সাইফুর রহমানের গল্প এর আগে কয়েকটি মাত্র পড়েছি। মরিচপোড়া গল্পটি পশ্চিমবঙ্গেই প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটি মনে দাগ কেটেছিল। সাইফুর নানা বিষয়ে নিবন্ধ লেখেন বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রে। সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধই বেশি। সেসব নিবন্ধ, প্রবন্ধে গভীরতা থাকে। অনলাইনে আমি তার কিছু পড়েছি। দুই বঙ্গের সাহিত্যই তার যে পড়া তা তার সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারি। বিশ্ব সাহিত্যের অনেকটাই তার পাঠের ভেতরে আছে। আছে যে তা তার প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ করোনা ও কফিন-এর প্রথম গল্পটি পড়লে ধরা যায়। সেই গল্পই করোনা ও কফিন। ইতালির এক ছোট শহর লোম্বারদিয়া এ গল্পের পটভূমি। গল্পের চরিত্ররা সবাই ইতালীয়। পিতা-পুত্রীকে নিয়েই গল্প। পিতা মারিও দিনির কফিন ব্যবসা। মৃতের শেষ আশ্রয় কফিন তৈরি করে বিক্রি। দোকানের নাম ‘অলতিমো সেলুট্যা’ (অন্তিম বিদায়)। আদ্রিয়ানার প্রেমিক লুকা। আদ্রিয়ানা সাহিত্যের ছাত্রী। তার হাতে দান্তের ডিভাইন কমেডি-লা দিভিনা কোম্মেদিয়া। ডিভাইন কমেডি নিয়ে আদ্রিয়ানা নানা কথা বলে তার প্রেমিক লুকাকে। নরক দর্শন এবং তা শেষ করে স্বর্গ যাত্রা নিয়ে কথা বলে। পড়তে পড়তে ধরা যায় লেখক দান্তের এ মহাকাব্যতে আবিষ্ট, যেমন আবিষ্ট আদ্রিয়ানা।
এ গল্প আসলে জীবন-মৃত্যুর। কফিনের দোকানে নানা মানুষ আসে কফিনের খোঁজে। ইহুদিদের কফিনে কোনো ধাতব পদার্থ থাকে না। কফিন কত রকমের হয়। সংগীতশিল্পীর মৃত্যু হলে তার জন্য থাকে গিটারের আকৃতির কফিন। বিভিন্ন রকমের কফিনের কথা বলেছেন লেখক। গল্প তাতে একটু বিস্তৃত হয়েছে। মৃত্যু এবং কফিন নিয়ে লেখকের লেখায় যে স্বাভাবিকতা দেখেছি, তা প্রশংসনীয়। গল্প নানাজন নিয়ে। গল্প আসলে সেই কফিনের দোকানের মালিক, আদ্রিয়ানার পিতা মারিও দিনিকে নিয়ে যিনি নিজের জন্য একটি কফিন নির্মাণ করে রেখে গিয়েছিলেন সবার অলক্ষে। কফিনের দোকানে খরিদ্দার সব দিন আসে না। সারা দিন বসে কেটে যায়। আদ্রিয়ানা এবং দোকানের কর্মচারীর দিন কেটে যায় আলস্যে। মারিও দিনির শরীর ভালো নেই। অনেক দেরি করে আসে। তখন খবর আসে চিন দেশের উহান প্রদেশের। করোনা জ্বরে মানুষ মারা যাচ্ছে। সেই জ্বর ইতালিতে এসে পৌঁছেছে। গল্পটির চলন ধীর কিন্তু গম্ভীর। আদ্রিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সে দান্তের কাব্যে কথিত নরকের বিভিন্ন স্তরের কথা শোনায় প্রেমিককে। নরকের দুয়ার খুলে যাচ্ছিল যেন করোনার বিস্তারে। শেষ অবধি মারিও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। নিজের কফিনের গায়ে করোনা ভাইরাসের ছবি চিত্রিত করে রেখে গিয়েছে সে। ‘নাম’ গল্পটি লেখার গুণে এবং গাম্ভীর্যে মনে থেকে যায়। লেখক নিজে একজন আইনজীবী। আদলতের একটি গল্প আছে এখানে, ফারিয়া আলমের ন্যায়বিচার।
গল্পটি বিচারপতি ফারিয়া আলমের জীবন এবং একটি মামলার ইতিবৃত্ত। সাইফুরের লেখা পড়লে ধরা যায় তার পঠন-পাঠনের বিস্তৃতি কতদূর। এটি আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। ফারিয়া আলম নারী বিচারপতি। তার প্রথম জীবনে এমন এক ঘটনা ঘটেছিল, যার বিষাদ এখনো তাকে আচ্ছন্ন করে। সে ঘটনা তার বিবাহিত জীবনের। যে মামলায় তিনি রায় দিতে অনেকবার ভাবছেন, সে মামলাটি ধর্মান্তরের। জনৈক নিতাই চন্দ্র সুরুজাবালা দেবীর স্বামী ছিল। ১৯৭৮ সালে তাদের বিবাহ হয়। ১৯৮৫ সালে নিতাই ধর্মান্তরিত হয়ে নিজামুদ্দিন নাম নেয়। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণ সিতারা বিবিকে বিবাহ। সেই নিতাই পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। তার দেহ মর্গে রাখা আছে। মামলা চলছে। তার দাহন হবে না কবর হবে। সে হিন্দু না মুসলমান। ইসলাম নেওয়ার পরও সে হিন্দু মন্দিরে গিয়ে নিয়মিত পুজোপাঠ করত। মন্দিরের পুরোহিত সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মামলায় সাক্ষ্য দিল। প্রমাণ দিল সে হিন্দুই ছিল। সুরুজাবালা দেবী সাক্ষ্য দিলেন, তার স্বামী আবার নিজ ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। স্থানীয় বড় মসজিদের ইমাম এসে সাক্ষ্য দিলেন, নিজামুদ্দিন (নিতাই) প্রতি জুমাবারে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ত। নিয়মিত ইসলামের ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করত। সুতরাং সে যে মুসলমান সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ জটিল মামলার রায় কী হতে পারে। ফারিয়া আলম বুঝতে পারেন না, মানুষটি ফিরবে না। দাহ হোক বা কবর হোক, তাতে মামলাকারীদের স্বার্থ কী? স্বার্থ খুঁজে বের করা গেল। এ গল্পটি এক মামলার সত্যাসত্য। রায় হয়েছিল। কী হয়েছিল, কীভাবে এ জটিল সমস্যার সমাধান হয়েছিল তা গল্পেই আছে। আমি আর বিশদে গেলাম না। সাইফুর রহমানের গদ্য সাবলীল। পড়তে ভালো লাগে। গল্পের পাঠ যোগ্যতা গল্পের গদ্যভাষার ওপর নির্ভরশীল যেমন, বলার ভঙ্গির ওপরও অনেকটা, বিষয়ও সেখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাইফুর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা ঘটান তার গল্পে। তার গল্প বলার ভঙ্গিও চমৎকার। তবে গল্পের বিস্তার ঘটান অনেক। তা রূপক হয়ে আসতে চায় গল্পে। করোনা ও কফিন গল্পে যেমন এসেছে।
আমি তো সূচনায় বলেছি, লেখকের নানা বিষয়ে আগ্রহ এবং পঠন-পাঠনের কথা। সেই পাঠ যেমন বিশ্ব সাহিত্যে, তেমনি বাংলা সাহিত্যেও। বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে তার একটি গল্প আছে, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের দীর্ঘশ্বাস’। এ গল্পে বঙ্কিম, সঞ্জীবচন্দ্র, নবীনচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার সরকার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-উনিশ শতকের এসব বিদ্বজ্জন এবং লেখকদের নিয়ে গল্প। গল্পটি আসলে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস, উনিশ শতকের নানা ঘটনা, বঙ্কিমের সমালোচনার ওপর লিখিত। সেই সময় নিয়ে সাইফুর রহমানের নিজস্ব এক ধারণা আছে। তা এখানে প্রতিফলিত। দুর্গেশনন্দিনী এবং ওয়াল্টার স্কটের আইভ্যানহো উপন্যাসের সাদৃশ নিয়ে বঙ্কিম বলছেন, তিনি আইভ্যানহো পড়েননি। প্রশ্নকর্তা নবীন সেন বললেন, দু’কপি আইভ্যানহো জাহাজে করে এসেছিল। তার এক কপি লাটসায়েবের গ্রন্থাগারে গিয়েছিল, অন্য কপিটি বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে। বঙ্কিম নিশ্চুপ। এ গল্পে ক্রমাগত বঙ্কিমের দিকে অভিযোগ তোলা হয়েছে। বঙ্কিম আত্মরক্ষা করতে চেয়েছেন নানাভাবে। আছে আনন্দমঠ নিয়ে বিতর্ক, আছে ঢাকা শহরের মুসলমান নিয়ে বঙ্কিমের তির্যক মন্তব্য। তবে এক জায়গায় আছে বঙ্কিম ক্ষোভের সুরে বলছেন, রবীন্দ্রনাথ নেহরুকে চিঠি লিখে বন্দেমাতরম যেন জাতীয় সংগীত না হয়, সে কথা লিখছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু ১৮৯৪ সালে। তিনি কী করে বলবেন ১৮৮৪ সালে এ কথা যখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ২৩। জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়েছে সে সময়। নেহরুর জন্ম ১৮৮৯ সালে। সুতরাং বঙ্কিমের মুখে বসানো কথায় তথ্যভ্রান্তি ঘটেছে। এ ভ্রান্তি না থাকাই বাঞ্ছনীয়। গল্পটিতে সে সময়ের লেখকদের ভেতরের সম্পর্ক, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে যে কথা আছে, তার সঙ্গে এ সময়ের মিল কম নয়। বঙ্কিম তার প্রতি অভিযোগে যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, তা হতাশার না মেনে নেওয়ার এ বিষয় অব্যক্ত রেখেছেন লেখক। এক রিকশাওয়ালা এবং তার যাত্রী দানিয়েলকে নিয়ে যে গল্প, ‘কলাভৃৎ’, তার ভেতর রয়েছে আকাশের গ্রহ-তারা নিয়ে অনেক কথা। পড়তে দারুণ লাগে এ গল্প। লেখক তারায় ভরা আকাশ নিয়ে কত কথা বলেছেন এ গল্পে। কালপুরুষের কথা বলেছেন। কালপুরুষ সব সময় চলমান। রিকশাওয়ালা সোহরাব আসলে এক প্রতিভা। গান গাইতে পারে চমৎকার। জামালপুরে বাড়ি। সেখান থেকে ডাক পায় গানের। সব মিলিয়ে দানিয়েলের সন্ধ্যা গেল খুব ভালো।
বাংলাদেশের লেখকই লিখবেন ‘উৎকোচ’-এর মতো গল্প। এ গল্পে কতরকম মাছের কথা যে আছে। উত্তরবঙ্গের কোনো নদী, কোনো বিল, কোনো বাঁওড়, হাওড়ের কোনো মাছ-মাছের কথা পড়তেই যেন এ গল্প পড়া। মাছ সবজি। বেগুন, লাউ কুমড়া নিয়েও কম কথা নেই। কত রকম বেগুনের কথা আছে এ গল্পে। বাজারে মাছ কিনতে গিয়ে ঘুসখোর আমলা সৎ আমলাকে মাছের বিবরণ দিচ্ছিল। তারপর তাদের পছন্দ করা মাছ ডবল দামে এক অভিজাত মহিলার কাছে বিক্রি করে দিয়ে মাছওয়ালা একটি পৌনে এক কেজির মতো রুই মাছ উপহার দেয় ঘুসখোর আমলাকে। কারণ তাদের বঞ্চিত করে মহিলাকে মাছগুলো ডবল দামে বেচে লাভ করেছে সে। ঠিক লোককেই বেছেছিল কছিমদ্দি। অসৎ আমলাকেই উপহার দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। সাইফুরের লেখার গুণ হলো গল্প ভনিতাহীন করে শেষ করা। খুব স্বাভাবিক এর চলন। সাতটি গল্প আছে এ বইয়ে। সাতটি গল্প লেখার গুণে আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। পাঠক-ধন্য হোক এ বই। তার পরবর্তী বইয়ের অপেক্ষায় থাকব।