বুধবার | ১৪ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:২৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (পঞ্চম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস আলোর পথযাত্রী : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (চতুর্থ পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস কন্নড় মেল্ল থেকেই সিন্ধুসভ্যতার ভূখণ্ডের প্রাচীন নাম মেলুহা : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (তৃতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস লোকভুবন থেকে রাজনীতিভুবন : পুরুষোত্তম সিংহ চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (দ্বিতীয় পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস রবীন্দ্রনাথের চার্লি — প্রতীচীর তীর্থ হতে (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত রবীন্দ্রনাথের ইরান যাত্রা : অভিজিৎ ব্যানার্জি ঠাকুরকে ঠাকুর না বানিয়ে আসুন একটু চেনার চেষ্টা করি : দিলীপ মজুমদার যুদ্ধ দারিদ্র কিংবা বেকারত্বের বিরুদ্ধে নয় তাই অশ্লীল উন্মত্ত উল্লাস : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ, পঁচিশে বৈশাখ ও জয়ঢাক : অসিত দাস রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী ও শান্তিনিকেতন : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বাঙালী রবীন্দ্রনাথ : সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক দূর পর্যন্ত ভেবেছিলেন আমাদের ঠাকুর : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথের প্রথম ইংরেজি জীবনী : সুব্রত কুমার দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (প্রথম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস শুক্লাম্বর দিঘী, বিশ্বাস করে দিঘীর কাছে কিছু চাইলে পাওয়া যায় : মুন দাশ মোহিনী একাদশীর ব্রতকথা ও মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত নিজের আংশিক বর্ণান্ধতা নিয়ে কবিগুরুর স্বীকারোক্তি : অসিত দাস ঝকঝকে ও মজবুত দাঁতের জন্য ভিটামিন : ডাঃ পিয়ালী চ্যাটার্জী (ব্যানার্জী) সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা : লুৎফর রহমান রিটন সংস্কৃতি জগতের এক নক্ষত্রের নাম বসন্ত চৌধুরী : রিঙ্কি সামন্ত আংশিক বর্ণান্ধতাজনিত হীনম্মন্যতাই রবীন্দ্রনাথের স্কুল ছাড়ার কারণ : অসিত দাস পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ কি অবশ্যম্ভাবী : তপন মল্লিক চৌধুরী সাত্যকি হালদার-এর ছোটগল্প ‘ডেলিভারি বয়’ নব নব রূপে এস প্রাণে : মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য ভারতের সংবিধান লেখার সেই ঝর্না কলমটা… : দিলীপ মজুমদার গীতা রাজনৈতিক অস্ত্র নয়, ভারতাত্মার মর্মকথা : সন্দীপন বিশ্বাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

নাট্যকার শম্ভু মিত্রের নাট্যভাবনা : ‘কাকে বলে নাট্যকলা’: অমৃতাভ দে

অমৃতাভ দে / ১০১৩ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ২৬ জুলাই, ২০২৩

বাংলা নাটকের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী নাট্যকার শম্ভু মিত্র যতদিন বেঁচেছিলেন নাটকের সাথেই জড়িয়ে ছিলেন আষ্টেপৃষ্ঠে। নাট্যনির্দেশক, নাট্যশিক্ষক, সুদক্ষ অভিনেতা, নাট্যরচয়িতা, আবৃত্তি-শিল্পী শম্ভু মিত্রের নাট্যবিষয়ে ভাবনাগুলি বিভিন্ন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বিচিত্র জীবনপ্রবাহে সঞ্চরণশীল শম্ভু মিত্র নাটক নিয়ে ভেবেছেন সব সময়। অভিনয়, মঞ্চসজ্জা, নাট্য আন্দোলন, নাটকের চরিত্রনির্ণাম, রঙ্গমঞ্চের সংকট, নাটকে দর্শকের ভূমিকা, নাটকে সঙ্গীতের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর চিন্তা, অনুভব-উপলব্ধি আমাদের নাটক সম্পর্কিত অজানা প্রশ্নগুলির উত্তর দেয়। তাঁর ‘সম্মার্গ সপর্যা’, ‘অভিনয় নাটক মঞ্চ’, ‘নাট্যভাষ’, ‘নাটক রক্তকরবী’, ‘প্রসঙ্গ : নাট্য’, ‘কাকে বলে নাট্যকলা’নাটক — বিষয়ক মূল্যবান এক-একটি গ্রন্থ। এইসব গ্রন্থের অন্তর্গত প্রবন্ধগুলি ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। এছাড়া বেশ কিছু বক্তৃতাকেও গ্রন্থভুক্ত করা হয়েছে। তাঁর নাটক দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু ছোটোবেলায় রেডিও — নাটকে তাঁর গম্ভীর উদাত্ত কণ্ঠে ‘চার অধ্যায়’, কিংবা ‘রক্তকরবী’ শুনেছি বারবার। জীবনানন্দ কিংবা রবীন্দ্রনাথ কিংবা সুধীন দত্তের কবিতাপাঠ শিরায় শিরায় স্রোত বইয়ে দিয়েছে। আর আজ তাঁর নাট্য বিষয়ে চিন্তা-চেতনা গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে আমাকে। মনন — ঋদ্ধ তাঁর প্রবন্ধগুলি নাটক সম্পর্কে আমাদের আগ্রহী করে তোলে। নাটক দেখতে, নাটক নিয়ে ভাবতে সাহস পাই আমরা। তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘কাকে বলে নাট্যকলা’। নাট্যকলা নিয়ে সংক্ষিপ্ত, মনোগ্রাহী এই আলোচনা নাট্যবিষয়ে উৎসাহী পাঠককে অবশ্যই পড়তে হবে।

ডা. আবীরলাল মুখোপাধ্যায় শম্ভু মিত্রকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা দেওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন ১৬ জুন ১৯৮৮ সালে। সেটি ছিল ‘জলসাঘর বক্তৃতা মালা’র অন্যতম একটি বক্তৃতা। এটি শম্ভু মিত্র মুখে মুখেই বলেছিলেন। পরে সেই বক্তৃতা সামান্য সামান্য সংশোধন করে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মূল্যবান একটি গ্রন্থ ‘কাকে বলে নাট্যকলা’। এই গ্রন্থটিতে নাট্যকলা বলতে কি বোঝায় তা নাট্যকার শম্ভু মিত্র বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে স্পষ্ট করেছেন। নাটক আর অভিনয়ের যুগ্ম মিলন হলেই তাকে নাট্যকলা বলা হয়। আসলে নাটক সংযুক্ত শিল্প (Composite Art)। প্রসঙ্গত সঙ্গীতের কথা এসেছে। এসেছে ছবির কথাও। গানও হয়তো গায়ক, গীতিকার, সুরকার তিনজনের সংযুক্ত পরিশ্রমের ফল। গল্পের সাথে ছবি থাকলে সেই ছবিকেও কেউ কেউ বলে ফেলতে পারেন সংযুক্ত শিল্প। শম্ভু মিত্র মনে করেন, ‘প্রত্যেক কলাশিল্পের একটা গঠনগত সম্পূর্ণতা থাকে।… নাট্যাভিনয়ের ক্ষেত্রে নাটকও নাট্যকলার একটি অংশ মাত্র ….’ অভিনয়ও একটা অংশ, নাটকের সঙ্গে যুক্ত না হলে সেটা সম্পূর্ণ হয় না। আলোচনা প্রসঙ্গে এসেছে ইউরোপে প্রচলিত অভিনেতাকেন্দ্রিক নাট্যরীতির কথা। যেখানে অভিনেতারা নিজেরাই মঞ্চের উপর নিজেদের সংলাপ তৈরী করে বলতেন। সেখানে নাট্যকারের কোন প্রয়োজন ছিল না। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে আর এক ধরণের নাটক, যেখানে অভিনয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি নাট্যকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এরকম চেষ্টা টেকেনি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই শম্ভু মিত্র ছায়ানাট্য, পুতুলনাট্য, মুকাভিনয় প্রভৃতি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন। আসলে তিনি আলোচনা করতে চেয়েছেন ‘সেই নাট্যের যেখানে নাটককারের যে কৃতি এবং নটনটীদের যে কৃতি উভয়ে মিলে আমাদের একটি গভীর উপলব্ধির মধ্যে নিয়ে যায়।এবং সেই যে নাট্য তার মধ্যে এই নাটকটা একটা অংশ।’

কলা শিল্পের প্রকাশ ক্ষমতার বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে শম্ভু মিত্র বলেছেন, ‘প্রত্যেক কলা শিল্পের প্রকাশের একটা নিজস্ব ক্ষেত্র আছে এবং অন্য কোন কলা শিল্পের দ্বারা তা প্রকাশ করা যায় না।’ এ প্রসঙ্গেও তিনি চিত্রশিল্প ও সঙ্গীতশিল্পের কথা বলেছেন। নাট্যকলার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। আলোচনা করতে গিয়ে তিনি তাঁর কিশোর বয়সের দেখা ‘দিগ্বীজয়ী’ নাটকের কথা তুলে ধরেছেন, যেখানে অভিনয় এমন একটা আশ্চর্য সৃষ্টি হত যা লিখিত অবয়ব-এর থেকেও অনেক বেশি স্তরের প্রতিভাষে অনেক বেশি জটিল হয়ে প্রকাশ পেতো। আসলে মঞ্চসজ্জা আলো, নেপথ্য শব্দ, মঞ্চের উপরে অভিনয় সমস্তটা মিলিয়েই একটা আশ্চর্য ঘটেছিল সেখানে। অন্তনির্হিত ভাব প্রকাশটাই আসল কথা। তিনি লিখেছেন নাট্যকলায় এমন কিছু অনুভব সঞ্চার করে যা অন্য আর কোন সময়ে সঞ্চারিত হয় না। তিনি নাটকের যে রূপ তার তফাৎকে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। তাই তার আলোচনায় স্বাভাবিক ভাবেই উঠে এসেছে দৈনন্দিন কথোপকথনের কথা —

‘সেজন্যে যখন কোনো অভিনেতা অভিনয় করে, তখন ওই লিখিত ভাষা যেটা — সেটা যতদূর সম্ভব দৈনন্দিন কথোপকথনের যে শব্দের ছক আছে — তার কাছে নিয়ে আসতে চায়।’

শম্ভু মিত্র জানেন আমাদের দৈনন্দিন যে কথোপকথন যে আচরণ তার মধ্যে সমসাময়িক বাস্তববোধ প্রকাশ পায় যেমন তার মধ্যে সমসাময়িক কল্পনারত একটা গড়ন থাকে। একজন অভিনেতাকেও ঠিক সেই কাজটি করতে হয়। তবে তার কথোপকথন জীবন্ত হয়।

‘অভিনয়-শিল্পীকে তার নিজের স্বরলিপি নিজেই তৈরী করতে হয় যাতে দর্শক, যারা এসেছে দেখতে এবং শুনতে তাদের যাতে ওটা সত্য বলে উপলব্ধি হয়।’

অভিনয়কালে নটনটীরা লিখিত বর্ণের সেই সীমিত প্রকাশ ক্ষমতাকেই পেরিয়ে যান। শম্ভু মিত্র তাঁর অন্য একটি বই ‘অভিনয়-নাটক-মঞ্চ’-এ এক জায়গায় লিখেছেন —

‘শিল্প সব সময়ে সাধারণ জীবনের তট ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, সাধারণ ভঙ্গিকে আয়ত্ত করে তার মধ্যে দিয়ে গভীর ভাব ফোটায়। সুতরাং আমাদেরও সবসময়ে কথোপকথনের ভঙ্গির থেকে সুর অর্জন করতে হবে। অর্থাৎ বাজে কথাবার্তার সুরহীনতার অনুকরণ নয়, যেখানে সাধারণ কথা প্রেম প্রকাশ করে, গভীরতা প্রকাশ করে। ছবি প্রকাশ করে।সেই সুর শিখতে হয়। কথ্য সুরে বিশেষ কবিতা আবৃত্তি করলে গলায় ছন্দবোধ বাড়ে এবং modulation বাড়ে।’ (অভিনয় কী?)

যিনি মনে করেন ভাষা কাপড়ের দোকানের রেডিমেট জামা নয়, ভাষা লেখবার বা ভাষা বলবার আগে নিজের অধিকার অর্জন করতে হয়, তিনিই তো বলবেন — ‘চিন্তা বর্ণান্ধতা যেন প্রকাশ পায় কথ্য ভাষার ছন্দের মধ্যে।’ (শিল্পকর্ম)

শম্ভু মিত্র একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন — নাট্যকলাটা কী কেবলমাত্র অভিনয়ের সময়ই সৃষ্টি হয়েছে? দর্শক তো মঞ্চসজ্জাকেও অভিনন্দিত করে। মঞ্চসজ্জাও নাট্যকলার একটি অংশ আবার তার নেপথ্য সংগীতও তার একটা অংশ। প্রসঙ্গত তাঁর অন্য একটি প্রবন্ধ ‘মঞ্চ সজ্জার ভূমিকা’ ( সন্মার্গ সপর্যা )-র কথা বলতে হয়। মঞ্চসজ্জার সৌকর্যের উপর যে নাট্যাভিনয়ের প্রসাদ গুণ অনেকটা নির্ভর করে তা তিনি সেখানে বলেছেন। শিশির কুমার ভাদুরীর হাতেই নাট্যাভিনয় প্রথম শ্রুতির এবং দৃষ্টির সমন্বয় বিধান করেছিল। এবং মঞ্চসজ্জায় একটা কল্পনা প্রকাশ পেয়েছিল। শম্ভু মিত্র মনে করেন প্রসার ক্ষমতাই হল মঞ্চসজ্জার প্রথম বৈশিষ্ট্য। ‘সবাই একটা মঞ্চের উপর দাঁড়ালে কখনই দৃশ্যের মধ্যে গভীর ভাবটা আসে না। তাই স্তর বৈচিত্র্য নাট্যাভিনয়ের একটা পরম প্রয়োজনীয় বস্তু।’ এই প্রবন্ধেও তিনি ‘দিগ্বীজয়ী ‘নাটকটির মঞ্চসজ্জার কথা বলেছেন। নাটক যে অভিনয়ের জন্য লেখা একটি বিশিষ্ট শৈলী তা শম্ভু মিত্র তাঁর ‘কাকে বলে নাট্যকলা’ গ্রন্থে বলেছেন। আবার এও বলেছেন নাটকও মঞ্চাভিনয়ের উদ্দেশ্যেই লেখা। একটা ভালো নাটকের ভালো অভিনয় সম্পর্কেই তিনি আলোচনা করতে চেয়েছেন। তাই নাট্যকলায় এই রকমভাবে যুগ্ম হলে জীবনের একটা জটিলতা প্রকাশ পায়। নাটক আসলে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। অভিনয়টা সবসময়ই চলে। আর চলার মধ্যেই জটিলতার সৃষ্টি হয়। তাই নাটকের সংলাপ কেবলমাত্র চরিত্রের আবেগকেই প্রকাশ করে না, গল্পটাকে এগিয়েই নিয়ে যায় না, আরও অনেক কিছুই প্রকাশ করে। আর ভালো অভিনয়ই সেটা পারে। আসলে নাট্যকলার মূল কথাই হল সম্পর্ক। শম্ভু মিত্র বলছেন — ‘নাট্যকলার মূল কথা যে সম্পর্ক, — সমাজের সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের সম্পর্কটা কী, আর নিজের সঙ্গে তার নিজের সম্পর্কটা কী এই কথাটাই প্রকাশ পায় নাট্যে।’

একদিকে তিনি আলোচনা করেছেন সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে অন্যদিকে মানুষের নিজের সঙ্গেও নিজের সম্পর্কের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সমাজের প্রত্যেকটা মানুষই হয়ত চায় শান্তি, কিন্তু আমাদের কল্পনায় যা আছে আর বাস্তবে যেটা দেখি আমরা তার সঙ্গে ভীষণ সংঘাত বেঁধে যায়। হ্যামলেটের উক্তিকে মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। খালি নিজের বুদ্ধি দিয়েই বুঝতে হবে।অভিনেতাকে নিপুণ যন্ত্রীর মতো সুরটা বাজাতে হয়। অভিনেতা নিজেই যন্ত্রী আবার নিজেই তার যন্ত্র।অভিনেতা তার সংলাপগুলোর সুর-স্বরলিপি নিজেই করে নেবে। অবশ্য সে সেটা করবে তার সহ অভিনেতা অভিনেত্রীর গলার সঙ্গে খাপ খাইয়ে। শ্রোতার কাছে তা এক অদ্ভুত হারমোনির মত মনে হবে। সমস্ত কলাশিল্পীই একটা সমগ্রের কল্পনা করে।শম্ভু মিত্র বিশ্বাস করেন নাট্যকলার কেন্দ্রে আছে মানুষ। সেই মানুষ বিমূর্ত মানুষ নয়। একেবারে রক্ত মাংসের বহুস্তরিক বহুপার্শ্বিক মানুষ। এই মানুষের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক আছে। আবার নিজের সঙ্গেও সম্পর্ক আছে। তিনি মনে করেন মহৎ নাট্যকলার প্রত্যেক চরিত্রের একটা নিজস্ব জীবনদর্শন আছে। প্রত্যেকটা চরিত্রের এক একটা আলাদা আলাদা গল্পও থেকে যায়। পুরো নাটকের একটা গল্প না, তা ছাড়িয়ে প্রত্যেকটা চরিত্রই এক একটা গল্পের মতো। শম্ভু মিত্রের মতে ‘রক্তকরবী’র মানুষগুলোও বিমূর্ত নয়। ওগুলো খুব জ্যান্ত জীবন্ত মানুষ।

সবশেষে শম্ভু মিত্র নির্দেশকের কাজ সম্পর্কে বলেছেন। তাঁর মনে হয় অভিনেতারা যখনই নেপথ্য ছেড়ে মঞ্চে চলে যায়, সে চলে যায় নির্দেশকের হাতের বাইরে। তাঁর মতে নির্দেশকের কাজ হচ্ছে কারও ভিতর থেকে ভালো অভিনয়টা বার করে আনা। এখানে শম্ভু মিত্র অভিনেতার কাজটা কি সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। নির্দেশক এবং অভিনেতার সম্পর্ককে এ গ্রন্থে তিনি এড়িয়ে গেছেন। অভিনয় প্রসঙ্গে দৈহিক ভঙ্গীর কথাও এসে গিয়েছে। তিনি মনে করেন ‘অভিনয় করতে গেলে ভঙ্গীটা জানতে হয়, যে, কেমন করে ওটা প্রকাশ করবে।’

তিনি গ্রন্থটি শেষ করেছেন এই প্রশ্ন তুলে যে একটা নাটক যখন শেষ হয় তাতে কী প্রকাশ পায়? ‘রক্তকরবী’ নাটকটির একটি দৃশ্যকে মনে করিয়ে দিয়েছেন ‘রক্তকরবী’র রাজার কথা। ‘চার অধ্যায়ে’র অন্তু চরিত্রের কথাও এসেছে। নিজের মধ্যে দুটো বিপরীত ভাবের দ্বন্দ্ব নাট্যকলায় প্রকাশ পায়। নাট্যকলার মধ্যেও নাটককার আর অভিনেতার সম্পর্ককে বোঝাতে গিয়ে দুটো সমান ওজনের তারার পরস্পর পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে চলার উদাহরণ দেন। প্রদক্ষিণ রেখাটা কখনোই গোল সোজাসুজি গোল হয় না। পরস্পর পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করতে করতে ঘোরে। নাটককার অভিনেতার অভিনয়ের ক্ষমতার বিরাট আকাশটাকে খুলে দেন, আর অভিনেতা নাটককারের তৈরী করা পরিস্থিতিগুলোকে, চরিত্রের কথাকে ভালোবেসে ফেলে। তিনি বলেন ‘মানুষের সম্পর্কের এই যে জটিল জাল, সেটাই আমাদের আধুনিক নাট্যের অন্তরে অন্তরে একটা টেনসন তৈরী করে। ‘

তিনি ‘Doll’s House ‘নাটকটির উদাহরণ দেন। তিনি বলতে চেয়েছেন কোন অভিনেতা কীভাবে কথা বলবেন সেটা স্থির হবে ঐ অভিনয়ের মধ্যে বা অভিনয় তৈরী করার মধ্যে। অভিনয় সত্য হয় কখন? শম্ভু মিত্র মনে করেন অভিনেতা অভিনেত্রীরা নিজেদের স্মৃতির ভাড়ার থেকে উপলব্ধি আহরণ করে যদি সম্পর্কের পটভূমিকা রচনা করে নিতে পারে তখনই তাদের অভিনয় সত্য হয়। নাট্যকার যে চরিত্রটি নির্মাণ করেন এবং সেই চরিত্রটি যিনি অভিনয় করেন তাকে নির্মিত চরিত্রটিকে এমনভাবে আত্মসাৎ করতে হবে যে দর্শক যেন দেখতে দেখতে তার মধ্যে ঐ চরিত্রের লক্ষণগুলি আবিষ্কার করে। তিনি এও বলেছেন দর্শক যেন সেটা নিজেই আবিষ্কার করেন। একথা বলতে গিয়ে তিনি আমাদের শিক্ষার ধরণটাকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি। বইয়ের কথার সাথে জীবনের কথাকে মিলিয়ে তা বোঝবার মধ্যেই আছে প্রকৃত শিক্ষা। তিনি মনে করেন নাটক তুলে ধরে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন আলাদা আলাদা চারটি চরিত্রের মাঝখানে মূল বাজনাটা নন্দিনীর কন্ঠ। আর সবটা মিলিয়ে তৈরী হয় Orchestration। তাঁর মতে দর্শকদের সচেতন জ্ঞানের মধ্যে তা অনেকসময় আসে না। কিন্তু অচেতনভাবে সেগুলি ভেতরে প্রবেশ করে যার ফল আছে।

‘আর মহৎ শিল্পকলামাত্রই তো এইরকম চেতন অবচেতন নিয়ে নানা স্তরে কাজ করে। কত নাড়া দেয়। সব সঙ্গোপনে, তারই নাম তো শিল্পকলা।’


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন