শ্যামলাতাল থেকে মায়াবতী এসে যখন পৌঁছল দেবদূত আর শিখা, তখন বারোটা বাজতে কিছুক্ষণ মাত্র দেরি। আসলে এতটা সময় বোধহয় লাগত না, কিন্তু শিখার এমন আদেখলে স্বভাব, যে কোন স্থানে মার্কেটপ্লেস দেখলেই হামলে পড়ে। যেন আর কোথাও এরকম জিনিস সে পাবে না, আর এই মুহূর্তে কিনতে না পারলে জীবন বৃথা। শ্যামলাতাল থেকে মায়াবতী আসতে মাঝে চম্পাবত বলে একটা ছোট্ট টাউন আছে। সেখানে একটা বাজারও আছে। এই গোটা এলাকায় বাজার বলতে চম্পাবত আর লোহাঘাট। আর কোথাও কিছু দোকানপাট নেই। শুধুই প্রকৃতি নিজের মত করে নিজেকে প্রকাশ করে চলেছে।
চম্পাবতে একটু চা খাওয়ার জন্য গাড়ি থামিয়ে নামা হয়েছিল, আর শিখা অমনি ঝাঁপিয়ে দোকানে ঢুকে যা পারল ব্যাগ বোঝাই করে অহেতুক সময় নষ্ট করল। এদিকে মায়াবতী আশ্রমে বারোটা বেজে গেলে খাওয়ার ঘর বন্ধ করে দেয়। গোটা রাস্তায় একটা উদ্বেগ নিয়ে আসতে হয়েছে দেবদূতকে। শিখার ওসব চিন্তা নেই। তার বক্তব্য যদি খেতে না দেয় তো সঙ্গে যা আছে দুপুর চলে যাবে।
যাইহোক, বারোটার আগেই মঠে ঢুকে পড়ে দেবদূত এখন অনেক শান্ত। নাহলে একটু আগেও গাড়িতে রাগে গনগনে হয়ে কত কিছু বলতে বলতে আসছিল।
শিখা চুপচাপ বসে থাকার মানুষ নয়, সেও চেপে চেপে যতটা শোনানো যায় শুনিয়েছে। এখানে আর একটা খারাপ ব্যাপার হলো সব ড্রাইভার বাংলা খুব ভাল বোঝে, তাই ঝগড়াটা ঠিকমতো করা যায় না। সব সম্পর্কের তো একটা দেখনদারি ব্যাপার সামনে রাখতেই হয়। ওই, বালিশের ওপর রঙিন ঝাড়নের মত।
***
মানুষটি উঠে আসছিলেন নিচের পাহাড় থেকে। রোগা চেহারা, মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা, খাড়া নাক, চোখদুটো একটু ঢোকা, কেমন যেন অন্যমনস্ক। হাঁটার সময় হাতের আঙুল নাড়াতে নাড়াতে উঠছেন। চেয়ারে শিখাকে বসে থাকতে দেখে হাসলেন। শিখাও হাসল। ভদ্রলোক এসে শিখার পাশে বসলেন। পাশেই একটা তামার কলস রাখা। ঝকঝকে তকতকে। সকলে পাহাড় ভেঙে উঠেই ঢকঢক করে জল খাচ্ছে। এই ভদ্রলোক কিন্তু জল খেলেন না।
শিখা দেখল, আস্তে আস্তে অনেক মানুষ জড়ো হচ্ছেন মঠে। দুপুরের খাবার খেতে সবাই আসছেন। ভদ্রলোক এবার শিখার একদম কানের কাছে মুখ এনে বললেন, “নীচ থেকে ওপরে আসার জন্যে আমার গাড়ি রাখা আছে, আপনি ইচ্ছা করলে আসা যাওয়া করতে পারবেন।” শিখা একটু অবাক হল। ভদ্রলোককে একেবারেই চেনা নেই। অবশ্য মঠে যারা আসেন তাদের মধ্যে একটা অন্তর্লীন যোগ থাকে। তবু। একেবারেই পরিচিতি নেই, পরিচয় তৈরি হবার সময়টুকুও পাওয়া যায় নি। সেখানে হঠাৎ করে ভদ্রলোক এসে গাড়িতে যেতে বলছেন দেখলে দেবদূত হয়তো আচমকা রেগে উঠবে। হয়তো শিখার ঢং ঢাং নিয়েও কথা উঠবে।
খাবার ঘরে ঢুকে শিখা যেখানে বসতে পেল সেখান থেকে দেবদূতকে দেখা যায়, কিন্তু দূরত্ব অনেকটা। ভালই লাগছে শিখার। ওই ভদ্রলোক চারদিকে একবার ঘুরে পাক দিয়ে এসে শিখার পাশের ফাঁকা চেয়ারে বসলেন।
“আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে।” ভদ্রলোক বললেন।
“আমার লাগছে না।” শিখা নম্রভাবে বলল।
“কোথায় থাকেন?”
“কি করেন?”
প্রশ্ন ওদিক থেকে আসছে। শিখা উত্তর দিতে দিতে দেখল দেবদূত তীক্ষ্ণ নজরে এদিকে তাকিয়ে।
শিখার বুকের ভেতরটা কেমন হাসির গোল্লা গুবগুবিয়ে উঠল। পনের বছর হয়ে গেল তাদের একসঙ্গে সংসার করা, কিন্তু দেবদূত এখনও শিখাকে বিশ্বাস করে না। শিখা বেশি কথা বললে দেবদূত বিরক্ত হয়। অন্য কারো সঙ্গে বেশি কথা বললে সন্দেহ করে বোধহয় আগে থেকেই জানাশোনা ছিল।
শিখার ভদ্রলোককে কেমন যেন একটু এলোমেলো মনে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে খুব অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন খেতে খেতে। খাওয়া শেষ হতে সবাই যখন হাত ধুতে গেল, তখন শিখা দেখল ভদ্রলোক আরও দু-তিনজনের সঙ্গে কথা বলছেন। শিখার পাশে দেবদূত দ্রুত এসে দাঁতে দাঁত চেপে খুব সন্তর্পনে বলল, “এখানেও জুটিয়ে নিয়েছো? পারো বটে? নোংরা মেয়েছেলে!” প্রায় ফিসফিস করে বললেও প্রতিটি কথাই শিখার কানে গরম সিসার মত প্রবেশ করছিল। শিখার মনে হচ্ছে এক ধাক্কা মারে ওকে, অনেকদিন ধরেই মনে হয়, কিন্তু পারেনা।
“না, আসলে আমি এখানকার দীক্ষিত নই। আমার ওসব ভড়ং ভাল লাগেনা। আমার মিসেস এখানকার দীক্ষিত। তাই আসা।” দেবদূত একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নামছে। শিখা সামান্য একটু দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছিল। হঠাৎ পেছন থেকে দ্রুত পদশব্দে তাকিয়ে দেখে ওই ভদ্রলোক নামছেন।
“চলুন, চলুন, আমার গাড়ি ওই যে” বলতে বলতে শিখাকে অমোঘ টানে টেনে নিয়ে ভদ্রলোক এগিয়ে চললেন দেবদূতকে পাশ কাটিয়ে। শিখা বুঝতে পারছে ওর পেছনে একজোড়া ফলার মত দৃষ্টি ওকে ফুঁড়ে ফেলতে চাইছে। তবু শিখা থামল না। এগিয়ে গেল ভদ্রলোকের সঙ্গে। কিছু একটা আছে ভদ্রলোকের মধ্যে, যাতে ওনাকে avoid করতে পারছে না শিখা। আছে! নাকি শিখা নিজের মনে এইসব উত্তর তৈরি করে নিচ্ছে, যাতে নিজেকেই ধোঁকা দেওয়া যায়।
গেস্ট হাউসের রুমের দরজায় ঠেসে ধরে দেবদূত প্রশ্ন করে, “কবে থেকে চিনিস ওকে?”
শিখা দুমড়ে যাওয়া কব্জির পীড়ন সহ্য করতে করতে তাচ্ছিল্য মাখানো উত্তর ছুঁড়ে দেয় “অনেকদিন”
“শালী রেন্ডি!”
উত্তরে শিখা আবার হাসে। প্রচণ্ড শীতে ওর গায়ে অর্ন্তবাস ছাড়া আর কিছু নেই এই মুহুর্তে। আসুরিক শক্তি প্রয়োগে সেগুলো ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। পৌরুষের প্রকাশ। তবু শিখা আজ হার মানে না অন্য দিনের মত।
শিখাকে ভাঙতে না পেরে আরও আক্রোশ দেবদূতকে পাগল করে তুলল।
“এত লোক থাকতে তোকেই কেন গাড়িতে তুলল লোকটা? এতলোক হেঁটে গেস্ট হাউস থেকে আশ্রমে উঠছে, নামছে। তাদের কষ্ট হচ্ছে না? শুধু তোর কষ্টই চোখে পড়ল ওর?”
দেবদূতের এই প্রশ্নটা শিখার মনেও ঘুরছে। এত মানুষ থাকতে তাকেই কেন!
***
আর্যবীর সান্যাল এ.সি.পি কোলকাতা পুলিশ। এসেছেন মায়াবতীতে একটু শান্তির খোঁজে। সঙ্গে আছেন আরও একদল পুলিশ বন্ধু। সকলেই আশ্রমের দীক্ষিত। দীর্ঘদিন পর একটা ছুটি নিয়ে বেরিয়েছেন আর্য। গেস্ট হাউস থেকে আশ্রম পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়ি রেখেছেন তিনি। তবে তিনি পনের মিনিট হেঁটেই খেতে ওঠেন রোজ। ভেবেছিলেন অপার শান্তি পাবেন এখানে এসে। পাচ্ছিলেনও। কিন্তু ঠিক নীনার মত দেখতে মেয়েটি কাল আশ্রমে এসে সব শান্তি এলোমেলো করে দিয়েছে।
“এলে?” হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করে নীনা।
ঘরে ঢুকে নীনার মাথায় হাত রেখে আর্য বলেন,
“এলাম। এবার ঘুমিয়ে পড়ো।”
নীনা শান্তি আর শ্রান্তিতে চোখ বন্ধ করে। দীর্ঘ তেরো বছর এভাবেই নিরামিষ জীবন কাটছে আর্যবীরের। নীনা একটা রোড অ্যাকসিডেন্টের পর থেকে প্যারালাইসড। কথাও জড়িয়ে যায়। তবু প্রাণ টুকু বেরোতে চায়না। সারাদিন রাত পুলিসের উঁচু পদের দায়িত্ব পালন করে বাড়িতে ফিরে কেয়ারিং হাজব্যান্ডের গুরুদায়িত্ব পালন করতে করতে কোথাও বোধহয় সুতো আলগা হয়েছিল। তবে নীনার চলে যাওয়ায় কষ্ট হলেও একটা বন্ধনমুক্তির আভাস মিলেছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই আর্যর। নীনার মৃত্যু কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে।
রাতে ঘুম আসছে না অতিরিক্ত ঠান্ডায়। কাঁপুনি দিচ্ছে মাঝেমাঝে। দেবদূত ছেড়ে দেবার পর অত রাতে স্নান করেছে শিখা। তার জেরেই এই কাঁপুনি। জ্বর আসতে পারে অনায়াসেই। কিন্তু শিখা জানে, আসবে না। বেহুঁশ হলে শিখা ভাল থাকবে। কিন্তু ঈশ্বর তাকে হুঁশেই রাখবেন ঠিক করেছেন। কিন্তু এখানে আসার পর থেকেই অতলান্ত খাদ দেখে শিখার মনে যে কি পরিমাণ টানাপোড়েন চলেছে শিখা কাউকে বোঝাতে পারবে না।
Mount Abott যাওয়ার জন্য গাড়ি বুক করা হয়েছে একসঙ্গে। অনেকে না গেলে গাড়ি নেওয়া দেবদূতের পক্ষে অনেক বেশি খরচসাপেক্ষ হয়ে যেত বলেই দেবদূত একসঙ্গে যেতে রাজি হয়েছে। Abott থেকে সারি সারি বরফে মোড়া শৃঙ্গগুলোর দিকে তাকিয়েও শিখার মনের মধ্যে খাদের হাতছানি। পাশে এসে দাঁড়ালেন আর্যবীর। সেই ভদ্রলোক, যার জন্য এখানে এসেও একটু শান্তি দেয়নি দেবদূত।
“আমি এ. সি. পি কলকাতা পুলিশ। আপনাকে দেখে পর্যন্ত আমি খুব অস্থির বোধ করছি জানেন! আপনার চোখের মধ্যে কিরকম একটা কিলার ইন্সটিংক্ট রয়েছে। আমি অনেক মানুষ নিয়ে ডিল করছি বহু বছর ধরে। আপনার চোখদুটোই আমাকে ভাবাচ্ছে জানেন শিখা ম্যাডাম। কিছু নিজে থেকে করতে যাবেন না। কি দরকার ফালতু ঝামেলায় জড়িয়ে… মিটে যাবে একদিন, দেখবেন… আমারও মিটে গিয়েছে।”
শিখা চমকে উঠে ভাল করে কথাগুলো অনুধাবন করার আগেই দেখল ভদ্রলোক এগিয়ে গিয়ে সকলকে নিয়ে কফি খাচ্ছেন। শিখা তাকাতে উনি শিখাকেও ডাকলেন কফি খেতে। শিখা অবাক হয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে উনি কি মন পড়তে পারেন! শিখা ঠোঁটে হাসি রেখে ওর কফির আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে গেল।
Osadharon laglo golpo ta pore , aro onek onek lekho porbo …😍😘
অনেক শুভেচ্ছা রাখলাম।
দারুণ
ধন্যবাদ