জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়
১১৩ নং কিস্তি
ইচ্ছে করেই ইসলামভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। দেখলাম ইসলামভাইয়ের কোনও রেসপন্স নেই। চোখদুটো মনেহচ্ছে আজ থেকে কুড়ি-একুশ বছর আগেকার সেই চোখ। আমার ভেতর পর্যন্ত মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখে ফেলছে।
এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।
কথা বলবে না।
কার সঙ্গে কথা বললি। ভিকু না আপ্পে?
গম গম করে উঠলো ইসলামভাইয়ের গলা।
এইবার ইসলামভাইয়ের চোখে চোখ রাখলাম। বুঝলাম এই তিন মাসে আমার পায়ের নোখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ইসলামভাই খোঁজ খবর নিয়ে নিয়েছে।
আবার জোড় করে হাসলাম।
ইসলামভাই একটুও হাসলো না। চোখদুটো সেরকমই স্থির। বরং আরও বেশি হিংস্র মনে হচ্ছে।
দু-জনের কেউ নয়, বৃথা তুমি টেনসন করছো।
তুই যা খুশি বলে যেতে পারিস, শুধু এইটুকু তোকে বলে রাখি, তোর ইসলামভাই মরে যায় নি। এই তিনমাস সব কাজ ফেলে চব্বিশঘণ্টা তোর মতো দাবা খেলেছি। তোর সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা তোর ইসলামভাই তৈরি করে নিয়েছে।
আমি ইসলামভাইকে জড়িয়ে ধরেই ইকবালভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
দেখছো ইকবালভাই, ইসলামভাই আমার ওপর কেমন রাগ করছে।
ইকবালভাই সামান্য হাসলো, কিন্তু আমার চোখ থেকে চোখ সরাল না।
ইকবাল ওর গায়ে আজমীর শরিফের চাদরটা চাপিয়ে দাও।
আবার গম গম করে উঠলো ইসলামভাইয়ের গলাটা।
আবিদ একটা প্যাকেট ইকবালভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিল। ইকবালভাই একটা লম্বা শিল্কের চাদর আমার গায়ে জড়িয়ে দিল। একটা প্যাকেট থেকে কিছু শুকনো প্রসাদ আমার হাতে দিল। মাথায় ঠেকিয়ে সেগুলো মুখে দিলাম। এরপর ইকবালভাই সবার হাতেই একটু একটু করে দিল।
সরাটা ঘর নিস্তব্ধ। দামিনীমাসি এক কোনে দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করে চলেছে।
ইসলামভাইয়ের ফোনটা বেজে উঠলো। একবার দেখে নিয়েই কানে তুললো।
হ্যাঁ, সামন্তদা বলুন।
ও ইসলাম ডাক্তার কি বলে আমাকে শোনাও। কালকে থেকে ও বাড়িতে একবারও যায় নি। বড়োমা বলে উঠলো।
ইসলামভাই মনে হয় ভয়েজ অন করলো, এবার ডাক্তারদাদার গলা শুনতে পেলাম।
ওখানে মনে হচ্ছে বান্ধবী আছে।
হ্যাঁ।
তোমার গলাটা কেমন গম্ভীর গম্ভীর শোনাচ্ছে।
অনির কাছে এসেছি।
তা বেশ করেছো। এ বাড়িতে পুলিশ এসেছে।
আচ্ছা ঝামেলা শুরু করলো।
ঝামেলা না। আরও লোকজন এসেছে। ঘর খুলে দেবে। বুঝে নিতে হবে। আমি বললাম, আমি বুঝে নিচ্ছি। থানার ওসি বলছে না ডাক্তারবাবু, বাড়ির লোকের থাকার দরকার, না হলে আমার চাকরি চলে যাবে। যা দুর্দিন চলছে।
বড়োমা দেখলাম কপালে হাত ঠেকাল।
বান্ধবী, ছোটো, দামিনীর কাছে মনে হয় ফোন নেই।
কিগো দিদি ফোন নিয়ে আসো নি। ইসলামভাই তাকালো ছোটোমার দিকে।
মনে হয় গাড়িতে ফেলে এসেছি। ছোটোমা বললো।
এই সময় কাকে পাঠাই, ওরা সব অনিকে খাওয়াতে এসেছে।
অনি এখনও খায় নি! এই সময়টা অবেলা করা উচিত নয়।
আপনাকে পরে বলবো।
আর কি বলবে, ও শোধরাবে না। ও যা পাকে পাকে জড়িয়েছে শুনলাম, একটা শেষ হলে আর একটা এসে জুটবে।
ঠিক আছে, আমি দিদিকে আর মামনিকে পাঠাচ্ছি।
তাই পাঠাও। আমি ওদের পরে আসতে বলছি।
তাই করুন।
ইসলামভাই ফোনটা পকেটে রেখে, বড়োমার দিকে তাকাল।
ওকে খাইয়ে নিয়ে ও বাড়িতে যাও। আমি দাদা আর মল্লিকদাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। আজ রাতে ও বাড়িতে রান্না হবে।
ইসলামভাই আমাকে পাত্তাই দিল না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পেছন পেছন ইকবালভাই, রতন, আবিদও বেরিয়ে গেল।
কারুর সঙ্গে একটা কথাও বললাম না। চুপ চাপ খেয়ে গেলাম। যতটা পারলাম খেলাম, বাকিটা সরিয়ে রাখলাম। ছোটোমা, বড়োমা টিক টিক করছিল। এমনভাবে তাকালাম চুপ করেগেল।
বড়োমা খিঁচিয়ে উঠলো।
আমার হয়েছে যতো জ্বালা।
ঘরে এখন কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। খাওয়ার শেষে কনিষ্ক এসে কয়েকটা ওষুধ দিয়ে গেছে। কষ্ট হলেও গিলতে হয়েছে।
ঘুম পাচ্ছে না। তবে সারাটা শরীরে একটা ক্লান্তি।
ইসলামভাই অনেকদিন পর আজ একহাত আমায় নিল।
সত্যিতো নিজের স্বার্থ ছাড়া আমি কী করেছি? নিজের জেদকে সবার আগে প্রাধান্য দিয়েছি। একটা মানুষকে মাটি থেকে শেকড় সমেত উপরে ফেলতে আঠারো বছর তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দিয়েছি। কারুর দিকে একফোঁটা নজর দিই নি। কি ভাবে ছেলে মেয়েগুলো বড়ো হয়ে গেলো তাইই জানি না।
প্রত্যেকটা মেয়ে ঘর চায়, বড় চায়। আমি তার কতটা কন্ট্রিবিউট করতে পেরেছি। ঝোড়ো বাতাসের মতো কয়েকটা মুহূর্ত ওদের জীবনে এসেছি, আবার চলে গেছি। ধীরে ধীরে নিজেক বেনিয়া বানিয়ে দিয়েছি। রসাতলে গেছে আমার সব কিছু। মিত্রাকে আকাশচুম্বী বড়ো দেখতে গিয়ে একটার পর একটা জায়গায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। আনুসাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে পরেছি আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে। নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করেছি। নিজের মনকে বোঝাতে বাধ্য করেছি এটা প্রয়োজনে।
যখন বুঝতে পেরেছি এদের সাহায্য ছাড়া আমি আমার অনেক কিছুই উদ্ধার করতে পারব না। নিজেকে করে তুলেছি ইনভিজিবিল ম্যান। সাথেও আছি পাছেও আছি, আবার কোনও কিছুতেই নেই। আইনের চোখে কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। অনি ব্যানার্জী একজন ক্রিমিন্যাল। ঘর শুদ্ধ সবাই আজ ইসলামভাইয়ের কথার গুরুত্ব দিল। বলতে গেলে ইসলামভাই যা বললো তাই মেনে নিল।
মেনে নেওয়াটাই স্বাভাবিক। ওরা কখনই আমাকে এই অবস্থায় দেখতে চায় নি। আমিও কোনওদিন এরকম ছিলাম না। নিপাট ভদ্র ছেলে।
তাহলে কী আমি নিজেকে ক্ষমতাবান পুরুষ হিসাবে দেখতে চেয়েছি। যাতে আমার নাম শুনেই সকলে ভয় পায়। আমার কার্যকলাপে কেউ ধারে কাছে ঘেঁসতে না পারে।
একটু আগে এদের এই সামান্য ব্যবহারটুকু আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। কিছুতেই নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারছি না।
অনিসা, অনন্য কি ভাবছে তার বাবা একজন ক্রিমিন্যাল? দাগী আসামী?
ফোনটা হাতে নিলাম। বটম টিপেই কানে দিলাম।
হ্যালো।
হ্যাঁ অনিদা বলো।
হানিফ দিবাকরের মুখ থেকে কিছু বার করতে পেরেছিস?
দুটো ঠিকানা দিয়েছে। তোমাকে ম্যাসেজ করে দেব।
দে। যা বলেছিলাম তাই করেছিস?
না।
কেন!
হানিফ চুপ করে রইলো।
ঠিক আছে। ও অনাদিকে ফোন করেছিল।
করেছিল।
কি শুনলি।
মোদ্দাকথা তোমাকে দেখে নেবে।
দিবাকর কোথায়?
ওপরের ঘরে শুয়ে আছে।
ওর কাছে মোবাইল নেই তো।
না।
পরে কথা বলছি।
লাইনটা কেটে দিলাম।
মোবাইলের ঘরিতে দেখলাম আড়াইটে বেজে গেছে। অর্জুনকে একটা রিং করলাম। একবার, দুবার, তিনবার। বুঝলাম অর্জুন লাইনটা কেটে দিচ্ছে।
তারমানে গেম আমার হাতের বাইরে চলে গেছে। নিশ্চই ভিকু, অর্জুনকে ফোন করে সব বলেছে। ঝিনুক, অভিমন্যুর ফোন নম্বর আমার কাছে নেই।
ইসলামভাই অর্জুনকে কি….!
না অর্জুন এত কাঁচা ছেলে নয়। গন্ধ পেলে আগেই সটকে পরবে।
ছিদামকে ফোনে ধরলাম।
তোমার লাল ফোনটা বন্ধ কেন।
কোথায় বন্ধ? খোলা আছে। ভাইব্রেসন মুডে দেওয়া আছে।
কঁক কঁক করে বলছে পরিষেবা সীমার বাইরে।
কী করবো এমন একটা ঘরে রেখেছে জানলা পর্যন্ত খুলতে পারছি না। খবর কি বল?
বাইরে ঝড় চলছে।
তার মানে!
অর্জুন রানাকে গিড়িয়ে দিয়েছে।
সব্বনাশ—তোকে কে বললো!
অরিত্রদা নিউজ করে ফিরলো, আবার দৌড়েছে এয়ারপোর্টে।
কেন!
ওখানে দুটো গুলি খেয়েছে।
তোকে অর্জুন ফোন করেছিল?
ম্যাসেজ করেছিল। কলকাতায় আজ আগুন জ্বালাবে। তোমাকে তখনই বললাম।
আমি ফোন করছি। লাইন কেটে দিচ্ছে।
তোমায় পরে ডিটেলস দিচ্ছি।
আচ্ছা। একটা কাজ করতে পারবি।
বলো। দ্বীপায়ণদার কাছে একটা মেটিরিয়ালস আছে। তোকে প্রিন্ট আউট করে দিতে বল। খামটা অনাদির যে দুটো চেলুয়া আছে আমাদের অফিসে, তাদের হাতে দিয়ে বল আজকের লিড নিউজ। ব্যাপারটা বুঝতে পারলি।
করে দিচ্ছি।
ছিদামকে ছেড়ে দিয়ে দ্বীপায়ণকে ফোনে ধরলাম।
কি খবর।
খুব খারাপ অবস্থা। চারদিকে হই হই।
আবার কি হলো?
দিনে দুপুরে জোড়া খুন।
মসনদের কিছু খবর পেয়েছো?
অনাদিদা পাগল হয়ে গেছে। যাকে যা পারছে বলে যাচ্ছে। সাংবাদিকরা খুব জোড় চেপে ধরেছে। সচিব কথা দিয়েছে মিনিস্টার আর কিছুক্ষণ পর প্রেস কনফারেন্স করবে।
কে আছে ওখানে?
সুমন্ত আছে।
তোমার কাছে ছিদাম যাচ্ছে। লেখাটা প্রিন্ট করে একটা খামে ভরে ছিদামের হাতে দিয়ে দাও।
আবার কি করবে?
অনাদির কাছে খামটা পৌঁছে দেবে। একবারে তাড়াহুড়ো করবে না।
আচ্ছা।
ফোনটা কেটে দিয়েই ভিকুকে ফোনে ধরলাম। এক চান্সে পেয়ে গেলাম।
ঠিক খবর পেয়ে গেছ।
এটা কি করলি?
বেশ করেছি। তুমি এখন কিছু করতে পারবে না। তোমার গায়ে হাত।
অর্জুন কোথায়?
পট্রোপলে। এতক্ষণে হয়তো বর্ডার পার হয়ে গেছে।
তিনজনেই।
না। ঝিনুক, অভিমন্যু হাওড়া থেকে রাজধানী ধরেছে।
ওরা সঙ্গে ছিল?
অর্জুন কাউকে সঙ্গে নেয়, তুমি তো জানো।
যে দুটোকে মেরেছে তাদের নাম কি?
জুয়েল আর আলতাফ।
তুই পাক্কা খবর নিয়েছিস মাধবন পাঠিয়েছিল।
পাক্কা। এই খবরটাও ওকে পৌঁছে দিয়েছি।
ওদের বায়ওডাটা আমার দু-নম্বর মেল আইডিতে পাঠাতে পারবি?
ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করো।
সাবধানে থাকিস। অর্জুনটার জন্য টেনসন হচ্ছে। লাস্ট আপডেট মেলেই পাঠাস।
ঠিক আছে।
ফোনটা কেটেই অরিত্রকে ধরলাম।
কোথায় রে?
এয়ারপোর্ট থেকে ফিরছি।
কেন!
আজ কলকাতায় শুধু মার্ডার হয়ে চলেছে। দু-ঘণ্টায় তিনটে মার্ডার। এটাই নিউজ। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া খুব খাচ্ছে বুঝলে।
অর্ক কোথায় জানিস?
জানি না। সকাল থেকে বহুবার ফোন করেছি, স্যুইচ অফ। তোমার কাজ কিছু এগোল।
দূর হয় নাকি। ঘরের বাইরে বেরতে না পারলে কাজ হবে না। কারা মরেছে নামধাম কিছু জানতে পেরেছিস?
খোঁজ খবর নিয়ে যা জানতে পেরেছি ইসলামভাইয়ের কেউ নয় এটা বুঝেছি। শুনলাম বম্বের দু-জন ব্যবসায়ী মারা গেছেন। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী। তবে বিকেলে সিপি প্রেস কনফারেন্স করে সব জানাবে।
বডি দেখেছিস?
সায়ন্তন দেখেছে। ও ছবি তুলেছে।
তোর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না। খবরটা ওইই দিল।
এটা এয়ারপোর্ট গেল, আর একটা?
রানা দেহ রেখেছে। আমি ভাবছি ছেলেটা মারলো কী করে, ওইরকম হাই সিকুরিটির মধ্যে।
ছেলেটাকে ধরতে পেরেছে?
দুর ধরতে পারলে একটা জব্বর খবর হতো। শুনেছি মরার অনেক পরে সবাই জানতে পেরেছে, রানা মরে গেছে।
তাহলে খবর লিখবি কি করে? এইভাবে?
যেটুকু পেয়েছি গল্প লিখে দেব।
ঠিক আছ। অফিসে যা।
ফোনটা কেটে দিয়ে সুমন্তকে ধরলাম।
কোথায় আছিস?
অনাদিদা প্রেস কনফারেন্স করবে।
কি কারণে?
দিনে দুপুরে কলকাতায় জোড়াখুন। চারদিকে হুলুস্থূলুস পড়ে গেছে। তার মধ্যে ওই হাই সিকুরিটির মধ্যে সতপাল রানা খুন হয়েছে। সাসপেক্ট করা হচ্ছে যে আগে ওর ওপর গুলি চালিয়েছিল সেইই কেশটা করেছে।
কাউকে ধরতে পেরেছে?
এখনও পারে নি। খোঁজ খবর চলছে।
এয়ারপোর্টে কারা মরেছে, কিছু জানতে পেরেছিস?
শুনছি দু-জন ব্যবসায়ী, কানাঘুষোয় অন্য কথা শুনছি।
কি?
বম্বে থেকে দু-জন নামকরা সার্প স্যুটার এসেছিল কাকে খুন করতে।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল?
একদল মরেছে, আর একদল বেপাত্তা।
আর কিছু আপডেট পেয়েছিস?
না।
অনাদির হাবভাব কি বুঝছিস?
এখনও চাক্ষুষ দেখি নি। তবে শুনছি খুব টেনসনে আছে।
বাজে বকছিস কেন?
হ্যাঁগো দৌড়দৌড়ি চলছে স্বরাষ্ট্রসচিব, মুখ্য সচিবের ঘরে।
কালকের নিউজের কোনও রিপার্কেসন?
সে তো চলছেই। অন্যান্য হাউস চেপে ধরেছে সবকটাকে, সব ত ত করছে। তারপর আজকে আবার এই ঘটনা। চাপা টেনসন একটা আছেই। দাঁড়াও দাঁড়াও তোমাকে পরে ফোন করছি।
কেন?
আমাদের অফিসের একটা দুগ্গীমাল পেছন দিয়ে অনাদিদার ঘরে ঢুকে পরলো।
দেখ দেখ কি করতে ঢুকলো। ভালো করে চিনে রাখ।
লাইনটা কেটে গেল।
মোবাইলের ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় পাঁচটা। এখনও কেউ আমার ঘরে এলো না।
কালকে চারটে নাগাদ সবাই চলে এসেছিল।
মনটা খুব ভারি ভারি লাগছে। কাজগুলো ঠিক প্ল্যানমাফিক হলো না। বলা যেতে পারে স্মুথ হলো না। ভিকুটাকে ফোন না করলেই ভালো হতো।
এ ঘরে একটা পাখাও নেই। যে শুয়ে শুয়ে পাখার ব্লেড গুনবো। ভীষণ ক্লান্তি লাগছে। ফোনগুলো সব বন্ধ করে কম্বলটা টেনে নিলাম। কেমন যেন শীত শীত করছে। আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে গুঁড়ি শুড়ি মেরে শুয়ে পরলাম।
সামান্য একটা ধাক্কায় হুড়মুড় করে উঠে বসতে গেলাম। ধুপুস করে আবার বিছানায় পরে গেলাম। চোখের সামনেটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার ঠেকলো।
কানে একটা তারস্বর আওয়াজ এলো, কনিষ্ক।
কিছুক্ষণ চুপ চাপ বিছানায় পড়ে রইলাম। মাথার ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা, হাল্কা হাল্কা মনে হচ্ছে। আমি যেন শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছি। হাত পা নাড়াতে পারছি না। মনে হচ্ছে গায়ে কোনও জোড় নেই। নিজে থেকে চেষ্টা করেও সফল হলাম না। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখের সামনে থেকে অন্ধকার ভাবটা কেটে গেল।
চোখ খুললাম। হাত-পা নাড়াবার চেষ্টা করলাম, হ্যাঁ নাড়াতে পারছি।
কেন এমন হলো?
চোখের সামনেটা একটু পরিষ্কার হতে দেখলাম কনিষ্ক আমার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসেছে। চোখে বিষ্ময়। পায়ে হাতে কার যেন স্পর্শ পেলাম। চোখটা ঘুরিয়ে দেখলাম নীরু, বটা, অনিকেত ঘরের মধ্যে। সবাই কেমনভাবে যেন দাঁড়িয়ে।
কি রে শরীর খারাপ লাগছে? কনিষ্ক বললো।
মাথা দোলালাম, না।
তাহলে হঠাৎ কি হলো!
একটু জল দে। উঠে বসার চেষ্টা করলাম।
না না উঠতে হবে না। শুয়ে থাক।
পারবো। হঠাৎ কেমন মাথাটা ঘুরে গেল।
আমি হাতের ওপর ভড় দিয়ে উঠে বসলাম।
নীরু একটা গ্লাসে করে জল আনলো।
ঢক ঢক করে খেতে শুরু করলাম। তেষ্টায় বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে।
আসতে খা। বিষম লেগে যাবে। নীরু বললো।
এক নিঃশ্বাসে জলটা খেয়ে নীরুর হাতে গ্লাসটা দিলাম।
কোনও ভয়ের স্বপ্ন-টপ্ন দেখছিলি?
না।
তাহলে উঠতে গিয়ে ধুপ করে পরে গেলি।
কি জানি। উঠে বসতে গেলাম। মাথাটা কেমন চক্কর মারলো ধুপুস কর পরে গেলাম।
ভাগ্যিস বিছানায় ছিলি। না হলে একটা বিপদ ঘটাতিস।
তোদের ওপর অনেক জুলুম করছি।
পোঁদপাকা, শালা জ্ঞানবৃক্ষের ফল। বটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো।
হাসলাম।
একেবারে পিষে মেরে দিচ্ছে।
থাম না। কনিষ্ক চেঁচালো।
এই ঘরটায় দিনরাত বোঝা মুস্কিল। কনিষ্কর দিকে তাকালাম।
কটা বাজে বল।
বেশি হয় নি। এগারোটা।
রাত না দিন?
রাত।
বড়োমারা আসেনি?
এসেছিল।
চলে গেছে!
হ্যাঁ।
কনিষ্কর কথাটা শুনে বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।
খুব কি অন্যায় করে ফেলেছি? আজকে কেউ আমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেল!
এমন তো কখনও হয় নি। হোক না ও বাড়িতে সবাই আজ তিন মাস পর গেল, তাতে কি হয়েছে। আমি তো অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে নেই। একটু ঘুমিয়ে পরেছিলাম। এইটুকু অপেক্ষা আমার জন্য ওরা করতে পারলো না।
আমাকে ডেকে আমার সঙ্গে দেখা করে যেতে পারতো।
আমার ভাবনাটা ভুলও হতে পারে। বাইরের পরিস্থিতি হয়তো আরও খারাপ, তাই জন্য সবাই আগে আগে চলে গেছে।
অনিমেষদা, ইসলামভাই হয়তো সেইরকমই বুঝিয়েছে।
তাছাড়া ও বাড়ির প্রত্যেকটা লোকের ওপর দিয়ে কনটিনিউ একটা ঝড় বিগত কয়েকমাস ধরে বয়ে চলেছে। তার জন্য হয়তো….।
নাকি অনাদি ওদের আবার হ্যারাস করতে শুরু করেছে?
কি ভাবছিস?
কনিষ্কর দিকে তাকালাম।
ওরা মিত্রার বাড়িতে না দাদার বাড়িতে?
দাদার বাড়িতে।
সবাই?
হ্যাঁ।
আমাকে একটু চা খাওয়াতে পারবি।
এতো রাতে!
দে না, খুব ইচ্ছে করছে।
তোর কি হয়েছে বলতো।
কিছু না।
হঠাৎ এতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলি। এখন কথাও বলছিস কেমন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে।
শালা এনার্জি স্টক করছে। বটা বললো।
কনিষ্ক কট কট করে বটার দিকে তাকাল।
আমি হাসলাম।
কি জানি তখন ভীষণ শীত করছিল, কম্বলটা চাপা দিয়ে শুয়ে পরেছিলাম, কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানি না।
বাইরের খবর কিছু জানিস? কনিষ্ক বললো।
না। কি হয়েছে?
তুই কিছুই জানিস না!
তুই ওষুধগুলো খাওয়াবার পর কেমন ঘুম ঘুম পেলো, বললাম না শীত করছিল, শুয়ে পরলাম।
তিনটে মার্ডার হয়েছে। তারমধ্যে ওই অফিসার সতপাল রানাও আছে।
আর ভাবতে ভালো লাগছে না। মরুক গে যাক, যা হয় হোক।
আগুন তুই জ্বালালি।
আমি কোথা থেকে জ্বাললাম?
আর কেউ জানুক আর নাই জানুক আমি জানি।
চুপ করে রইলাম।
অনাদি ফোন করেছিল। তোর সঙ্গে দেখা করতে চায়।
বলে দে আমি অসুস্থ, দেখা হবে না।
তুই এখন সেইরকম অসুস্থ নোস, যে আমি না করতে পারি। তাছাড়া দু-জন এসে দেখে গেছে তুই ঘুমচ্ছিস। আমাদের ওপরও একটা প্রেসার আসছে। ঘুম থেকে উঠলে খবর দিতে বলেছে।
ঠিক আছে খবর পাঠা আমি জেগেছি। বড়োমারা সবাই ঠিক আছে?
আপাততঃ ঠিক আছে, তবে কতোক্ষণ থাকবে জানি না।
তোরা এখন যা, আমি একটু একা থাকব, পারলে একটু চা পাঠা।
শেষ পেরেকটা ঠুকবি। বটা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো।
আর কোনও পেরেক অবশিষ্ট নেই।
কনিষ্ক হাসছে। বটা, নীরু, অনিকেত আমার দিকে তাকিয়ে।
ফোনগুলো কম্বলের তলায় নিয়ে শুয়ে ছিলি কেন?
কনিষ্কর দিকে তাকালাম।
কি ভেবেছিলি কেউ নিয়ে চলে যাবে?
না। বালিশের তলায় রাখবো ভাবলাম, তারপর ওখানেই রয়ে গেছে।
ফোনগুলো টেবিলে রয়েছে। খাবি কখন?
খেতে ইচ্ছে করছে না।
ঠিক আছে।
ওরা বেড়িয়ে গেল।
আমার পামটপটা নিয়ে প্রথমেই মেল চেক করলাম। দেখলাম ভিকু মেল পাঠিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ডকুমেন্টগুলো ডাউনলোড করে নিলাম। খুলে দেখলাম আমি যেরকমটি চেয়েছিলাম সেইরকম ভাবেই পাঠিয়েছে। জুয়েল ছেলেটা বম্বেতে ডোম নামে বিখ্যাত। আর আলতাফ ছেলেটা ছোটে মিঞা।
নামগুলো আমি শুনেছি। তবে এরই মধ্যে ওরা যে এতটা বিখ্যাত হয়ে গেছিল জানি না।
বম্বের আন্ডারওয়ার্লডে নিত্য নতুন ছেলে উঠে আসছে। আবার ঝটতি উধাও হয়ে যাচ্ছে। খুব টাফ কম্পিটিসন বেঁচে থাকাটা। একটু ভুল করলেই পা পিছলে একবারে খতম। কেউ না কেউ কারুর না করুর খুঁটি ধরে রয়েছে। যার খুঁটির জোর যতো বেশি সে ততো বড়ো দাদা।
টাকাও উড়ছে হাওয়ার মতো। যে যেখান থেকে পারে ধরে নিচ্ছে। হিসেব করলে দেখা যাবে কোনও কোনও জায়গায় ঘরে ঘরে মাস্তান। ওখানকার রাজনীতি, ব্যবসা, শুষ্ঠভাবে বেঁচে থাকা সব আন্ডারওয়ার্লড কন্ট্রোল করে। রিমোট কন্ট্রোল সব দুবাইয়ে।
ভালো করে বায়োডাটা দুটো পড়ে নতুন করে লিখে কারেকশন করে দ্বীপায়ণকে পাঠালাম। তারপর ফোনে ধরলাম।
কোথায় আছো?
ছিদামের কাছে এসেছি চা খেতে। ঘুম ভাঙলো?
বাবা তোমরা পর্যন্ত জেনে গেছো আমি ঘুমিয়ে আছি।
কতোবার যে ফোন হয়ে গেল তার ঠিক আছে।
এয়ারপোর্টের মার্ডার কেশের ছেলেদুটোর পরিচয় পাওয়া গেছে?
ওতো তুমি জানো।
যতো সব বাজে কথা।
কাজের কথা কি তাহলে তুমি বলো। দেখো আর কেউ জানে না। তবে ছিদাম যতটুকু জানে, বিশ্বাস করে আমায় বলেছে। তোমার তত্ত্বটা খুব বিশ্বাস করি, যে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে সাধনা করবে, সেই মাটি পর্যন্ত জানবে না তুমি কি চিন্তা করছো।
হো হো করে হেসে উঠলাম।
তোমাকে একটা মেল পাঠিয়েছি। দেখো সায়ন্তন যে ছবি তুলে এনেছে তার সঙ্গে ছবি দুটো মেলে কিনা। পরিচয়টাও একটু লিখে দিয়েছি দেখে নাও। লেখা দুটো যতটুকু পেরেছি বাংলা তর্জমা করে দিলাম একবার দেখি নিও আর পারলাম না। বাকিটা তুমি সাজিয়ে গুছিয়ে নিও।
আচ্ছা।
পাতা ছেড়েছো?
সেই নিয়েই তো সন্দীপদার সঙ্গে এক প্রস্থ হয়ে গেল। রাগের চোটে আমাকে বললো যা পারিস কর। তাই ওপরে উঠে এসে তোমার ফোনের অপেক্ষা করছি। এর মধ্যে শুধু একটা অন্যায় করেছি।
কি অন্যায় করলে।
নীরুদাকে বলেছিলাম দাদার পার্মিশন ছাড়া আজকের শেষ এডিসন ছাড়তে পারবো না। এগারটার মধ্যে যদি ওঠে ভালো, না হলে একটু জাগিয়ে দিয়ো।
সেই জন্য নীরু ব্যাটা ঠেলে তুলে দিল।
দ্বীপায়ণ হাসছে।
যেটা পাঠালাম সেটা ঢোকানো যায় কিনা একবার দেখে নাও। ওটাকে লিড নিউজ করো। প্রিন্ট অর্ডারে তুমি সই করবে, দু-লাখ বেশি ছাপবে।
বলো কি!
যা বলছি শোনো। অনাদির প্রেস কনফারেন্সের খবর কি?
ভুল ভাল বকেছে। সব বিরোধীদের চক্রান্ত। যা হয় আর কি। মার্ডারটার ব্যাপারে একপ্রকার এড়িয়ে গেছে। বলেছে তদন্তের খাতিরে এখন কিছু বলা যাবে না।
আমাকে নিয়ে কিছু উচ্চবাচ্য করেনি সাংবাদিকরা।
করেছিল, বলেছে উনি অসুস্থ, সুস্থ না হলে ইন্ট্রোগেশন করা যাবে না।
ঠিক আছে আজকের কাগজটার এডিটর তুমি।
দ্বীপায়ন হাসছে।
একটু ছিদামকে দাও।
ধরো।
হ্যালো দাদা।
বল।
সব ঠিক আছে, তোমাকে ভাবতে হবে না। অনাদিদা তোমার সঙ্গে আজ রাতেই দেখা করবে। বাকিটা তোমার খেলা।
ওদিককার খবর।
কোনও খবর পাই নি।
ঠিক আছে।
ফোনটা কেটে দিয়ে হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম, আচ্ছা ব্যাপারটাকে যদি ন্যাশনাল ইস্যু করা যায় তাহলে কেমন হয়।
ভাবা মাত্রই আগে সমস্ত ডকুমেন্টস একটা একটা করে মৈনাকের মেলবক্সে সেণ্ড করে দিলাম। পামটপটা বন্ধ করে পাশে রাখলাম।
মৈনাককে ফোনে ধরলাম।
কিরে এতো রাতে, ঠিক আছিস তো?
হ্যাঁ, ভালো আছি।
কনিষ্ককে সন্ধ্যের দিকে ফোন করেছিলাম। বললো অঘোরে ঘুমোচ্ছিস।
একটু ঘুমিয়ে পরেছিলাম।
যা ঝড় তোর ওপর দিয়ে গেলো, আমরা হলে টেঁসে যেতাম।
কই মাছের জান বুঝলি। শোন না একটা উপকার করতে পারবি।
কি।
একটা ভালো স্ক্যাম আছে। আমি চাইছি ন্যাশন্যাল ইস্যু করতে।
আজ কলকাতায় তিনটে টেঁসেছে।
সব পাঠাচ্ছি। কাল শুধুমাত্র আমাদের কাগজে বেরবে। আমি চাই তোদের কাগজে বেরোক। যদি পারিস সর্বভারতীয় এডিসনে দিতে পারলে ভালো।
কথা দিতে পারবো না। লেট নাইট চলছে।
জানি। তোকে রিকোয়েস্ট করলাম।
ফালতু কথা একদম বলবি না। মাথা গরম হয়ে যাবে।
ঠিক আছে বলবো না। তোর মেল বক্সটা একবার দেখ।
দাঁড়া।
কি বোর্ডের আওয়াজ পেলাম বুঝলাম মৈনাক মেল খুলছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মৈনাক চেঁচিয়ে উঠলো।
তুই করেছিস কি! পরে কথা বলবো, এখুনি এডিটরকে মালটা দেখাই।
সব ডকুমেন্টস আছে। একটাও বাদ দিস না। একটু ভালো করে ট্রানস্লেট করিস।
রাখতো, এবার মাথা গরম হয়ে যাবে।
ফোনটা তখনও কাটি নি দেখলাম দরজা খুলে কনিষ্ক, নীরু, বটা ঢুকলো।
ওমনি ফুসুর ফুসুর শুরু করে দিয়েছিস।
হাসলাম।
নীরুর হাতে দেখলাম একটা থার্ম ফ্লাক্স। বটার হাতে কয়েকটা ডিসপসেবল প্লাস্টিকের গ্লাস।
কিরে। থার্ম ফ্লাক্সে আনলি?
তোমার জন্য যে এই কানা রাতে চায়ের ব্যবস্থা করতে হবে তা জানা ছিল না। হরলিক্স চাইলে তবু দিতে পারতাম।
কোথা থেকে আনলি?
তোর জেনে লাভ, চা চেয়েছিস পেয়ে গেছিস।
সুবল কোথায়?
গেটের কাছে বসে আছে।
ও ঘুমোয় না।
তুই ঘুমলে ও ঘুমোয়। বড়োমা খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে।
কে দিয়ে গেল?
সেটাও তোকে বলতে হবে।
না বলতে চাইলে বলিস না। অনিকেত কোথায়?
নিচে আছে। বাবু এলে সিগন্যাল দেবেন।
একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারিস।
হঠাৎ! আবার কি মাথায় তেলাপোকা নড়াচড়া করে উঠলো।
কাল সকালে একটু দেশের বাড়ি যাব।
এখন একপাও কোথাও নড়া চলবে না।
তোরা আমাকে আটকে রাখতে পারবি না।
ঘাউড়ামি করবি না। কালকে থেকে অনেক কিছু সহ্য করছি।
নীরু, বটা আমার দিকে কট কট করে তাকিয়ে।
সব কাজ শেষ করে ফেলেছি, একজনের সঙ্গে শেষ বোঝা পড়াটা করতে হবে। তারপরে আমার ছুটি।
এবার কিন্তু ব্যাপারটা অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কনিষ্ক ঝাঁজিয়ে উঠলো।
ঠিক আছে একটু চা দে, আমি কয়েকটা ফোন করবো, মনে কিছু করিস না।
সে তুই যা ইচ্ছে কর। আমাদের কিছু যায় আসে না।
আমি ফোনটা বার করে একবার অর্ককে ডায়াল করলাম।
হ্যালো।
জেগে আছিস, না ঘুমিয়ে আছিস।
আজকে বহুত বড়ো খেল খেললে। ইসলামভাই পুরো বোল্ড আউট।
যাক একমাত্র তুইই আমাকে খানিকটা বুঝতে পেরেছিস।
সারাদিন ধরে অনেক মজার ঘটনা ঘটলো বুঝলে।
কিরকম?
একটা পাপ করেছি, একটা পুণ্য করেছি।
যেমন।
বড়োমা এসে আমাকে পেন্নাম করেছে।
এ্যাঁ।
আর বলো না। মেকআপটা যে এতো নিখুঁত হয়েছে তোমায় কি বলবো। দু-তিনবার গাঁজা খেলাম। খারাপ লাগলো না। আর সারাদিন ধরে জয় শিবশম্ভু আওড়াতে আওড়াতে জিভের থুতু গঁদের আটা হয়ে গেল।
পুণ্যি কি করলি।
বড়োমার ভূত ভবিষ্যত সব বলে দিলাম। বললাম তোর পাতান ছেলে বিরাট কাজ করছে, একটু অপেক্ষা কর সব জানতে পারবি।
বাংলায় ঝাড়লি না হিন্দীতে।
জিভের তলায় হাফ সুপুরি গুঁজে রেখেছি। ঝাড়া হিন্দী, সারাদিন টেন্ট থেকে বেরই নি। রাতে বেরিয়ে ছিলাম। ভলাই ইনকাম হলো। একটা গণ্ডগোল হয়েগেছে।
আবার কি হয়েছে?
ম্যাডাম পর্যন্ত পায়ে হাত ঠেকিয়েছে। কাল গিয়ে শোধবোধ করতে হবে।
করিস।
ঝেড়ে একটা ভালো আর্টিকেল নামাতে পারবো।
নামাস। খারাপ হবে না।
হারামী অনাদি তোমার কাছে আসছে।
খবর পেলি কি করে?
তোমার শিষ্য বলে কথা। গুরুর সেখান বিদ্যে কিছুটা পাব।
বিকেল থেকে কারা কারা এসেছিল?
সব নতুন মাল।
শুভ তোর কাছে?
হ্যাঁ। শোনো।
বল।
আধঘণ্টা আগে থেকে লক্ষ্য করছি, তিনটে কালো গাড়ি, কাঁচ তোলা, শুধু নার্সিংহোমের চারদিকে রাউন্ড মারছে।
নম্বর নোট কর।
করলাম, এক নম্বর। তোমার কোনও ছক।
না।
কোনও দিন হ্যাঁ বলতে শিখেছো?
আমাকে ঝাড়তে এসেছে হয়তো।
তোমাকে যে ঝাড়তে এসেছিল, সে দুপুরে ঝাড় হয়ে গেছে।
তুই কি করে জানলি?
তোমার চেনের একটাকে বুগড়ি করে দিয়েছি। সে এখন আমার সঙ্গে। সেই-ই সব খবর দিচ্ছে।
তুই তো বহুত শেয়ানা ছেলে।
শেয়ানা না হলে তোমার সঙ্গে টিঁকতে পারি। কবে ফুটে যেতাম। তোমার চিন্তাভাবনা এতো সূক্ষ্ম সারাদিন বসে বসে ভাবছিলাম। কোথা দিয়ে যে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।
অনাদি ঢুকলেই ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াকে খবর দিবি।
সব গোছান আছে। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। শুভ টগ-বগ করে ফুটছে। জীবনের প্রথম এক্সপিরিয়েন্স, ওকে তোমার রাজনাথের গল্প বলে আরও চার্জ করে দিয়েছি।
সব ঠিক ঠাক আছে, কেউ বুঝতে পারে নি?
একেবারে নিখুত গেমপ্ল্যান। তোমায় সব ছবি দেখাব। মাল ঢুকছে। পরে কথা হবে।
আচ্ছা।
ফোনটা অফ করে পাশে রাখলাম।
ওরা তিনজনেই আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে। এতক্ষণ চা খেতে খেতেই অর্কর সঙ্গে কথা বলছিলাম। আমাকে যেন তিনজনেই একসঙ্গে গিলে খাবে।
তুই এতক্ষণ অর্কর সঙ্গে কথা বললি! কনিষ্ক আমার দিকে তাকাল।
হ্যাঁ।
ও কোথায়?
কেন!
পুলিস ওকে কুত্তার মতো হন্যে হয়ে খুঁজছে। তোর থেকেও ওকে ওদের সবচেয়ে বেশি দরকার।
নার্সিংহোম থেকে কয়েক ফার্লং দূরে আছে।
কবে থেকে!
কাল থেকে।
এ্যাঁ।
এ্যাঁ না হ্যাঁ। যা অনাদি এসেছে। নিয়ে আয়।
কনিষ্করা স্থানুর মতো বসে আছে।
কি হলো, যা।
আমার মাথায় ঠিক ঢুকছে না!
ঢোকাতে হবে না।
মোবাইলগুলো বালিশের তলায় ঢুকিয়ে দিলাম।
কম্বলটা বুকের কাছ পর্যন্ত টেনে নিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পরলাম।
কনিষ্ক বসে রইলো। নীরু, বটা বেরিয়ে গেল।
দরজাটা খুলতেই সামান্য চেঁচামিচির আওয়াজ শুনতে পেলাম। মনে হলো সুবল চেঁচাচ্ছে।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
বাইরের কোনও আওয়াজ এই মুহূর্তে ভেতরে এসে পৌঁচচ্ছে না।
মনে হয় জীবনের শেষ অভিনয়টা নিখুঁত ভাবে আমাকে করতে হবে। যতোটা সম্ভব ক্লান্তির ছাপ চোখে মুখে আনার চেষ্টা করলাম। আয়না নেই যে নিজের মুখটা ভালো করে দেখতে পাব।
কিছুক্ষণ পর দেখলাম একজন ভদ্রমহিলাকে সঙ্গে নিয়ে অনাদি, ভক্তিবাবু এবং লতিফসাহেব ঢুকলেন। আমি নিস্তেজের মতো বিছানায় পড়ে আছি।
অনাদি বেশ একটা পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছে। হাসলেও চোখের কোলের কালি লোকাতে পারছে না। মাস তিনেক পর দেখছি। চেহারার মধ্যে যে ঝক ঝকানি লক্ষ্য করেছিলাম সেটা একটু টোল খেয়েছে। ভদ্রমহিলা বেশ সপ্রতিভ। ঝকঝকে। চোখে মুখে কথা বলছেন। বয়েসটাকে বেশ ধরে রেখেছেন। এর পাশে কাঞ্চন। নিজের মনে নিজেই হেসে ফেললাম।
কনিষ্করা চেয়ার এগিয়ে দিল। অনাদি আমার কাছে এসে বসলো।
শরীর কেমন আছে?
ঠিক জুতে নেই। মাঝে মাঝেই মাথাটা কেমন ঘুরছে। ওনাকে চিনতে পারলাম না?
আমার মিসেস, প্রিয়দর্শিনী চন্দ্র।
শুয়ে শুয়েই বুকের ওপর হাত তুলে নমস্কার করলাম।
তোর সঙ্গে আগে দেখা হয় নি? অনাদি বললো।
দেখা হবে কি করে। সেই যে তোর সঙ্গে কথা হলো, তারপর তুই ব্যস্ত হয়ে পরলি। ব্যাটারা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে এমন মারল, তিন মাস নার্সিংহোমে।
আমি ব্যাপারটা নিয়ে সেন্ট্রালের সঙ্গে কথা বলেছি।
লাভ কি হয়েছে। আমি কি মুক্তি পেয়েছি।
সরি।
কালকেও তোর লোকরা এসে সকাল বেলা বিরক্ত করলো। সেই যে শরীরে ধ্বস নামলো এখনও শুয়ে আছি। ওদেরও দোষ নেই, সত্যি কথা বলতে কি, তুই হয়তো ওদের ধরে নিয়ে যেতে বলেছিস, তোকে খুশি করার জন্য ওরা বেঁধে নিয়ে যেতে চাইল।
আমি কাউকে পাঠাই নি। তোর সঙ্গে একটু কথা ছিল।
বল না কি কথা।
বার বার অনাদির পাঞ্জাবীর বোতামের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। সব কটা বোতামের মধ্যে একটা বোতাম কেমন ঝক ঝক করছে। অনেকটা হীরের মতো। ওকে বুঝতে দিলাম না।
সবার সামনে বলা যাবে না।
নীরু, বটা, অনিকেত বাইরে গেলেও কনিষ্ক থাকবে। তোর আপত্তি আছে?
অনাদি চুপ করে রইলো।
নীরু, বটা, অনিকেত ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল।
এরা আমার স্বাস্থ্যরক্ষার মেডিকেল টিম কনিষ্ক তার হেড। আমি না করলেও আমার স্বাস্থ্য রক্ষার্থে ওদের থাকা জরুরি।
তোর সম্বন্ধে অনেক এলিগেসন জমা পড়েছে আমার কাছে।
আইন মাফিক নিরপেক্ষ ভাবে কাজ কর। তাতে যদি আইনের চোখে দোষী সাব্যস্ত হই, শাস্তি দিবি। শুধু আমি বলে নয়, যে কোনও ব্যক্তি, তিনি সেলিব্রিটি হতে পারেন কিন্তু আইনের উর্দ্ধে তিন নন।
তুই দেশের আইন লঙ্ঘন করেছিস বিশেষ করে রাজ্যের আইন। এসবি রিপোর্ট তাই বলছে।
কিছু বোঝার আগেই ঝট করে অনাদির পাঞ্জাবীর বোতামটা চেপে ধরলাম।
যে ভেবেছি ঠিক তাই।
সবাই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। হাঁই হাঁই করে প্রিয়দর্শিনী, ভক্তিবাবু, লতিফসাহেব, চেঁচিয়ে উঠলেন। এ কি করছেন! এ কি করছেন!
ছিঃ ছিঃ ছিঃ অনিবাবু এটা ঠিক কাজ করলেন না। ভক্তিবাবু বলে উঠলেন।
অনাদি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরেছে। সামান্য ধস্তা ধস্তি চলেছে দু-জনের মধ্যে। বাঁ-হাতটা কোনপ্রকারে বাঁচিয়ে ডানহাতে শরীরে যতটা শক্তি আছে তাই দিয়ে খামচে ধরেছি পাঞ্জাবী।
কনিষ্ক ছুটে এসে আমার হাতটা চেপে ধরেছে। নীরুরাও ঘরে ঢুকে পরেছে।
কিছুতেই আমার হাতটা ছাড়াতে পারছে না অনাদির পাঞ্জাবী থেকে।
আমি অনাদির চোখে চোখ রেখেছি। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম।
বুঝলি অনাদি, এই খেলাটা আমি অনেকদিন আগে খেলে এসেছি। টানাটানি করলে তোর বোতামটা ছিঁড়ে আমার হাতে চলে আসবে। ভালোয় ভালোয় এটা দিয়ে দে।
অনাদি আমার চোখে চোখ রেখেছে। পাকা খেলোয়াড়ের মতো পড়ার চেষ্টা করছে।
আপনি এতটা নীচ, সেটা জানতাম না। আপনার সম্বন্ধে অনেক গল্প শুনেছি, বিশ্বাস করিনি। আজ বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি। প্রিয়দর্শিনী টেঁক টেঁক করে উঠলো।
প্লিজ ছাড়ুন অনিবাবু এটা কি করছেন। অনাদিবাবু আপনার বাল্য বন্ধু। লতিফসাহেব বললেন।
আগে এটা দে।
দাঁতে দাঁত চিপে আমি অনাদির দিকে তাকিয়ে বললাম।
তুই আগে কলার ছাড়। কনিষ্ক চেঁচিয়ে উঠলো।
তোরা কেউ কথা বলবি না। বোঝাপড়াটা আমার সঙ্গে ওর, তোরা শুধু নির্বাক দর্শক।
অনাদি তখনও আমার দু-হাত চেপে ধরে আছে। চোখে আগুনের ঝলকানি।
বোতামটা খুলে নিতে দে। নাহলে ছিঁড়ে আমার হাতে নিয়ে নেব। সেটা তোর পক্ষে মঙ্গল জনক হবে না।
আমার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, অনাদি হাতটা সরিয়ে নিল। আমি বোতামটা টেনে খুলে আমার হাতে নিলাম। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভালো করে দেখলাম।
বোতামটা একবার চারিদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবার মুখ তুলে নিলাম, কারা কারা এই মুহূর্তে এই ঘরে রয়েছে। প্রিয়দর্শিনী মুখ ঢাকার চেষ্টা করেছিল পারলো না।
মুখের কাছে নিয়ে এসে বললাম, ইয়েস আমি অনিন্দ ব্যানার্জী এলাইস অনি ব্যানার্জী। বর্তমান নিবাস, ব্লুভিউ নার্সিংহোম, নিয়ার লেকটেম্পল রোড, রুম নং কেবিন টেন। সাধারণ মানুষের কাছে আমি অনি ব্যানার্জী নামে খ্যাত। বর্তমানে আমি স্বরাষ্টমন্ত্রী অনাদি চন্দ্রর সঙ্গে কথা বলছি। এককথায় বলা যেতে পারে একটা নিগোসিয়েসনের টেবিলে বসতে চলেছি।
গোপন কথাবার্তা রেকর্ড করা আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ। যিনি এই রেকর্ড করছেন ভারতীয় দন্ডবিধির কয়েকটা ধারায় গর্হিত কাজ করছেন। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এই পর্যন্তই আপনারা রেকর্ড করবেন, এরপর আর নয়।
(আবার আগামীকাল)