‘আমার মতো একজন ব্রাত্য কবির রচনাকে তারা শ্রেষ্ঠ কবিতার হাটে বিকোতে চান। ‘১৯৭০ সালের ১৮ই জানুয়ারি প্রথম সংস্করণের ভূমিকা ‘ভারবি’-র অসীম সাহস সম্পর্কে এ কথা বলেছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ব্রাত্য কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা সংস্থা। আমার মনেও এই প্রশ্ন ওঠে কবিরা কি সবসময়ই ব্রাত্য? কবির জীবন ছন্নছাড়া, অগোছালো। বেশিরভাগ কবির প্রিয়জনেরাই চান না কবিতা লিখুন। অভাব, দারিদ্র্য তাদের পিছু ছাড়ে না। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে বই ছাপানোতে কি আনন্দ পান তাঁরা? তবু কবিতা লিখে যেতে ইচ্ছে করে হয়তো।
আজও তাঁর কবিতা মুখে মুখে ফেরে। সময় বলে দেয় কারা থাকবে কারা থাকবে না। কার লেখা মানুষ গ্রহণ করবে, কার লেখা মানুষ গ্রহণ করবে না। মনে পড়ে যখন উচ্চমাধ্যমিক পড়ি তখন পাঠ্যবই-এ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা ছিল রাস্তা কারও একার নয়। কবিতাটি পড়ে থমকে গিয়েছিলাম। পৃথিবীর কালো সাদা হলুদ মানুষের গান তাদের স্বপ্ন কখনো থেমে থাকে না। আজও বুঝি কেউ কারোকে রাস্তা ছেড়ে দেয় না যতদিন এই পৃথিবীতে গান থাকে গানের মানুষ থাকে স্বপ্ন থাকে। মনেপ্রাণে উপলব্ধি করি তাকেই একদিন রাস্তা ছাড়তে হয় যার স্পর্ধা আকাশ ছুঁয়ে যায়। শতবর্ষ পেরিয়ে যাচ্ছেন এই কবি মানুষের কথা বলতে বলতে। যাদের ঘর ত্রিপুরায়, আসামে, বাংলায়, সাঁওতাল পরগণায়, দাক্ষিণাত্যে, মেঘালয়ে, পাহাড়ে, জঙ্গলে, চা-বাগানে, কয়লা খনিতে, যারা হাঁটে, কুঁজো হয়ে কাজ করে, আধপেটা খায়, বিনা চিকিৎসায় মরে যায়। দেশ থাকতে দেশ নেই তাদের, পথের ঠিকানা নেই। ভারতবর্ষ তাদের রক্ত আর হাড় দিয়ে নির্মিত, তারাই গড়েছে এই মহাদেশ, শত শতাব্দীর শ্রমে, পরিচ্ছন্ন সত্তায়, মানবিক শুভেচ্ছায়-বোধে। ‘অথচ ভারতবর্ষ তাদের’কবিতাটি পড়তে পড়তে আজও বিস্মিত হই। ১৯৮৪ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি যে কবিতা লেখা হয়েছিল, সে কবিতা আজও জীবন্ত। ১৯৮০-তে শ্রেষ্ঠ কবিতা দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন “মানুষের আশা অবিনাশী। চারদিকের নরকের মধ্যেও মানুষ তাই স্বপ্ন দেখে। তখন, স্বয়ং মৃত্যু এসেও যদি তার সামনে দাঁড়ায় — সে তাকে সহজে পথ ছেড়ে দেয় না
— প্রশ্ন করে। প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নয়, প্রশ্ন করাটাই হয়তো কবির ধর্ম।
‘সময়, স্বদেশ, মনুষ্যত্ব— কবি, কবিতা, কবিতার পাঠক’— কোথাও এক সূত্রে বাঁধা পড়ুক এটাই চেয়েছিলেন তিনি। যেদিন সবাই মিলে পরিশুদ্ধ হবো সেদিনই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। আজও সব প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। পরিশুদ্ধই তো হতে পারলাম না।
“কে মুখোশ কে মুখ এখন
স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না। কঠিন অসুখ
সেরে গেলে যেরকম অসহায়”
— এ এক অমোঘ উচ্চারণ। মাথার ভিতরে স্মৃতি ঘোরে, শিয়রে পায়ের কাছে ইচ্ছেগুলো সাপের চুমার মতো অন্ধকার। ঘুমের ভিতর স্বপ্নগুলো পারেনা নিঃশ্বাস নিতে। আর এসব কথা সত্য হয়ে ওঠে। আজ থেকে ৫২ বছর আগে লেখা শব্দমালা প্রশ্নের সামনেই তো দাঁড় করায় আমাদের। একটি স্বাধীন দেশের বুক থেকে যখন উলঙ্গের আর্তনাদ আর নিরন্নের চিৎকারই শুধু উচ্চারিত হতে থাকে তখন যতই মদ গেলানো হোক না কেন— কেউ বলতে পারে না— ‘আমি স্বর্গ নরক বানাচ্ছি’।
‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’ দিয়ে শুরু তারপর ‘গ্রহচ্যুত’ ‘রানুর জন্য’, ‘উলুখড়ের কবিতা’, ‘মৃত্যুত্তীর্ণ’, ‘লখিন্দর’, ‘জাতক’, ‘সভা ভেঙে গেলে’,’মুখে যদি রক্ত ওঠে’, ‘ভিসা অফিসের সামনে’, ‘মহাদেবের দুয়ার’ পেরিয়ে ‘মানুষের মুখ’-শাশ্বত চিরন্তন সব কবিতাগ্রন্থ। মানুষকে ছুঁয়ে, মানুষের জীবনকে ছুঁয়ে, মানুষের উপর নেমে-আসা কালো অন্ধকারকে ছুঁয়ে নির্মিত হয় তাঁর কাব্যভাষা, তাঁর কবিতার জগত। তিনি বলতে পারেন মুন্ডহীন ‘ধড়গুলো আহ্লাদে চিৎকার করে’, তিনি কবিতার বইয়ের নাম দিতে পারেন ‘আমার রাজা হওয়ার স্পর্ধা’, ‘জ্বলুক সহস্র চিতা এ পাড়ায় ও পাড়ায়’, ‘মানুষখেকো বাঘেরা বড় লাফায়’, ‘বাহবা সময়, তোর সার্কাসের খেলা’, ‘ন্যাংটো ছেলে আকাশ দেখছে’, ‘ন্যাংটো ছেলের সূর্য নেই’, ‘ভাতে পড়ল মাছি’। এই কবি লেখেন ‘বেঁচে থাকার কবিতা’, ‘শীত বসন্তের গল্প’, ‘আর এক আরম্ভের জন্য’, ‘অথচ ভারতবর্ষ তাদের’, ‘অফুরন্ত জীবনের মিছিল’, ‘আমার যজ্ঞের ঘোড়া’। একটি পুরনো রূপকথা হয়ে ওঠে এ সময়ের কাব্যভাষ্য —
“একটি মেয়ে উপুড় হয়ে কাঁদছে যন্ত্রণায়
বিবর্ণ তার নয়ন দুটি, কিন্তু বড় মিঠে।
একটি ছেলে জানে না, তাই অঘোরে নিদ্রা যায়
জানলে পরে থাকতো এখন পঙ্খীরাজের পিঠে”
(আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে)
জীবনকে তীব্রভাবে ভালোবাসতেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। জীবনকে ভালোবাসতেন বলেই বোধহয় অন্ধকারময় ধূসর রক্তাক্ত এই পৃথিবীর মধ্যে স্বপ্নের বীজ বুনে দিতে চেয়েছিলেন। মাটি, মানুষ, রূপকথা, জীবন, স্বপ্ন, মৃত্যু, বিষণ্ণতা, ভাতের গন্ধ, খিদে, আগুন, গান, দুঃস্বপ্ন, ভালোবাসা, বৃষ্টি, জল, চাঁদ, মিলেমিশে একাকার তাঁর কবিতায়।
###
সেই নতুন পৃথিবীর জন্য
শুধু তার জন্যই
আমি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই;
কেননা, আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা
আমাকে হাজার বার কান ধরে ওঠ-বোস করালেও
একই সঙ্গে আমাকে এই অভয় মন্ত্র দিয়েছে,
ভয় দেখানোর মাস্টারমশাইরাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্য নয়;
ভূত, রাক্ষস, মানুষ-খেকো এমনকি সাক্ষাৎ মৃত্যুও নয়;
আসল সত্য রয়েছে আমার মায়ের দেওয়া
ছোটবেলার স্বপ্নের মধ্যে
মা আমার বুকের ভেতর থেকে কেউ কোনদিন ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
###
আমি আর একবার সেই আশ্চর্য স্বপ্ন
যা আমার হারিয়ে যাওয়া কবিতা
মা আমার এবং যে কোনো মানুষের একটি বেঁচে থাকার পৃথিবী-
তাকে খুঁজে বের করবো।
সেজন্য আমাকে যত মূল্যই দিতে হোক্।
(আর এক আরম্ভের জন্য)
একটা পৃথিবী চেয়েছেন তিনি মায়ের আঁচলের মতো, সেই আঁচল জুড়ে থাকবে গান, শিশুরা শান্তিতে ঘুমোতে পারবে,ঘুম থেকে জেগে উঠে তারা দেখবে তাদের জন্য মায়ের বুক খোলা আছে, যে বুকে শুধুই অফুরন্ত ভালোবাসার শস্য। এমন একটা পৃথিবী চেয়েছেন তিনি, শুকনো কাঠের মতো মায়েদের শরীরের কান্না নিয়ে নয়। বাইরের দিকে তাকালে চোখে ধাঁধা লাগে, চোখ পুড়ে যায়, স্বাধীন দেশে পা রাখার জায়গা পাওয়া যায় না। অথচ বুদ্ধিমান বিচক্ষণ যারা তারা রক্তকে সোনা আর মানুষের হাত-পা-কে স্বর্গের সিঁড়ি মনে করে। তারা অনেক আশ্চর্য ম্যাজিক জানে। কবি আকাশ ছাড়া মাটি ছাড়া শূন্যে ঝুলে থাকেন যখন, যারা বোবা তারা ভাবে কবি তাদের জন্য ‘একটি নিরাপদ, মানুষের পৃথিবী’ রচনা করছেন। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘একটি নিরাপদ, মানুষের পৃথিবী’ই রচনা করতে চেয়েছিলেন শব্দের অক্ষরে অক্ষরে। আজও ন্যাংটো ছেলে আকাশে হাত বাড়ায়,খিদেয় তার গা পুড়ে যায় অথচ ফুটপাতে জাগে জোছনা, চাঁদ হেসে তার কপালে চুমু খায়। ‘লুকিয়ে মোছেন চোখের জল, মা।’
আজও সারারাত কেউ জেগে থাকে আশ্চর্য ভাতের গন্ধে। আজও আমরা আগুনে হাত রেখে প্রেমের গান গাই। আজও উচ্চারণ করি —
আলো আসুক, আলো আসুক, আলো
বুকের মধ্যে মন্ত্র হোক, রক্তজবা!
আসলে আগুন ছাড়া মিথ্যে ভালোবাসা। ‘কালো বস্তির পাঁচালি’ পড়ে আজও স্তম্ভিত হতে হয় —
“আয় রোদ্দুর আয়।
আয় আমাদের ন্যাংটা খুকুর নোংরা বিছানায়
আই রোদ্দুর বস্তিতে
আধমরা ওই খুকুর ঠোঁটে একটু চুমুর স্বস্তি দে।”
‘মুখে যদি রক্ত ওঠে’ কাব্যগ্রন্থের এইসব কবিতাগুলি সাধারণ মানুষের যাপনচিত্রকে তুলে ধরে। ষাটের দশকে লেখা কবিতায় ফুটে ওঠে যন্ত্রণা।
“অন্ন বাক্য/ অন্ন প্রাণ/অন্ন চেতনা/ অন্ন ধ্বনি/ অন্ন মন্ত্র/অন্ন আরাধনা।” ওই সময়ে রক্ত বমিও করা ছিল পাপ, যন্ত্রণায় ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া ছিল পাপ।
‘মহাদেবের দুয়ার’ কবিতাটি মহাকাব্য। সেখানে তিনি বলেছেন, ছত্রিশ লাইন কবিতা না লিখে, যদি আমি মাটিকে জানতাম। ‘সারা জীবন ধরে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মাটিকেই জানতে চেয়েছেন, জানতে চেয়েছেন মাটির সাথে লগ্ন-থাকা মানুষকে। চারিদিকে ক্লান্তির শব্দ শুনতে পেলেও, পাতা ঝরে গেলেও, অন্ধকার আর গভীর কুয়াশা থাকলেও মার খাওয়ার স্বপ্ন, রুগ্ন প্রেম, শীর্ণ ভালোবাসা মুখে রক্ত তুলে মাথা তুলতে চায়। কালবৈশাখী ঝড়কে আহবান করেন, যা বুকে স্পর্ধা আনবে, কন্ঠে দেবে জীবনের গান অন্ধ,বোবা স্বদেশের বুকের ভিতর। ভারতবর্ষকে শপথের আলোকে অন্যভাবে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। পুনর্জন্মের প্রার্থনা করেছিলেন —
নবজন্মে বাংলার অমৃত
মাটি পাবে শান্তির কোমল
‘মানুষের মুখ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি যেন ক্রুশবিদ্ধ মানুষের ছবি। এমন এক অন্ধকার সময় আসে যখন বন্ধুর দিকে দুই হাত বাড়ানোই আত্মহত্যা, যখন সৎ থাকার অর্থ রাস্তায় দাঁড়ানো, যখন বিশ্বাস মানেই পায়ের নিচে মাটি নেই। যে কবি হতে চেয়েছিল, সে শুয়ে থাকে মর্গে। যে ভালবাসতে চেয়েছিল তার তখন গভীর ঘুম। ওদিকে কবি দেখেন আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে পতাকায়, ফেস্টনে গর্জনে। দৃশ্যের দর্পণে বুঝি দ্রুত পৃথিবী বদলায়, কিন্তু —
কুয়াশায়
ও শুধু চোখের ভুল,
যা দেখিস
ভিক্ষার মিছিল যায়
আন্তর্জাতিক প্রহসন নয় সত্যিকারের পৃথিবীর জন্য কবিতা লিখে গেছেন তিনি। শতবর্ষ পেরিয়ে গেছেন কবি। তাঁকে বেশি বেশি করে পড়ার সময় বোধহয় হয়েছে।
অমৃতাভ দে, ‘কথার ঘর’, শিবতলা লেন, ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
ভালো লাগল লেখাটি।
নিবন্ধটি অসাধারণ! কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ভাষার মুগ্ধতায় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন নিবন্ধকার। বর্তমান সময়ের আলোকে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদেরকে বড়ো বেশি ভাবমুগ্ধ করে তোলেন। কারণ, তাঁর রচনার মধ্যে সাধারণ মানুষের কথা জীবন্তরূপে ধরা দিয়েছে। নিবন্ধকার কবির কবিতা থেকে নানা উদ্ধৃতি দিয়ে কবির জীবনমুখিনতাকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন।
সুন্দর আলোচনা।ভালো লাগল।
জীবনকে তীব্র ভাবে ভালোবেসেই কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ধূসর রক্তাক্ত অন্ধকারময় এই পৃথিবীতে বুনে দিতে চেয়েছিলেন স্বপ্নের বীজ। অমৃতাভ, তুমি সঠিকভাবেই চিনে নিতে পেরেছ এই কবিকে। মাটি, মানুষ, রূপকথা, জীবন,স্বপ্ন,মৃত্যু,বিষন্নতা, ভাতের গন্ধ, খিদে,আগুন এসব নিয়েই তো কবির স্বাধীন সতেজ উচ্চারণ পাঠককে দাঁড় করায় প্রার্থিত পথের চৌমাথায় যেখান থেকে পাঠক নিজেই বেছে নিতে পারে সঠিক রাস্তা। শুধুই চাঁদ ফুল তারার শৌখিনতায় মোড়া নয় কবির পৃথিবী। কবির বাসভূমি হল সমস্যাদীর্ণ এই বাস্তবের পৃথিবী। সমস্যাকে পেরোনোর যাত্রাই কবিতা।খুব ভালো লাগল তোমার বিশ্লেষণ।