ঐতিহ্যের শহর চুঁচুড়াতে প্রথম কবে কার্তিকপূজোর সূচনা হয়েছিল তা নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও এই প্রাচীন পুজোকে ঘিরে রয়েছে নানা লোককথা ও ইতিহাস। ঐতিহাসিকদের মতে নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কালে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিল। চোল রাজবংশীয় রাজা রাজেন্দ্র চোল দিগ্বিজয়ী বীর ছিলেন। তিনি রাজরাজেশ্বর মন্দিরের নির্মাণ করেন, এবং রণশূর, ধর্মপালদের পরাজিত করে ত্রিবেণীতে আসেন। শত শত বাহকের মাধ্যমে গঙ্গার জল তামিলনাড়ুতে নিয়ে যান। সেই থেকেই ত্রিবেনী সপ্তগ্রাম বন্দর নগরীতে বহু তামিলমানুষের বসতি শুরু হয়। নানা কারণে তামিল ও বঙ্গভূমির মধ্যে সামাজিক অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক স্থাপন হয়। রাজা রাজেন্দ্র চোল শুধু শিব ভক্ত ছিলেন না তিনি শিব পুত্র স্কন্দ-কার্তিকেয় দেবের পরম ভক্ত ছিলেন। তার অনুচরেরাই সপ্তগ্রামে কার্তিক পূজা শুরু করেন। পরে সরস্বতী নদীর নব্যতা হ্রাস পেলে বণিকসম্প্রদায়, শিক্ষিত সমাজ হুগলী চুঁচুড়ায় বাঁশবাড়িয়া অঞ্চলে নববসতি, বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলে আর ভক্তদের দ্বারা কার্তিক পুজো ধারাবাহিত হয় বাঁশবেড়িয়া, হুগলী-চুঁচুড়া বলয়ে। জনশ্রুতি আছে ষণ্ডেশ্বরতলায় বুড়ো শিবের প্রতিষ্ঠা করেন চাঁদ সওদাগর এবং এখানে কার্তিক পুজো করেন বুড়োশিব শংকর। তাই এখানে জামাই কার্তিকের দেখা মেলে।
তোলাফটক-এর শিব, কার্তিক, গনেশ
কার্তিকের চেহারা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও সুন্দর তাই দম্পতিরা সুস্থ এবং সুন্দর চেহারার সন্তানের সন্তান প্রার্থনা করে থাকেন কার্তিক পূজার মাধ্যমে। কার্তিককে চিরকুমার বলা হলেও, পুরান বলে ব্রহ্মা এবং সাবিত্রির মেয়ে দেবী ষষ্ঠী কার্তিকের স্ত্রী। নারীর সংসার ভরে উঠবে সন্তানে। এই কামনা নিয়েই কার্তিক ব্রত পালন করা হয়।
“শিব তুল্য স্বামী চাই। / কার্তিক গণেশ কোলে পাই।।”
কার্তিক শুধু যোদ্ধা নন তিনি সন্তান দাতাও। ফসলের সঙ্গেও তার সম্পর্ক রয়েছে। চুঁচুড়া অঞ্চলের মানুষজন কার্তিকের সামনে সড়ায় ধান, ধান গাছ লাগিয়ে, চন্দ্র সূর্য পৃথিবী বন্দনার মাধ্যমে ইতুঘট স্থাপন করেন।
কামারপাড়ার কার্তিক
হুগলি-চুঁচুড়ার কার্তিক পুজোর যে ধারাটি গড়ে উঠেছে তা নিতান্তই লৌকিক। ধর্ম কিম্বা শাস্ত্রের সঙ্গে মিল নেই বললেই চলে। তবে পারিবারিক পূজা হতো ষোড়শ শতকের শুরুতেই। চুঁচুড়ার বারাঙ্গনা সমাজ কার্তিক গুনসম্পন্ন “বাবু” ধরার জন্য পূজা করতো কার্তিক ঠাকুরের। যৌনপল্লীতে এই বাবু’দের উৎসাহে ও অর্থানুকুল্যে এই পূজা হতো। শোনা যায় বাবুদের মধ্যে খরচের একটা প্রতিযোগিতাও চলতো। চুঁচুড়া গণিকারা নকল শস্যক্ষেত্র তৈরি করে কার্তিক পুজোর অনুরঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করতেন।
আবার বাগদিপাড়ায়, মুচি পাড়ায়, রুইদাসপাড়ায়, জেলেপাড়া ভিন্ন কারণে কার্তিক পূজা করত, এখনো হয়।
ফটোতে কার্তিক পুজো
সুতরাং মিশ্র সংস্কৃতি অঞ্চলে নিছক সন্তান কামনায় নয়, মিশ্র হিন্দু মোগল ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমারোহ পূর্ণ সামাজিক উৎসব পালনের ইচ্ছা থেকেও কার্তিক পূজার প্রচলন শুরু হয়। কলকাতা, বর্ধমান, মহিষাদল, কৃষ্ণনগর থেকে বহু মানুষ আসতেন পুজোয়। তখন সংয়ের সাজ ছিল বিখ্যাত। পুজোর আগের দিন থেকে পালাগান, মেলা, রামযাত্রা, কবির লড়াই হতো। বেশ কিছু বছর আগেও মল্লিকা কাশিম হাটে মহাদেব পূজা উপলক্ষে রাম যাত্রা, কবির লড়াই হতো। এছাড়া “বসাসঙ” ছিল কার্তিক পূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
চুঁচুড়ায় যে অসংখ্য কার্তিক প্রতিমা পূজিত হয় তার প্রধান ছটি রূপ বলা যেতে পারে।
১) ঘট পূজা : ষণ্ডেশ্বরতলায়, দাশপাড়া, কামারপাড়া, শুঁড়িপাড়া, মালপাড়া অঞ্চলে বেশ কিছু বাড়িতে কার্তিক ঠাকুর ঘট, সড়া, চিত্রে পূজিত হন। চিত্রে কার্তিক শিব দুর্গা উপস্থিত। বাড়িতে সন্ধ্যার পর পূজা হয়, মধ্যরাত্রি থেকে পরের দিন পর্যন্ত প্রসাদ বিতরণ হয়।
২) ষড়ানন : ছটি মুখ গলা। একটি দিব্য কান্তি চেহারা নিয়ে ময়ূরের পিঠের দুপাশে পা ঝুলে বিরাজমান। পরনে ফরাস ডাঙ্গার তাঁতের ধুতি, কাঁধে কাশ্মীরি শাল, পায়ে নাগরা জুতো, কানে মনিময়দুল, কন্ঠহার, মণিবন্ধন। কামারপাড়া হিন্দুদেবদেবী অর্চনা সমিতি প্রায় শতাধিক বছর ধরে এই পূজা করছেন। এই মূর্তির দুপাশে কার্তিকের দুই স্ত্রী রেবতী ও শ্রীমতি।
৩) রাজা কার্তিক : চুঁচুড়ার চাপাতলা, তেতুলতলা, কনকশালী, বড় বাজার, বাবুগঞ্জ অঞ্চলে এই পূজা হয়। কার্তিকের রাজবেশ, ময়ূরের পাশে দীপ্ত ভাবে পাঠান সাজে সজ্জিত বেশভূষা।
৪) লড়াই কার্তিক : মোগল পর্তুগীজ ডাচ ইংরেজ ও ফরাসিদের কাছে চুঁচুড়া-হুগলি চন্দননগর লোভনীয় স্থান ছিল। সেনানিবাসের জন্য এখানকার মাঠগুলি ছিল ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া। সেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে কাহিনীগুলো এই অঞ্চলে তরুণদের লড়াইরত কার্তিক পুজোয় উদ্ভূত করেছে। বর্তমানে গোলা বাগান, ফুলপুকুর, শুঁড়িপাড়া, মতিবাগান কনকশালী ষণ্ডেশ্বরতলা অঞ্চলে বহু বছর ধরে বিশাল কার্তিক পূজা জনপ্রিয়। দেব সেনাপতিকে দেওয়া ব্রিটিশ কমিশনারের ঢাল আর তরবারি (British Era Sword) আজও স্বযত্নে প্রথা মেনে প্রতিবছরের মতোই বেঁধে দেওয়া হয় সেনাপতির কোমরে চুঁচুড়ার গোলাবাগানে।
৫) বাবু কার্তিক : ময়ূরের পিঠের দুপাশে দু-পা ঝুলিয়ে তিনি সমাসীন। পরানে চুনট করা ফরাস ডাঙ্গার ধুতি, কাশ্মীরি শাল গাত্রবরণ, এক মাথা বাবরি চুল, গোঁফটি পুরুষ্ট, মূল্যবান কর্নাভরন।এ মূর্তি অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের ‘বাবু কালচার।’ বাগদী পাড়া, তোলা ফটক, ঠাকুর গলি, চৌমাথা, খিরকিগলি, সুজন বাগান বাবুগঞ্জ, বড়বাজার অঞ্চলের প্রাচীন পূজা।
মল্লিক কাসিম হাটের মহাদেব
৬) শিব কার্তিক গণেশ : কার্তিক সংক্রান্তিতে চুঁচুড়ায় নানা মাপের মহাদেব পুজো হয় সঙ্গে কার্তিক গণেশ। মল্লিক কাসিম হাটের মহাদেব সবচেয়ে প্রাচীন। ১৮৭ বছরের (প্রায়) ইতিহাস। সেখানে মূর্তি তৈরি হয় কালীমন্দিরে। বাবুগঞ্জ লেবুতলা তোলা ফটো রায়ের বের লা কনকশালী অঞ্চলে শিব কার্তিক গণেশ পূজিত হন। মহাদেবের এক হাতে ত্রিশূল, অন্য হাতে কমন্ডুল, সামনে দণ্ডায়মান কার্তিক গণেশ।
ডিডিং ডিডিং দ্যংলা
কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা,
একবার আসেন মায়ের সাথে,
একবার আসেন একলা।।
এই একলা আসা কার্তিক ঠাকুরের পুজো আজ। এই ছড়া শুধু চুঁচুড়ার লোক জীবনে নয় বাংলার লোককথায় স্থান পেয়েছে। ঐতিহ্যবাহী নানান রূপের কার্তিক ঠাকুর দেখার জন্য চুঁচুড়াতে আপনাদের স্বাগত জানাই।।
তথ্যসূত্র : হুগলি চুঁচুড়ার ইতিহাস সংগ্রাম মল্লিক; নিউজ মিডিয়া এবং নিজস্ব অনুসন্ধান।
ঘরে বসেই কার্তিক ঠাকুর দেখা হয়ে গেল। ধন্যবাদ
খুব খুশি হলাম।