হাঁসফাঁস গরমের দিনে একগ্লাস বেলের শরবত নিমেষেই সব ক্লান্তি দূর করে দেয়। খুব সহজেই তৈরি করা যায় ঘরে। অনেকেই বেলের শরবত বানানোর জন্য আগের দিন রাত্রে অন্তত ১২ ঘণ্টা বেল ভিজিয়ে রাখেন। সেটা না পারলে, বেল ফাটিয়ে চামচ দিয়ে ভিতরের শাঁস কুড়িয়ে নিয়ে অল্প জলে এক দুই ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে হাত দিয়ে কচলে নিয়ে বেলের আঁশ, বীজ আলাদা করে ফেলে দিয়ে মাড় বের করে নিতে হবে। তারপর কাত ছেঁকে দই, জল, চিনি মিশিয়ে সামান্য বরফ কুচি দিয়ে পরিবেশন করুন। বিশ্বাস করুন, কাটফাটা গরমের দিনে একগ্লাস পাকা ঠান্ডা বেলের শরবত অমৃত সমান।
ইফতারে নিজেকে হাইড্রেট রাখতে ফাইবার, ভিটামিন-সি, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রনের পুষ্টি উপাদানে ভরপুর বেলের শরবত প্রতিদিন খেতে পারেন।
বেল নিয়ে লিখতে গেলেই দেব দেবীর আনাগোনা চলে আসে লেখায়। সামনে আসে রূপক আর প্রবাদের কথা। শাস্ত্র বেল গাছকে দেবতার আসন দিয়েছে। পবিত্র বৃক্ষ বেল গাছের শত হাত ব্যাপী স্থানকে শিবক্ষেত্র বলা হয়। ওষধি গুণ সম্পন্ন বেল গাছ রোগ প্রতিকারের জন্য ব্যবহৃত হয়। সাংসারিক সুখ-ঐশ্বর্য, রোগব্যাধি এমনকি যৌবন সুরক্ষার ক্ষেত্রে কাঁচাবেল, বেলশুঁঠ, ফুল মূল ও গাছের ছাল ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন পেটের রোগ উপশমে, বেদনা কষ্ট দূর করতে সক্ষম বলে একে বলা হয় শান্ডিল্য। এই ফলের ভিতরের অংশ গন্ধযুক্ত হওয়ার কারণে গন্ধগর্ভ নামেও পরিচিত। আপেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে বলে কোথা কোথা এর নাম গোল্ডেন অ্যাপেল।
সেই কোন কাল থেকে দেবাদিদেব মহাদেব, শ্রীবিষ্ণু, ব্রহ্মাদি-সহ সকল দেবতা, ঋষিমুণি থেকে আচার্য শংকরাচার্য সকলেই বেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব ব্রহ্মের স্বরূপ বোঝাতে বেলের উপমা ব্যবহার করতেন। বলতেন, ‘বেলের খোলাটা যেন জগৎ। জীবগুলি যেন বিচি…. যে সত্তাতে শাঁস নেই সেই সত্তা দিয়ে বেলের খোলা আর বিচি হয়েছে। বেল বুঝেতে গেলে সব বুঝিয়ে যাবে।’
শাস্ত্রে বেলকে বলা হয় শ্রীফল। একদিন লক্ষ্মী দেবী নারায়ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ত্রিলোকে আমি আপনার সবচেয়ে প্রিয়। তাই লোকে আমাকে বলে বিষ্ণুপ্রিয়া। আমার চেয়েও কি প্রিয় কেউ আছেন?’
শ্রী হরি লক্ষ্মী দেবীকে বলেন, ‘সমগ্র বিশ্বমন্ডলের শিবশঙ্কর আমার পরমপ্রিয়। অন্য কেউ নয়।’
লক্ষ্মী দেবী জিজ্ঞাসা করলেন “কেন?”
শ্রীহরি বললেন, “আদি কালে আমি ও ভগবান শিবশঙ্কর পৃথিবীতে গিয়েছিলাম প্রিয়প্রাপ্তি কামনায়। ঠিক করেছিলাম যাকে প্রথম দেখতে পাবো সেই আমার অকৃত্তিম পরম প্রিয় হবে। দর্শন মিললো শিবশঙ্করের সঙ্গে। দৃষ্টি বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে পারস্পরিক প্রীতি জন্মালো। তাই যে শ্রদ্ধা ও ভক্তি-সহ শিবের পূজা করে সেই আমার পরম প্রিয় হয়।’
শ্রীহরি আরো বললেন, পদ্মফুল শিবের সব থেকে প্রিয়। শিবের আরাধনায় পদ্মফুল লাগে। তাই লক্ষ্মীদেবী হরির প্রিয় ও প্রীতিভাজন হওয়ায় জন্যে প্রতিদিন এক হাজার পদ্ম ফুল তুলে স্বর্ণময় শিবলিঙ্গে ভক্তি ভরে পুজা করতে লাগলেন। একদিন পুজো করবার সময় দেখলেন এক হাজার থেকে দুটি পদ্মফুল কম। হাজার পদ্ম না হলে পূজার সংকল্প পূর্ন হবে না। সেই মুহূর্তে কোথায় পাবেন দুটি ফুল?
লক্ষী দেবীর মনে পড়লো শ্রীহরি তার স্তনকে পদ্মের সাথে তুলনা করেছিলেন। হরিবাক্য সদা সত্য। তাই লক্ষ্মী দেবী ধারালো ছুরি দিয়ে তার বাম স্তনটি কেটে ভগবানকে অর্পণ করলেন। এরপর ডান স্তনটি অর্পণ করতে যাওয়ার সময় মহাদেব লিঙ্গ মূর্তি থেকে বেরিয়ে এসে নিজ মূর্তিতে লক্ষ্মীদেবীর সামনে এসে বললেন, “মা তুমি শ্রীঅঙ্গ ছেদন করো না। তোমার ভক্তি ও নিষ্ঠায় আমি প্রসন্ন হয়েছি। তোমার বাম স্তন পুনরায় স্বস্থানে সমুৎপন্ন হবে। পৃথিবী তোমার ভক্তির প্রতিভূ রূপে ধরাধামে শ্রীফল নামে এক পবিত্র বৃক্ষের উৎপত্তি হবে”।
সেই থেকেই বেল গাছের অপর নাম শ্রীবৃক্ষ। লক্ষ্মীদেবী সর্বদা এখানে বসবাস করেন। শাস্ত্র বলে, কপালমোচন ক্ষেত্রে বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়ায় প্রথম বেলগাছ উদ্ভূত হয়। দুর্গাপূজায় নব পত্রিকার পঞ্চম পত্রিকা হল বেল। মহাদেবী শিবার প্রথম আবির্ভাব বেল গাছের গোড়ায়। শাস্ত্রমতে বেল গাছকে নিত্য পূজাও মার্জন করতে হয়। চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় এই চার মাস বেল গাছকে জল সেচ দিতে হয়।
গৃহপ্রাঙ্গনের মধ্যে বেল গাছ বসাতে নেই। যদি দৈবাত কোন কারনে বেল গাছের উদ্ভব হয়, তবে তা শিব জ্ঞানে পূজিত হয়। সন্ধ্যায় দুপুরে বেলপাতা ও বেল গাছের ডাল ভাঙতে নেই। সূর্য ও গণেশ পুজো ছাড়া বাকি সব দেবতার পূজায় বেলপাতা দিয়ে করা যায়।
বেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যালকালয়েডস, পলিস্যাকারাইড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন সি, ডি, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, পটাশিয়াম, কপার, প্রোটিন. পেকটিন, ট্যানিন, মার্মেলোসিন ইত্যাদি। এসব ছাড়া পাকা বেলে রয়েছে ‘মেথানল ফেরোনিয়া গাম’ নামের উপাদান যা ব্লাড সুগারের জন্য খুবই উপকারি। পাকা বেলের শরবত বিকালের দিকে খেতে পারেন। পরপর দু-তিন দিন খেলে উপকার পাবেন। তবে ধারাবাহিকভাবে খাওয়া চলবে না। কাঁচা বেলের মোরব্বা তৈরি করে রাখুন টানা খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য-এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও কাঁচা বেল সেদ্ধ জল খেলে পেপটিক বা গ্যাস্ট্রিক আলসারের ক্ষত সারায়।
ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষ করে ব্রেস্ট ক্যান্সারে কাঁচা ও পাকা বেল ভালো কাজ করে। কারণ পলিফেনলের কয়েকটি মূল্যবান যৌগ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রয়েছে। ধাতুদৌর্বল্যে বেলমুলের চূর্ণ যষ্টিমধুর সঙ্গে খেলে খুবই এফেক্টিভ।
অতিরিক্ত ঘামে, অতিরিক্ত কামেচ্ছা দমনে (বেলপাতা বাটা), অতিসারে, রক্তে কোলেস্টেরলের বৃদ্ধিতে স্মৃতিশক্তি বাড়াতে হলে, এলার্জিতে, স্তন্যাল্পতায়, শোথে, পেটের নানা সমস্যা ও দুর্বলতায়, শরীর ঠাণ্ডা রাখতে বেল বিশেষ করে কাঁচা বেল ভীষণ কাজ করে।
যে কোন জিনিসের অতিরিক্ত যেমন ভালো নয় তেমনই বেলও বেশী খেলে, বিশেষ করে পাকা বেলে নানান সমস্যা দেখা যায়। কাঁচা বেলের শুঁঠ চূর্ণ প্রতিদিন সর্বোচ্চ তিন থেকে ছয় গ্রাম পর্যন্ত খেতে পারেন। সন্তানসম্ভবা অবস্থায়, ব্রেস্ট ফিডিং করালে, সার্জারির আগে ও পড়ে বেল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
বেলকে শুঁঠে রূপান্তরিত করাই এই ফল সংরক্ষণের অন্যতম উপায়। কাঁচা বেল টুকরো টুকরো করে কেটে রোদে ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে তৈরি করা হয় বেলশুঁঠ। বেলের মোরব্বা বানিয়েও বেশ ক’দিন ধরে খাওয়া যেতে পারে।
“বেল পাকলে কাকের কি?” তা জানা নেই তবে গরমে পাকা বেলের শরবত ঘরে তৈরি করলে খবর রাখে ও খেতে চায় সবাই। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ব্রহ্মদৈত্য নাকি বেলগাছে থাকে বা “ন্যাড়া বেলতলায় একবার যায়” যদিও ছোটো বয়সে আমি ন্যাড়া মাথায় বাড়ির বাগানে বেল গাছের তলায় বেল কুড়োতে অনেক বারই গেছি। সে যাই হোক, পাকলে সব ফলের উৎকর্ষ বাড়ে, শুধু বেলের বেলায় উল্টো কাঁচাটাই শ্রেষ্ঠ। সেই কোন যুগ থেকেই মানুষজন বেলের ব্যবহার জানতেন। নগর সভ্যতা যতই আধুনিক হোক না কেন, প্রকৃতির দান ব্যবহার করলে লাভ বই, লোকসান নেই।
Aapnar lekha mane natun kichhu jante para…khub bhalo lagllo…onek onek subhechha janai…
অনেক ধন্যবাদ