।

কেন নামতে দাও সাপ-টাপ আছে, কামড়ে-টামড়ে দিলে বিপদ।

তাহলেই হয়েছে। ব্যাঙ্কে যাওয়ার পথে ও টেনে তুললো। তাতেই তার কি রাগ।

মৌসুমিমাসি ফ্যাল ফ্যাল করে নীপার দিকে তাকিয়ে আছে।

এতক্ষণে ছোটোমারা সবাই বাইরের বারান্দায় এলো। সুজিতদা, বৌদিকে দেখলাম।

তোমরা কোথায় ছিলে? দেখতে পেলাম না।

সুজিতদা হাসছে।

গুবলুরা কোথায়!

কেন পুকুরে দেখে এলি না।

চোখে পরলো না।

বৌদি হাসছে।

বোনপোর ঘরবাড়ি কেমন দেখছো। ছোটোমা, মাসীমনির দিকে তাকিয়ে।

মাসীমনি কোনও কথা বলতে পারলো না। চোখটা ছল ছল করে উঠলো।

এই দেখো। ছোটোমা, মাসীমনির গলা জরিয়ে ধরলো।

অনেক কথা মনে পরে যাচ্ছে জানিস ছোটো।

এখন আর ওসব কথা মনে করে মন খারাপ করো না।

মন খারাপ করেই বা কি করবো বল।

বোনপোর ঘরে গেছিলে।

না।

অনিদা।

তাকিয়ে দেখলাম বনি, নাগেশ বারান্দার ওপাশ দিয়ে এপাশে আসছে। পেছনে সুরো।

কোথায় গেছিলি!

তোমার খট্টাঙ্গে একটু শুয়ে এলাম। বনি বললো।

দু-জনে!

নীরু খামারের দিকে তাকিয়ে হেসেফেললো।

দেখলে ছোটোমা।

বলতে গেলি কেন। জানিস তো তোর অনিদার মুখ।

তোলা থাকলো।

সুরোর দিকে তাকালাম।

ওই দুটো কোথায়রে?

জানি না।

তারমানে!

আছে কোথাও।

সামনে পেছনে পুকুর।

দেখার মতো অনেক লোক আছে।

কনিষ্ক হাসছে।

তোরটা। বনির দিকে তাকালাম।

একসঙ্গেই আছে। হারাবে না।

তোর এতো খোঁজ খবর নেওয়ার কি আছে? কনিষ্ক বললো।

তুই জানিস না? নীরু বললো।

জেনে কাজ নেই।

তনু, মিত্রা দুজনে দুটো কাঁচের প্লেট হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কাঁচা আম টুকরো টুকরো করে কেটে নিয়ে এসেছে। সকলে হেসে গড়িয়ে পরছে।

হাঁ করো। মিত্রা মাসীমনির দিকে তাকিয়ে বললো।

কেন।

নাতি-নাতনিরা এত আনন্দকরে কাঁচা আম পারলো একটু খাবে না।

এক কুচি, বেশি দেবে না। কনিষ্ক বললো।

তুমি দেখো এইরকম গুড়ি গুড়ি করে কেটেছি।

তনু আমার আর কনিষ্কর মাঝখানে প্লেটটা এগিয়ে দিল।

তোমরাও পারো। কনিষ্ক বললো।

দারুন টেস্ট, কাঁচা মিঠে।

বনি, সুরো কয়েকটা আমের কুঁচি তুলে নিয়ে মুখে ফেলেছে।

টকাস টকাস করে জিভে আওয়াজ তুলে বনি বলে উঠলো, নাগেশ খাট্টামিঠা লে লো।

আমি কয়েক টুকরো তুলে মুখে দিলাম। নীরু, কনিষ্কও তুলে নিল।

কি রে আমাকে দে। সুজিতদা বড়ো বড়ো চোখ করে মিত্রার দিকে তাকাল।

গেসো রুগী, একবারে দিবি না। বৌদি মিত্রার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।

আমি নিজে সুজিতদার হাতে কয়েক কুচি তুলে দিলাম।

সুজিতদা দাঁত বার করে বৌদির দিকে তাকিয়ে হাসছে। ব্যাপারটা এরকম, মজা দেখ।

সবাই কম বেশি তুললো, নিমেষের মধ্যে প্লেট শেষ।

কিরে তনু।

তনু তাকাল মিত্রার দিকে।

তুই বলেছিলি না, আর কেটো না। খাবার লোক নেই।

সুরোমাসি ভেতর থেকে বাইরের বারান্দায় এলো। আমার দিকে তাকিয়ে।

যা আর দেরি করিস না। বেলা হয়ে গেছে।

যাচ্ছি।

দিদি তুমি কাপর ছেরে নেবে চলো। সুরোমাসি, মাসীমনির দিকে তাকাল।

একবার ও বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।

খেয়ে নিয়ে যাবে খোন।

সুরোমাসি, মাসিমনির হাত ধরলো।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। কনিষ্কর দিকে তাকালাম।

তোরা স্নন করবি না।

সকালে একবার করে এসেছি।

এখন আর একবার করে নে।

দাঁড়া মিলি আসুক।

নীরু হাসলো।

(আবার আগামীকাল)


আপনার মতামত লিখুন :

2 responses to “কাজলদীঘি, ২১২ নং কিস্তি”

  1. Rkm says:

    Dada puro golpo ta pawa gale khub valo hoto..Jodi purota pawa Jai to upload korun

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন